#বিষাদময়_সুর
#পর্ব_৫
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি (লেখিকা)
বিয়ের তিনদিন পর রাহি বাবা-র বাড়ি এসেছে। এটা বিয়ের একটা রীতি। বিয়ের তিনদিন পর বা পাঁচদিন পর নতুন বর কে নিয়ে বাবা’র বাসায় আসা। রাহি ঠোঁটের কোণে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। যে কেউ দেখলেই বলবে রাহি খুব খুশি। রাহি’র সাথে এসেছে জারির, আর জারিরের চাচাতো বোন রিপ্তি। রাহি রা আসছে মিনিট বিশেক হবে। বাবা’র বাড়ি আসার পর এখনো নিজের রুমে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি রাহি’র। এখনো পর্যন্ত ফ্রেশ হয়নি। রাহি’র ছোটো চাচা’র ছেলে রাফিকে বলছে জারির কে নিয়ে তাঁর রুমে যেতে। রাফি বড়ো আপুর কথা শুনে জিজুকে নিয়ে আপুর রুমে পৌঁছে দিছে।
রাহির বাবা রাশেদুল ইসলাম, মা শায়েদা খাতুন। মেয়ে আর মেয়ের জামাই নিয়ে মেতে উঠেছে। রাহি সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে অবশেষে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
________
রাহি নিজের চিরচেনা রুমে প্রবেশ করে। রুমে ঢুকে দেখে জারির মাত্র হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হয়েছে। রাহি ড্রয়ার থেকে সুতি থ্রি পিস নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায়। শশুর বাড়ি থেকে যে শাড়ি পরে আসছিল সেটা চেঞ্জ করে নিজের একটা সুতি থ্রি পিস পরে। তারপর হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। রাহি কে বের হতে দেখে জারির এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
” এখন কি করতে হবে?
জারিরের কথায় টাস্কি খেয়ে যায় রাহি। আশ্চর্য হয়ে জারিরের কথায় জবাব দেয়,
” মানেহহ! এখন কি করতে হবে,কথার মানে কি?
” সরি সরি,আমি সে ভাবে বলিনি। আই মিন এখন কি করবা তুমি।
” আম্মু বার বার নিচে যেতে বলেছে। তাই এখন আমি আর আপনি দু’জনে নিচে যাব বলে শাড়ি ভাজ করে ড্রয়ারের ভিতর গুছিয়ে রাখে রাহি। কিছুক্ষণ পর রাহি’র খালাতো বোন রিতু আসে ডাকতে। নিচ থেকে ডাকতে ডাকতে আসছে,
” রাহিপু তাড়াতাড়ি আসো, আন্টি তোমাদের নিচে ডাকছে। জিজু কে সাথে এনো। আরও নানান কথা বলতে বলতে রুমের সামনে চলে আসে। রিতু দরজা নক করে বলল,
” আসব?
রাহি বলল, হ্যা, আয়। রিতু রুমে ঢুকে জারিরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
” কাহিনী কি জিজু। আসার পর থেকে দেখছি, আপনি আপুর পিছনই ছাড়ছেন না উহু।
রিতুর কথায় রাহি জারির দু’জন ই লজ্জা পায়। রাহি ভাবেনি রিতু এমন বেফাস কথা বলে ফেলবে। জারির আমতা আমতা করে। রাহি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগি গলায় রিতুকে বলে,
” রিতু স্টপ ইট। আর একটাও বেফাস কথা বলবি না। ছোটো ছোটোর মতো থাক। উনি সম্পর্কে তোর জিজু হয়।
রিতু মন খারাপ করে বলে, সবাই ঠিকই বলে, বিয়ের পর সবাই পাল্টে যায়। তুমিও পাল্টে গেছো আপু। তুমিও অন্য সবার মতো হয়ে গেছো। আর জিজু অ্যাই এম সরি, আমি মজা করে বলছিলাম বলে দ্রুত পায়ে রুম থেকে চলে যায়। রিতুর যাওয়ার পানে অনেক নয়নে তাকিয়ে থাকে রাহি। রিতু তাকে কি বলে গেলো, সে পাল্টে গেছে। কিন্তু কেন? সে তো খারাপ কিছু বলেনি। রাহি’র পিছন থেকে জারির সামনে এসে বলে,
” তুমি ওভাবে না বললেও পারতে। ও তো আর আমাদের সম্পর্কের কথা জানে না,সেজন্য মজা করে বলে ফেলছে। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। জারিরের কথা শুনে রাহি জারিরের দিকে তাকায়। জারির ইশারায় নিচে যাওয়ার কথা বলে। রাহি’র মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। সে একটু রুড বিহেভ করে ফেলছে তার বোনের সাথে। কিন্তু সেই বা কি করবে রিতু তো আর জানে তাদের সম্পর্কে। যেখানে সম্পর্কই থাকবে না সেখানে দু’দিনের জন্য কেন মায়া বাড়াবে। মনে মনে ভাবে রাহি। তারপর জারির কে সাথে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে দেখে সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
সন্ধ্যার পরে রাহি রা আসছে। এখন রাত আটটা বাজে। রাহি এসে ডাইনিং টেবিলে বসে আর জারির কেও বসতে বলে। জারির ভদ্র ছেলের মতো চেয়ারে বসে পরে। খাবার টেবিলে আছে রাহি’র দাদু জামাল সাহেব, রাহির দাদি নেই। রাহি’র কাকা কামাল সাহেব। রাহি’র মা আর কাকি মিলে খাবার সার্ভ করবে। রাহি’র খালামণি আসছিল তবে সে চলে গেছে, শুধু থেকে গেছে রিতু। ডাইনিং টেবিলে রিতু কে দেখতে না পেয়ে রাহি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” আম্মু রিতু কে দেখছি না, রিতু কোথায়?
