বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৬

0
36

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৬

আজাদরা যখন গাড়িতে উঠল, তখন ঘড়ির কাটা দুটো পেরিয়ে গেছে। নানা ঝামেলায় কারোই দুপুরের খাওয়া হয়নি। তার চেয়েও বড় সমস্যা আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।

খলিল চিন্তিত ভাবে বলল,– আজ যাওয়ার দরকার নেই চাচা। আজ রাতটা আরেকটু কষ্ট করে না হয় আমার এখানেই থাকেন। কাল আস্তে ধীরে রওনা দিয়েন।

আবসার রাজি হলো না। যে ঝামেলা লেগেছে এখানে থাকাই বিপজ্জনক। তাদের এলাকায় এসে তাদের লোকের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। সবার সামনে হয়তো কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবে কেন? না সে আর কোন ঝামেলা চায় না।

সে কৃতজ্ঞতামাখা কন্ঠে ইমরুল, মারুফার কাছ থেকে বিদায় নিলো। ছেলে মেয়ে দুটো অনেক করেছে। আজকাল রক্তের সম্পর্ক ছাড়া করেই বা কে?

আবসার খলিলের কাছ থেকেও বিদায় নিলো, নিয়ে একেবারে গাড়িতে উঠল। পেছনে বসেছে আহমাদ আর রমিজ। মাঝে সে আর আনতারা। তার জ্বর মনে হয় আবার বেড়েছে। বেহুশের মতো পড়ে আছে। বেঁচে আছে না মারা গেছে দেখে বোঝার উপায় নেই। ড্রাইভারের পাশে আজাদ। তার মধ্যে তেমন হাবভাব দেখা গেল না। সে সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে শোয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছে।

আবসার নিজেও বসল। বসে বলল, — কাঁথা বালিশ লাগবে নাকি রে দাদাভাই ?

আজাদও তার মতোই বলল, — যে বিয়ে করিয়েছো এর পরে আর কিছু লাগবে বলে মনে হয় না।

আবসার হালকা হাসল! এরকম অবস্থায় এ রকম উত্তর একমাত্র তার নাতির থেকেই সম্ভব। সে হেসেই বলল — পেছনে বাপ বসা। একটু তো লেহাজ কর।

— করেছি বলেই তো ভদ্র ভাবে বললাম। তা না হলে আমার মুখ তুমি জানো?

— আমি সবই জানি। তাই কান খুলে শুনে রাখো। আমার বোনের ব্যাপারে সাবধান। আমি তোমার দাদা হলেও, আনতারা ব্যাপারে আমি শুধুই তার নানা। সে যদি কোন কারণে আমাকে ডাকে, সেখানে অন্য কোন সম্পর্ক আমি দেখবো না।

আজাদ হাসলো! সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতে করতে বলল, — তুমি কিছুই জানো না দাদাভাই। আর তোমার বোন তোমার সিন্দুকে ভরে রাখো, আজাদের না হলেও চলবে।

আবসার আবারো হাসলো! হেসে বলল, — সেখানেই তো রাখলাম দাদাভাই। আমার আমানত গুচ্ছিতো রেখো।

আজাদ উত্তর দিল না, তবে ঠোঁটটা নিঃশব্দে আরেকটু বিস্তৃত হলো। আবসারও আর কিছু বলল না। সে আনতারার দিকে আবার তাকালো। সাথে একজন মেয়ে মানুষ থাকলে ভালো হতো। মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। মনের কষ্ঠের ছাপ শরীরে পড়ে। আনতারারও পড়েছে। তাই কোন ঔষুধে ধরছে না। একবার কষ্ট সয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মানব জাতির এইতো বিশেষ গুণ। পেটে যত দানা পড়বে, কষ্ট গুলো তত তাড়াতাড়ি সয়ে যাবে। সেটা যত বড় কষ্টই হোক।

আবসার সামনে তাকালো। তাদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তার সাথে টুপটাপ বৃষ্টিও শুরু হয়েছে । সেই টুপটাপ বৃষ্টি নদীরঘাটে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভারী বৃষ্টিতে পরিণিত হলো।

