বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩১]
প্রভা আফরিন
_
সাম্য চিত্রার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো। খাটে বসিয়ে ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে বলল,
“রাতে ঘুমাওনি না?”
“ঘুম আসছিলো না।”
“এখন ঘুমিয়ে নাও একটু।”
“বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ঘুমাব না।”
সাম্য একটু অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
“ঠিকমতো ঘুমাও না, খাও না, এত অনিয়ম করলে মাথা ঘুরে পড়বেই তো। কোনো সমস্যা হলে বলো আমায়।”
“ঠিক আছি।”
“বাড়ির মানুষদের জন্য কষ্ট হয়?”
চিত্রা একটু চুপ রইল। ঘুরিয়ে উত্তর দিলো,
“ফেলে আসা অতীত, আপন মানুষদের জন্য কষ্ট তো হবেই।”
“চিন্তা কোরো না। আস্তেধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো।”
সাম্য চিত্রাকে জোর করে শোয়ালো। চিত্রা বাধা দিয়ে বলল,
“ঘুম আসবে না আমার।”
সাম্য ওর মাথায় বার দুয়েক হাত বুলিয়ে দেয়,
“তবুও শুয়ে গড়াগড়ি করো। ডাক্তার এসে দেখে যাবে, এরপর ঘরের বাইরে যাবে তুমি।”
স্বামীর এতো যত্নে স্ত্রীর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু চিত্রার বিরক্ত লাগছে। কেন বিরক্ত লাগছে তার ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই। অথবা আছে, সাহস নেই। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কান্নারা গলা চেপে ধরে। চিত্রা মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। কাঁদবে না সে। আবেগে ভেসে গেলে চলবে না। আগে সবটা জানতে হবে।
খানিক বাদে সাম্য বাইরে থেকে ফিরে দেখল চিত্রা উঠে পড়েছে। সে বলল,
“আবার উঠলে কেন?”
“গা কুটকুট করছে। ফুলগুলো পরিষ্কার করতে হবে।”
সাম্য বাসি, শুকনো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বলল,
“আর ফুল! আমি ফজিলাকে ডাকছি। তোমায় কিছু করতে হবে না।”
ফজিলা ঘর পরিষ্কার করতে এসে চিত্রাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,
“নতুন বউ, শইলডা কি বেশি খারাপ হইছেনি তোমার?”
চিত্রা উঠে বসে,
“আমি ঠিকই আছি। আপনার ছোটো ভাইজান ইচ্ছে করে শুয়িয়ে রেখেছে।”
ফজিলা বিছানা ঝাড়ু দিতে দিতে বলল,
“সাম্য ভাইয়ের মনডা ছুডুকালের তন এক্কেরে নরম। পরানডা ভরা মহাব্বত। কাইল তোমার মাথা ঘুরানির পরে যেই অস্থির হইছিল! তোমারে মেলা ভালোবাসে গো বউ!”
“আর রনি?”
মুখ ফসকে কথাটা বলে চিত্রা নিজেই থতমত খেয়ে গেল। গলা ঝেড়ে বলল,
“আমি বোধহয় দেখেছিলাম ওনার বড়ো ভাই এসেছিলেন। কিন্তু আলাপ হয়নি। রনি না কী জানি নামটা…”
“বড়ো ভাইজানের নাম তো রবিন। ভুইলা গেছো দেহি!”
চিত্রা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকায়। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের অভিব্যক্তি লুকোতে। সে বুঝে গেছে ফজিলা পেট পাতলা মানুষ। কোনো কথা চেপে রাখতে পারে না। তার কাছে নিজের সত্যিটা ঘূনাক্ষরেও প্রকাশ করা যাবে না। তবে অনেক কথাই জানা যাবে। সেই অভিলাষে বলল,
“ওই আরকি, খেয়াল করিনি। উনি আবার আমার অবস্থা দেখে কিছু মনে করলেন নাকি?”
“ভাইজানে আইয়া বেশিক্ষণ খাড়ায় নাই। তোমারে লইয়া হগলে ব্যস্ত হইয়া গেছিল, তাই লগে লগেই গেছেগা।”
“তিনি কী বাড়ি থেকে চলে যাবেন আবার?”
