বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৩

0
37

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৩

আহমাদ নিশ্চুপ কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর বাবার দিকে তাকালো। সে কি বলবে, কি করবে কিছুই তার মাথায় এলো না। জাহিদ বা জাহিদের মা তাদের ব্যাপারে বাবা কখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। সবাই যেটুকু জানে সেও সেইটুকুই জানে। অবশ্য এই নিয়ে তারাও কখনো তেমন ভাবে মাথা ঘামায়নি।

আবসার দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বলল, — দুর্দশা তার পেছন কখনও ছাড়ে নি। আমার বন্ধুর বাসায় থাকলে কি হবে। টাকা পয়সা সব আমি বহন করলে কি হবে? সেখানেও সে লাঞ্চনার শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেত যখন তাকে তার রক্তের খোটা দেওয়া হতো। সব সহ্য করলেও এটা তার সহ্যের বাইরে ছিল। দু- চোখ যেখানে গেছে সেখানে চলে গেছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ পাওয়া যায়, তবে নিজ ইচ্ছায় হারানো মানুষ কখনও পাওয়া যায় না। তাই আমিও পাইনি। তবে আমি সারা জীবন নামাজে দু- হাত তুলে একজনের জন্যই দোয়া করেছি। সেটা হলো জাহিদ। আমি চেয়েছি সে যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। আল্লাহর রহমতে থাকুক। কিন্তু এই ছেলেটার ভাগ্য বরাবরই খারাপ। সুখ তার কাছে মরিচিকার মতো। হাত বাড়িয়ে ধরেতো সে, তবে ধরতেই ভেঙে গুড়িয়ে যায়। আমি তার মায়ের জন্য কিছু করতে পারিনি, জাহিদের জন্য কিছু করতে পারিনি । তবে এর মেয়ের জন্য চাই।

আমজাদ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। তার আব্বা নাতি কে বিয়ে করাতে চায় করাবে। এটা আর এমন কি? তবে এখন তার পছন্দ হলো না। সে এই জাহিদ নামের কাউকে চেনে না। চেনার কথাও না। তখন তার বয়স কম। তেমন কিছু মনে নেই। তবে এইটুকু বুঝলো, জলে ভাসা মানুষ। এরকম একটা মানুষের মেয়ে বাড়ির বউ হবে তার ভাবতে ভালো লাগলো না। সে একটু অসন্তোষ কন্ঠেই বলল — বেশ তো করবেন! তাকে আমরা নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো। সে হবে এই বাড়িরই মেয়ে। এই বাড়ির মেয়েরা আমাদের সয় সম্মত্তি থেকে যতটুকু পাবে, এই মেয়েও ঠিক ততটুকুই পাবে। পরে ভালো ঘর টর দেখে বিয়ে দিয়ে দিলেই হবে। নিজেদের ছেলের জন্য আনতে হবে কেন?

আজাদ ঠোঁট টিপে হাসলো। অবশ্য তার এই হাসি এবার কেউ খেয়ালও করল না। সবার নজর এখন আবসারের উপর।

আবসার আবারো বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! এই একটা দীর্ঘশ্বাসে কতটা কষ্ট মেশানো। সামনে বসা এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই বুঝলো। বুঝলো বলেই সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেল।

অনেক অনেক দিন পরে আবসারের কন্ঠ আদ্র হলো। আদ্র কন্ঠেই বলল, — এরকম একটা আশ্বাস দিয়েই আমি একজনকে এনেছিলাম। তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলাম, — আজ থেকে আমি তোমার ভাই। বড় ভাই! আমার কাছে আমার বোনেরা যে রকম, তুমিও সেই রকম। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি এই দায়িত্ব পালন করবো।

