বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
715

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#শেষপর্ব
#লেখিকা #শারমিন_আক্তার_বর্ষা
অন্ধকার নিস্তব্ধতায় মোড়া জঙ্গলে একা হাঁটছে রুহানি। বেশ কয়েকবার পা ফসকে পড়ে যাওয়ার অতিক্রম হয়েছে। নিজেকে সামলে সামনে হাঁটছে। ভেতর ভেতর ভয়ের আশংকা রয়েছে। নানান পশুপাখির ডাক ভয় তো লাগবে। শুঁকনো ঢোক গিলে জঙ্গলের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। জঙ্গলের শেষ মাথায় একটা পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে রাস্তা আছে ওপরে উঠার। পাহাড়ের চূড়ান্তে এক আলো দেখতে পাচ্ছে রুহানি। অনেক উপরে বলে, আলো খানি ও অল্প পরিমাণে স্বচ্ছ। রুহানি শাড়ির কুঁচি ধরে ওপরে তুলে নেয়। শাড়ি পড়ে পাহাড়ে ওঠা চারটি খানি কথা নয়। বেশ তর্জব করেই ওপরে উঠল। বিপর্যয় অবস্থায় একজন লোক মাটিতে পরে আছে। লোকটা কে চারপাশ থেকে মারা হচ্ছে। কিছুটা দূরে চোখ পরল। ল্যাম্পপোস্টের মতো বা ছোট ল্যাম্পপোস্ট বলা যায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে বসে আছে আরিশ। তার দুই পাশে সঠান দাঁড়িয়ে আছে তাজ, আমান, ওয়াসিফ ও প্রবীর।

রুহানির উপস্থিতি এখানে কেউ ঠাহর পায়নি। আরিশের এক কথায় লোকটা কে শুট করে দিলো। নিজের সামনে প্রথম বার কাউকে এভাবে মরতে দেখে চিৎকার করে ওঠে রুহানি। রুহানির আওয়াজ কর্ণপাত হতে অপদস্তক ওঠে দাঁড়াল আরিশ। রুহানি কে এখানে দেখে তারা অবাক হলো। রুহানির শরীর কাঁপছে। আরিশ দ্রুত গিয়ে রুহানি কে জড়িয়ে ধরে। শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি এখানে কি করছো? তোমার তো এই সময়ে বাড়িতে থাকার কথা। আমি তো বলে ছিলাম আমি কিছুক্ষণ পর আসবো।’

আরিশকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় রুহানি। আরিশ দু কদম পিছনে চলে যায়। তাকে এভাবে ধাক্কা দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে রুহানির দিকে এগিয়ে আসতে নেয় তার একজন লোক। আরিশ হাত তুলে লোকটা কে এখান থেকপ চলে যাওয়ার জন্য বলে। রুহানি মৃত লোকটার দিকে তাকিয়ে কান্না করে ফেলল। রুহানি কে সামলানোর জন্য আরিশ তার দিকে এগিয়ে গেল। রুহানি অসাবধানতায় আরিশের গালে চড় মারে। চিৎকার করে বলল, ‘তুমি একটা গুন্ডা। লোকজন কে মারাই তোমার কাজ। কোন অধিকারে তুমি তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলো? একজন মানুষ কে যেভাবে মেরে ফেলো সেভাবে কি পারবে তাকে পূনরায় জীবন ফিরিয়ে দিতে। যাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাকে মৃত্যু দেওয়ার ও রাইট উনার৷ তুমি কে উনার সৃষ্টি কে মারার?’

আরিশ শান্ত গলাশ রুহানির হাত ধরার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি ভুল বুঝতেছো রুহি। আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতেছি।’

রুহানি আরিশ কে ধাক্কা মেরে কিছুটা দূরে সরিয়ে দেয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি খুব খারাপ আরিশ। তোমাকে আমি মন থেকে ভালোবাসতাম আর তুমি আমার সাথে ছলনা করেছো। সব কিছু তোমার নাটক ছিল। তুমি এতটা নিচ আমি ভাবতেও পারছি না। তুমি কেন করলে আমার সাথে এমন?’