“কি জানি! থাকতেও পারে। আগে তো বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকত। বছরখানিক ধইরা আর থাকে না।”
ঘর পরিষ্কার হয়ে গেছে। চিত্রার শরীরটা কেমন ভেঙে আসছে। সে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। জানতে ইচ্ছে হলো সকালে কেন নাজমুল মোক্তার রবিনকে বকাঝকা করছিল? কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রাখল। বেলা গড়াতে সাম্য ডাক্তার ডেকে আনল বাড়িতে। ডাক্তার চিত্রাকে দেখে বলল শরীর দুর্বল হয়ে গেছে৷ বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সে কথা শুনে সাম্য তাকে সারাদিন খাট থেকেই প্রায় নামতে দেয় না। নিজেও ঘর থেকে বের হয় না। ভালোবাসা, যত্ন, দায়িত্ববোধে কোনো কমতি রাখে না। চিত্রা বোঝে সাম্যও বিনিময়ে তার ভালোবাসা চায়। প্রবলভাবে নিজের করে পেতে চায়। ইনিয়েবিনিয়ে তা প্রকাশও করে। স্বামী হিসেবে এটুকু চাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু চিত্রা নিজের হৃদয়কে মানাতে পারে না। মাঝে মাঝে সাম্যের সরল মুখের দিকে তাকিয়ে খানিক অনুশোচনা উঁকি দেয় মনে।
চিত্রার সাড়াদানে নির্লিপ্ততা, বিরক্তিকর চাহনি যে সাম্য বোঝে না তা নয়। শঙ্কা বা অনিশ্চয়তা মুছে দিতেই পড়ন্ত বিকেলে চিত্রার পাশে বসে তাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে আবেগী কণ্ঠে অনুরোধ করল,
“আমি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিবেদিত প্রেমিক নই চিত্রা। ভালোবাসার বদলে আমারও ভালোবাসা চাই। যত্নের বিনিময়ে যত্ন চাই। আদরের বিনিময়ে আদর চাই। আমার সবটা তোমার মাঝে বিলিয়ে তোমাকেও নিজের মাঝে খুঁজে পেতে চাই। দরকার পড়লে আরো সময় নাও। তবুও এমন কোনো প্রতিদান দিয়ো না যা আমার সহ্য হবে না।”
চিত্রা কেঁপে ওঠে। অস্থিরতা চেপে ধরে বুকে। সে কি লোকটার সঙ্গে খুব বেশি অন্যায় করছে? তার দো’ষটাই বা কোথায়? অনুভূতির বেড়াজালে সে নিজেই যে জ’র্জরিত। তবে এই ভাবনা সাময়িক। খানিক বাদে তার চিন্তা আবারো বদলে যায়। অজানা কিছু জানার আগ্রহে সাম্য, রবিন কিংবা নিজের অনুভূতি, সবকিছুই তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সারাদিনে অসংখ্যবার সে ঘর থেকে বের হতে চেয়েছে। রবিন লোকটা যদি আবারো চলে যায়! মনে মনে হাজারো ফ’ন্দিফিকির এঁটেছে দেখা করার। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ। কেউ না কেউ তার আশেপাশে সর্বদাই থাকে। নতুন বউয়ের সঙ্গে আলাপ করতে রোজ কত অচেনা মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। চোখ এড়ানো দায়।
রাতের বেলা নিচে নামল চিত্রা। হাসনা শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেছে। ফিরে গেছে হেনার স্বামী উজ্জ্বলও। তবে হেনা রয়ে গেছে। উজ্জ্বল যাওয়ার সময় হু’মকি দিয়ে গেছে ফিরে গিয়ে সংসার না করলে তাকে তালাক দেবে। সে কথায়ও হেনার হেলদোল দেখা যায়নি। যেন সে নিজেই প্রস্তুত সম্পর্ক ভাঙতে। তার এই বেপরোয়া স্বভাবের আবির্ভাব ঘটেছে যেদিন রবিন বাড়ি এসে জানায় সে খুব শীঘ্রই বিয়ে করবে। হেনা তারপর থেকে বাপের বাড়ি ছাড়ার নামই নিচ্ছে না।
বাড়ির পুরুষদের খাওয়া শেষ হয়েছে। রমিজা, রাজিয়া ও নাজনীনের সঙ্গে খেতে বসেছে চিত্রা। ফিরোজা আজ থেকে নিজের বাড়িতে রান্না চড়িয়েছেন। রমিজাকে জোর করে খেতে পাঠিয়েছে নাজমুল মোক্তার। রমিজা খেতে বসে গলদা চিংড়ির তরকারি দেখে বললেন,
“ইছা মাছের তরকারি রবিনের লইগ্যা ইট্টু পাডায় দিয়ো তো বড়ো বউ। ছেড়াডা পছন্দ করে।”
“মাগরিবের ওয়াক্তেই পাডাইছি।” রাজিয়ার নির্লিপ্ত উত্তর।
রবিনের নাম উঠতেই চিত্রা সতর্ক হয়। ভাতের পাতে তাকিয়ে কান খাড়া করে রাখে তাদের দিকে। রমিজা বললেন,
“ভালা করছো। বড়ো নাতিডা কেমুন জানি হইয়া গেছে। বাড়িরতন বাইর হইতাছে না। খায়ও না ঠিকমতো। এই বয়সে কিয়ের যে এত চিন্তা!”
নাজনীন বলল,
“বিয়ে করান। বউ আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হেরে তো মানাইতেই পারি না। খালি কয় দেহা যাইব সময় হইলে।”
“মাঝে একটু মত দিয়েছিল না?”
“আইজ জিগাইলাম, হ বা না কিছুই কয় না। বোবার মতো চাইয়া থাহে।”
রাজিয়া মুখের ভাত শেষ করে পানি খেলেন। এরপর বললেন,
“হেইসব খাওয়া ধরছেনি? চোখমুখ চকরা-বকরা হইতাছে দেহি আবার। একবার এগুলান খাওন ধরলে তো মাইনষে জীবনেও ছাড়তে পারে না।”
চিত্রার গলায় ভাত আটকায়। কীসব খাওয়ার কথা বলছে আম্মা? কী ছাড়তে পারে না? রমিজা খেকিয়ে উঠে বললেন,
“আজাইরা কথা কইয়ো না বড়ো বউ। রবিন এহন আর ওইসবের ধারেকাছে দিয়াও যায় না।”
“উপরে দিয়া দেইক্ষা কি আর তা বুঝুন যায়? কাইল রাইতে গরুর একখান টিপ ওরে দিয়া পাডাইতে চাইছিল হেনার বাপে। সব তোড়জোড় করার পরে আর গেলোই না! কত্তডি টেহার কারবার আছিলো! হেরলইগ্যা সকালে খাইলো একচোট গা’লি। তাও কোনো হেলদোল নাই?”