আজাদ, রমিজ অনেক কষ্টে পলিথিনে মুড়িয়ে আহমাদ আর আবসারকে বোটে তুললো। তুলে রমিজ আবসারের পাশেই বসল। তার এমন ভাব বাকিটুকু যার মাল সে,ই আনুক।

আজাদ অবশ্য তার ভাবের দিকে তাকালোও না। সে পুরোদমে ভেজা। সেই ভেজা শরীর নিয়েই সে গাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

গাড়ির দরজা খুলতেই বৃষ্টি ছাট আনতারা চোখে মুখে ছিটে এলো। সাথে সাথেই আনতারা চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। বৃষ্টির ছাট, ঠান্ডা বাতাসে সে আরো কুঁকড়ে গেল। নিজের দু- হাতে নিজেকে জড়িয়ে তাকানোর চেষ্টা করল। তবে জ্বরের ঘোর আর বৃষ্টির ছাটের কারণে কিছুই পারল না। সেই না পারার মাঝেই তার উপরে কিছু একটা পেঁচিয়ে গেল। আর কিছু বোঝার আগেই সে টুপ করে শূণ্য উঠে গেল। সে কি উড়ছে! তার তো পাখা নেই। পড়ে যাবে তো। সে ভয়ে দু- হাত হাতড়ে কিছু ধরার চেষ্টা করল। কিছু একটা দু- হাতে আসতেই ঝাপটে ধরল। ধরে ফিসফিস করে বলল, — আমার পাখা নেই। পড়ে যাবতো।

আজাদ থমকে দাঁড়ালো! আনতারা তার গলা জাপটে বুকে মুখ গুজে আছে। মুখ না দেখলেও ফিসফিস করে বলা কথা তার কানে ঠিক গেল। সে হেসে ফেললো! তখনি আশে পাশে কোথাও একটা বাজ পড়ল। আনতারা আরো আস্ট্রেপিস্ট্রে জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিসফিস করে বলল,– ভয় করছে বাবা, ভয় করছে।

আজাদ আর দাঁড়ালো না। বৃষ্টি পলিথিনের কারণে হাত পিছলে যাচ্ছে। সে আরেকটু শক্ত করে ধরেই সোজা বোটের ছাউনির ভিতরে এনে রাখল। এই মেয়ের জন্যই দাদা বোটে বিছানার ব্যবস্থা করতে বলেছে। সেই বিছানায় কোনরকম রেখেই বেরিয়ে এলো। আকাশ ভেঙে নামছে তখন তুমুল বৃষ্টি । এই বৃষ্টিতে বোট ছাড়বে না । সে চোখ বন্ধ করে সেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে নিজেও জানে না। ধ্যান ভাঙলো ইঞ্জিল চলার শব্দে। বৃষ্টি কমেছে, সন্ধ্যা নামো নামো করছে। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে।

বোট যখন তাদের গ্রামের ঘাটে থামলো তখন রাত দশটার উপরে। আবসার ভয়ে ভয়ে দোয়া পড়তে পড়তে এসেছে। বোটে তারা একা এসেছে। আনতারা আছে তাই অন্য যাত্রী সে তুলতে দেয়নি। পুরোটাই ভাড়া করেছে। আজকাল মাঝ নদীতে ডাকাত পরে। তবে বৃষ্টির কারণে রক্ষে। টাকা পয়সা তাদের জান নিয়ে তার ভয় নেই। তার সব ভয় ছিল তার বুবুকে নিয়ে। আল্লাহ সহায়! ভালোয় ভালোয় এসেছে।

গাও গ্রামে দশটার উপরে মানে মধ্য রাত। এত রাতে রিকশা পাওয়া যাবে না। তাদের বোট ঘাটে থামতেই রমিজ দৌড়ে গেছে। তাদের বাড়ির দু- বাড়ি পরেই কদ্দুসের ভ্যান আছে। সেটাই নিয়ে এসেছে। আর সাথে এসেছে আসাদ আর আমজাদ।

রমিজ, আজাদ আগে সব মালামাল নামালো। আসাদ এগিয়ে ধীরে ধীরে বাবা আবসার কে। আনতারাকে কে আনতে আজাদ ছাউনির ভেতরে আসতেই দেখলো, আনতারা সটান হয়ে বসে আছে। এই মেয়ে পুরো পাঁচ, ছয় ঘন্টা বেহুশের মতো ঘুমিয়েছে। জ্বর মনে হয় কমেছে। তা না হলে এতক্ষণ তো মাথাও সোজা করতে পারেনি।