স্তব্ধ বাকরুদ্ধ ঠাই দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। বুঝতে পারছে না রুহানি কি বলছে। চোখ জোড়া ছোটছোট করে বলল, ‘তুমি কি বলছো তুমি বুঝতে পারছো রুহানি? আমি কখনো তোমার সাথে ছলনা নাটক করিনি।’

রুহানি আসার সময় নাজিনের ফোনটাও সাথে নিয়ে আসে। নাজিনের লক সম্পর্কে সে জানে। লক খুলে অডিও অন করে ফোনটা আরিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। রেকর্ডিং শুনে ছলছল নয়নে রুহানির দিকে তাকাই। রুহানি তাকে ভুল বুঝতেছে। ভয়েস রেকর্ডে সবটা সত্যি না। হ্যাঁ সে মানছে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেকজন কে মেরেছে কারণ অকারণে অনেকজন কে মেরে লাশ গায়েব করে দিয়েছে। এটা সত্য কিন্তু রুহানির দিকে ওইটা সত্য না৷ আরিশ সত্যি সত্যি রুহানি কে ভালোবাসে।

‘কসম রুহানি আমার তোমার প্রতি ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি ছিল না। আমি তোমাকে ভালোবাসি রুহানি। ওই রেকর্ডিং যা আছে সবটা সত্য নয়। তুমি তার পিছনের কাহিনি জানো না।’

‘আমি জানি না আর শুনতেও চাই না। কিন্তু শুনে রাখো তোমার মতো ক্রিমিনালের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই। আমি তোমার মুখ আর দেখতে চাই না।’

আরিশ বুঝতে পারছে রুহানি তার ওপরে ভীষণ রাগ করেছে। এই রাগ যে কমবার নহে। কিন্তু সে কিছুতেই মানতে পারবে না। রুহানি তার ভালোবাসার ওপর আঙুল তুলে বলবে, তার প্রতি ভালোবাসা মিথ্যে। পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়ালো আরিশ। রুহানি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। রুহানির মুখশ্রীর দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকাই আছে আরিশ। আরিশের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ানো কারো চোখে পরেনি। সকলে যে মাথা নিচু করে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

আরিশ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাচ্ছে বারবার তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর দিকে। চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গাল গড়িয়ে পরল। শুঁকনো ঢোক গিলল আরিশ। চোখ জোড়া বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ মেলে তাকাল দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এতে কোনো ভুল নেই। আমি ভালোবেসে তোমার সাথে আজীবন থাকতে চেয়েছি এতেও কোনো ভুল নেই। তবে আমি ব্যর্থ তুমি তুলেছো আঙুল আমার ভালোবাসায়। অস্বীকার করছো তোমার প্রতি আমি মুগ্ধতা। আমি তোমাকে ভালোবাসি রুহানি। জীবনের শেষ মূহুর্তে দাঁড়িয়েও বলবো, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি বুঝানোর জন্য মৃত্যু ই কেনো? বেঁচে থেকেও ভালোবাসা বুঝানো যায়। কিন্তু আমি ব্যর্থ। যে চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে যে চোখে ভালোবাসার পরম স্পর্শ অ্যাঁকেছি। আজ সে চোখে আমি আমার প্রতি ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বাস করো রুহি, তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার পবিত্র স্বচ্ছ জলের মতো।

রোজিনা গোধূলি লগ্নে রহিয়াছ তুমি পানে।
হাত বাড়ালে জানি, তুমি কভু দূরে!
প্রিয় সখী!’

একপা পিছাইলে আরিশ পাহাড় থেকে নিচে পরে যাবে। আরিশের কথা শুনে রুহানি অভিমানে গাল ফুলিয়ে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশ রুহানির চোখে চোখ রেখে বলল, ‘চোখে তে পড়িল চোখ নয়নে লাগিলো নেশা।’

পরিবেশ মূহুর্তে নিস্তব্ধ হয়ে পরল। কি হল কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই জেনো কারেন্টের শকট খেয়েছে। নিজের জ্ঞানে ফিরে আসতে ‘আরিশ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল রুহানি। ছুটে গেলো পাহাড়ের কিনারে। একটুর জন্য রুহানি পাহাড় থেকে পরে যেতো আমান তাকে ধরে নিলো। শেষ বার রুহানির চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল আরিশ।দুইবার চোখের পলক ফেলল, ওই চোখের পলক জেনো কথা বলেছিল, ‘ভয় পেয়ো না। আমি আছি।’

রুহানির চিৎকার গাড় হলো। সে সর্বোচ্চ দিয়ে চিৎকার করে আরিশ কে ডাকছে। মূহুর্তে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। এত উপর থেকে নিচে পরেছে যে রেসকিউটিপ আরিশের দেহ টাও খুঁজে পায়নি।
___________
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রুহানি। রাতে তার জ্ঞান ফিরেনি উল্টো প্রচন্ড জ্বর এসেছে। তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসছে। আরিশের কথা সবাই কে বলা হলো। তারাও কষ্টে ভেঙে পরলেন। কিছুক্ষণ আগে কল দিয়ে জানানো হয়েছে আরিশ কে পাওয়া যায়নি। নাজিন অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এক কর্ণারে। আমান তাকে কড়াভাবে যা ইচ্ছে তাই শুনিয়েছে। রেকর্ড করেছে ভালো কথা একবার তাকে তো জিজ্ঞেস করতে পারতো। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আজ এমন হত না।