ফিরোজা এখানে অনুপস্থিত। থাকলে ছেলের নামে ক’টূক্তি মোটেও হজম করতো না। রমিজাও নাতির অ’পমান সইতে পারলেন না। বললেন,
“সব কামে রবিনই যাইব ক্যান? দুনিয়াত আর মানুষ নাই? ছেড়াডা এতদিন পরে বাড়িত আইছে। আমি কি বুঝি না মনে করছো? নিজের ছেড়িরে তো ঘাড় ধইরা হউড় বাড়ি পাডাইতে পারো না। রবিনরে খালি এইকামে হেইকামে বাইত্তে সরায় দেও। আবার দো’ষও ধরো! নিজের বিইত্তা ছেড়ির চরিত্র শোধরাও। নাইলে জামাই ত্যাগ দিবো। তহন আবার রবিনের ঘাড়ে এই বে’লাজা ছেড়ি ঝুলাইতে আইয়ো না।”
যুক্তিত’র্কে জিততে গিয়ে শ্বাশুড়ি-বউ ভুলেই বসেছে বাড়িতে নতুন আরেকটি বউ এসেছে। রাজিয়া খাবার ঠেলে উঠে গলা চড়িয়ে বললেন,
“আমার ছেড়ির চরিত্র নিয়া তো ভালাই ভাষণ দিলেন। আপনের নাতির চরিত্র যদি এতোই ভালা হইতো তয় পলায় থাকন লাগত না।”
“বড়োবউ! আন্দাজে দো’ষাইবা না। বেবাক মাইনষে জানে আমার নাতি নির্দোষ।”
নাজনীন ব্য’ঙ্গ করে বলল,
“যা রটে তা কিছু হলেও বটে।”
তাল মেলায় রাজিয়া,
“নে’শাখো’র মাইনষের কুনু বিশ্বাস নাই। পরও কুনুদিন আপন হয় না। দোষের বেলায় সব আমার ছেড়ির ভাগে। আর ভালাডা নিজের নাতির ভাগে। চিনছি হগলরে। দরকার পড়লে ছেড়িরে সারাজীবন ঘরে গাইড়া থুমু। তাও রবিনের ঘরে পাডামু না।”
রাজিয়া হনহনিয়ে চলে গেল। রমিজারও খাওয়া হলো না। তবে নাজনীন খাওয়া ছাড়ল না। সে ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখেই খাবার চিবোতে থাকে। চিত্রার মাথা ঘোরে। এসব কী বলল সকলে? রবিন নে’শাখো’র! চরিত্রের দো’ষে পালিয়ে ছিল! কী শুনছে সে? আর কতকিছু লুকিয়ে আছে লোকটার মাঝে? কোনোরকমে সিড়ি বেয়ে ওপরে গেল চিত্রা। রবিনকে সে প্রতিনিয়ত দুর্ভেদ্য দেয়াল হিসেবে আবিষ্কার করছে। সব দেয়াল ভাঙবে তার মুখোমুখি হলেই।
ঘুমানোর সময় সাম্য চিত্রাকে কাছে ডাকল। প্রিয়তমার ওষ্ঠদ্বয়ের ভেজা, নরম শিশিরের আবেশ প্রথমবারের মতো লেপ্টে গেল তার ঠোঁটে। কিন্তু চিত্রার সাড়া পেল না। তার অভিব্যক্তি বুঝে সাম্যও আর জোর করল না। প্রলম্বিত শ্বাস আঁকড়ে ধরে নিস্তব্ধ নিগূঢ়তায় ঘুমে তলিয়ে গেল। সেই রাতটিও চিত্রা কেমন ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিলো।
পরদিন সকালে সাম্য বাইরে থেকে ফিরে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি রবিন ভাইয়াকে আগে থেকে চিনতে?”
চিত্রা চমকে তাকায়। সাম্যের মুখভঙ্গি কেমন গুরুতর দেখাচ্ছে। তাহলে কী সে সব জেনে গেল?
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩২]
প্রভা আফরিন
_
মোক্তার বাড়ির বড়ো ছেলে এবং নুরুল মোক্তারের একমাত্র সন্তান রবিন। ছোটোবেলা থেকেই সে স্বভাবে নম্রভদ্র ও বাবা-চাচাদের বাধ্যগত। তার মাঝে দায়িত্বশীলতা প্রবল। কোনো কাজের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হলে তা নিষ্ঠার সঙ্গেই সমাপ্ত করত, একমাত্র পড়াশোনা ছাড়া। পড়াশোনায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না তার। টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তার অনিহা দেখে নুরুল মোক্তার ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা ত্যাগ করে তাকে নিজেদের সঙ্গে কাজে জড়িয়ে নিতে শুরু করে। তবে কাজ, পরিবারের বাইরে রবিনের একটি আলাদা জগৎ ছিল। বন্ধুবান্ধবদের জগৎ। সেই জগতেই রবিন রঙিন নে’শার সন্ধান পায়। যার শুরুটা বি’ড়ি-সি’গারেট দিয়ে হয় এবং এক পর্যায়ে গা-জা-য় অভ্যস্ত হয়ে যায় সে। বাড়িতে ধরা খেয়ে অশান্তিও বেধেছে প্রচুর। তবে রবিন শোধরায়নি। বরং ধীরে ধীরে তার আচরণ হয়ে উঠছিল একরোখা। রবিন মুখে ঝ’গড়া-প্রতিবাদ করত না কখনোই। ত’র্ক বা মা’রা’মা’রিতেও নেই। সে জেদ নিজের মাঝে পুষে রেখে প্রতিবার বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। রাগ পড়লে নিজেই ফিরে আসত। তার এমন খামখেয়ালিপনায় নুরুল-ফিরোজা দম্পতির মানসিক স্থিরতা বিদায় নিয়েছিল অচিরেই। এরমাঝে উপরি ঝামেলা হিসেবে প্রকাশিত হলো হেনার একের পর এক বিয়ে ভাঙা, রবিনের প্রতি পাগলামি। ছেলে যতই ভালো হোক, জেনেশুনে কোনো পরিবার মেয়েকে এক নে’শাগ্রস্থ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে না। নাজমুল মোক্তারও ব্যতিক্রম হলেন না। একই পরিবারের মধ্যে তো নয়-ই। তিনি রবিনকে পুরোপুরি কাজে ডুবিয়ে দিলেন। দায়িত্ব চাপালেন অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি।
