বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৭

0
32

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৭

অলি আবসারের প্রথম নাতনী ছিল আশা। তার জন্ম আসাদেরও আগে। তার পর আসাদ, আসাদের পর আজাদ, আজাদেন পর মুনিয়া। তারপর অনেক পরে বিথী, মিথি। তাদের বয়সের ব্যবধান খুব একটা বেশি না। মাস দেড়েকের হবে। বিথী আহমাদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। তার জন্ম আসাদ, আজাদের অনেকটাই পরে। এমনিতেই এক মেয়ের মৃত্যু তার মধ্যে সবার ছোট হওয়ায়, মা – বাবা ভাইদের আদরের দুলালী সে। আর ঐ যে বলেনা আদরে আদরে বাঁদর। এই প্রবাদটা ঠিক যেন তার জন্যই প্রযোজ্য।

সে তার ছোট ভাইয়ের বিয়ের খবর পেয়েছে সবার পরে। সে ছিল তার নানা বাড়িতে। এটা নতুন না। দুদিন যেতে না যেতেই তার নানি তাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখেন। এমন না তার আর নাতি নাতনী নেই। তবে কথায় আছে না, যার বাবা – মায়ের যত বড় অবস্থা, আত্মীয় – স্বজনের কাছে তত বড়ই সমাদর।

তাই বিথীরও ছোট বেলা থেকে কোন দিক থেকেই সমাদরের কোন কমতি হয়নি। সেই কোন কিছুর কমতিছাড়া বোন, ভাইয়ের বিয়ের খবর পেয়েছে একেবারে শেষ সময়ে। গাল ফুলাবে না এমন হয়?

তাই আসাদ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে নানির সাথে বোনকেও নিয়ে এসেছে। আসলে কি হবে? মেজাজ তার তুঙ্গে। মুর্শিদা গিয়েছিল মেয়ের মান ভাঙাতে। তবে তাকে দিয়েছে এক ঝাড়ি।

ঝাড়িতে অবশ্য মুর্শিদা কোন রা করেনি। মেয়ের ক্ষেত্রে করেনও না। এই মেয়ের জন্য এই বাড়িতে সাত খুন মাপ। তাকে শান্ত করেছে শবনম। শান্ত করে নিজের রুমেই বসিয়েছে। ক্যারেন্ট নেই, বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া ঠান্ডা। শবনম তবুও ননদকে পাখা দিয়ে বাতাস করছে। বাতাস করলেও শবনম বিথীকে দেখতে পারে না। না দেখারও অবশ্য কারণ আছে। এই মেয়ের মুখ ভালো না। সম্পর্কে সে বড় ভাবি। সম্মান তো ভালোই, আজ পর্যন্ত ভালো ভাবে কথা বলেছে কি না সন্দেহ। সাথে অসভ্যের হাড্ডি এই মেয়ে। যখন যা মনে চায় করতে থাকে, বলতে থাকে। তাই সে একটু ভয়ে ভয়েই থাকে। কেননা আসাদ এমনিতে ভদ্র নম্র হলেও, বউয়ের বেলায় পুরো উল্টো। পান থেকে চুন খসলেই ধমক। বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত যেই পরিমাণ ধমক আর চোখরাঙানি সে খেয়েছে। সেই পরিমাণ ভাতের দানা তার পেটে গেলে, শরীরে মাংস রাখার আর জায়গা থাকতো না। তাছাড়া বিয়ের প্রথম রাতেই আসাদ কড়া করে বলেছে, আর যাই করো আমার মা, আর বোন যেন কখনও কোন কষ্ট না পায়। কখনও কোন ব্যবহারে তাদের মুখ ভার না হয়। ”

শবনমের বিয়ের বয়স তিন বছর । এই তিন বছরে যা বুঝেছে তা হলো। এই মেয়ের মুখ ভার হওয়ার মতো কেউ কিছু করেই না। সে থাকে নিজের মতো। সেই নিজের মতো থেকেও কারণে, অকারণে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। এই কারণেই শবনম থাকে ভয়ে ভয়ে।

— মেয়ে দেখতে কেমন ভাবি? চেনা নেই জানা নেই টুপ করে বিয়ে। এটা কোন কথা?

