#বিষাদময়_সুর
#পর্ব_২
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি(লেখিকা)
রাহি তাঁর’ শশুরের কথা শুনে থমকে যায়! মুহূর্তেই যেন তার দুনিয়া থমকে গেছে! কথা টা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রাহি। রাহি’র দুচোখে অশ্রু এসে ভড় করে। যেকোনো সময় তা গড়িয়ে পড়তে পারে। রাহি বিস্মিত অশ্রুসিক্ত নয়নে সকলের পানে তাকায়। ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলেই রাহি’র দিকে করুন চোখে তাকায়। আসাদ চৌধুরী বললেন,
” রাহি মামনি জারির দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বিশ্বাস করো মামনি আমরা এ ব্যাপারে কিছু জানি না। কি থেকে যে কি হয়ে গেলো? আসাদ চৌধুরী’র কথা শুনে ডুকরে কেঁদে ওঠে রাহি। রাহি’র কান্না’র শব্দ পেয়ে তিনি ফের বললেন,
” রাহি মামনি, তুমি প্লিজ কান্না থামাও? প্লিজ তুমি ভেঙে পড়ো না। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি , সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাহি এতক্ষণ কিছু না বললেও এবার মুখ খোলে, কাপাকাপা কন্ঠে বলল, কি ঠিক হবে আঙ্কেল? কিচ্ছু ঠিক হবে না। যা ঠিক হওয়ার না তা কখনো হবে না। দয়া করে আপনারা আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দেবেন না বলে থেমে, দম নিয়ে ফের বলল,
” আমি আজই নিজের বাড়ি বাবা’ মা’র কাছে ফিরে যাব।
রাহি’র কথা শুনে জারিরের দাদি সুফিয়া বেগম বলেন, সেকি কথা নাতবউ। বিয়ের পরে মেয়েদের স্বামী’র বাড়িই সব। এমন কথা মুখে আনতে নেই বু।
রাহি তাচ্ছিল্যের হেসে বলে,
” আমি জানি দাদিমা, বিয়ের পর প্রতিটা মেয়েরই তার স্বামী’র বাড়িই সব হয়। আর যেখানে আমার স্বামী’ই নেই সেখানে থাকাটা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি এখানে কোন পরিচয়ে থাকবো বলতে পারেন?
রাহি’র কথা শুনে উপস্থিত সকলেই চুপ হয়ে যায়। কারণ রাহি ভূল কিছু বলেনি। যা বলেছে সবটাই বাস্তব।
রাহি চুপচাপ সোফা থেকে উঠে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। তাকে কাল যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেই রুমের দিকে অগ্রসর হয়। রাহি’র যাওয়ার পানে সকলেই তাকিয়ে থাকে। তাদের বলার মতো ভাষা নেই। আসাদ চৌধুরী নির্বাক হয়ে রাহি’র দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি যে বড্ড ভয় পাচ্ছেন। তাদের এতদিনের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে না তো। সামান্য একটা ভুল সব কিছু শেষ করে দেবে না তো? অতিরিক্ত টেনশনের কারণে তার বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তিনি বুকে হাত দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে, রা-হি মা-মনি কে আট-কাও। অতঃপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়েন। আসাদ চৌধুরীর স্ত্রী হালিমা বেগম স্বামী কে লুটিয়ে পড়তে দেখে চিৎকার করে বলেন,
” আম্মা আপনার ছেলে। আসাদ চৌধুরীর পাশেই তার ভাই আলতাফ চৌধুরী ছিলেন। বড়ো ভাবির কথা শুনে দ্রুত ভাইকে ধরেন। ড্রয়িংরুমের সবাই হতবাক হয়ে যায়। সবাই ছোটাছুটি করে পাঁজা কোলে তুলে আসাদ চৌধুরী কে রুমে নিয়ে যান। রুমে এনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। হালিমা বেগম স্বামী র পাশে বসে অনবরত কেঁদেই চলেছেন। চৌধুরী বাড়ির সকলেই জারিরের উপর খুব রেগে আছেন।
জারিরের দাদু আইয়ূব চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে দুশ্চিন্তায় বড়ো ছেলের কক্ষে বসে আছেন। বুড়ো বয়সে তিনি আর এত প্রেসার নিতে পারছেন না। কি করবেন না করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে গেছে।
_________
রাহি বিছানায় বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। বাবা মা য়ের সুখের জন্য নিজের অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও বিয়ে নামক শব্দের মতো একটা সিরিয়াস বিষয়ে চুপচাপ মেনে নিয়েছে। বাবা মা জানলে কি করবে ভেবেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে রাহি’র। নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিয়েটা সজ্ঞানে করেছে রাহি। বাবা মায়ের র মুখে দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে স্বামী’র বাড়ি এসেছে। বিয়ে নিয়ে সবারই স্বপ্ন থাকে,আর সেই স্বপ্ন গুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে রাহি’র। রাহি ভাবে তাদের বাসার সবাই যখন সত্যি টা জানবে তখন কি নিজেদের ঠিক রাখতে পারবে?