এরপরের বছরগুলো সবই ঠিক ছিল। বয়সের সঙ্গে রবিনের আচরণে পরিপক্কতাও এলো। তবে লুকিয়ে নে’শা করাটা সে একেবারে ছাড়তে পারল না। যার ফলে ওজন কমা, চোখ গর্তে ঢুকে যাওয়া, চোখের নিচে কালি পড়াসহ নানান স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে।
রবিন ও তার বন্ধুবান্ধব সকলের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার স্থান ছিল বিলের মাঝে বাশ দিয়ে বানানো টঙে। শুষ্ক মৌসুমে বিলের পানি শুকিয়ে গেলে এটি বানানো হয়েছিল। বর্ষায় সেই ঘর থৈথৈ জলরাশির মধ্যে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাতে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাশের লম্বা সাঁকো। রবিনদের টুকটাক তা-স খেলা, নে-শা করা সব সেখানেই হতো। কিন্তু বছর দেড়েক আগে হুট করে সেই ঘরে একটি বি’বস্ত্র মেয়েকে অচেতন উদ্ধার করা হয়। জানা যায় মেয়েটি জেলে পাড়ার। অবস্থা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না মেয়েটা ধ-র্ষ-ণের শি’কার। সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি মা’রা যায়। যেহেতু রবিন ও তার বন্ধুবান্ধবদের সেখানে নিয়মিত যাতায়াত, কাজেই দোষটা অনায়াসে তাদের ঘাড়েই বর্তায়। সাব-ইন্সপেক্টর জাফর সেদিন তাদের বাড়ি এসে গোপনে প্রাথমিক সন্দেহের কথা জানালে বাড়িতে অস্থিরতা তৈরি হলো। রবিন নিজে থেকেই স্পষ্ট করে জানায় সজ্ঞানে তার দ্বারা এতটা ঘৃ’ণ্য কাজ অসম্ভব। অজ্ঞান হওয়ার মতো নে-শা সে জীবনেও করেনি।
কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে তার উলটো কথা। ঘটনার আগেরদিন সন্ধ্যায়ও রবিন টঙের ঘরে উপস্থিত ছিল। রবিন বা তার বন্ধুবান্ধবদের দ্বারাই কাজটা ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে প্রবল। কাজেই দো’ষ করুক বা না করুক রবিন ফেঁ’সে যাবে অনায়াসে৷ সে কথা শুনে রবিন ঘাবড়ে যায়। বারবার বলে নারীঘটিত কোনো রেকর্ড তার জীবনে নেই। তার বন্ধুবান্ধব এসবে জড়িত কিনা তাও সে জানে না। গতদিন সন্ধ্যায় টঙের ঘরে গিয়ে সে বেশিক্ষণ কালক্ষেপণ করেনি। আধার হতেই বাড়ি ফিরেছিল। সাক্ষী তার বাড়ির লোক। বন্ধুরা কিছু করলে তার জানা নেই। সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল বারবার। এমন ঘটনা যেন সে নিজেই মেনে নিতে পারছিল না। মেনে নিতে পারছিল না বাড়ির লোকও। নাজমুল মোক্তার সম্মান বাঁচাতে মড়িয়া হয়ে জাফরের সঙ্গে কথা বলে সমাধান চাইলেন। তাদের সিদ্ধান্তে রবিন সেদিনই লুকিয়ে গ্রাম ত্যাগ করল। কিছুদিন বাদেই অবশ্য দোষী প্রকাশ পেয়েছিল। রবিনের দুজন বন্ধু নে-শা করে কান্ডটি ঘটায় জানা যায়। জাফরের সহযোগিতায় রবিন পুলিশের সন্দেহমুক্ত হলেও গ্রামে ফেরে বেশ কয়েকমাস পরে।
চিত্রা নতশির হয়ে বসে আছে। সে একেবারে নিশ্চুপ। যতটা চুপ হলে নিঃশ্বাসের শব্দটাও লুকিয়ে রাখা যায়, ততটাই। অথচ ভেতরটা চিৎকার করে কাঁদছে। ছি’ন্নভি’ন্ন হয়ে যাচ্ছে মনের অলিগলি। সাম্য ওর পাশ ঘেঁষে পা উঠিয়ে বসে আছে। শব্দ করে দম ফেলে বলল,
“ভাইয়া তোমাদের গ্রামে ছিল কয়েকমাস। তোমার আব্বার কাছে নাকি পরিচয় লুকিয়ে কাজ করেছে। আজ জানতে পারলাম ভাইয়ার কাছ থেকে। তাই জিজ্ঞেস করলাম তুমি রবিন ভাইয়াকে আগে থেকে চেনো কিনা।”
চিত্রা চোখ তুলল না। তার চোখে শিশির জমছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। যে কোনো সময় বড়ো ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়বে চোখের কোল বেয়ে। সে কিছু বলতে চাইল। কোনো শব্দ বের হয় না। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আছে। চিত্রা খাকারি টানল জোরে। সাম্যের চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার আগে মৃদুস্বরে বলে গেল,
“আমি ওনাকে চিনি না। রবিন নামের কাউকে চিনি না আমি।”
চিত্রা সারাটি দিন বিমর্ষচিত্তে রইল। দরকারের বাইরে কারো সঙ্গে একটা কথাও বলল না। রাজিয়া ওকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“কি হইছে তোমার? বেজারমুখে আছো ক্যান?”
