বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯+৪০+৪১

0
208

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৭]
প্রভা আফরিন
_

রাজিয়াকে শূন্যহস্তে, বিক্ষিপ্ত মনে নিবাসপুর ফিরে যেতে হয়েছে। শ্বাশুড়ির কান্নার বিপরীতে চিত্রা কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। রাজিয়া বাড়ি ছাড়তেই জুলেখা চড়াও হয়েছে মেয়ের ওপর। বাড়ি মাথায় তুলে ব’কাব’কি শুরু করলেন তিনি। সব ভুলে তারা যেহেতু বাড়ির বউকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে মেয়ের এত নখরা কেন? এমন তো না সে জজ-ব্যারিস্টার হতে চায়! তার কোনো লক্ষণ বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই চিত্রার মাঝে। অতীতে মোক্তার বাড়ির লোকেরা যা করেছে তার জন্য অনুতপ্ততা প্রকাশ করেছে। তাহলে চিত্রা কেন বৈরাগী হতে চাইছে? মেয়েদের জীবনে শ্বশুর বাড়িই আসল জীবন-সংসার। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমস্যা হতেই পারে। তাই বলে জেদ ধরে আলাদা থাকলে চলে? বিবাহিত মেয়ে বাপের বাড়ি পরে থাকলে কেউ ভালো চোখে দেখে না। আবার বিয়ে দিতে গেলেও ভালো বর মিলবে না। তাছাড়া দুদিন পর হিমাদের সংসার হবে। একসময় তার বউয়ের হাতে সংসারের হাল উঠবে। তখন চিত্রা কী বাড়ির উচ্ছিষ্ট হয়ে থাকবে? বয়স বাড়লে কে দেখবে তাকে? এমন হাজারো কথা বলে মেয়ে ছন্নছাড়া, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আ’হাজা’রি করতে লাগলেন জুলেখা।
চিত্রা অবশ্য মায়ের কথা বিশেষ গায়ে মাখল না। কথা শুনে শুনে গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গিয়েছে এখন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো রবিউল খন্দকার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের কথা উচ্চারণ করেননি। যেদিন থেকে তিনি রবিনের সত্যতা জেনেছিলেন সেদিন থেকে সব সিদ্ধান্ত চিত্রার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে চিত্রা এখন আরও বেশি গা ছাড়া স্বভাবের হয়েছে। মেয়ের নির্লিপ্ততা সইতে না পেরে এক পর্যায়ে জুলেখা বলেই ফেললেন,
“তুই কি এহনো ওই ছেড়ার আশায় আছোস? মান-ইজ্জত গাঙ্গে জলাঞ্জলি দেওনের পরেও হের সংসারের স্বপ্ন দেহোস?”

মা কোন ছেলের ইঙ্গিত দিয়েছে চিত্রার বুঝতে অসুবিধা হলো না। জুলেখা ভেবেছিলেন চিত্রা এবার রেগে যাবে। তবে ওনাকে অবাক করে দিয়ে সে ফিচেল হাসল। বলল,
“সংসার বাধার স্বপ্ন কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে ফেলেছিলাম, মা। শুধু আক্ষেপটা রয়ে গেছিলো। হয়তো সারাজীবনই থাকবে। তবুও আমরা এক হতে পারব না। সুযোগ পেলেও না। কি অদ্ভুত ভালোবাসা, না?”

চিত্রা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বুকের ভেতরটা কেমন জ্ব’লছে। প্রত্যেকটা ঘটনা তার হৃদয়ে এখনো দ’গদ’গে হয়ে আছে। কীভাবে তাকে ক’লঙ্কিত করা হয়েছিল, সব এখনো অম্লান হয়ে আছে মানসপটে।

সেই দুঃসহ রাতের পর চিত্রা যখন চোখ মেলেছিল সাম্যকে কোথাও পায়নি। তাকে ঘুমে রেখেই সে বাড়ি ত্যাগ করেছিল। চিত্রাকে ফেলে গিয়েছিল ন’রক য’ন্ত্রণায়। হেনা আসল কথায় রঙ মিশিয়ে তার ও রবিনের সম্পর্ককে প’র’কীয়ায় রূপান্তর করে উপস্থাপন করেছিল সবার সামনে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ চিত্রার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রাজিয়া তাকে দিন-রাত অভি’স’ম্পাত করতেন। ছেলেকে ঘরে বাধতে বিয়ে দিয়ে বউ আনলেন অথচ সেই বউ-ই কিনা তার ছেলেকে গৃহত্যাগী করল! তিনি পারিবারিক সালিশ বসিয়ে সকলের সামনে চিত্রাকে
লাঞ্ছিত করেছেন। ছেলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছেন। তবে সাম্য তা চায়নি। সে বাড়ি না এলেও যোগাযোগ করেছিল কয়েকবার। স্পষ্ট জানিয়েছিল চিত্রা তার অধিকারেই মোক্তার বাড়িতে থাকবে, তাকে যেন কোনোপ্রকার অবহেলা, অযত্ন না করা হয়। সাম্যের প্রথম কথাটি রাখা হয়েছিল, তবে দ্বিতীয়টি নয়। উঠতে-বসতে ভাতের দানার চেয়েও অধিক ক’টূবাক্য গিলতে হয়েছে চিত্রাকে। সকলের ঘৃণাভরা দৃষ্টি তার সর্বাঙ্গে যেন অ’গ্নি নিক্ষেপ করত। বি’ষা’ক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়াও ক’ষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাসখানেকের ভেতরই চিত্রার ওজন প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছিল। মানসিক চাপে জর্জরিত মন নিয়ে সে একেবারে ভেঙে পরেছিল।

শ্বশুরবাড়িতে চিত্রার স্বামীবিহীন সংসার টিকে ছিল দুইমাস। স্বল্প সময়টুকুর মাঝে সে একবারও রজঃস্বলা না হলে মেয়ে মহলে চাপা গুঞ্জন উঠল চিত্রা গর্ভবতী হয়েছে। অভিজ্ঞ রমিজাও তাকে দেখে সায় দেয়। সেই গর্ভধারণ নিয়েও সংশয় দেখা দিলো। এবার তা ফুলেফেঁপে আরো ভ’য়াবহ আকার ধারণ করল। চিত্রা ও রবিনকে দহলিজ ঘরে ডেকে রমিজা প্রশ্ন করলেন তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে। আঙুল তুললেন গর্ভের সন্তানের ঔরস নিয়ে। চিত্রার তখন ম’রে যেতে ইচ্ছে করছিল। নিজের সম্মান রক্ষা করতে কত চেষ্টাই না করেছিল, কত অনুনয় করেছিল! কিন্তু টিকতে পারেনি তাদের সন্দেহের বি’ষ মাখানো তীরের সামনে। চোখের সামনে নিজেকে সকলের নোং’রা বাক্য ও ভর্ৎ’স’নার পাত্রী হতে দেখেছে, কিছুই করতে পারেনি। ক’লঙ্কের অসহনীয় বোঝা ঘাড়ে নিয়ে সে মু’মূ’র্ষু রো’গীতে রূপান্তর হয়েছিল। পরদিনই ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানায় চিত্রা আসলে গর্ভবতী-ই নয়। কোনো কারণে তার স্বাভাবিক ঋতুচক্র অনিয়মিত হয়েছে। সেদিনই চিত্রা এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে বাপের বাড়ি ফিরে আসে।

রবিন এতগুলো দিন বাড়িতেই ছিল। পাছে চিত্রাকে পরিবারের লোক নি’র্যা’তন করে, সেই ভয়ে বাড়ি ছাড়েনি। সর্বদা তার খবরাখবর রেখেছে। কিন্তু সেদিন দহলিজ ঘরে তার নিষ্কলুষ ভালোবাসায় আঙুল তোলার পর রবিন তার ব্যর্থ, র’ক্তা’ক্ত হৃদয়ে একটি ঝরে যাওয়া চিত্রাফুলের মায়া নিয়ে শুধু বাড়ি নয়, কয়েক মাসের ভেতর একেবারে দেশ ছেড়ে প্রবাসজীবন গ্রহণ করে।

সাম্য দূরে বসে সব ঘটনাই শুনেছিল। চিত্রা বাড়ি ছাড়ার পর সেও আর বাড়ি ফিরে যায়নি। বছরখানিক পর চিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল অবশ্য। তবে সরাসরি নয়, পত্রের মাধ্যমে। জানায় চিত্রা চাইলে সে এই সম্পর্কের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দেবে, তালাকনামা পাঠাবে। সে চাইলে রবিনের সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে, তার নিকট পাঠিয়ে দিতেও পারবে। চিত্রা কোনো জবাব দেয়নি। দিনগুলো স্রোতের সঙ্গে বয়ে গেল, অথচ চিত্রার কাছে এখনো সব জ্বলজ্বলে। সে জানে রাজিয়া মন থেকে তাকে গ্রহণ করতে আসেনি। এসেছিল তাকে ফিরিয়ে নিজের ছেলেকেও ঘরে ফেরাতে। নয়তো ঘুরেও চাইতো না তার দিকে।