রিপ্না বেগম এতক্ষণ খেয়াল না করলেও রাহি’র কথা শুনে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আসলেই রিতু নেই। তিনি বললেন,
” রিতু তো তোদের ডাকতে গেছে আর ফিরে আসেনি ।
রাহি কিছু না বলে টেবিল থেকে উঠে, রিতুকে খুজতে চলে যায়। রিপ্না বেগম জারির কে খাবার দিতে ব্যস্ত হ’য়ে পরে।
__________
রাহি বাসার ছাদে চলে যায়, গিয়ে দেখে রিতু চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। রাহি পিছন থেকে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রিতুকে। আচমকা এমন হওয়ায় ঘাবড়ে যায় রিতু। তুতলিয়ে বলে ওঠে,
” ক-কে?
রিতু ভয়ার্ত চেহারা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রাহি। রাহি’র হাসির শব্দ শুনে রিতু বুঝতে পারে কে। রিতু রাগি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” তুই এখানে কেন হ্যাঁ যা না তোর জামাইয়ের কাছে। এখানে কেন এসেছিস। জামাই কে নিয়ে থাক না বইন।
রাহি ভ্রু কুচকে চোখ ছোটো ছোটো করে রিতুর দিকে তাকায়। রাহি’র তাকানোর ফেস দেখে রিতু বলল,
” কি বলছি কানে যায় নি। আর এমন ডায়োর চোখের মতো তাকাই আছোস ক্যান উহু।
রাহি রিতুর চুলে টান মেরে বলল,
” কাহিনী কি হ্যাঁ, খাবার খাওয়ার জন্য ডেকে নিজে এখানে এসে দাড়ায় আছোস। আর মনটা এমন বাংলো প্যাচের মতো করে রাখছিস ক্যান। তোকে দেখতে পুরো হুতুম প্যাচার মতো লাগছে বলে হেঁসে ওঠে।
রাহি’র হাসি দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে রিতু। রাগেতে নিজের চুল খামচে ধরে। রাহি হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,
” রাগিস না বইন। আমি জাস্ট মজা করে বলছি। তুই জানিস আমার বোনটাকে কি সুন্দর লাগে।
” উহু, আমি সব জানি। তোর ঢং বাদ দে। কেন এসেছিস তাই বলে বিদায় হু।
” নিচে চল, সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
” আমাদের জন্য না বলে, বল তোর বর তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
মুহূর্তেই রাহি’র মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। রিতু বিষয় টা খেয়াল করে বলল,
” আপু কি হয়েছে তোর?
রাহি গম্ভীর কণ্ঠে সুধালো,
” রিতু।
” হ্যাঁ,
” তুই আমার থেকে বছর দুয়েক ছোটো। তবে আমাদের কেউ বড়ো ছোটো বলে না। আমরা সবসময় ফ্রেন্ডলি থেকেছে। এমন কোনো কথা নেই যা তুই জানিস না।
” এমন করে বলছিস কেন? ক্লিয়ারলি বল প্লিজ,৷ আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
” সব বলব, এখন নিচে চল সবাই অপেক্ষা করছে। বলে চলে যেতে গেলে রিতু হাত টেনে ধরে। রাহি পিছনে ফিরে বলে, কি হলো?
” সবাই অপেক্ষা করুক, কি হয়েছে আমাকে আগে বল। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।
রাহি ছাদে ঝোলানো দোলনায় বসে, রাহি’র পাশে রিতু ও বসে পরে। রিতু রাহি’র দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে। রাহি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
” আমাদের জীবন খুব অদ্ভুত! দেখ আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না তবুও ড্যাড আর মমের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছি। তাদেরকে খুশি করার জন্য মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছি। তবুও!