চিত্রা নিজেকে সামলে বলল,
“মাথা ব্যথা করছে আম্মা। দমবন্ধ লাগছে।”
রাজিয়া কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে হেনাকে বললেন চিত্রাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে হেটে আসতে।
চিত্রা আজ প্রথমবার বাড়ির ছাদে উঠেছে। চারপাশ ঝকঝকে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় বোঝা গেল। পেছনের বিস্তৃত জলরাশি যেন মেঘমেদুর আকাশটির প্রতিচ্ছবি। চিত্রা নিরবে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হেনা সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমাগো সব ঠিক আছে তো চিত্রা? দুইজনেই দেহি মনম’রা হইয়া ঘুইরা বেড়াও!”
চিত্রা চোখ না ফিরিয়েই বলল,
“আচ্ছা আপা, আমরা কি মানুষকে ভালোবাসি নাকি মানুষের স্বভাবকে?”
হেনা ভ্রু কুঞ্চন করে। একটু রয়েসয়ে বলল,
“মানুষ যতই অসুন্দর হোক, সুন্দর স্বভাবে দিয়া অন্যরে ব’শ করন যায়। সুন্দর মানুষের স্বভাব যদি চা’মারের মতোন হয় তাইলে কি তারে কেউ ভালোবাসব? স্বভাবরে ভালোবাসলে হেই মানুষটার লইগ্যাও ভালোবাসা হয়।”
“আর যদি জানতে পারেন স্বভাবটাই একটা ভান!”
“তাইলে মানুষটারেও ভালোবাসার প্রশ্ন ওঠে না। এডি জিগাও ক্যান? তুমগো মইদ্য সব ঠিক আছে তো?”
চিত্রা মাথা দুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। এমনিই ভালো লাগছে না।”
“বেলা পইড়া গেছে। লও নিচে যাই।”
“আরেকটু থাকি?”
“আইচ্ছা, তুমি একটু পরে নাইমা পইড়ো। আমি কাপড়ডি নিয়া যাই।”
হেনা ছাদে মেলা কাপড় তুলে নেমে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে রইল অনেকটা সময়। বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। চারিদিকে আলোক স্বল্পতা বিরাজমান। হুট করে তার নজর গেল পাশের ছাদে। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সে। রবিন ছাদে উঠেছে! চিত্রা অস্থির হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। মানুষটার মুখোমুখি একবার যে হতেই হবে। চিত্রা ছুটে ছাদের অপরপাশে গেল। উঠানে এখন কেউ নেই। রান্নাঘরেও কেউ থাকে না এই সময়। সকলে নিজ নিজ ঘরে জিড়িয়ে নেয় এই সময়টা। সাম্য ঘরে নেই। চিত্রাকে কেউ খোঁজার সম্ভাবনা নেই এখন। চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে গেলে টের পাবে না। চিত্রা অতি সন্তর্পণে ছাদ থেকে নামল নিচতলায়। দহলিজ ঘরে কেউ নেই। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চারিদিকে নজর বুলিয়ে নেয়। এরপর চুপিসারে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে।
ফিরোজাদের দরজার সামনে গিয়ে সে আবার থমকে দাঁড়ায়। ফিরোজা চাচির সামনে পড়লে কী বলবে? দাদির সঙ্গে কথা বলতে এসেছে? যেই ভাবা সেই কাজ। তবে ভাগ্য সহায় চিত্রাকে কারো সামনে পড়তে হলো না। ফিরোজা চাচি বোধহয় নামাজে বসেছে। সে দ্রুত ছাদে উঠে গেল। মাথার আচল সরে, খোপা খুলে ততক্ষণে তার বেশভূষা এলোমেলো। রবিন ছাদে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কারো পায়ের শব্দে ঘাড় ঘোরালো সে। শুধু একটি পলক দৃষ্টি বিনিময়! রবিন তরাক করে উঠে বসল। চিত্রা ততক্ষণে ছাদের দরজা আটকে দিয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য যেন সেই আগের সময়টায় ফিরে গেল দুজনে। চিত্রা লুকিয়ে এসেছে দেখা করতে আর রবিনের দুচোখে ভয় এসে ভর করেছে। সে অস্থির ভঙ্গিতে উঠে চলে যেতে নিলে চিত্রা পথ আটকায়। কণ্ঠ নিংড়ে ফিসফিস করে বলে,
“যাবেন না।”
দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অনেকটা সময়। উভয়ের এক একটা নিঃশ্বাস যেন হৃদয়ে ঢেউ তুলছে। কত অপেক্ষার পর দেখা আজ! কত আকাঙ্ক্ষার! অথচ চিত্রা সেই পাগলামি দেখাতে পারে না, আর না রবিন তার পাগলামিতে আতঙ্কিত হয়। চিত্রার গাল বেয়ে নোনা জল গড়ায়। রবিন ঘোরগ্রস্থের মতো তার গালের মুক্তোদানায় আলতো করে একটি আঙুল ছোঁয়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে ম্লান আকাশটি মাথায় নিয়ে চিত্রার মনে পড়ে নৌকায় তাদের শেষ দেখা হওয়াটা। ঠিক একই ভঙ্গিতে তার অশ্রুতে আঙুল ছুঁইয়ে রনির বলা শেষ কথাটা,
“এই চিত্রা ফুলটা ঝরে যাক আমি চাই না।”