**
সব কিছু আজ ঠিক থাকলে, নিয়ম মতো আজ তাদের বউভাত হতো। অথচ তাকে বিয়ের পরের দিন ই বাবা’র বাড়ি ফিরে যেতে হবে। রাহি’র ভাবনার ছেদ পড়ে সাত বছরের বাচ্চার কথায়, বাচ্চাটা বলছে,
” বউমণি, কাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তোমাকে যেতে বলছে আম্মু।
রাহি ছেলেটার কথা শুনে অনুমান করতে পারে, ছেলেটা হয়তো জারিরের চাচাতো ভাই। আর অসুস্থই বা কে হয়েছে আঙ্কেল ভাবতেই চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করে,
” বাবু কাকায় মানে তোমার জারির ভাউয়ার বাবা’র কথা বলছো তুমি? ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে রুম থেকে দৌড়ে চলে যায়। ছেলেটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে তার কিছুক্ষণ পরই রুম থেকে বের হয় রাহি। এ বাড়ির কিছুই রাহি’র চেনা নয়, সব কিছু অচেনা। রাহি দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে। তারপর খুঁজে খুজে নির্ধারিত রুম টা খুঁজে বের করে। রাহি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ভিতরে যাবে কি যাবে না ভাবছে। রাহি কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আসাদ চৌধুরী বলেন,
” রাহি মামনি তুমি ওখানে কেন, এদিকে আসো?
আসাদ চৌধুরীর কথায় রাহি রুমে ঢোকে। রাহি আসায় আসাদ চৌধুরী বিছানা থেকে উঠে বসেন। তাকে উঠতে দেখে রাহি দ্রুততার সহিত বলল,
” আঙ্কেল, আপনি উঠছেন কেন শুয়ে থাকুন?
রাহির কথায় আসাদ চৌধুরী মৃদু হেসে বলে, মামণি আমার পাশে একটু বসবে তুমি? শশুরের কথায় সংকোচ বোধ করে রাহি। বিষয়টা বুঝতে পেরে আসাদ চৌধুরী বলেন,
” মামণি তুমি চেয়ারটা টেনে এনে বসো।
রাহি তাই করল। চেয়ারটা কাছে এগিয়ে নিয়ে বসে। রাহি নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়। তারপর রাহি জিজ্ঞেস করে,
” আঙ্কেল, শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন,এখন কেমন লাগছে আপনার?
রাহি’র কথায় তিনি জবাব দেন,
” মোটামুটি আলহামদুলিল্লাহ মামণি। কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,
” মামণি একটা অনুরোধ রাখবে আমার? করুণ স্বরে
” এভাবে বলছেন কেন আঙ্কেল, কি বলেন।
” তুমি থেকে যাও না এখানে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি নিজে সব ঠিক করব।
রাহি গম্ভীর কণ্ঠে সুধালো,
” এখানে কোন পরিচয়ে থাকব আঙ্কেল?
” কেন জারিরের বউয়ের পরিচয়ে অবাক হয়ে।
” তিনি তো আমাকে বউ হিসেবে মানেন না আঙ্কেল।
” এসবতুমি কি বলছো?
” যা সত্যি তাই বলছি আঙ্কেল। আপনারা হয়তো জানেন না, আপনার ছেলে কাল রাতে আমাকে ডিভোর্স পেপার দিয়ে বলছে তার ডিভোর্স চাই। তাহলে এখানে থাকাটা কি আমার জন্য ঠিক হবে বলুন?
রাহি’র কথা’য় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন আসাদ চৌধুরী। তার ছেলে যে এটা করতে পারে তিনি ভাবতে পারছেন না। দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। তবে নিজেকে সামলে রাহি’র হাত ধরে বলল,
” মামণি তুমি আজকে অন্তত চলে যেও না। আজ যদি তুমি চলে যাও তাহলে অনেক কথা উঠবে, তোমাকে কথা শুনাবে। তার থেকে ভালো আজ থেকে কাল যেও তবুও আজ যেও না। আল্লাহ চাইলে কোনো শক্তিই তোমাদের আলাদা করতে পারবে না এটা আমার বিশ্বাস।
রাহি অনেক ভেবে চিন্তে ডিসিশন নেয় আজ থেকে যাবে। তারপর কাল বাসায় ফিরে সোজা দেশ ছাড়বে। এখানে আর থাকবে না। রাহি থাকবে বলে রুম থেকে বের হয়।
___
সারাটা দিন বিষন্নতায় কাটে রাহি’র। দুবার বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে তবে এখনো কিছু বলেনি। কিভাবে বলবে সেটাই বুজে উঠতে পারছে না। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা পেড়িয়ে গভীর রাত। রাহি’র কাছে রাতটা মনে হচ্ছে শেষ হচ্ছে না। চারদিক দিকে তাকে যন্ত্রণায় চেপে ধরছে। এভাবে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সেটা টের পায় না।
———-
এলামের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাহি’র। আড়মোড়া ছেড়ে উঠে কান খাড়া করতেই বাইরে থেকে জোরে জোরে কথার আওয়াজ পায়। তখন আবার দরজায় খটখট শব্দ হয়, সেটা শুনে রাহি বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে সামনের মানুষ কে দেখে আঁতকে ওঠে রাহি!
চলবে ইনশা আল্লাহ