বিষাদময় সুর পর্ব-০১

0
1375

#বিষাদময়_সুর
#সূচনা_পর্ব
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি( লেখিকা)

”বাসর ঘরে আমার স্বামী আমার মুখের উপর ডিভোর্স পেপার ছুড়ে মেরে গটগট পা’য়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আমি শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। আমার চাহুনি ছিল নির্বাক হতভম্ব আশ্চর্য! কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছিলাম। মুখ দিয়ে টু শব্দ করার শক্তি পর্যন্ত পায় নি। সবটা কেমন দ্রুত ঘটে গেলো। যা আমার বুঝে উঠতে ঢের সময় লাগল। যখন আমি বুঝতে পারলাম তখন ছুটে রুম থেকে বের হয়ে আসি। কিন্তু আমি যাওয়ার আগেই আমার স্বামী বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ”

_____

বিরাট বড়ো আলিশান বাড়িটা নিশ্চুপ নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাত প্রায় বারোটা বাজে। আমি ফিরে আসি সেই রুমে। যে রুম ফুল দ্বারা সাজানো হয়েছে । আমরা যাকে বলি বাসর ঘর। বাসর ঘর নামটা মাথায় আসতেই তাচ্ছিল্যের হাসে রাহি। পুরো নাম রাফিয়া রাহি। সবাই রাহি বলেই ডাকে।

রাহি রুমের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে খাটে বসে। রাহি’র মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,কেন তার সদ্য বিয়ে করা স্বামী এমন করল। রাহি তার স্বামীর চোখে তার জন্য রাগ ছাড়া আর কিছু দেখেনি। তার দুটি চোখ ছিল লাল টকটকে। তাকে দেখে রাহি’র মনে হয়েছে কোনো বিষয় নিয়ে খুব রেগে আছে।

****

সারাটা রাত নির্ঘুম কাটে রাহি’র । দুচোখে ঘুম ধরা দেয় না। বারবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। দু-চোখের অশ্রুতে বালিশ ভিজিয়েছে। ঘরের বাইরে কাউকে তার কান্নার শব্দ বুঝতে দেইনি। আমি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। সহজে কাউকে কিছু বলতে পারি না। ছোটো বেলা থেকেই এমন।। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। অতি আদরে বড়ো হয়েছি। কখনো কোনো কষ্ট আমায় ছুতে পারেনি। ছোট বেলা থেকেই আমি বিদেশে থেকেছি। আমার জন্ম হওয়ার বছর পাচেক পরই আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে ভিনদেশে পাড়ি জমায়। বিদেশের কালচারে বেড়ে উঠেছি আমি। নিজের দেশের কালচারের সাথে খুব একটা মানানসই না আমি। তবুও আমি চেষ্টা করি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে। সবসময় নিজের মর্জি মতো চলেছি। আমার বাবা মা’ও কখনো বাধা দেয় নি আমাকে। চাওয়ার আগেই সব পেয়ে গেছি। কিন্তু কোথা থেকে হুট করে আমার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। দেশে এসেছি মাস দুই হয়েছে। এর মধ্যে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার সুখময় জীবনে নেমে আসে আরেকটা মানুষের জীবন। যার সাথে আমাকে সারাজীবনের মতো বেঁধে দেওয়া হয়।

আসলে একটা কথা সত্য, ভাগ্য সবসময় সহয় থাকে না। যদি থাকত তাহলে বাসর রাতের মতো এমন একটা রাতে আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স পেপার ছুড়ে মারত না। প্রতিটা মেয়ের এই রাত নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এক নিমিষেই সব তছনছ হয়ে গেছে রাহি’র। মুহূর্তেই মনে হয় তার জীবনে বিষাদের ছোঁয়া লেগেছে।

আমার স্বামী সাফওয়ান চৌধুরী জারির। আমি শুধু তার নামটায় জানি। বাবা-র মুখে শুনেছি বাবা’র কোন বন্ধুর ছেলের সাথে নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে । এর বেশি কিছু আমি জানি না। এত তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা কোনো টায় ছিল না। বাবা মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হতে হয়েছে আমাকে। তাদের মুখের উপর না করার সাহস আমার ছিল না। তাদের এত এত ভালোবাসার মূল্য তো আমাকে দিতেই হতো কিন্তু আমার সাথে যে এমন কিছু ঘটবে কস্মিনকালেও ভাবিনি আমি, ভাবতে ভাবতে ডুকরে কেঁদে ওঠে রাহি। চার দেয়ালের ভিতর তার কান্নার আওয়াজ বাড়ং বার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। নিজের ভাগ্য কে উপহাস করছে রাহি। কেন তার সাথে এমন টা হলো কেন কেন? কোনো কেন’র জবাব নেয় তার কাছে।

********

রাত বারো টা। একটা ক্লাবে কতগুলো ছেলে মেয়ে গানের তালে তালে হেলছে দুলছে নাচছে। তাদের প্রত্যকের হাতে ড্রিংকসের গ্লাস । কারোর কোনো হুশ নেই। যে যার মতো মাছতি করতে ব্যস্ত। ছেলেমেয়ে গুলো একে অপরের উপর ঢলে পড়ছে।