চিত্রার নিজের ওপর ক’রুণা হয়। ভাগ্যের ওপর মায়া হয়। সকলে তার থেকে নিজের লাভ-ক্ষ’তির হিসেব মিলিয়ে নিতে চেয়েছে। অথচ তাকে একটুও বুঝতে চেষ্টা করেনি। যন্ত্রণা প্রশমনের কোনো পথ্য নিয়ে একটু প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেনি কেউ। কেউ না। চিত্রা কী আদৌ কারো আশা করেছিল?
____________

টিয়া খন্দকার বাড়িতে এসে হাজির হলো পরদিন বিকেলে। পরনে রঙিন শাড়ি, হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, খোলা চুল লুটিয়ে আছে পিঠের ওপর। লাজুক হাসি ঠোঁটে লেপ্টে আছে। জুলেখা তাকে দেখে স্নেহের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। টিয়া লাজুক হেসে বলল,
“একটু হাটতে বের হয়েছিলাম। ভাবলাম আপনাদের বাড়িতে ঘুরে যাই। চাচি রাগ করলেন না তো?”
জুলেখা তাকে বসতে দিয়ে বললেন,
“কি যে কও! যহন মনে চায় আইবা। আমাগো পর মনে করার কোনো কারণ নাই।”
“বলছেন? তাহলে কিন্তু বিরক্ত হলেও বাড়ি ছাড়ছি না।”
কথাটা বলেই টিয়া হেসে ফেলল। ফরসা, মিষ্টি গড়নের মেয়েটিকে জুলেখার ভারী পছন্দ। টিয়াকে দেখলে প্রতিবারই ওনার মনে হয় হিমাদের পাশে বেশ মানাবে মেয়েটিকে। অনেকদিন ধরে রবিউল খন্দকারের কানে কথাটা তুলবে তুলবে করেও তোলা হচ্ছে না।

টিয়াকে দেখে পালি এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করল। টিয়া খানিক উশখুশ করে বলে উঠল,
“বাড়িতে আর কাউকে দেখছি না যে?”
পালি সে কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসল। পুকুরপাড়ের নির্জন, ঝোপযুক্ত প্রান্তে বসে, পানিতে ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল হিমাদ। আসলে সে একটু নিরবে বসে সময় কা’টাতে চাইছিল। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা নিরব কাজগুলোর একটি বলে একইসঙ্গে দুই কার্য সম্পাদন করতে এসেছিল। সেই নিরবতা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো পালি। পেছন থেকে উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল,
“মাছ ধরা রাখো হিমাদ ভাই, পাখি শিকারে যাও।”
হিমাদ ঘুরে তাকাতেই দেখল পালি পেছনে দুহাত গুজে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ডানে-বামে দুলছে। হিমাদ তার হেয়ালি কথা ধরতে না পেরে বলল,
“মানে?”
“টিয়া পাখি উড়ে এসেছে। তোমায় না দেখতে পেয়ে কিচিরমিচির করছে।”
হিমাদ আশ্চর্য হলো পালির স্প’র্ধা দেখে। র’ক্তনেত্রে তাকিয়ে বলল,
“আজকাল একটু বেশি কথা বলছিস মনে হচ্ছে?”
“ভুল বললাম?”
হিমাদ উঠে দাঁড়ালো। মাছ রাখা পাতিলটা পালির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আ’জাইরা থাকলে মাথায় অনেক ফাও কথাবার্তা ঘুরে বেড়ায়। নে, কাজ দিলাম। সবগুলো কুটে-বেছে, ভেজে নিবি। নিজের হাতে করবি। রাতে খাবার সময় যেন পাতে পাই।”
পালির মুখটা নিভে গেল। পাতিলে বেশ অনেকগুলো তেলাপিয়া মাছ। সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“এগুলো করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। আমি পড়তে বসব কখন? দুটো দিনও বাকি নেই পরীক্ষার।”
“রাত তো পরেই আছে। সারাদিন কি করেছিস?”
রাগে পালির নাসিকা গহ্বর ছোটো-বড়ো হতে লাগল। সে হিমাদের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“তুমি যে এখনো সি’গা’রেট খাও তা কিন্তু আমি জানি।”
“তোর সঙ্গে বসে খাই কিনা! জানবি-ই তো!”
“জানতে হলে সঙ্গে খেতে হবে নাকি? তোমার কালো ঠোঁট দেখলেই বোঝা যায়।”
“আচ্ছা! কতজনের ঠোঁটে গবেষণা করেছিস এসব নিয়ে?”
“ছি!” হিমাদের বাঁকা কথায় পালি অবাক হয়ে গেল।হিমাদ ঝুকে এসে, আঙুল উঁচিয়ে অ’হং’কার করে বলল,
“তোর কালো ঠোঁটের চেয়ে আমার ঠোঁট অনেক সুন্দর।”
“আমি তো জন্মকালো। স্বভাবে কালো না।”
পালি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। তার কথার ধারে হিমাদ কয়েক সেকেন্ড থমকে গেল। পালি আবার বলল,
“তোমাদের কাছে হয়তো আমি কালো, কিন্তু মা আমাকে কি বলত জানো? আমি হলাম এক খন্ড আষাঢ়ি মেঘ। বর্ষাপ্রেমী ব্যতীত এই মেঘের গুরুত্ব কেউ বুঝবে না।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৮]
প্রভা আফরিন
_

হিমাদ তার সিদ্ধান্তে অনড়। মাছ পালিকেই কা’টতে হবে। জুলেখা ছেলের এমন কথা শুনে ভ্রু কুচকালেন। হিমাদ বলল,
“তুমি ও চামেলি খালা সারাদিন রান্নাঘরে পরিশ্রম করো। এখন আমার জন্য তোমাদের আর অতিরিক্ত কষ্ট করতে হবে না। পালিকে কা’টা-ভাজার দায়িত্ব দিলাম। ওই করুক।”

ছেলে তার কষ্টের কথা ভেবেছে শুনে জুলেখা খুশি হলেন। তার সিদ্ধান্তে অমত করলেন না। অনেক ছ’লচা’তুরী করেও হিমাদের নির্দেশ থেকে কিছুতেই রেহাই পেল না পালি। অগত্যা, চুলে হাতখোপা করে, কোমড়ে ওড়না গুজে, রান্নাঘরের সামনে পিঁড়ি পেতে বসে মাছ কা’টতে শুরু করল সে। টিয়া তখনো উঠানে বসা। অষ্টাদশী টিয়া দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। হিমাদকে দেখা মাত্রি তার গালের রঙ বদলেছে। ফলে মুখশ্রী এখন আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হিমাদ দরজার সামনের তিনধাপের সিড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে বসে বলল,
“শাড়িতে বেশ মানিয়েছে তোমাকে।”

টিয়া যেন হাওয়ায় ভাসতে লাগল। স্বল্পভাষী, নিরুত্তাপ স্বভাবের হিমাদ কিনা তার প্রশংসা করছে! দৃষ্টিদ্বয় যেন গর্ব করে বলছে তার শাড়ি পরে সাজগোজ করা স্বার্থক হলো। প্রত্যুত্তরে বলল,
“আপনার প্রিয় রঙের নাম কী?”
“আমার প্রিয় রঙ?”
“হু।”
হিমাদ একটু ভাবুক হয়ে আশেপাশে তাকালো, যেন প্রিয় রঙ খুঁজছে। তার হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে থুতনিকে উঁকি দেওয়া ঘন দাড়ি চুলকানোর ভঙ্গিটাও কি সুন্দর লাগল! পালি মাছ কা’টতে কা’টতেই একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। একপাশে ঠোঁটের কোণা প্রসারিত করে ভাবে,
“সবই টিয়া পাখিকে মুগ্ধ করার বাহানা মাত্র।”
হিমাদ উত্তর দিলো,
“নির্দিষ্ট প্রিয় কোনো রঙ নেই। তবে উজ্জ্বল রঙ টানে বেশি। এই যেমন এখন তোমার শাড়ির আকাশী রঙটা ভালো লাগছে।”

টিয়া লজ্জায় হাবুডুবু খায়। তার মনে হচ্ছে হিমাদের মন আজ কোনো কারণে খুব ভালো। সে যদি আরো কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যায় হিমাদ সায় দেবে। কিন্তু বাড়ির লোকেদের সামনে জড়তায় তেমন একটা কথা বলা হলো না। টিয়া বেশিক্ষণ বসলও না। বেলা পড়ে যাওয়ায় সে মন খারাপ করে ফিরে যাওয়ার জন্য উঠলে জুলেখা বললেন,
“একলা ফিরতে পারবা?”
“একাই তো এসেছি চাচি।”
“সন্ধ্যা মিলাইতাছে। একলা ফিরা কাম নাই। চুল-টুল বাইন্ধা লও।”
টিয়া চুলে হাতখোপা করল। হিমাদ একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। কেন জানি টিয়ার খোপা করাটা তার ভালো লাগল না। খোলা চুলের মাধুর্যটা মিলিয়ে গেল। সে চোখ ফিরিয়ে পালির দিকে তাকায়। একে তো ঘন চুল, তারওপর লম্বা। মেয়েটার ঘাড়ে ফেলে রাখা খোপার কুন্ডলিকে দেখে মনে হচ্ছে সেটা আরেকটা ছোটো মাথা। এইটুকু মেয়েকে এত বড়ো চুল রাখতে কে বলেছে? জুলেখা ছেলেকে বললেন,
“ওরে ইট্টু পৌঁছায় দে বাড়িত।”
হিমাদ আপত্তি করল না। সে টিয়াকে আগে হাটতে বলে খানিক দূরত্ব নিয়ে পেছনে হাটা দিলো।