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৩]
প্রভা আফরিন
_
আঁধার যত ধেয়ে আসছে প্রকৃতি ততই রহস্যময় হয়ে উঠছে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র শব্দও স্পষ্ট হয়ে ভেসে আসছে। প্রায়ান্ধকারের শীতল হাওয়া চিত্রার দেহে কাঁপুনি দেয়। ছায়াময়, দ্বিধাময় এই সন্ধ্যায় তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি, ফোঁপানোর শব্দ যেন স্পষ্ট জানান দিচ্ছে রবিন নামক ছ’লনা রচনাকারী মানুষটা হেরে গিয়েছে। সময়ের কাছে না কি পরিস্থিতির কাছে? রবিন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রার সামনে। একটু আগে আবেগের বশে, স্থান, কাল ভুলে সে চিত্রার অশ্রুতে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়েছিল। ক্ষণেই সতর্ক হয়ে ছিটকে দূরে সরে গিয়েছে সে। এভাবে ছাদের দরজা আটকে রাখা বিপ’দজ’নক। কারো চোখে পড়লে শেষ রক্ষে হবে না। রবিন হাওয়ার গতিতে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। চিত্রা চিৎকার করে ওঠে,
“এই শেষবার অনুরোধ করছি, পালাবেন না।”
রবিন পালালো না। তবে চিত্রার চিৎকারে ভড়কে গেল। সে নত মস্তকে, দ্রুত পদে ফিরে এলো। অনুনয়ের সুরে বলল,
“নিজের স’র্বনাশ করবেন না। আস্তে কথা বলেন।”
চিত্রা সে কথার জবাব দিলো না। তবে রবিনের অবিকল সেই আকুল কণ্ঠধ্বনি শুনে সে থিতিয়ে গেল। এই মানুষটার ভালোবাসা পেতে কত পাগলানিই না করেছে সে! কত আশা বেধেছে মনে, কত অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে! অথচ যখন সামনে এলো চিত্রার সমস্ত খেয়ালিপনায় শেকল পরানো হয়ে গেছে। কি যে হা’সফা’স লাগে! কি দ’মব’ন্ধকর চারপাশ! একটু শ্বাস নিতেও যেন যু’দ্ধ করতে হচ্ছে। কোনোভাবে সময়টা বদলে দেওয়া যেত যদি! এই নি’ষ্ঠুর মানুষটাকেই যদি জীবন থেকে মুছে ফেলা যেত! এইটুকু বয়সে জীবনটা বড্ড জটিল হয়ে গিয়েছে তার। চিত্রা অবিশ্বাসী দৃষ্টি মেলে বলল,
“আপনি নে-শা করেন? আমার বিশ্বাস হয় না।”
রবিন ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে বলল,
“ফিরা যান। কেউ দেখলে আপনেরই ক্ষ’তি।”
“আমার ক্ষ’তি এখনো বাকি আছে কিছু?”
“সম্মানহানির চেয়ে বড়ো ক্ষ’তি কিছুতে নাই। মনের ক্ষ’তিরে সেই পাল্লায় মাপা বোকামি। এহনো ছেলেমানুষ-ই আছেন!”
“তাহলে এই ছেলেমানুষটাকে এত বড়ো ধা’ক্কাটা কেন দিলেন? কেন তার ডানা কে’টে দিলেন?”
রবিন চুপ রইল। তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হচ্ছে না। চিত্রা হাল ছেড়ে দেওয়া ভাঙা গলায় বলল,
“কেন করলেন এমনটা?”
“এতক্ষণে নিশ্চয়ই সব জাইনা গেছেন।”
“আর আমি? আমার অনুভূতি? আমাকে এভাবে ধোঁ’কা দিতে আপনার বুক কাঁপল না? একটুও না?”
“আপনের লগে আমার ধোঁ’কা দেওনের সম্পর্ক আছিলো না।”
“আসলেই ছিল না? বুকে হাত রেখে বলুন তো।”
রবিন সে কথার উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। ঝুম ঝুম সন্ধ্যায় তার নৈঃশব্দতা চিত্রার য’ন্ত্র’ণা বাড়ায়। উত্তর দিতে এত দ্বিধা কেন? তাহলে কি তার ছেলেমানুষির মাঝে সদা সতর্ক নারী চক্ষু ভুল চেনেনি? এই লোকটাও তাকে…। তার ভাবনার মাঝে ব্য’ঘা’ত ঘটিয়ে রবিন বলল,
“আপনে এহন কারো বউ। দু’র্ভাগ্য হইলেও সত্যি আপনে আমরই ভাইয়ের বউ। আমাগো এই ধরনের কথা কওয়া সাজে না।”
“সাজে না-ই যখন তবে কেন বিয়েটা হতে দিলেন? আমাকে একেবারে গুড়িয়ে না ফেললে আপনার চলছিলো না? কী ক্ষ’তি করেছিলাম আপনার?”
“সাম্যের লগে কার বিয়া হইতাছে আমি জানতাম না। আগ্রহও দেখাই নাই। বাড়ি থাইকা দূরে আছিলাম কয়েক মাস। জানলে এই বিয়া হইতে দিতাম না।”
চিত্রা তাচ্ছিল্য করে,
“আ’টকে দিতেন? কেন আ’টকাতেন? আপনি তো আমায় ভালোই বাসেননি।”
রবিন সে কথার উত্তর দিলো না। চিত্রা অসহিষ্ণু হয়ে গেল,
“আজ শেষ বারের মতো প্রশ্ন করছি। উত্তর দেবেন?”
‘শেষ বারের মতো প্রশ্ন!’ রবিন বিচলিত হয়েও সামলে নিল নিজেকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে চিত্রা বলল,
“কেন ভালোবাসলেন না আমায়? কোথায় কমতি ছিল আমার?” হঠাৎ মনে পড়তেই সঙ্গে যোগ করল,
“কারণটা কি হেনা আপা? তাকে মনের মাঝে পুষেছিলেন বলেই কি আমার ঠাঁই হয়নি?”