” তবুও কি?
” বাসর রাতে আমার মুখে উপর ডিভোর্স পেপার ছুড়ে মারে।
” হোয়াটটট? কি বলছিস?
” হ্যাঁ, জারির অন্য মেয়েকে ভালোবাসে। আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। জারিরের মনে অন্য নারীর বসবাস, সেখানে আমার কোনো ঠাই নেয়। তার ডিভোর্স চাই, আমি মেনে নিয়েছি তিনমাস হলে জারির কে ডিভোর্স দিয়ে লন্ডন ব্যাক করব।
” তোর মাথা ঠিক আছে আপু। এটা হতে পারে না। অসম্ভব! জিজু যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে তোকে কেন বিয়ে করল? কেন বিয়ের আগে তোকে বলেনি তুই জিজ্ঞেস করিসনি?
” জারির ফ্যামিলির কাউকে কিছু বলতে পারেনি।
” কেন পারেনি?
” জানি না আমি।
” শুনিস নি?
” ইচ্ছে হয়নি।
” তাহলে এখন কি করবি?
” ডিভোর্স দিয়ে চলে যাব।
” আঙ্কেল আন্টিদের কি বলবিনির?
” যাই হোক কিছু তো বলতে হবেই।
নিচে চল, বেশিক্ষণ থাকলে খারাপ দেখায়। এই তিনমাস সব মেনেই চলতে হবে। জারির নতুন পরিবেশে আনইজি ফিল করবে বলে ছাদ থেকে নেমে যায়।
রাহি’র যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিতু। বিড়বিড় করে বলে, তোর সাথেই এমনটা কেন হলো রাহিপু। তুই এটা ডিজার্ভ করিস না। তারপর রিতুও নিচে নেমে আসে।
জারির খাবার টেবিলে বসে চুপচাপ খাচ্ছে। রিপ্না বেগম তাকে একের পর এক দিয়েই যাচ্ছে। আর জারির না না করেই যাচ্ছে। তবুও রিপ্না বেগম শুনছেন না। জারির কে জামাই আদর করছে মন মতো।
রাহি ডাইনিং টেবিলে এসে জারিরের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে। তারপর মা কে থামিয়ে দিয়ে জারির কে ডাইনিং ছেড়ে যেতে সাহায্য করে। জারির যাওয়ার আগে রাহি’র দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অতঃপর রাহি’র রুমে চলে যায়।
রাহি’র খাওয়ার শেষ হলে রুমে আসে। তারপর ড্রয়ার থেকে নিজের একটা টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। ড্রেজ চেঞ্জ করে রুমে এসে দেখে জারির বিছানায় বসে ফোন টিপছে। রাহি আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে এক নজরে দেখে। তার পরনে কালো রঙের টিশার্ট। ফর্সা গায়ে খুব বেশি মানিয়েছে। চুল গুলো খুপা দিয়ে উঁচু করে বেঁধে নেয়।
আচমকা একটা মেয়েকে শার্ট প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় দেখে চমকে ওঠে জারির। মুখ ফসকে বলে ফেলে,
” কে তুমি?
রাহি পিছনে ফিরে বলে, আমি।
” ওহ, তুমি। কিন্তু এই পোশাকে, কোথাও যাচ্ছো নাকি?
” আব- না মানে কোথায় যাব। কোথাও যাচ্ছি না।
” সাবধানে থাকবেন। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন। কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না। আমি অন্য রুমেই থাকব।
” কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে।
” কেউ দেখার আগেই আমি রুমে হাজির হবো।
” আচ্ছা।
অতঃপর রাহি চলে যায়। জারির আগের মতো ফোন স্কল করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। ফোন স্কল করতে করতে চোখ আটকে যায় একটা পোস্টে। পোস্ট টা দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে জারিরের। পোস্টে লেখা আছে, রকস্টার হৃিদ চৌধুরী বাংলাদেশে এসেছে। আর আজ রাত বারোটায় তার প্রথম কন্সার্ট। কিন্তু এই মুহূর্তে জারির বাইরে যেতে পারবে না। কারণ এখন সে রাহিদের বাসায়। এত রাতে বাইরে গেলে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তার থেকে ভালো বাসায় থেকে লাইভে কন্সার্ট দেখবে। খুশিতে চোখ চিকচিক করে জারিরের। এটা ভেবে খুশি হয় যে রাহি রুমে নেয়। রুমে থাকলে কি ভাবতো?
চলবে ইনশা আল্লাহ