পারলাম কই! এই দুনিয়ায় শুধু জোর রক্তের সম্পর্কের। ভালোবাসার সম্পর্কের কোন দাম নেই। ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। দুনিয়া চাইলেই টেনে হিঁচড়ে আলাদা করতে পারে। তবে রক্তের সম্পর্কের পরে সবচেয়ে বেশি জোর আল্লাহর সাক্ষী রাখার সম্পর্ক। কবুলের সম্পর্ক। তাদের দায়িত্ব তো পালন করতে পারি নি। তাই এবার দায়িত্ব নিবো পুক্ত ভাবে। কেউ চাইলেও যাতে ছাড়াতে না পারে। তাই এই মেয়ের জন্য আমি অলি আবসার তার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনীদের কাছে দু- হাত পেতে ভিক্ষা চাইছি। আমার দু- হাত তোমরা খালি ফিরিয়ে দিয়ো না।

আহমাদ, আমজাদ বাবার এই রকম আকুতিতে দুজনেই কাঠ হয়ে গেল! বাড়ির বউরা মুখে আঁচল চাপলো। আজাদ এবার হাসলো না। এগিয়ে গিয়ে দাদার দু- হাত জাপটে ধরলো। ধরে বলল, — আপনি আদেশ করবেন ভিক্ষে না। আর আপনার আদেশ আমাদের সবার শিরোধার্য।

বাড়ির একটা মানুষও আর টু শব্দ করেনি। তাই পরেরদিন ভোরেই রওনা দেওয়া হলো। ঠিকানা শহরের। তাদের গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া একমাত্র সহজ মাধ্যম হলো ইঞ্জিন চালিত বোট। পাঁচ ছয় ঘন্টা মতো লাগে। আহমাদ বলেছিল, আজাদ খাইরুলের ভাইয়ের সাথে গিয়ে মেয়ে নিয়ে আসুক। পরে ধীরে সুস্থে সব করা যাবে।”

তবে বাঁধ সাধলেন অলি আবসার। সে নিজে যাবে। আর বিয়ে ছাড়া জাহিদের মেয়েকে তিনি এই গ্রামে প্রবেশ করাবেন না।

এই শেষ বয়সে এসে আব্বার এ কেমন জেদ আহমাদ বুঝতে পারছে না। পাঁচ ছয় ঘন্টার ধকল এই শরীরে সইবে? আসাদের স্কুল আছে। আমজাদতো মহা ব্যস্ত। একেকদিন রাতেও সে বাসায় ফিরে না। আড়তে তার থাকার ব্যবস্থা আছে। সে আর চোখে মুখে উপায় দেখলো না। নিজেই বাপ, ছেলেকে নিয়ে রওনা দিলো।

এদিকে গত রাত থেকে মুর্শিদা থম মেরে বসেছে যে বসেছে। শবনম কি করবে বুঝতে পারল না। বউ আনতে গেছে। কিছু করতে হবে নাকি? আজকের রান্না বান্নাও বাকি। সে করবে টা কি?

শবনম দিশে না পেয়ে ছোট মার কাছে দৌড়ে গেল। তাদের ছোট মা হলো আমেনা বেগম। আমজাদের বউ। তার শরীর বছরের বেশি ভাগ সময়ই থাকে অসুস্থ। এই সংসারের যাবতীয় সব দায়িত্ব মুর্শিদা দেখে। সে তার শরীরের বেদনা নিয়েই দিশে পায়না, সংসার করবে কি?

আমেনা কুঁকাতে কুঁকাতেই উঠল। গত রাতে আব্বার রুম থেকে এসে পড়েছে যে পড়েছে। উঠল এখন। উঠতে উঠতে সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বৈশাখ মাস। কোন রাগ ঢাক ছাড়াই হঠাৎ আকাশ গর্জে উঠে। আর আজকে তো চারকুল সেজে অন্ধকার হয়ে আসছে। গ্রাম মনে হয় আজকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে বেরুতে বেরুতে হাক ছাড়লো, — এ কে কোথায় মরছিস। উঠানে যে লাকড়ির মেলা লাগাইছিস। এই মেলা গুছাইবো কে? নাকি বৃষ্টির পানিতে গোসলের জন্য বসাইয়া রাখছিস।