“হেনারে আমি ভালোবাসি না।”
চিত্রা অবাক হলো। তা দেখে রবিন আরো বলল,
“হেনা ছোটো থাইকা আমার লইগ্যা পাগল। আমি না। তারে নিয়া আমার মনে বিন্দুমাত্র অনুভূতি নাই। এইডা সবাই জানে।”
“তাহলে আমি কেন ঠাঁই পেলাম না? আমি তো আপনাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করেছিলাম। সকল আয়েশ ত্যাগ করে নিঃস্ব, ভীতু, সরল মানুষটাকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। হৃদয়ের উপচে পড়া কলসখানিতে জমানো সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিতে চেয়েছিলাম। অথচ আপনি ক’পটতা নিয়ে আমার সমস্ত অনুভূতিকে অ’পমান করলেন! নিজের হাতে যে ফুলটা ফোটালেন, তাকে অযত্নে, শুকিয়ে, ঝরেও যেতে দিলেন!”
চিত্রা মেঝেতে বসে পড়েছে। শরীর কাঁ’পছে মেয়েটার। পর পর এতগুলো ধা’ক্কা সইতে হি’মশি’ম খাচ্ছে মস্তিষ্ক। চোখের সামনে প্রথম আবেগের নি’ষ্ঠুর মৃ’ত্যু মেনে নিতে ক’ষ্ট হচ্ছে তার। তারচেয়ে লোকটার সঙ্গে তার আর দেখাই না হতো!
রবিন নিরুত্তর রইল অনেকটা সময়। যেন চিত্রার কান্নার শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বুকের ভেতর থেকে কি যেন ঠেলে বের হতে চাইছে। তার মনের আগল আলগা হয়েছে সেই রাতে, যখন চিত্রা ফুলের সাজে সজ্জিত হয়েছিল তার-ই ছোটো ভাইয়ের জন্য। ধা’ক্কাটা সেও যে সইতে পারেনি। বোবা হয়েছিল দুটো দিন। জগতে নিজেকে বড়োই অযাচিত মনে হচ্ছিলো। সব সাজানো ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে।
শালুগঞ্জে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখা হয়ে গেল একটি নিষ্ক’লুষ, সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের সঙ্গে। এরপর কি থেকে কি হয়ে গেল! খুব গোপনে মেয়েটি তার হৃদয়ে ঘাটি গাড়ল। রবিন বুঝেও আটকাতে পারল না। হয়তো চাইলোও না। কিন্তু ভাগ্যের অনিশ্চয়তায় মেয়েটিকে কাছে টানতে পারল না। ফুলটা যে বড়োই পবিত্র। তার অপবিত্র হাতের ছোঁয়ায় কলু’ষিত না হয়! আবার হারিয়ে ফেলার ভয়ে দূরেও ঠেলে দিলো না। রবিন দোলাচলে দুলছিলো। মেয়েটির পাগলামি তার কাছে নে-শা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে নে-শায় বুদ হলে নিজেকে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে সে। মেয়েটার সান্নিধ্য পেতে মনটা উতলা হয় বানভাসি নদীর মতোই। নিজের ইচ্ছেতেই রোজ স্কুল ছুটির পর চিত্রার জন্য ঘাটে অপেক্ষায় থাকে। একটু কথা হয়, একটু পাগলামির দেখা মেলে, তাতেই হৃদয় বিবশ হয়ে যায়। রবিউল খন্দকার সবটা জেনে যাওয়ায় পরিচয় প্রকাশের আশঙ্কায় রবিনকে আগেই গ্রাম ত্যাগ করতে হয়েছিল। তবে শালুগঞ্জ থেকে সে ফিরেছিল একবুক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। হেনার পাগলামিতে সে নিজেই বাড়িতে থাকতে অপছন্দ করত। বড়ো চাচা তাকে দূরে পাঠিয়ে দিলে বরং খুশিই হতো। বিয়ের ওপরও এক প্রকার বি’তৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল। কিন্তু চিত্রাফুলের সন্ধান পাওয়ার পর সে বাড়িতে ফিরেই পরিবারকে বিয়ের আশ্বাস দিলো। সাথে খানিকটা সময় চেয়ে নিল, নিজের অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। মাঝে চিত্রার খোঁজও নিয়েছিল। মেয়েটা পড়াশোনা করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে জেনে ভেবেছিল সময় পাবে কিছুটা। কিন্তু ভেতরের খবরটা সে জানতে পারেনি। ভাগ্য সহায় ছিল না বলেই হয়তো।
চিত্রার আকুতিতে রবিন হাল ছেড়ে দিলো। হাটু মুড়ে চিত্রার সামনে বসে পড়ল। বলল,
“আমার চরিত্র নোং’রা না হইলেও খারাপ ছেলেদের তালিকায় আছি। তা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নাই। কিন্তু আপনে নিষ্পাপ। আমার ছন্নছাড়া জীবনে আপনেরে টাইনা আইনা কষ্ট দিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আছিলো না। ডরাইতাম, সব সত্যি জাইনা গেলে যদি আমারে ঘে’ন্না করেন? যদি ভাবেন আমার জীবনে নিজেরে জড়াইয়া সবচেয়ে বড়ো ভুল করছেন? যদি দূরে সইরা যান? এর মাঝেই আপনের আব্বা আমাগো ব্যাপারে জাইনা যাওয়ায় অপারগ হইয়া গ্রাম ছাড়ছিলাম। নয়তো উনারে যদ্দুর চিনছি, আমারে সহজে ছাড়ত না।”
“চলে যাওয়ার আগে আমায় একটিবার কেন জানালেন না। আমি সেদিন রাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম আপনার হাত ধরে পালাব বলে। একবার ভালোবেসে হাতটা ধরতেন, আপনার সব দো’ষ মেনে নিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম।”