জ্ঞান ফিরলো আরিশের শেষ বারের কথাগুলো বারবার রুহানির মনে উঁকি দিচ্ছে। মাথা নিচু করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাজ ও বাকিরা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শব্দ করে কেঁদে উঠল রুহানি।
_________
দীর্ঘ এক মাস পর, ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস তো সে নিচ্ছে কিন্তু বেঁচে নেই। সব সময় চোখে জেনো পানি জ্বলজ্বল করে। সন্ধ্যা সাতটা বাজে একা একা ছাঁদে আসছে। আরিশ চলে যাওয়ার পর থেকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হারিয়ে ফেলেছে রুহানি তাকে একা এখন কোথাও ছাড়া হয়না। সব সময় তার পাশে একজন থাকে তার ওপর নজর রাখার জন্য। দূর আকাশে সবে উদয় হওয়া চাঁদ টার দিকপ তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল রুহানি। মনে হচ্ছে ওই চাঁদ টা আরিশ৷ আর আরিশ জেনো তাকে প্রাণ ভরে দেখছে। চোখের কোণে ছলছল করে উঠল জল।

ইয়ানা পাশে এসে দাঁড়ালো রুহানির কাঁধে হাত রেখে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘রুহি?’

মা’য়ের হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠল রুহানি। কান্না ভেজা গলায় বলল,

‘ আজ ‘ওর’ আমার মাঝে বিশাল দূরত্ব। ও’ আমার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে, এক মূহুর্ত দেখারও অনুমতি নেই। এখন আমি বুঝতে পারি ‘ও’ ছাড়া আমি শূন্য! প্রতিটি মূহুর্ত ও-কে আমি অসম্ভব মিস করি। আল্লাহর কাছে আমার একটাই দোয়া, ‘পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে জেনো আর একটি বার আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। কথা দিচ্ছি, আমি হারাবো না আর তাকে। এটা কি আদৌও সম্ভব? কাঠখোট্টা রোদে এক পিপাসকের মতো আমিও মরুভূমি তে হাঁটছি। হাহাকারে কাটছে আমার দিবারাত্রি। শুধু একটি মাত্র আকাঙ্খা, মৃত্যুর আগে জেনো ও-কে দু’টি হাতে স্পর্শ করতে পারি। বুকে জড়িয়ে কাঁদতে পারি। আমি অসম্ভব বাজে ভাবে ভেঙে ঘুরিয়ে গেছি মা। আমার বেঁচে থাকার জন্যও যে ও-কে চাই। সে-হীন আমি যে নিঃস্ব মা। ‘
______________
ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন রুহানির সামনে দেখা করতে আসল ডাক্তার শীষ। ঘন্টা খানেক বসে রুহানির সামনে কথা বলল। ছয় মাস পর দেখছে সে এই মেয়েটা কে। ছয় মাসে তার মধ্যে বিশাল পরিবর্তন। আগের মতো সে চঞ্চলতা স্বভাব টা আর নেই। ধূসর রঙের একটা সুতি কাপড় গায়ে জড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার নিশ্চুপতা জেনো শীষের হৃদয়ে দাগ কাটছে। গত কাল হাসপাতালে আমানের সাথে দেখা হয়েছিল। তার থেকে শুনেছে আরিশ চলে যাওয়ার খবর। এজন্য আজ রুহানির সাথে দেখা করতে আসছে শীষ। আমতা আমতা করে মনের কথা বলেই ফেলল সে। রুহানি কে দ্বিতীয় বার বিয়ের প্রস্তাব দিলো। পাশের সোফায় বসে ছিলেন ইয়ানা ও ইয়াসির। শীষের প্রস্তাবে উনারা ভীষণ খুশি।

রুহানি বেশ কিয়ৎক্ষণ নিরব নির্বাক্য বসে রইল। পরক্ষণে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আমার কাছে একজন ভালো ব্যতিত অন্য কিছু নন। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আসলে পারবো না। যে বুকে মাথা রেখে আমার আরিশ মাথা রেখে ঘুমিয়েছে সে বুকে অন্য কারো স্থান দিতে আমায় ক্ষমা করবেন।’

বলে কাপড়ের আঁচল টেনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যাচ্ছে রুহানি। নিষ্পলক চোখে রুহানির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ওর বাবা, মা ও শীষ৷
মস্তিষ্কে শুধু আরিশের শেষ কথাটি বিরাজ করছে। চোখে আরিশের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠছে তার ওই ভয়ানক মৃত্যু শেষ হাসি৷ রুহানির কানে বাজছে আরিশের শেষ কথা,
‘রোজিনা গোধূলি লগ্নে রহিয়াছ তুমি পানে।
হাত বাড়ালে জানি, তুমি কভু দূরে!
প্রিয় সখী!’

______সমাপ্ত______