রবিউল খন্দকার বাইরে থেকে ফিরে পালিকে মাছ কা’টতে দেখে অসন্তোষের সঙ্গে বললেন,
“তোরে ক্যাডা এই কাম দিছে? জুলেখা কই? চামেলি কী করে?”
পালি গোমড়া মুখে বলল,
“হিমাদ ভাই দিয়েছে মামা।”
“দুইদিন বাদে বোর্ড পরীক্ষা, হাত-পাও কাইট্যা বইলে কেমনে হইব?”
জুলেখা বললেন,
“মাইয়া মানুষ সংসার কইরা, পোলাপাইন সামাল দিয়াও লেহাপড়া করতে পারে। হিমাদ শখ কইরা মাছ ধরছে। ওরে ভাজতে কইছে, ভাইজা দিক। আপনে এত চিন্তা কইরেন না, ঘরে যান।”

পালি সবগুলো মাছ ভেজে তা থেকে কিছু ভাজা মাছ আলাদা করে নিয়ে পেয়াজ দিয়ে ভুনা করে নিল। তার রান্নার কাজ যখন শেষ হলো তখন আঁধার ঘন হয়ে জেকে বসেছে সন্ধ্যার গায়ে। উত্তুরে হিম হাওয়ায় ভেসে আশা কুয়াশা গায়ে জড়িয়ে প্রকৃতি স্তব্ধ, নিশ্চুপ। আষ্টে গন্ধ নিয়ে পালির আবার গোসল করার ইচ্ছে হলো। মেহেরুন বানু তা শোনা মাত্রই ধমকে উঠলেন। এই কনকনে শীতের মধ্যে অসময়ে গোসল করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। সাবান দিয়ে হাত-পা ধুয়ে নিতে বললেন তিনি। পালি তাই করল।

টিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নানান জায়গায় সময় কাটিয়ে হিমাদ বাড়ি ফিরল রাত ন’টায়। ততক্ষণে সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, পালি ছাড়া। খেয়ে নিলেই শরীরে আলস্য ভীড় করে। পড়া হয় না। তাই সে পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খায়। হিমাদ ভাত খেতে বসে পর পর সাতটি ভাজা মাছ খেয়ে নিয়েছে। পালি পড়া থেকে উঠে এসে জিজ্ঞেস করল,
“মাছ কেমন হয়েছে হিমাদ ভাই?”
“মাছ ভাজা এমন মহৎ কোনো রান্না নয়।”
পালির মুখটা দপ করে নিভে গেল। তবে দমে গেল না। বলল,
“হোক সাধারণ। আমি কে’টেছি, ধুয়েছি, মশলা মাখিয়ে তেলে ভেজেছি। যদি আঁইশসহ কা’টতাম, ভালোমতো না ধুয়ে, গন্ধ না ছাড়িয়ে, পরিমান মতো মশলার উপকরণ না মাখিয়ে ভাজতাম, তবে কী মুখে দিতে পারতে?”

হিমাদ খাওয়া থামিয়ে নিরবে কিছুক্ষণ পালির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পালি মনে মনে শ’ঙ্কিত হলো, অতিরিক্ত কথা ফেলল কিনা? হিমাদ পুনরায় ভাত চিবোতে চিবোতে শুধু বলল,
“আরো শিখতে হবে।”
পালি মনে মনে উৎফুল্ল হলো। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হিমাদ যখন ভুনা করা মাছের তরকারিটা পাতে তুলে নিল, তাতে লম্বা চুল পেল। পালি সেটা দেখা মাত্রই চোখ বড়ো বড়ো করে। দাতে জিভ কা’টে। হিমাদের ভাতের থালায় তখনো অর্ধেকটা ভাত অবশিষ্ট। হিমাদের আর খাওয়া হলো না। সে ভাতের ওপর পুরো তরকারি বাটিটা উলটে দিয়ে বলল,
“খুব তো রান্না নিয়ে জ্ঞান দেওয়া হচ্ছিলো! এবার মাথা থেকে ঝরে পড়া জ্ঞান মিশিয়ে ভাত খা।”

হিমাদ খাওয়া ফেলে চলে গেল। পালির চোখ ফেটে জল আসে। এত সতর্ক থাকার পরেও কীভাবে ভুলটা হয়ে গেল সে জানে না। পালিরও সে রাতে খাওয়া হলো না। পড়ায় মনও বসল না। পরের দিনগুলো সে হিমাদকে এক প্রকার এড়িয়েই চলল। পালি পরীক্ষা কেন্দ্র পড়েছে উপজেলা সরকারি কলেজে। এখান থেকে তার দূরত্ব নদী পেরিয়ে আরো চার মাইল। ভোরে সে ট্রলারে চেপে মামার সঙ্গে রওনা দেয়। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়ায়। সবগুলো পরীক্ষাতে কখনো মেহেরুন বানু, চিত্রা বা রবিউল খন্দকার গিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে হিমাদের ডিপার্টমেন্ট-এর ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। হিমাদেরও ফিরে যাওয়ার তাড়া নেই। তাই শেষের দুটি পরীক্ষায় পালিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাকে দিলেন রবিউল খন্দকার। হিমাদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আব্বার কথা ফেলতে পারল না। সে নিয়ে তো গেল কিন্তু পালির সঙ্গে টু শব্দটিও করল না। কেন্দ্রে ঢোকার আগে কোনো রকম উৎসাহ, উপদেশমূলক বার্তা কিংবা বেরোনোর পর পরীক্ষা কেমন হয়েছে, ক’টা প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে সেসব নিয়েও কোনো কথা বলল না। পালি মনে হলো সে এক জড়বস্তুর সঙ্গে যাতায়াত করছে। যার পালি নামক মেয়েটির কোনো বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। ঘাটে নেমে হিমাদ প্রথমবার কথা বলল।
“তুই চলে যা। আমার ফিরতে দেরি হবে।”

সে কথায় পালি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল। ঘাট পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই তার দেখা হলো নিলয়ের সঙ্গে। মুখে হাসি ফুটল দুজনেরই। পুরোটা পথ দুজনে কে কয়টা পারল, কত পৃষ্ঠা লিখল, গার্ড কেমন পড়েছিল সেসব নিয়ে আলোচনা করে বাড়ি ফিরে গেল। পরদিন হিমাদ একই রকম ভাব বজায় রাখলে পালি থাকতে না পেরে বলেই ফেলল,
“তুমি এমন কেন হিমাদ ভাই?”
“কেমন?” হিমাদের গা ছাড়া উত্তর।
“মানুষ অপরিচিত কারো সঙ্গে গেলেও তো সৌজন্য দেখিয়ে দুটো কথা বলে। আর আমি তোমার ফুপাতো বোন, তোমার সঙ্গে আছি, একটা ভালোমন্দ কথাও বললে না!”
“বলার তো বিশেষ কিছু দেখি না।”
“এতটা অপছন্দ কেন করো আমায়? ছোটোবেলায় তোমার সি’গারেট খাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় তো আমার কোনো দো’ষ ছিল না। তবুও আমায় মে’রেছিলে তুমি। কাউকে কিচ্ছুটি বলিনি। এতদিন নিশ্চয়ই বাচ্চাদের মতো সেসব ধরে বসে থাকোনি! তবে কেন অপছন্দ করো? তোমাদের সংসারে উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে আছি বলে?”

হিমাদ সে কথার উত্তর দিলো না। মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে পালির চোখ থেকে নিরবে অশ্রু নির্গমন হয়। মন থেকে তাগিদ আসে তাকে বড়ো হতে হবে। নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।

শীত পেরিয়ে, প্রকৃতি মাতিয়ে বসন্ত এলো। পালির পরীক্ষাও শেষ হলো। পেল অফুরন্ত অবসর। সেটুকু সময় কাজে লাগাতে পালি হাতের কাজ শেখে। এমনই এক সাধারণ দিনে রবিউল খন্দকার ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফিরলেন। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। কেমন অস্থিরতা চেপে ধরেছে ওনাকে। পালি চিন্তিত হয়ে বলল,
“মামা, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
রবিউল খন্দকার বললেন,
“ঠা’ডা ম’রা রইদ দিয়া হাইটা আইছি তো, তাই মনে হয় এইরম লাগতাছে।”
পালি রাগ করে বলল,
“ছাতা কোথায় আপনার? ফেলে এসেছেন, তাইনা?”
রবিউল খন্দকার পালির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন। অ’প’রাধ স্বীকার করে বলেন,
“ভুল হইছে আম্মা। বয়স হইতাছে তো। কোনোকিছু মনে থাকে না।”
“কিচ্ছু বয়স হয়নি। আপনি একটু কাজের চাপ কমান। কিছুদিন অবসরে থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মস্তিষ্কের বয়সও কমে যাবে।”
রবিউল খন্দকার পা’গল মেয়ের কথায় হাসেন। কিন্তু রাত গড়াতেই ওনার অবস্থা খারাপ হলো এবং ঘুমের মাঝেই স্ট্রো’ক করে তিনি প’ক্ষাঘা’ত আ’ক্রা’ন্ত হলেন।

চলবে..