সোহাগী দৌড়ে গেল। নাহার এই গ্রামেরই মেয়ে। জামাই মরলো কলেরায়। স্বামীর ভিটে থেকে ভাসুর, দেবর, শাশুড়ি দুর দুর করে নামাইলো। এক মেয়ে সোহাগীকে নিয়ে আর কই যাবে। মুর্শিদার পায়ে এসে পড়ল। কাজের মানুষেরও দরকার ছিল। মুর্শিদা দু- জন কে’ই তুলে নিল। সেই থেকে তারা এ বাড়িতে’ই আছে।

আমেনা শবনমকে রান্নার আয়োজন বুঝিয়ে মুর্শিদার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সে যখন এই বাড়িতে পা রাখে তখন তার বয়স তের। মুর্শিদার আঠারো কিবা ঊনিশও হতে পারে। সংসারতো ভালোই দিন দুনিয়ার কোন জ্ঞানই নাই। শাশুড়িরা কি আর জ্ঞান বুঝাইবে? তারা খোঁজে শুধু দোষ। বলতে গেলে মুর্শিদাই তাকে গড়ে পিঠে নিছে । গড়ে পিঠে নিলেও মুর্শিদারর বান ভালো। বরং আমেনার শরীরেই ক্ষয় ধরছে আগে।

আমেনা মনে মনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার শাশুড়ি ছিল জাঁদরের বংশধর। উঠতে বসতে তাদের ঘুম হারাম করত। মুর্শিদা পুরোপুরি না পেলেও কিছুটা শাশুড়ির নাম রাখছে। যেখানে বড় ছেলের বউ নিজে দেখে শুনে যাচাই করে আনছে তবুও রাখে আঙ্গুলের ডগায়। আর সেখানে নিজের বোনের মেয়ের জায়গা দখল করে আরেকজন আসছে। এর কপালে না জানি কি আছে?

আবসারদের পৌছুতে পৌছুতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো। তারা উঠল খাইরুলের ভাইয়ের বাসায়। খাইরুল তাদের এলাকারই এক ভাইয়ের বউ। সে তার ভাইকে পই পই করে বলে দিয়েছে। এদের যেন খাতির যত্নের কোন কমতি না হয়। যদি হয় তাহলে যেন সে ভুলে যায় তার এক বোন আছে।

খাইরুলের ভাইয়ের নাম খলিল। স্টিলের কারখানায় কাজ করে কোন রকম পেট চালায়। তবুও সে তাদের যত্নের চূড়ান্ত করল। করে তাদের আরাম করতে বলে আজাদ আর রমিজ কে নিয়ে বেরুলো। আসলে সেও তেমন কিছু জানে না। তাকে এই চিঠি দিছে তার এক বন্ধু ইমরুল। সে ঐ কারখানার সুপার ভাইজার। সে জানতো তার এক বোনের বিয়ে হয়েছে সেই গ্রামে। তাই তার হাতে দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। সঠিক ঠিকানা জানে না। শুধু গ্রাম আর অলি আবসার নামটা জানতো। তাই হাতে দিয়ে বলেছিল, যদি খুঁজে পায় দিতে। খুঁজতে অবশ্য তার কষ্ট হয়নি। তার বোনকে বলতেই চিনেছে। তবে তার কাজ থাকার সাথে সাথে আসতে পারেনি। এসেছে কয়েকদিন পরে।

আজাদরা ইমরুলের বাড়িতে এসে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। তালা দেওয়া সমস্যা নেই, পরে আসা যাবে। কিন্তু শুরু হলো আরেক বিপত্তি। আকাশ ভেঙে নামলো বৃষ্টি। যেন তেন বৃষ্টি না। একেবারে যাকে বলে কাল বৈশাখি ঝড়। সেই ঝড়ে তারা পাশের বাসায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পেল। সেখান থেকেই শুনলো, ইমরুলের কে জানি মারা গেছে। সে সেই বাসায়ই আছে। খলিল, রমিজ কি করবে বুঝতে পারল না। তারা আজাদের দিকে তাকালো। আজাদ দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার। তার দৃষ্টি বাইরের ঝড়ের তান্ডবে।