শবনম মনে মনে ভেংচি কাটলো! তাদের এই গাওগ্রামে কোন মেয়েরই চেনে জেনে বিয়ে হয়। লোকের কথা কি বলবে সে, তার নিজেরই কি হয়েছে? আসাদ তাকে দেখতেও যায়নি। যা দেখার যা করার সব করেছে তার অতি গুণধর শাশুড়ি। বাসর ঘরে আসাদের জায়গায় অন্য কাউকে ঢুকিয়ে দিলেও সে ধরতে পারত না। সে মনের বিরক্তি মনে চেপেই বলল,

— আমি জানি না। এই বিয়ের সব সিন্ধান্ত দাদাভাইয়ে নিছে।

— এই বুইড়ার হঠাৎ আবার এতো ভীমরতি হলো কেন?

শবনম মনে মনে বিথীকে সুন্দর করে ভয়ংকর একটা গালি দিল। উপরে দেওয়ার সাহস নেই। তাই মনে মনে। এই পুরো বাড়িতে তার দুটো মানুষই পছন্দ। এক দাদা ভাই, দুই আজাদ। আজাদ যেমন তেমন তবে দাদা ভাইকে একটু অসম্মান করে কেউ কিছু বললে তার গায়ে লাগে। সে দাদার আদর কখনো পায়নি। তার জন্মের আগেই মারা গেছেন। দাদার আদর বলতে যা বুঝে সব এই দাদা ভাই থেকে ।

সে গালি দিয়ে একটু ঠোঁট ছড়িয়ে বলল, — আমি তাও জানি না।

বিথীর চোখে মুখে বিরক্তি দেখা গেল। এমন ঢংয়ের বিয়ে তো সে জীবনেও দেখেনি।

বিথীর চেহেরা দেখে মিথি হাসলো! সে উপুড় হয়ে আছে শবনমের খাটে। মিথি যেমন রাগি, জেদি, সে প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি মেয়ে। বিথী যেমন বাবা, মায়ের দুলালী। মিথি সে রকম না। তার মা থাকে বারোমাস অসুস্থ। বাবা বলতে গেলে তাদের খবরই নেয় না। তার তো যত আফসোস একটা ছেলে নেই বলে।

সে হেসে পা নাচাতে নাচাতে বলল,– বিয়ে ছোট ভাইয়ের তুই গাল ফুলিয়ে আছিস কেন? না চেনে, না জেনে তোকে তো আর বিয়ে দিচ্ছে না?

বিথী খেঁকিয়ে উঠে বলল, — তুই একদম এর মধ্যে কথা বলবি না মিথির বাচ্চা। আমার ভাই আমি বুঝব।

— বললে কি করবি ভাইয়ের আদরের চামচি? এতো আদরের বোন তো বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে, বোনের কথাতো মনেও পড়ল না।

বিথী এগিয়ে মিথির বেনি টেনে ধরল। মিথিও ঘুরে দু- হাতে চুল টেনে ধরল। শবনম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব নতুন না। এদের চুল ছেড়াছেড়ি চলতেই থাকে। আবার দু- জনকে ছাড়া দু- জনের চলেও না। তখনি বাইরে বউ আইছে, বউ আইছে বলে হিড়িক পড়ল।

মিথি ধাক্কা মেরে বিথী ফেলে দৌড়ে গেল। অন্য সময় হলে বিথীও তার পিছু পিছু দৌড়ে যেত। তবে আজ গেল না। মিথি তাকে যেভাবে ধাক্কা মেরে ফেলেছে সে ভাবেই হাত, পা ছড়িয়ে শুয়ে রইল। বিথীর জন্য শবনমও উঠতে পারল না। তবে তার ভেতর আঁকুপাঁকু করছে। নতুন বউ আসছে, এভাবে বসে থাকার মানে হয়? সে মনে মনে আরেকটা ভয়ংকর গালি দিল। এই শয়তান বিদায় হবে কবে।

বাড়ির উঠানে ভ্যান যখন এসে থামলো। তখনি বিদ্যুৎ চমকানো আর বাতাস শুরু হলো। তবুও কাদায় মাখামাখি হয়ে উঠানে মানুষের গিজগিজ করতে লাগলো। ভ্যানে শুধু আনতারা আর আবসার। রমিজ ভ্যানের সাথে এসেছে দৌড়ে। বাকি সবাই ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। তাই তারা এখনো পৌঁছায়নি।

রমিজ ধীরে ধীরে আবসার কে ধরে নামালো। আবসার নামতেই আশে পাশে তাকালো। গ্রামের দুনিয়ার মানুষ। এমন মানুষ অনেক অনেক দিন আগেও তাদের বাড়িতে ভিড় করেছিল। তখন সে সবাইকে খুশিতে’ই সমাদর করত। তবে কেউ তার সেই সমাদরের হাত রাখেনি।

যেই আবসার কখনও রাগতো ভালোই বিরক্তির সামান্য রেখাও তার কপালে পড়ে না। আজ শান্ত তবে কন্ঠে, চোখে, মুখে বিরক্তি এনে বলল, — বড় বউ কই? বড় বউকে ডাকো। আর বাড়িতে মানুষের এত মেলা কেন?