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৩৯]
প্রভা আফরিন
_

রবিউল খন্দকার শুয়ে আছেন বদ্ধ ঘরের বিশাল পালঙ্কে। দরজা-জানালা বন্ধ, সম্পূর্ণ ঘরে ক্ষীণ আলোর উপস্থিতি। কত বেলা হলো? জানেন না তিনি। জানানোর মতো কাউকে দেখলেনও না। সব কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। বাড়িটা যেন পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিনত হয়েছে। আগের মতো ছোটাছুটি, দাপাদাপি বা কথার উচ্ছ্বসিত শব্দ শোনা যায় না। কেমন ফিসফাস করে কথা হয়। কখনো বা চাপা কান্নার ধ্বনি জেগে ওঠে। খানিকক্ষণ পর আবারো চুপচাপ। যেন একটি জনমানবহীন অরণ্যে বাস করছেন তিনি। ঘরে ভ্যাপসা গরম ছুটেছে। দীর্ঘশ্বাসের উত্তাপে বোধহয়। ভেবে রবিউল খন্দকার আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলা শুকিয়ে এসেছে। পানি খাওয়া প্রয়োজন। কাউকে ডেকে পানি চাইবেন কী? তিনি ডাকতে চাইলেন। ভারী, নির্জীব ঠোঁটদুটি নড়লো। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হলো। শুনতে বড়োই বি’চ্ছিরি লাগল নিজের কানে। রবিউল খন্দকার চমকে চুপ হয়ে যান সঙ্গে সঙ্গে। ভুলে যান তিনি স্বাভাবিক গলায় কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। কিছু বলতে গেলে শব্দগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে বিদঘুটে সব বাক্যে রূপান্তর হচ্ছে। কোথায় সেই দরাজ স্বর? গুরুগম্ভীর শব্দগুচ্ছের আভিজাত্য? দো’র্দ’ণ্ডপ্র’তাপশালী চালচলন? নেই কিচ্ছু নেই। তিনি শূন্য, নিষ্ফল, অর্থব এক ব্যক্তি। ওনার মুখ একপাশে বেঁকে গিয়েছে। জিভ নাড়াতেও ভীষণ কষ্ট হয়। রবিউল খন্দকার নিজেকে আয়নায় দেখেননি অবশ্য। নিশ্চয়ই বি’কৃতভাষ্যের মতো মুখটাও বি’কৃত দেখায়। তিনি আজকাল খুব বেশি ভাবতেও পারেন না। মস্তিষ্কে চাপ পড়ে, য’ন্ত্রণা হয়। সেই য’ন্ত্রণা মুখ ফুটে বলা যায় না। ওনার দিশেহারা দৃষ্টি দেয়ালে দেয়ালে দাপিয়ে বেড়ায়। খুঁজে চলেন সেই চিরচেনা নিজেকে, কিন্তু খুঁজে পান একরাশ অন্ধকার। কেউ ওনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছমছমে, স্তব্ধতায় নিমজ্জিত এক গহীন বনে। যেখানে তিনি অসহায়, ভীষণ অসহায়!

ক্যাচক্যাচ শব্দ করে কাঠের ভারী দরজাটা খুলে গেল। নূপুরের অতি ক্ষীণ ছন্দ মাড়িয়ে একজোড়া পা এগিয়ে আসছে। রবিউল খন্দকার চোখ বুজেই টের পেলেন কার আগমণ ঘটেছে। জানালা খোলার শব্দ হলো। ঘর ভেসে গেল আলোয়। একটা হাত ওনার কপাল স্পর্শ করল।
“মামা?”

রবিউল খন্দকার চোখ মেলে তাকান। একটি অসিত, সরল, ঘর্মাক্ত মুখশ্রী ভেসে ওঠে চোখের তারায়। বিক্ষি’প্ত মন স্থির হলো। পালি হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল,
“এই ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস ঢোকে না মামা। এনাম মামাকে বলে আপনার ঘরটা দক্ষিণের বড়ো খোলামেলা ঘরটায় স্থানান্তর করব। তাহলে বিদ্যুৎ না থাকলেও গরম কম লাগবে।”

রবিউল খন্দকার চুপ করে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা এত সকালে ঘেমে-নেয়ে চুপসে আছে কেন? জুলেখা তাকে দিয়ে কাজ করায়? তেমন কিছু এখন অসম্ভব না। রবিউল খন্দকার অবাকও হবেন না। যেদিন তিনি স্ট্রো’ক করে অসুস্থ হলেন জুলেখা কান্নাকাটি করেছিল খুব। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর তিনি জুলেখার দৃষ্টিতে বদল দেখেছেন। ওই চোখে সর্বদা বশ্যতা, ভ’য়, ও শ’ঙ্কা দেখা যেত। কিন্তু এখন চোখজোড়া ভাটার মতো সর্বদা জ্ব’লতে থাকে। যেন সে বুঝে গিয়েছে আর ভয় নেই। রবিউল খন্দকার তার গায়ে হাত তুলতে পারবেন না। এই বয়সে এসে সংসার থেকে তাড়াতেও পারবেন না। সে এখন স্বাধীন। সেই স্বাধীনতার পূর্ণ প্রয়োগ জুলেখা করবে। জড়তা ভাঙতে শুরুটা পালির ওপরই করবে৷ রবিউল খন্দকার অসহায় বোধ করেন। ইদানীং একটা জিনিস খেয়াল করেছেন তিনি। জুলেখা ওনার সেবা-শুশ্রূষা করতে নিলে কেমন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়। মনে হয় এই কাজটুকু করে সে রবিউল খন্দকারের ওপর দয়া করছে। জুলেখার নিকট নিজেকে অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করতে ওনার হৃদয়ে তী’ক্ষ্ণ ব্য’থা হু’ল ফোটায়।

রবিউল খন্দকার আরো একটা বিষয় খেয়াল করেছেন। জুলেখা যখন ঘরে থাকে ওনার অস্বস্তি হয়। রাতে এক বিছানায় ঘুমাতে তীব্র ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি জুলেখা ওনাকে বালিশ চাপা দেবে। তিনি অসহায়ের মতো কা’ত’রাবেন, কেউ বাঁচাতে আসবে না। তিনি নিজেও না। একসময় নিস্তেজ হয়ে যাবেন। সেই নিথর দেহ দেখে জুলেখা বিজয়ের হাসি হাসবে। এত বড়ো একটা ধা’ক্কার পর রবিউল খন্দকারের মনে মৃ’ত্যু নিয়ে ভয় তো চেপেছেই। কিন্তু জুলেখার হাতে মৃ’ত্যু হওয়ার চেয়ে এমনি ম’রে গেলে আফসোস কম হবে।

রবিউল খন্দকারের বড্ড আফসোস হয়। সম্মুখে বসে থাকা শান্ত চোখের এই কৃষ্ণ মেয়েটির জীবনের কৃষ্ণ ছায়া কী মুছবে না? বিধাতা কী তাকে সেই সৌভাগ্যও দিলো না? এই মেয়েটির কাছে যে তিনি আজন্ম অপরাধী হয়ে রইলেন। করবীর কাছেও। অতীতের সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি করা হলো না?
ওনার ভাবনার মাঝে পালি এনামকে ডেকে আনল। এনাম রবিউল খন্দকারকে কোলে তুলে ঘাটে নিয়ে বসায়। ওনার বা-পাশ সম্পূর্ণ পক্ষাঘা’তগ্রস্ত হয়েছে। ডানপাশ আংশিক। ডান হাত খানিক নড়াচড়া করতে পারেন। তবে ডান পায়ে বিশেষ বল পান না। সম্পূর্ণই অচল। পালি মামার দাত মেজে দেয়। এনামের সাহায্য নিয়ে গোসল করায়। নিজের হাতে খায়িয়ে দেয়। আঁচলে মুখ মুছে দেয়। পরম মমতা নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। রবিউল খন্দকারের চোখ ভিজে যায়। বড়ো বেলায় তিনি একটা ছোট্টো মা পেয়েছেন। মা তার সন্তানকে যেমন যত্ন করে পালি ঠিক তাই করছে। রবিউল খন্দকারের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে। পারেন না। নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। বয়স, সম্পর্কের ধরন কিংবা গায়ের রঙে কখনো ভালোবাসা নামক অনুভূতির পরিমাপ হয় না। অনুভূতির পরিমাপ শুধুই অনুভূতি।

মেহেরুন বানুর শরীর ভেঙে পড়েছে। মানুষটা কেমন নরম হয়ে গিয়েছে। আগের মতো সব বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহ পান না। মতামত জাহির করেন না। কে কি করছে খেয়াল করেন না। দেহের চেয়েও দেহের খা’চায় ব’ন্দী মনটি যেন বার্ধক্যজনিত রো’গে আ’ক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে নিঃসাড় হয়ে পড়ছে। আকস্মিক ধা’ক্কাটি পুরো পরিবারকে নড়বড়ে করে দিয়েছে।