ঝড় থামলো রাতে। তারা বেরুবে সেই সময় খলিল তাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে এল। যদি আসে তাহলে কষ্ট করে যেন একটু খবর পৌঁছায়।

তারা বাসায় ফিরলো কাক ভেজা হয়। ঝড় থেমেছে তবে বৃষ্টি থামেনি। কাক ভেজে হয়ে বাসায় ফিরে রমিজ হাসতে হাসতে আবসারকে বলল, — কি মেয়ে যে ঠিক করেছো গো দাদাজান। খুঁজতে খুঁজতেই সবার হালুটা টাইট হওয়ার অবস্থা। ঝড়, তুফান মাথায় করে সে আসছে। এই মেয়ে তোমার নাতির বারোটা বাজাবে।

আজাদ বাঁকা হাসলো। হেসে রমিজের কাঁধে হাত রেখে বলল, — আজাদের বারোটা বাজাবে এমন মেয়ে দুনিয়ায় পয়দা হয় নাইরে রমিজা। আর এ তো কোন কানা, লেংড়া, বোবা। বরং তোর দাদাজানের জন্য খাটিয়া রেডি রাখ। তার পেয়ারের লেংড়ির দুঃখে পটল না তাড়াতাড়ি তুলে।

আবসার হেসে ফেললো। হেসে শান্ত ভাবে বলল, — উল্টো ও তো হতে পারে দাদাভাই। দেখা গেল এই কানা, লেংড়ির জন্যই তুমি দেওয়ানা হইয়া পাগলা খাতায় নাম লেখাইলা।

আজাদ হাসলো! রহস্য মাখা হাসি। এই হাসির অর্থ আবসার, রমিজ কারো বোঝার সাধ্য নেই। সে হেসে বাইরে এলো। সিগারেটে তৃষ্ণা পেয়েছে তার। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। বাড়ির কেউ জানে না সে সিগারেট খায়। তাই এখানেও সম্ভব না। ধুর! বলেই তার চোখে মুখে বিরক্তি ছেয়ে গেল। কানা, লেংড়া মেয়ে বিয়ের চেয়ে সিগারেটের জন্যই তাকে বেশি চিন্তিত দেখা গেল।

আজাদ বাইরে যেতেই আবসার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটার কোন অবস্থায় আছে কে জানে? আর মারা গেছে কে? তার কেন জানি ভালো লাগছে না। গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে। সে ওযু করে নামাজে দাঁড়ালো। যদি একটু মনটা শান্ত হয়।

তার পরের দিনও গেল সারাদিন ঝড়- বৃষ্টি। তারা বাসায় থেকে বেরুতেই পারল না। খলিল ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কাজে গেল। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে তেমনি ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে ফিরে এল। এসে বলল, ইমরুল খবর পাঠাইছে। জাহিদ ভাই মারা গেছে। ইমরুল তার বাসায়ই আছে। তার মেয়ে আনতারা। তার অবস্থাও নাকি খুব একটা ভালো না।

আবসার চোখ বন্ধ করলেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। অনেক দিন, অনেক দিন পরে তিনি হাউ মাউ করে আবার কাঁদলেন।

আহমাদ, রমিজ করুণ মুখে আবসারে অবস্থা দেখলেন। তবে সান্তনার কোন বাণী তারা খুজে পেল না। তবে আজাদ এগিয়ে গেল। আবসার কে জড়িয়ে ধরলো। মুখে যত যাই বলুক। তাদের দাদা যে তাদের মাথার মুকুট । সে জড়িয়ে ধরেই নিশ্চুপ বসে রইল। আর এই নিশ্চুপের মাঝে একটা নাম মাথায় ঘোরপাক খেতে লাগলো আনতারা…

চলবে…….