আজাদকে দেখেই আনতারা সজ্ঞানে সুস্থ, স্বাভাবিক স্পষ্ট ভাবে প্রথম কথা বলল, অবশ্য খুবই মিহি ভাবে ,– পানি খাব! মাথার ঘোমটা একটু ফেলি। অস্থির লাগছে।

আজাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপরে বেরিয়ে এলো। মালামাল সব নামানো হয়ে গেছে। পানির বোতলও সেখানে। সে আবার গিয়ে ভ্যান থেকে পানির বোতল এনে এগিয়ে দিলো। দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। তার নিজেই এখন শীত শীত করছে, জ্বর আসবে কিনা কে জানে।

সে ঘুরতেই আনতারা ঘোমটা ফেললো! ওড়না চাদরে পুরো পেঁচিয়ে আছে। শরীর ঘেমে একাকার। জ্বর ছেড়েছে।

ওড়না চাদর ফেলে একটু স্বস্থি লাগতেই সে আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো। বোটে টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছে। সেই হারিকেনের স্বল্প আলোতে এই লোক কে সে চিনতে পারল না। শুধু মনে পড়ছে ঐ বৃদ্ধ লোকটার কথা। সে নাকি তার নানা হয়। কি জানি? কখনও তো সে কাউকে দেখেনিই। তার দুনিয়া ছিল তার বাবা। বাবা কখনও তার সম্পর্কে কিছু বলেনি। জিজ্ঞেস করলেই বলত, — আমি এতিম রে মা। জন্মগত এতিম। এই দুনিয়ায় বলার মতো আমার কেউ কখনও ছিল না। এখনো নেই।

বাবা কথাগুলো বলতো একরাশ দুঃখ নিয়ে। তাই আনতারা জ্ঞান হওয়ার পরে কখনও আর কিছু জিজ্ঞেসই করেনি। তার সেই বাবা নেই। এই কথা মনে পড়তেই তার বুক আবার ভেঙে এলো। কেন তাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেল?

আনতারা আর পানি খেলো না । খেতে ইচ্ছেও করল না। পানির বোতল টুপ করে পানিতে ফেলে দিলো। এই অভিমান কার উপর আনতারা নিজেও জানে না। শুধু জানে এই পৃথিবী তার নিজের বলতে এখন আর কেউ নেই, কেউ না। সেও এখন তার বাবার মতো এতিম।

সে বোটের ছাউনি ধরে কোন রকম দাঁড়ালো! শরীর কাঁপছে তার। একতো জ্বর তার মধ্যে গত কয়েকদিন বলতে গেলে পুরো না খাওয়া। সে পড়ে যেতে নিল।

আজাদ তখনি ঘুরে তার বাহু টেনে ধরল। আনতারা কিছু বলবে তার আগেই ঝট করে কোলে তুলে নিল। আনতারার মাথায় ঘোমটা নেই। হঠাৎ ঝাঁকিতে কোন রকম বেঁধে রাখা খোঁপাটা খুলে ছড়িয়ে গেল। আজাদ শুধু একবার তাকালো। তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

আনতারা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। দুর্বলতার জন্য নাকি স্বজ্ঞানে অপরিচয় মানুষের কোলে ওঠার জন্য বোঝা গেল না। তবে সে অস্ফুটভাবে বলল, — আমি হেঁটে যাব। আমাকে নামিয়ে দিন।

আজাদ শুনলো! তবে তার পা থামলো না। বৃষ্টি কারণে পুরো ঘাটে কাদায় মাখামাখি। টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে। সেই হাঁটার মাঝেই বলল, — পানির বোতল যেমন টুপ করে পানিতে ফেলেছো। বেশি কথা বললে তার মতোই টুপ করে নিচে ফেলে দেবো।

আনতারা সাথে সাথে আজাদের বুকের শার্ট খামচে ধরল। এই লোককে তো তার সুবিধা মনে হচ্ছে না। সে ভালো করে আজাদকে দেখার চেষ্টা করল। তবে অন্ধকারের জন্য সে তেমন কিছুই দেখতে পারল না।