চিত্রা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। জুলেখা মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে আরো বেশি তৎপর হয়েছেন। বাপ বিছানায়, বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। হিমাদটার এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এমন অবস্থায় একটি বিবাহিত মেয়ে বাড়িতে থাকা আরো বেশি কষ্টের। সে যদি শ্বশুর বাড়ি ফিরে গিয়ে সুখে সংসার করে হয়তো তা দেখেই রবিউল খন্দকার মনে বল পাবেন। এসব কথা চিত্রার কানের কাছে বেজেই চলেছে। জুলেখার ভাবনা, চিত্রা নিজের সংসার বুঝে নিলে তিনি হিমাদের বিয়ের তোড়ে করবেন। এই দুঃসময়ে একটি শক্ত সহায়তার হাত পাশে থাকা দরকার। চেয়ারম্যান বাড়ির চেয়ে শক্ত কাউকে চোখে পড়ে না জুলেখার। টিয়া এ বাড়ির বউ হলে দুই পরিবারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। এতে লাভটা হিমাদেরই হবে।

এত লাভ-ক্ষতি বোঝে না চিত্রা। নিজের বি’ক্ষি’প্ত, ছ’ন্নছাড়া জীবন তার ওপর বাড়ির করুণ পরিস্থিতি। সবকিছু অসহ্য লাগে তার। চিত্রা নিজেকে পারলে এক প্রকার লুকিয়ে রাখে। বাড়িতে যে একটি বড়ো মেয়ে আছে তা দিনের বেলাতেও নজরে আসে না। একাকিত্ব এখন তাকে গ্রা’স করতে আরো বেশি আগ্রা’সী। চিত্রা অসহায় বোধ করে। অতৃপ্ত মন গু’মরে কাঁদে। কোথায় এ ছন্নছাড়া জীবনের সমাপ্তি? তার জীবনে কী আদৌ সুখ আছে?
____________

চৈত্র মাসের রঙিন সকাল। আম গাছের নতুন হওয়া লাল পাতা ছিড়ে, তা ভাজ করে দুই ঠোঁটের মাঝে রাখল পালি। এরপর জোরে একটা ফু দিলো। একটা বেসুরো পৎপৎ শব্দ করে পাতাটি মাঝখান দিয়ে ফেটে গেল। পালির মন সেই শব্দে খুশি হয়ে গেল। গাছে এবার জেকে মুকুল এসেছে। ছোটো ছোটো আম উঁকি দিচ্ছে তাদের থেকে। কাঁঠাল গাছে ছোটো ছোটো মুচি ধরেছে। ভর্তা করে খাওয়ার মতো সাইজ হয়েছে। পালি ধুয়ে আনা কাপড় দড়িতে মেলতে মেলতে গাছগুলোতে ভালোমতো চোখ বুলিয়ে নেয়। শরীরের অর্ধেকটা ভিজে গিয়েছে তার। পেলব হাত দুটির চামড়া কাপড় ধোয়ার ক্ষা’রে পাতলা হয়ে গেছে। কাপড় বয়ে আনা গামলাটি কোলে তুলে বাড়ির ভেতর ঢুকল।

মামার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেল হিমাদ এখন থেকে ধীরে ধীরে আব্বার সব দায়িত্ব নেওয়া শুরু করবে। প্রথমে রাইস মিল, এরপর হাটের খাজনাসহ ফসলি জমির বিষয়। আজই সে রাইসমিলে বসবে। হিমাদ বিশেষ কিছুই বলেনি, তবে মেনে নিয়েছে। গত একমাস ধরেই মনে মনে তৈরি হচ্ছিলো এমন কিছু শুনবে বলে সে। আব্বার আকস্মিক বিছানায় পড়া, পারিবারিক বি’প’র্যয়ে সে নিজেও বি’ধ্ব’স্ত হয়ে পড়েছিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে পালির সামনে পড়ল। পালি ভড়কে গিয়ে দু’পা পেছায়। হিমাদ নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে একপলক পালির মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নেয়। অর্ধেক ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির হাতে তখনো গামলাটি ধরে রাখা। হিমাদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পালি জিজ্ঞেস করল,
“কী?”
“শুনেছিস?”
“কোন বিষয়ে?”
“সংসারের হাল ধরছি।”

পালির মুখটা শুকিয়ে গেল। হিমাদ ততক্ষণে সামনে থেকে চলে গিয়েছে। সকালে পালি কিছু খেলো না। দুপুরে কিংবা বিকালেও না। মেহেরুন বানু চিন্তিত হলেন। অসুখ বাধালো নাকি মেয়েটা? এমনিতেই জুলেখার তীর্যক বান এড়াতে সে নিজ থেকেই কাজে হাত লাগায়। খিদেও বেড়েছে। অথচ আজ একবারও খেলো না?
পালি কিছু যে খেলো না তা নয়। ঘন্টায় ঘন্টায় পেট ভরে পানি খেয়েছে। এটা প্রকৃতির অফুরন্ত দেওয়া, কাজেই তাতে কারো একার অধিকার নেই। কিন্তু ভারী কিছু না খেয়ে যে টেকা যায় না! পেটের খিদেয় না টিকতে পেরে সে দুপুরের পর কাঁঠালের মুচি ভর্তা করে খেয়ে নিল। খালি পেটে তার প্রভাব হলো ভ’য়াবহ। পেট ব্যথায় বাকিটা বেলা সে বিছানায় পড়ে রইল। তবুও অন্ন গ্রহণ করল না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে কথা শুনে হিমাদ প্রথমে পাত্তা না দিলেও যখন পালিকে পেট চেপে কাঁদতে দেখল তখন কপালে একটি সরু রেখার উদয় হলো।

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪০]
প্রভা আফরিন
_

পালির ছিপছিপে দেহটি বিছানায় মিশে আছে। মুখে য’ন্ত্রণার ছাপ। মেহেরুন বানু পালির আকস্মিক খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারলেন না। উনার কেন জানি মনে হচ্ছে সে কারো প্ররোচিত শব্দবা’ণে ম’র্মাহ’ত হয়ে আহার বিমুখ হয়েছে। মেয়েটির আত্মসম্মানবোধ প্রবল, একেকবারে করবীর মতোই। তিনি চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,
“সইত্য কইরা ক দেহি, জুলেখা তোরে খাওন নিয়া কিছু কইছে? খোঁটা দিছে?”
পালি মৃদু মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“তইলে হুট কইরা খাওয়া বন্ধ করলি ক্যা? কেডা কী কইছে তোরে? কইছি না মাইনষের কথা কানে তুলবি না?”
“কেউ বলেনি।”
একটু থেমে আবার বলল,
“আমার আর পড়া হবে না, নানি? মামা কবে সুস্থ হবে?”
“মামার অসুখের লইগ্যা তোর পড়া আটকাইবো ক্যান?”
“খরচ তো মামা দিতো।”
“এহনো দিবো।”
পালি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বিড়বিড় করে বলে,
“হাল তো অন্যজনের হাতে উঠছে। যার কাছে আমি শুধুই বাড়তি বোঝা।”
সে কথা মেহেরুন বানু শুনলেন না। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,
“মনে শান্তি নাই, সংসারেও শান্তি নাই। অত পইড়া আর কি করবি? তোরে লইয়া এহন আমার টিক্কা থাহনই যু’দ্ধের সমান। শ’য়তান ব’ন্দী থুইলেও শ’য়তানই থাকে। ছাড়া পাইলে লীলাখেলা তো দেখাইবো-ই। এরচেয়ে ভালা একখান পাত্র পাইলে তোরে এহনই বিয়া দিয়া দিতাম।”
পালির ঠোঁট ভেঙে আসে। বলে,
“আমি পড়তে চাই নানি… উ! মাগো!”

পালি আর্তনাদ করে ওঠে। হিমাদকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে মেহেরুন বানু চিন্তিত গলায় বললেন,
“হিমাদ, এনামরে একবার ডাক্তার বাড়ি যাইতে ক ভাই।”
“কেন?”
“মাইয়াডা সকালে খালিপেটে এক গামলা কাপড় ধুইছে। হেরপরে সারাদিন কিচ্ছু মুহে দেয় নাই। দুপুরের পরে পেটে বেদনা শুরু হইছে। কী গোলমাল বাধাইলো বুঝতাছি না।”
“ডাক্তার অসুখ সারাতে পারে দাদি, ভঙ ধরা না।”

পালি সে কথা শুনে একেবারে নিরব হয়ে গেল। মুখশ্রী থমথমে করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। খোলা চুল একত্র করে, দুই হাতের সাহায্যে গোল গোল ঘুরিয়ে খোপা করে ঘাড়ে ফেলে দিলো। এরপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল হিমাদের সামনে দিয়ে। মেহেরুন বানু অসন্তোষের সঙ্গে বললেন,
“এডি কিরকম কথা হিমাদ? নিজের ক্ষতি করতে কেউ ভঙ ধরে? পালিরে তুই চিনোস না?”
হিমাদ পালির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“তুমি বুঝবে না দাদি।”
দাদিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হিমাদ চলে গেল।

পালি ছুটেছে টয়লেটে। দিনভর পানি খেয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় এ কাজটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে নিজের ওপর রীতিমতো বিরক্ত। একবার ভাবে কেন সেদিন ওই কথাটি বলতে গেল? বাড়ির লোক যেমনই হোক না খেয়ে তো থাকতে হতো না! আবার ভাবে, বেশ করেছে বলেছে। প্রাণ যায় যাক, আত্মসম্মান খোয়ানো যাবে না। নয়তো নিজের আত্মার কাছেই মুখ দেখানো যাবে না। সে টয়লেট থেকে বেরিয়ে আর ঘরে গেল না। দুর্বল পায়ে পুকুরঘাটে চলে গেল। মাগরিবের আযান হয়েছে সবে। অন্ধকার পুরোপুরি ঘিরে ধরেনি। পালি মাথায় কাপড় দিয়ে ঘাটের শেষ সিড়িতে নেমে দাঁড়ায়।

“সারাদিন খাসনি কেন?”
আচমকা একটি ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে পালি কেঁপে উঠল। পেছনে ফিরে দেখল হিমাদ ওপরের সিড়িতে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ সবসময়ের মতোই গম্ভীর। পালি একটু চুপ থেকে নিস্তরঙ্গ গলায় জবাব দিলো,
“জানোনা? ভঙ ধরে।”
“বে’য়া’দব হয়েছিস।”
“তুমিই বলেছিলে।”
“পেটে ব্যথা কী কারণে? নাকি সেটাও ভঙ?”
“আমার পুরো জীবনটাই ভঙ। এটাই বা বাদ যাবে কেন?”
“খুব কথা শিখেছিস।”
“ভুল তো বলিনি। জবানেও নিষেধাজ্ঞা দেবে?”