রমিজ চমকালো! চমকালো আশে পাশের মানুষও। এই আবসারকে তারা যেন চেনে না। তারা অবাক হয়েই সরে দাঁড়ালো। বউ আসতেই তারা ঘিরে ধরেছিল। এটা এই গ্রামে নতুন না। বউ আসলে এমনি হয়। তারা বউ নামায়, বরণ করে, মিষ্টি মুখ করায়। তার সাথে কত কত দুষ্টামি ফাজলামি। সেখানে ছেলেদের কোন কাজ থাকে না। তবে আজ আবসারকে সেখান ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কেউ আর এগুলো না।

মুর্শিদা ভেতরে ছিল। সোহাগী দৌড়ে এসে বলতেই সে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে আবসার আগের মতোই বলল, — আনতারাকে ভেতরে নেওয়ার ব্যবস্থা করো বড় বউ। আর কোন গেঞ্জাম আমি চাই না। সোজা দাদাভাইয়ের রুমে নাউ। সে খুব অসুস্থ তার মধ্যে সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। খাবার দাবারের ব্যবস্থা কর।

মুর্শিদাও ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার এত বছরের সংসার জীবনে শ্বশুরের এই কন্ঠ শুনেছে বলে মনে পরে না। তার ভেতর অজানা কোন আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। সে চোখ ঘুরিয়ে অন্ধকারে ভ্যানের উপরে জবুথবু ভাবে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। তাকিয়ে নিঃস্পৃহ কন্ঠে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাহার কে বলল, আসাদের বউরে আসতে বল। নতুন বউকে ধরে ভেতরে নিয়ে যা।

উঠান ভর্তি কাদা। ভ্যান টেনে একেবারে বাড়ির দৌড়গায় আনলো। নাহারের গিয়ে বলতে দেরি শবনমের আসতে দেরি হয়নি। যেন সে এই ডাকের অপেক্ষায়ই ছিল। সে এগিয়ে এসে আনতারা কে ধরল।

আনতারা উঠে বসলো। বসতেই তার মাথার ঘোমটা গড়িয়ে পড়ল। খোলা চুলে ঘোমটা থাকার কথাও না। তখন ঘোমটা তোল বলতেই সে সাথে সাথেই ঘোমটা দিয়েছে। একজন মানুষের কোলে বসে তো আর খোঁপা করা সম্ভব না। আর ভ্যানের সামনে এতোগুলো মানুষ দেখে আর সাহস,ই হয়নি। তাছাড়া তার শরীর বলতে গেলে একেবারেই নিস্তেজ। তারমধ্যে আবার মাটির এবরো থেবরো রাস্তা। ঝাঁকিতে তার অবস্থা আরো নিস্তেজ।

এদিকে তার ঘোমটা পড়তেই সবাই অবাক হয়ে তাকালো। শবনমতো হা হয়ে গেল। হারিকেনে স্বল্প আলোতে এই গোলগাল ফর্সা মুখটাকে ঠিক চাঁদের মতো মনে হলো। এলাকার করিমন চাচি চেঁচিয়ে বলল, — ও আসাদের মা। তোমার উঠানে তো চাঁদ নাইমা আইছে। এজন্যই তো আকাশ এতো ক্ষেপছে। তার চাঁদ তো এখন তোমার ঘরে।