———-
একটা ছেলে হাওয়া চটে ক্লাবে ঢুকে পরে। এসে সোজা চলে যায় রিসিপশনের ওখানে। সেখান থেকে অনেক গুলো মদের বোতলের অর্ডার দেয়। তারপর একটা টেবিলে গিয়ে বসে পরে। কিছুক্ষণ পর একজন ছেলে এসে ছেলে টাকে তার অর্ডার করা বোতল গুলো দিয়ে যায়। সেখান থেকে একটা বোতল নিয়ে তার ছিপ খুলে মুখে পুরে নেয়। এভাবে একের পর এক মদের বোতল শেষ করতে থাকে। দেখতে দেখতে পাঁচটা মদের বোতল শেষ করে ফেলে ছেলেটা । ক্লাবে থাকা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যায় ছেলেটার মদ খাওয়া দেখে । অনেক বেশি মদ খাওয়ায় নেশা হয়ে যায় জারিরের। হ্যাঁ ছেলেটা সাফওয়ান চৌধুরী জারির। জারির টেবিল থেকে উঠে নেশার ঘোরে মাতাল অবস্থায় সেখানে থাকা মেয়েদের সাথে ডান্স করে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে জারির ।

______________

সকাল নয়টায় ঘুম ভাঙে রাহি’র। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের সময় চোখ দুটো টা লেগে আসছিল রাহির। কখন যে ঘুমিয়ে পরছে সেটা বুঝতে পারে নি। সহসা তার কাল রাতের কথা মনে পরে যায়। চোখ মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। চোখ মুখ অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে। তাদের ব্যপারে বাড়ির সবাই জেনে যায়নি তো? আর জেনে গেলে কি হবে? সবাই কে কি বলবে? দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায়। এত বেলা হয়ে গেছে সেটা সে টেরই পায়নি। দ্রুত ফ্লোর থেকে উঠে পরে। ঠান্ডায় রাতে ফ্লোরেই ঘুমিয়েছিল। কাল রাতে খাবার না খাওয়ায় খিদেতে পেট ছো ছো করছে রাহির। রাহি রুমটা এক নজরে ঘুরে দেখে। সব কিছু খুব পরিপার্টি দেখে বুঝতে পারে জারির খুব গোছালো স্বভাবের ছেলে। রাহি সময় নষ্ট না করে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। ফ্রেশ হয়ে একটা লাল রঙের সুতি শাড়ি পরে নিচে নামে। নিচে নামার সময় ড্রয়িংরুমে থাকা সকল কে গম্ভীর দেখে আঁতকে ওঠে রাহি। তার ধারণা টায় সত্যি হয়ে গেলো না তো?

রাহি ধীরে ধীরে পা ফেলে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ায়। নতুন বউ কে দেখে একজন মহিলা এগিয়ে আসে তার কাছে। রাহি ড্রয়িংরুমে থাকা সকল কে উদ্দেশ্য করে সালাম দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে সবাই সালামের উত্তর দেয়। রাহি আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় সোফায় বসে থাকা ষাটোর্ধ পুরুষ লোকটি বলেন,

” এখানে এসে বসো নাতবউ । লোকটির কথা শুনে রাহি মহিলার পানে তাকান। মহিলা ইশারায় বসতে বলে। রাহি ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে পরে।

ড্রয়িংরুমে উপস্থিত আছে চারজন পুরুষ, দু’জন মহিলা। রাহি ড্রয়িংরুম থেকে দেখতে পারে কিচেনে আরও দুজন মহিলা আছে। যারা রান্না করছেন। সোফায় বসে থাকা একজন ষাটোর্ধ পুরুষ ও পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব মহিলা। তাদের কে দেখে রাহি আন্দাজ করে ইনারা দুজন হয়তো জারিরের দাদা-দাদি।
তার পাশের লোকটাকে রাহি চেনে। ইনিই তার বাবা’র বন্ধু আসাদ চৌধুরী। যার ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“রাহি সোফায় গুটিশুটি হয়ে বসে। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আকুপাকু করছে। জারির কাল রাতে বাসায় ফিরছে তো? নাকি ফেরেনি? আর যদি জারির বাসায়ই থাকবে তাহলে তাকে দেখছে না কেন? কি কারণে কালকের রাতের মতো সুন্দর রাত টাকে খারাপ করে দিলো? যদি বিয়েতে অমতই থাকে তাহলে বিয়ে কেন করছে? তার সব প্রশ্নের জবাব সাফওয়ান চৌধুরী জারির কে দিতেই হবে। রাহি’র ভাবনার মাঝেই রাহির শশুর রাহিকে যা বলে তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শশুরের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে রাহি। মুহূর্তেই চোখে অশ্রু এসে ভিড় করে। রাহি বিস্ময়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সকলের দিকে তাকায়।

চলবে ইনশা আল্লাহ