আজাদ বুঝলো! বুঝে ঠোঁট টিপে হাসলো! অবশ্য অন্ধকারে এ হাসি আনতারা দেখলো না। আকাশ আবার কালো হচ্ছে। ঝড় শুরু করার আগেই বাসায় পৌঁছুতে হবে। তাই আজাদ তাড়াতাড়ি পা চালালো। চালাতে চালাতে শুধু আস্তে করে বলল, — ঘোমটা তুলো।

রাত তখন প্রায় এগারোটা। তবুও অলি আবসারের বাড়ির উঠানে আজ মানুষের মেলা লেগে গেছে। রাত যত হোক নতুন বউ আসবে এলাকার চাচি, বউরা আসবে না, তা কি করে হয়?

রমিজ ভ্যান নিয়ে যেতেই বাড়িতে হিড়িক লেগে গেছে। বৃষ্টির কারণে ক্যারেন্ট নেই। প্রায় সবার হাতেই ছোট ছোট হারিকেন। উঠান কাঁদায় মাখামাখি। এর মধ্যেও দু- একজন গীত গাইছে। ছোট বাচ্চারা কাদা, পানি নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করছে।

এর মধ্যে মুর্শিদা বসে আছে চুপচাপ। তার পাশে বসে আছে তার বৃদ্ধ মা। সে পান ছেঁচে একটু একটু করে মুখে পুরছে। দাঁত নেই তুবুও নেশা ছাড়তে পারে না। তারা এসেছে বিকেলে। বউ আসার কথা শুনেই আসাদকে বলেছে স্কুল থেকে আসার সময় নিয়ে আসতে।

বৃদ্ধ মুখে পান পুরে বলল, — এহন ঠাটা খাইয়া বইয়া থাইকা লাভ কি? কুল নাই, কিনারা নাই, এমন মাইয়ার লগে বিয়া। আরে ভাই বাপ মরছে বাড়িতে নিয়ামু। খাইবো, পিনবো, কাম করবো। পুতের লগে বিয়া দিতে হইবো ক্যা?

মুর্শিদা উত্তর দিল না। কুল, কিনারা নিয়ে তার সমস্যা নাই। বরং কুল, কিনারা থাকলেই সমস্যা। মুখ চলে নদীর কলকালানের পানির মতো। আর কিছু হইলেই বাপের বাড়ি দৌড়। সে চিন্তায় আছে বোনকে কি বলবে? সম্পর্ক মনে হয় না আর থাকবে। তাছাড়া সে করতোই বা কি? তার শ্বশুরের উপরে সে কখনো কিছু বলতে পারবে না। কখনো না।

সে দেখতে কালো, খাটো। বয়স আঠারোর ঘরে গিয়ে ঠেকেছিল। গাঁও গ্রামে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। পনেরোর আগেই সবার চেষ্টা থাকে বিদায় করতে। সেখানে তার আঠারো। বিয়ে হচ্ছিলোই না। তার মধ্যে যৌতুক চায় দুনিয়ার। যা তার মধ্যবিত্ত বাবার জন্য ছিল সাধ্যের বাইরে। আর এই সাধ্যের বাইরের মধ্যেই একদিন তার শ্বশুর এসে হাজির। উঠানে পা রেখে বলল, এইটা আমার ছেলে। ঢাকায় সরকারি চাকরি করছে। আপনাদের মেয়ের জন্য আনছি, দেখেন তো পছন্দ হয় কিনা?

যেই মুর্শিদারে সবাই কালো, খাটো বিয়ে হইবো না বলে নানান কথা শুনাতো। সেই মুর্শিদা এক রাতেই সোনার সোহাগী হয়ে গেল। বিনা যৌতুকে সম্মানে এই বাড়ির বউ হলো। আর যেই মানুষটার জন্য হলো। তার মুখের উপরে সে কিভাবে কিছু বলবে? এই জীবন থাকতে তার পক্ষে কি সম্ভব?

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বেরিয়ে হাক ছেড়ে বলল, — এই কে কোথায় আছিস। শুধু হুটোপুটি করলে হবে? পিঁড়ি বের কর। বরণ ডালা সাজা।

চলবে……..