মুর্শিদা বারান্দায় দাঁড়ানো! সে সেখান থেকেই দু- কদম এগিয়ে বারান্দার খুঁটিতে হাত রাখল। সে নিজেও চমকেছে। এই বাড়ির বলতে গেলে সবার গায়ের রং’ই কালো। আসাদের দাদা থেকে শুরু করে আসাদের বাপ, চাচা, এমনকি তাদের ছেলে মেয়েও। আমেনা একটু ফর্সার দিকে গেলেও, তার নিজের রং তো একেবারেই কালো। তার শ্বশুর জাত, রং এসব মানে না। বাছ বিচারও নাই। সে শুধু দেখে মানুষ। এই কারণে ছেলেদের বাচ বিচার ছাড়াই বিয়ে করিয়েছেন। যার ফলে পিরি আর এতোটুকুও ঘুরে নাই। বলতে গেলে সবাই কালো। তাই মুর্শিদা চেয়েছে সে তাদের ছেলেদের দেখে শুনে বিয়ে করাবেন। করিয়েছেনও তাই। শবনমের গায়ের রং ফর্সা। তার বোনের মেয়ে আনারও এই কারণ ছিল। তার গায়ের রংও ফর্সা। তবে এই মেয়ের কাছে সবাই কেই যেন তার ফিকে মনে হলো। এই মেয়ের যেমন গায়ের রং, তেমনি চোখ, নাক, মুখ,। যেন উপওয়ালা নিখুঁত ভাবে নিজ হাতে বানিয়েছেন।

মুর্শিদা চমকেই তাকিয়ে রইল। খুঁটিতে রাখা হাত আপনা আপনি কখন মুঠো হয়েছে তার জানা নেই।সে তার স্বামীর মতো উচ্চ শিক্ষায় তো ভালোই লেখাপড়াই করেনি। কোন রকম নিজের নাম সাক্ষর করতে পারে। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও সংসারিক যাবতীয় বিদ্যা তার ভালো জানা আছে। তাই সে এইটুকু জানে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো বয়ে আনে না। তার মধ্যে মায়ের মন। বড় ছেলে তার এখনো বড় ছেলেই আছে। এই আগুর ধরা রুপ না আবার তার ছোট ছেলেকে কেড়ে নেয়।

আনতারা মুর্শিদার সংসারে প্রবেশ করল বিনা বরণে। এমন নজির এই গ্রামে কমই হয়েছে। যার কোন সামার্থ্য না থাকে সামন্য চিনি মুখেও বউ বরণ করে। তবে আজ সব থাকতেও আবসারের কঠিনে কিছুই হলো না। একদিকে আনতারাকে আজাদের রুমে নেওয়া হলো আরেক দিকে ফিসফাস শুরু হলো।

এই ফিসফাসে আবসার কানও দিল না। এই জীবনে সে বেশির ভাগ কাজই করেছেন সমাজের বিপরীত নিয়মে। এই আর নতুন কি?

গ্রামের সবাই ফিসফাস করতে করতেই বেরিয়ে গেল। এই প্রথম অলি আবসারে উঠান থেকে মানুষ কালো মুখে বেরুলো। মুখ কালো করে বের হলেও সবার মুখে এক কথা। একেবারে চান্দের লাহান বউ। আসমানের পরীও এর কাছে ফেল খাইয়া যায়। কারো কারো কাছে চান্দের মতো হলেও মুরব্বিদের মধ্যে কেউ কেউ বিস্ময়ে বাক্যহারা হল। কেননা তারা অনেকেই আনজুমকে দেখছে। তাই তারা আনতারাকে দেখে বাক্যহারা হলো। তবে এই বিষয়ে কেউ টু শব্দও করল না। কেনানা আগের অলি আবসার আর এখন অলি আবসারের অবস্থার মধ্যে আকাশ পাতাল তাফাৎ। আর তারা যদি এই খারাপ রক্ত নিয়ে ঘর করবার পারে, করুক। তাদের কি?

সবাই যে যার মতো বেরুলো। এদিকে রুমে আসতেই আনতারার গায়ে আবার উথাল পাথাল জ্বর এলো। শবনম ভয় পেল। শরীর থেকে যেন আগুনের তাপ বের হচ্ছে। শবনম নিজেই মাথায় পানি দিলো। কিছু খাওনের চেষ্টা করল। কিন্তু এই মেয়ের তো হুশই নেই।

আর ঐদিকে যার বউ তার খবরও দেখা গেল না। সে অন্ধকারে নির্জনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ মুখ কুঁচকে সিগারেট খেলো। তারপর বাড়িতে ঢুকে তার রুমে মানুষের মেলা দেখে, সে সোজা চলে গেছে তার দাদা ভাইয়ের রুমে। সারাদিন গায়ে বৃষ্টির পানিতে ভেজা। তারও জ্বর জ্বর ভাব। তাই সে আর ডানে বামে না দেখে দাদার পুরোনো খাটে ধপাস করে পড়ল। আর সব সময়ের মতো তার দাদার স্মৃতি মাখা আদরের খাট চিৎকার করে উঠল।

চলবে…….