কথাটা বলে হিমাদের শক্ত চোয়ালে দৃষ্টি পড়তেই পালি মাথা নুইয়ে চুপ রইল। হিমাদ আটটি সিড়ি নেমে আসে। থামে পালির ওপরের সিড়িতে। কন্ঠস্বর আগের চেয়ে খানিক নিচু অথচ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে,
“ভাবখানা এই যে, তুই এখানে খুব কষ্টে আছিস? তোর ওপর অ’ত্যা’চার করা হচ্ছে? খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে তাই বোঝাতে চাইছিস?”
পালি নিরুত্তর। ঘাটের চারপাশ থেকে নাম না জানা পোকা-মাকড় শব্দমুখর হতে শুরু করেছে। ঝুমঝুম ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে ক্রমশ কালো হতে থাকা জলের ওপর। হিমাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
“এতই যখন কষ্টে আছিস, বিয়ে দিয়ে দেই? এ বাড়ি থেকে মুক্তি পাবি। শ্বশুরবাড়ি আরামে থাকবি।”

পালির শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কান্নাভেজা, কাঁপা স্বরে বলল,
“দিয়ে দাও। আমার চেয়ে বরং তোমরাই মুক্তি পাবে।”
“এই সুরত নিয়ে কে বিয়ে করবে তোকে? যৌতুক দিয়ে গছাতে হবে। জানিস কত খরচের?”
“তাহলে ডুবে ম’রি? সব জ্বা’লা জুড়াক।”

পালি তড়িৎ পুকুরমুখী হলো। তার মাথার আঁচল পড়ে গেছে। ঢিলে খোপা খুলে দীঘল চুল তার নিটোল দেহটিকে আড়াল করে নিয়েছে। হিমাদ খপ করে পালির বাহু টেনে ধরল। তার ঠোঁটে ঈষৎ কৌতুকের রেখা। বলল,
“সাঁতার জানা মানুষ ডোবে নাকি?”
“তাহলে দড়ি-কলসি আনো। হাত-পা বেধে দাও।” পালির কান্নার বেগ বাড়ে। সেই কান্নার কোনো শব্দ নেই। শুধু বাতাসের সঙ্গে নিঃশ্বাসের ধা’ক্কাটা কানে আসে।
“খিদেয় মাথা পাগল হয়েছে তোর।”
“তুমি খারাপ, খুব খারাপ। তোমার মাঝে একটুও মায়া নেই।”
“আমি তো তেমন কিছু বলিনি। সিদ্ধান্ত তুই একাই নিচ্ছিস প্রতিবার। খাওয়া নিয়েও কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সে সিদ্ধান্তও তোর একার।”
“চোরকে গৃহস্থের বাড়ি দেখিয়ে বলছো চুরি করতে বলিনি? আমি কি ছোটো বাচ্চা যে বুঝব না?”

হিমাদের ঠোঁটের কোণ আরেকটু প্রসারিত হয়েছে। সে নিজেকে সামলে নেয়। পালির চোখের কার্নিশে জলের ছাপ। ঘন, লম্বা পাপড়ি ভিজে একটি আরেকটির গায়ে লেপ্টে আছে। ওষ্ঠের ওপর এবং নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামের আবির্ভাব লক্ষণীয়। কান্নার ফলে সে নাক টানছে মৃদু। নাকের পাটা সংকুচিত হচ্ছে বারবার। এলোমেলো চুল তার ঘাড়-গলা সব ঢেকে দিয়েছে। হিমাদ পালির চোখের দিকে তাকায়। ঘন পল্লবের মাঝে অভিমানে ঠাসা একজোড়া দৃষ্টি প্রস্ফুটিত। ছলছল জলের মধ্যে ভেসে থাকা কালো মণিদ্বয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই প্রায়ান্ধকারে কিছু একটা হয়ে গেল। হিমাদ খাবি খাওয়া মাছের মতো সেই গহীন চোখে ডুবতে গিয়ে ভেসে উঠল। পালি ছোটো নেই, শব্দটা তখনই বোধহয় মনোযোগ পেল। সে সঙ্গে সঙ্গে বাহু ছেড়ে দিলো। পালি পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলাতে হিমাদের বাহু খা’মচে ধরে দু-হাতে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাস ফেলতেই হিমাদ চলে যাওয়ার আগে বলে গেল,
“অস্তিত্ব বিপন্ন হয় এমন কিছুর সঙ্গে রাগ দেখাতে নেই। তাতে নিজেরই ক্ষ’তি। আর নিজের ক্ষতি করে বোকারা, বুদ্ধিদীপ্তরা নয়।”

পালি খায়নি, রবিউল খন্দকার এ কথা জানলেন রাতের খাবারের সময়। তিনি পালিকে ডাকালেন। কারণ জানতে চাইলে পালি মৌন পন্থাই অবলম্বন করল। হিমাদের সঙ্গে তার খাওয়া নিয়ে কি কথা হয়েছে তা বলতে কেন জানি বাধল। শিকড়হীন মানুষের এমন কথা বলা যে কত বড়ো ভুল সে হারে হারে টের পেয়েছে আজ। রবিউল খন্দকার তাকে খাওয়াতে মিথ্যা জেদ ধরে বললেন, পালি না খেলে তিনিও খাবেন না। এ কথায় কাজ হলো। পালি খিদের যন্ত্রণা সইতে না পেরে মামার মন ভোলানো কথা অতি সহজে মেনে নিল। দুই থালা ভাত এক বসাতেই শেষ করল। হিমাদ তার খাওয়া দেখে ঠোঁট চেপে হাসে। সে হাসি নজরে পড়তেই পালির আবার কান্না পেল। নিচু গলায় বলল,
“আমার খরচের হিসেব লিখে রাখো। আমি রোজগার করে সব শোধ করে দেব।”
___________

সকালের রান্না চুলায় উঠেছে। চামেলি শুকনো খড়ি স্তুপ করে রাখল উনুনের একপাশে। সে অনেকক্ষণ যাবত উশখুশ করছে। কিছু বলতে চায়, সঙ্কোচে পারছে না। মেহেরুন বানু তার ভাব দেখেই তা ধরতে পারলেন। বললেন,
“কিছু কবি?”
“রাগ না করলে একখান কথা কইতাম চাচি।”
“রাগের কথা কইলে রাগ তো হইবোই।”
“আমি তো আপনেগো মন্দ চাই না।”
“তাইলে কইয়া ফালা।”
“গেরামে ভালা চিকিৎসা নাই। খন্দকার ভাইরে তো নিয়মিত ডাক্তার দেহান যায় না। দুইজন বড়ো ডাক্তার আইছে। দেহাইলে উপকার হইতো।”
“তো রাগের কি আছে? এনামরে দিয়া খবর পাডা।”
“ডাক্তার ক্যাডায় হুইন্যা লন।”
“ক্যাডা?”
“ঘোষপাড়ার।”
মেহেরুন বানুর কোচকানো কপালে তিনটে গভীর ভাজের সৃষ্টি হলো। ঘোষপাড়ায় বড়ো ডাক্তার! উনার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে চামেলি সঙ্কোচের সঙ্গে বলল,
“নিগম সেন আর সৌদামিনী গেরামে আইছে।” ধোঁয়ায় রান্নাঘর ভরে গিয়েছে। চামেলি উনুনে জ্বাল ঠেলে দিলো। মেহেরুন বানু থমথমে মুখে বসে রইলেন অনেকটা সময়। এরপর বললেন,
“রবিউলের শইল এহন অনেক ভালা। ওইরকম দরকার পরলে হিমাদ আছে, শহরে নিব।”

চামেলি আর কিছু বলল না। পালি নানির সুপারি কে’টে নিচ্ছিলো বাইরে বসে। ভেতরের কথা সবই তার কানে এসেছে। সে অবাক হলো। নিগম সেন বড়ো ডাক্তার! সে তো শুনেছিল মাস্টার!