রবিন থমকালো। বেদনাতুর মুখশ্রীতে আফসোসের কালো ছায়া জমেছে। অন্ধকারের মাঝে যেন তা আরো নিগূঢ় হয়ে উঠেছে। চিত্রা বলল,
“অন্তত পরে একবার যোগাযোগ করতেন, আমি জীবন থাকতে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতাম না।”
“আপনে যদি সাম্যের বউ না হইতেন, খোদার কসম! আমি আপনেরে এক মুহূর্তের জন্যও এইহানে রাখতাম না। দরকার পড়লে তুইলা নিয়া যাইতাম। কিন্তু ভাগ্য আমার হাত-পাও সব দিক দিয়া বাইন্ধা দিছে।”
একটি কথায় পরিষ্কার হয়ে গেল দুজনের আর এক হওয়ার পথ নেই। দুজনের মাঝে সেই স্বপ্নও নিষ্প্রাণ। শুধু রয়ে গেল অতি কাছে থেকেও না পাওয়ার য’ন্ত্র’ণা। সমগ্র ছাদে এক গুমোট হা’হাকার যেন আ’র্ত’নাদ করতে থাকল। অন্ধকারও বুঝি মনের অবস্থা টের পেয়ে নিজ তাগিদেই আঁধারের ঘনত্ব বাড়ালো। চিত্রা ক্ষ’য়ে আসা কণ্ঠে আওড়ালো,
“আমার সবচেয়ে বড়ো আফসোস আপনাকে ভালোবাসা।”
“আমার সবচেয়ে বড়ো আফসোস আপনের ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারা। প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে আমার এক জীবনের সবখানি সুখ আপনের নামে দলিল হোক। আপনের দুঃখ আমার ভাগ্যের দলিলে সামিল হোক।”
চিত্রা আর এক মুহূর্তও কালক্ষেপণ করল না সেখানে। জগতের করুণ দৃশ্যগুলোর একটি হলো অসহায় পুরুষের কান্না। এই কান্না ধারণের ক্ষমতা নিগূঢ় রাতের আছে, ক্ষ’য়িষ্ণু চিত্রার নেই। সে বি’ধ্ব’স্ত মন নিয়ে ফিরে গেল স্বামীর ঘরে।
__________
সন্ধ্যায় চিত্রাকে ঘরে না পেয়ে হেনা ভেবেছিল সে ছাদেই রয়ে গেছে। তাই হেনা পুনরায় উঠেছিল ছাদে। কিন্তু সেখানে গিয়েই আচমকা তার দৃষ্টি থমকায় পাশের ছাদে। রবিন ভাই সাম্যের বউয়ের গালে আঙুল ছুঁয়িয়েছে! হেনা তড়িঘড়ি করে নেমে যায় ছাদ থেকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে ছুটে যায় পাশের ভবনে। ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে সে যেটুকু শুনেছে, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। রবিনের জন্য সেই কৈশোরবেলা থেকেই পাগল হেনা। অথচ রবিন তারই আদরের ছোটো ভাইয়ের বউয়ের প্রতি দুর্বল! হেনা এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি আর।
রাত কতটা গড়িয়েছে চিত্রা জানে না। সাম্য কখন ঘরে ঢুকেছে তাও টের পায়নি। দরজা আটকানোর শব্দে সে মাথা তুলে তাকায়। সাম্যের চাহনি আজ অন্যরকম। সেই চোখে মুগ্ধতা, ভালোবাসার লেশমাত্র নেই। সাম্য সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
“কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের?”
চিত্রা চমকালো। কথাটা ঠিক কী ভেবে বলেছে বোঝার জন্য বলল,
“মানে?”
“বিয়ের পরও পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে মেলামেশা করছো অথচ আমার প্রশ্নে অবুঝ হওয়ার ভান করছো?”
সাম্যের কণ্ঠের তীক্ষ্ণতায় চিত্রা খেই হারিয়ে ফেলে। সাম্য উ’ত্তে’জিত হয়ে আবার বলল,
“আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে বে’ঈ’মানি করতে তোমার বা’ধল না? অবশ্য তোমাকেই বা বলছি কেন? আমার বড়ো ভাইয়ের-ই বা’ধল না। দুইজন মানুষকে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি। আর সেই ভালোবাসার মানুষই আমার পিঠে ছু-রি বসালো! এ জন্যই বুঝি আমার কাছে আসতে তোমার এত আপত্তি? আমার ছোঁয়ায় এত বিতৃষ্ণা? ভাইয়ার ছোঁয়ায় বুঝি খুব খুশি হও?”
একের পর এক ঘটনা হজম করতে করতে চিত্রা ভেঙে পড়েছে। এরই মাঝে সাম্যের উচ্চবাচ্য ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় তার মেজাজ বিগড়ে গেল। চিত্রা ক্রো’ধের বশে, বাক্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বলে উঠল,
“হ্যাঁ, তাই। আপনার ছোঁয়া অসহ্য লাগে আমার। অসহ্য…”
জে’দের বশবর্তী হয়ে চিত্রার নিস্তেজ দেহে সে রাতে সাম্য তার আ’গ্রা’সী থা’বা বসাল। ভঙ্গুর মেয়েটিকে একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো। যে রাতটি হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে মধুর তাই তাদের জীবনে নেমে এলো দুঃস্বপ্নের মতো। বি’ধ্ব’স্ত, মেয়েটিকে ফেলে পরদিন সকালে সাম্য অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ি ছাড়ল।
চলবে…
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]