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [৪১]
প্রভা আফরিন
_

বেলা দশটা। সকালের সূর্যটা এখন উত্তপ্ত হয়ে চৈত্র মাসের সার্থকতা ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত। এমন সময় পালি সকলের চোখ এড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বড়ো মাঠের পাশে নিলয় তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। দেখা মাত্রই হাত তুলে ইশারা করল। পালি দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার কাছে। নিলয় বলল,
“হঠাৎ এত জরুরী তলব?”
“দরকার আছে।”
“সেটাই তো জানতে চাইছি।”
পালি ওড়না দিয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছে বলল,
“আমারে ঘোষপাড়া নিয়ে যাবি।”
“কেন? সেখানে কী?”
“সেখানে নাকি বড়ো ডাক্তার এসেছে। নাম নিগম সেন। উনার সঙ্গে দেখা করতে যাব।”
“নিগম আঙ্কেলকে চিনি আমি। তুই অসুস্থ?”
পালি মাথা নাড়ল। সত্যি কথা বলতে গিয়ে সামলে নিল। সে নিজেই এখনো স্পষ্ট করে কিছু জানে না। বলল,
“মামার ব্যাপারে কথা বলব।”
“তো তুই যাবি কেন? বাড়িতে ডাকিয়ে নে।”
পালি এবার বিরক্ত হলো,
“তুই কি নিয়ে যাবি আমায়? নাকি একাই যাব?”
“আচ্ছা, আচ্ছা, নিয়ে যাব। শুধু এভাবে লুকিয়ে যাওয়ার কারণটা জানতে চাইছি।”
“পরে বলব।”

নিলয় আর কথা বাড়ালো না। দুজনে রওনা হলো ঘোষপাড়ার উদ্দেশ্যে। ঘোষপাড়া একই গ্রামের ছোট্টো একটি পাড়া। খুব দূরে নয়, হাটা পথ। পাড়ার শুরুতেই জমজমাট ছোটো একটি গলি পড়ে। বাজার নয় তবে তেমনই সব জিনিসপত্রে ঠাসা। তা পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই গৃহস্থালি বাড়িঘর।
এটুকু এসে পালি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। চলে তো এসেছে কিন্তু দেখা করে কি বলবে? অস্বস্তির মাঝেই বিশাল বট গাছের নিচে তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। গাছের গুড়িতে একজন অতিশয় সুদর্শন ব্যক্তি বসে আছে। পালির নজর আটকালো ব্যক্তিটির ওপর। নিলয় বলল,
“ইনিই নিগম সেন।”
নিগম সেন ততক্ষণে নিলয়কে দেখে বিস্তর এক হাসি দিয়ে বললেন,
“নিলয় যে, এখানে কি মনে করে?”
“আপনার কাছেই এসেছি।”
“তা দূরে কেন?”
পালি রীতিমতো চমকে গেল। লোকটি যেমন সুদর্শন, তেমনই মনোযোগ আকর্ষণ করা কণ্ঠস্বর। কথার আধুনিক টান, দেহের ভঙ্গিমা সব পালিকে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে দিলো। নিলয় পালির মুখের ভাব দেখেই সতর্ক করে বলল,
“বাবার বয়সী কিন্তু।”

পালি থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিল। নিলয়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সে ঠোঁট উলটে, নিষ্পাপ ভঙ্গিতে নিগম সেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিগম সেন বললেন,
“আমার কাছে হঠাৎ কী মনে করে?”
নিলয় বলল,
“আসলে আমি না।” পালিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আবার বলল, “ও আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”
নিগম সেন পালির দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“এটি কে হয় তোমার?”
“বান্ধবী।”
নিগম সেন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সে হাসিতে তারা দুজনই একটু অপ্রস্তুত হলো। বড়ো দুই ছেলে-মেয়ে বন্ধু শুনলেই লোকের মাঝে প্রথমেই যেমন ভাবনা আসে এখানেও বুঝি তেমনটাই হলো! পালির মন খারাপ হলো। লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্য সে একদমই অন্যরকম ভেবে বসেছিল। নিগম সেন নরম গলায় ডাকলেন,
“মিষ্টি মেয়ে, দূরে কেন? এদিকে এসো। আমার সঙ্গে কীসের দরকার তোমার?”
পালির উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি নিজেই আবার বললেন,
“ডাক্তার দেখাতে আসোনি তো? গ্রামে এসেই এক বিপদ হয়েছে। সবাই আমাদের সর্ব রোগের চিকিৎসক বানিয়ে রোগী দেখাতে আনছে। অথচ আমরা এসেছি ছুটি কাটাতে।”
“আমরা?” পালি এই প্রথম কিছু বলল।
“হ্যাঁ। আমি এবং আমার বান্ধবী সৌদামিনী। সে-ও এ পাড়ার মেয়ে।”

বান্ধবী শব্দটা টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন তিনি। বোঝাতে চাইলেন নিলয়ের একটু আগের বলা শব্দটা। এবার পালি স্মিত হাসি দিয়ে বলল,
“আমি ডাক্তার দেখাতে আসিনি। আপনাকে দেখতে এসেছি।”
“তাই!”
“হ্যাঁ। আপনার পরিবার আসেনি গ্রামে?”
“পরিবার! সংসার! সে তো মায়া। আমি নিজেকে মায়ায় বাধতে চাই না।”
নিগম সেনের কণ্ঠটা একটু উদাসী শোনায়। পালি একটু থমকালো বটে কিন্তু সে কথার অর্থ ভেবে সময় ক্ষেপণ করল না। মনের কথা না চেপে বলল,
“ভেবেছিলাম আপনি মধ্যবয়সী, নাকের ওপর চশমা, চুলে পাক ধরা কেউ হবেন। কিন্তু আপনাকে দেখে তত বয়সের মনে হচ্ছে না।”
নিগম সেন আবারো প্রশস্ত এক হাসি দিলেন। পেছনে ফিরে গলা উঁচিয়ে ডেকে বললেন,
“শুনে যাও সৌদামিনী, আমাকে তো উঠতে-বসতে বুড়ো বুড়ো করো। অথচ আমার বয়সটা এখনো তরুণে আটকে আছে। বাচ্চা মেয়েটাও তা বুঝেছে।”
বাড়ির দিক থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। নিগম সেন পালিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার পরিচয়টাই জানা হলো না।”
“আমি আম্রপালি।”
“চমৎকার নাম। কে রেখেছে?”
পালি গর্ব করে উত্তর দিলো,
“আমার মা।”
“বেশ। আমাকে দেখতে আসার বিশেষ কোনো কারণ? তরুণীরা আমাকে সাগ্রহে দেখতে চাওয়ার মতো সুদর্শন রয়েছি তবে!”

নিগম সেন প্রাণখোলা মানুষ, পালির তা বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু সে কেন এসেছে তার কি কারণ বলবে? লোকটি যে তার মায়ের শিক্ষক ছিল এটুকু তার কাছে জলের মতো স্বচ্ছ। কিন্তু এর বাইরের কোনো কিছুই সে নিশ্চিত জানে না। নিলয়কে পাশে নিয়ে নিজের সন্দেহের প্রকাশ ঘটানোও ঠিক নয়। লোকটি যে তার পরিচয় জানে না সেটুকুও নিশ্চিত। তাছাড়া তিনি ব্যাপারটা কীভাবে নেবে তাতেও অনেককিছু নির্ভর করে। পালি নিগম সেনের অভিব্যক্তি দেখার জন্যই ফট করে বলে ফেলল,
“আমার মামা অসুস্থ তো। ডাক্তারের নাম উঠতেই আপনার কথা শুনলাম। আপনি এতবছর গ্রামে আসেননি কেন?”
নিগম সেনের প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় লক্ষণীয় একটি পরিবর্তন এলো। এবারের হাসিটা ঠিক জমলো না। তিনি বট গাছের মগডালে দৃষ্টি স্থাপন করে বললেন,
“ভেবেছিলাম আর ফিরব না। নাড়ির টান বলেই বোধহয় অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। সেসব যাক। তোমার মামাটি কে?”
“রবিউল খন্দকার।” পালির তড়িৎ উত্তর। নিগম সেনের মুখের আদল বদলে গেল মুহূর্তেই। চোখে ভর করল অজানা এক উৎকণ্ঠা। তিনি বিড়বিড় করলেন, “রবিউল খন্দকার…মামা…খন্দকার বাড়ি…”
এরপর পালির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কিছু মনে কোরো না, তোমার মায়ের নামটা?”
পালি উনার প্রতিটি অভিব্যক্তি মুখস্থ করে নিচ্ছিলো যেন। স্পষ্ট ও ধীর স্বরে বলল,
“করবী।”

“র’ক্তকরবী…”
ফিসফিস করে নড়ে উঠল নিগম সেনের পাতলা ঠোঁটজোড়া। এরপর! প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। ছন্দপতন ঘটলো আলাপের মাঝে। নিগম সেন অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন সম্মুখের মেয়েটির নিখাদ, নিরুদ্বেগ চোখে। এমন সময় একটি আধুনিকা মধ্যবয়সী মহিলা বেরিয়ে এলো বাইরে। পরনে সালোয়ার-কামিজ। পালি তাকেও মনোযোগ দিয়ে দেখে নেয়। প্রথম দর্শনেই সুন্দরী বলার মতো। বয়স তার রূপের জৌলুশ চাপা দিতে পারেনি। পালি মনে মনে মাথা ঝাকায়, উহু, তার মায়ের মতো সুন্দরী নয়। সৌদামিনী তাদের দেখে বললেন,
“তোমরা?”
নিগম সেন রুদ্ধ কণ্ঠের দ্বার ভেঙে গাঢ় স্বরে বললেন,
“করবীর মেয়ে।”
সৌদামিনীর অবাক-বিস্ময় দৃষ্টির সামনে পালির আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না।

সে বাড়ির পথে রওনা দিতেই খেয়াল হলো আকাশে মেঘ করেছে। কালো মেঘ উড়াউড়ি করছে। শীতল হাওয়া সন্তর্পণে ধেয়ে আসছে। কাজেই বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো যায় না। পালি চিন্তিত অন্য বিষয়ে। বাড়িতে গিয়ে এখন কি জবাব দেবে সেটাই ভাবনার বিষয়। তবে আর কোনো লুকোছাপা সে করবে না, করতে দেবেও না। পালি যে কিছুই বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা তেমনও নয়। অনুমান করতে পারে কেবল। কিন্তু এবার অনুমান নয়, স্পষ্ট জানা চাই। নিলয় তার সঙ্গে পা মিলিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা কি হলো বলতো? তোর পরিচয় জেনে সবার মুখের রেখা বদলে গেল কেন? কি বাধিয়েছিস?”
পালি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ে।
“উনি আমার মায়ের শিক্ষক ছিল। তাই আমার পরিচয় পেয়ে বোধহয় অবাক হলো।”
“দেখা করতে যাওয়ার কারণটাই তো বুঝলাম না।”
“ওই যে বললাম, মায়ের শিক্ষক। তাই দেখতে চাইছিলাম লোকটা কেমন।”
নিলয়ের সে কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না। সে টি’প্পনী কে’টে বলল,
“বাবার বয়সী কিন্তু।”

পালি কটমট করে তাকায়। দাতে দাত ঘষে নিলয়ের বাহুতে থা’প্পড় দিতে হাত বাড়াতেই সে থেমে গেল। হিমাদ সাইকেল চালিয়ে এদিকেই আসছে। পালি চুপসে গেল। এখনই দেখা হতে হলো! নিলয় হিমাদকে দেখে বলল,
“হিমাদ ভাইয়ের সাথে চলে যা। আমি মাঠে যাব। আজ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আছে আরেক পাড়ার সাথে।”
নিলয় চলে গেল। হিমাদের সাইকেলটা এসে থামল পালির থেকে হাত পাঁচেক দূরে। দৃষ্টি অত্যাধিক শান্ত।
“দুপুরবেলায় এখানে কী?”
পালি আমতা আমতা করে উত্তর দিলো,
“এই যে হাটছি।”
“আচ্ছা হাটতে থাক।”
হিমাদ চলে যেতে নিলে পালি অবাক হয়ে তড়িঘড়ি করে পেছন থেকে টেনে ধরল।
“আমাকেও নিয়ে যাও।”
“কেন? হাটবি না?”
“না, বৃষ্টি নামবে। ভিজে যাব তো।”

হিমাদ কিছু বলল না। চলেও গেল না। পালি তার সবসময়ের নির্বিকার মুখখানায় একবার নজর বুলিয়ে নেয়। হিমাদ ভাইটা কেমন জানি! সে ঠিক বুঝতে পারে না। আগে যাও একটু স্বাভাবিক ছিল, শহরে যাওয়ার পর আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। মনে হয় যেন দূর্ভেদ্য এক দেয়াল। আশেপাশের কোনোকিছুতেই তার বিশেষ আগ্রহ নেই। পালির মনে হয় এখন যদি সে বলে,
“হিমাদ ভাই, আজ তোমার বিয়ে।”
হিমাদ নির্লিপ্ত গলায় খানিক বিরক্তি ঢেলে বলবে,
“গায়ে হলুদের আয়োজন কর। বিয়ের আগে গায়ে হলুদ হতে হবে।”

হিমাদের চোখে এবার বিরক্তির আভাস পাওয়া গেল। খেয়াল করে পালি উঠে বসল সাইকেলে। একহাত সভয়ে হিমাদের পিঠে রাখল। অন্যহাতে সিট আঁকড়ে ধরেছে। হিমাদ প্যাডেল ঘোরালো। সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী গ’র্জে উঠল। বছরের প্রথম ঝড় এলো বুঝি! পালি একটু কুঁ’কড়ে উঠে হিমাদের পিঠে রাখা হাতখানা জোরালো করল। ব’জ্রপাতের শব্দে সে ভয় পায় না। কিন্তু গতবছর পাশের পাড়ার হারুন চাচা খড়খড়ে শুকনো দিনে মাছ ধরতে গিয়ে আকস্মিক ব’জ্রপাতের আলিঙ্গনে স্থানেই শক্ত হয়ে গেছিলো। পালি দেখেছিল লা’শটি। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে আতঙ্কিত গলায় বলল,
“হিমাদ ভাই, জলদি চালাও।”

তারা বাড়ি পৌঁছানোর একটু আগেই বৃষ্টি নামল ঝরঝর করে। বাতাস জোড়ালো হতে শুরু করেছে। প্রায় ভেজা অবস্থায় উঠানে পা দিয়ে বাধল আরেক বিপ’ত্তি। পালি পিচ্ছিল উঠানে ধপাস করে পড়ল। শুধু পা পিছলে নয়, একেবারে মুখ থুবড়ে। হিমাদের ঠোঁটে কোণে একটি চাপা হাসি উঁকি দিলো। পালির মুখটা কাঁদো কাঁদো, অসহায় দেখায়। হিমাদের হাসি দেখে ইচ্ছে করে লজ্জায় কাদাতেই মিশে যেতে। সেই লজ্জা আরেকদফা বৃদ্ধি পেল হিমাদ যখন তাকে হাত ধরে টেনে ওঠালো। ভেজাগায়ে কাদা মেখে সে ন্যুব্জ হয়ে গেল।

পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে জুলেখা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পালিকে কাদা মেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখ কুচকে বললেন,
“সারাবেলা কই আছিলি?”
পালি উত্তর দিলো না। হিমাদ রান্নাঘরের দেওয়ালের সাথে সাইকেল ঠেস দিতে গেছে। জুলেখা পালির সারাগায়ে চোখ বুলিয়ে চাপা গলায় বললেন,
“পুরুষ মাইনষের সামনে ভিজা গতরে খাড়ান লাগে না, এদ্দুর আক্কেল হয় নাই? হায়া-শরমের বালাই তো দেহি না।”
পালি সচকিত হলো। জুলেখা থেমে আবার বললেন,
“হিমাদের লগেপাছে এত ঘুরঘুর করবি না। সামনের তে যা।”

হঠাৎ পালির কান গরম হতে শুরু করেছে। সে তড়িঘড়ি করে বাড়িতে ঢুকতে চাইলে জুলেখা আবারো ধ’মক দিলেন,
“ক্যাদা লইয়া ঘরে ঢুকন যাইব না। গতর ধুইয়া ঢুকবি।”
পালি মামির সামনে আর দাঁড়ালো না। পিছলে পড়ার ভয় উপেক্ষা করে ছুটল পুকুড়পাড়ে। মামিটা বড্ড ঠোঁটকা’টা স্বভাবের। কখন কি বলে দেবে ঠিক নেই।

হিমাদ সাইকেল রেখে আসতে জুলেখা বললেন,
“পাও ধুইয়া ঘরে ঢুক।”
“কাপড় বের করে রাখো। আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজব।”
“বৎসরের পরথম বৃষ্টি, অসুখ বাধব।”
“কিচ্ছু হবে না। তুমি রুমে যাও।”

হিমাদ গেল বাড়ির পেছনে। সেখান থেকে ঘুরেফিরে পুকুরপাড়ে। পালি ঘাটের শেষ সিড়িতে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে আছে। মুষলধারে ঝরা শুভ্র বৃষ্টির ফোঁটা তার দেহ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সামনের বিস্তৃত টলটলে পানিতে। সবুজাভ পুকুরের ওপর বৃষ্টির নৃত্যরত ছন্দে কানে আরাম লাগছে। আশেপাশের আর কোনো শব্দই কানে লাগছে। থেকে থেকে খানিক বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কিন্তু পালির এখন আর ভয় লাগছে না। হিমাদ নিঃশব্দে এসে পালির ওপরের সিড়িতে বসল। পালি খেয়াল করেই সংকুচিত হয়ে গেল। কানের কাছে বাজতে লাগল মামির বলা শব্দটা। পুরুষ মানুষ শব্দটা একটু বেশিই ভারী লাগল তার কাছে। এরচেয়ে বড়ো ভাই বলতে পারত। তাহলে এই অস্বস্তিটা জেকে বসতে পারত না। পালি কোনো কথা বলল না। নড়েচড়ে চুলে পিঠ ঢেকে নিজেকে আড়াল করে বসে। তার অস্বস্তি হিমাদ ভাই টের পাক সে মোটেও চায় না।

হিমাদের বৃষ্টিভেজা দৃষ্টি পালির গালের ওপর। মেয়েটার কপাল ও কানের পাশটা লোমশ। তাতে খানিক কাদা লেগে আছে। বৃষ্টির ফোটা তা ধুয়ে নিতে পারেনি। হিমাদ হাত বাড়ালো। পালির গাল ছুঁইছুঁই হতেই তার হাত থেমে গেল। এরপর সজোরে ধাক্কা দিয়ে পালিকে পানিতে ফেলে দিলো। নিজেও ততক্ষণে ঝাপিয়ে পড়ে, সাঁতরে অন্যপ্রান্তে চলে গিয়েছে।

চলবে..