বিষাদ বৃক্ষ পর্ব-০৮

0
38

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৮

আনতারার ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। আযান পড়ছে। মসজিদ হয়তো আশে পাশেই। শব্দটা তার কাছে খুব কাছে মনে হলো। অবশ্য প্রচন্ড নিস্তব্ধতায় অনেক দূরের শব্দও কাছের মনে হয়।

সে আযান শুনতে শুনতেই পাশ ফিরলো! তার পাশেই সুন্দর পরিপাটি ভাবে গুছিয়ে মাঝারি গড়নের একটা মেয়ে শুয়ে আছে। এই মেয়েটা সম্ববতো তার বড় জা। কালকে যখন ধরে রুমে আনলো তখন শুনলো।

সে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েটাকে দেখতে খুব মায়াবী লাগছে। ছোট একটা বাচ্চার মতো। তারপর সে আস্তে আস্তে উঠে বসলো। তার বাথরুমে যেতে হবে। এই বাড়ির বাথরুম কোথায় সে জানে না। জানার কথাও না। কালকে সারা দিন না খাওয়া। তার মধ্যে জ্বর। দিন দুনিয়া কোন হুশ’ই ছিলনা, তাই বাথরুমের প্রয়োজনও পরেনি। তাই কোথায় সে জানে না। অবশ্য জেনেও লাভ হতো না। সে বরই ভীতু মেয়ে। এমনিতে ভীতু না। তবে অন্ধকার দেখলেই তার ভয় করে। তাদের রুমের পাশেই বাথরুম ছিল। তবুও রাতে যতবার বাথরুমে যেত বাবাকে ডেকে সজাগ করে যেত। দরজা তো ভুলেও লাগাতো না। এখানে কি করবে কে জানে।

সে চুপচাপই বসে রইল! বসে বসে পুরো ঘরে চোখ বুলালো। বরই এলোমেলো একটা রুম। রুমে এই বিশাল সাইজের খাট ছাড়া একটা পড়ার টেবিল। যেখানে বর্তমানে দুনিয়ার হাবি জাবি, যার মধ্যে কাগজ, খাতা এমনকি চেয়ারসহ কাপড়ের বিশাল স্তুপ । তার সামনেই একটা কাঠের এক পাল্লার আলমারি, তার পাশেই একটা আলনা।

এলোমেলো কোন কিছু তার দেখতে ভালো লাগে না। মা না থাকায় ছোট বেলা থেকেই যতটুকু পরে নিজের কাজ নিজে করত। বড় হওয়ার পরে তো বলতে গেলে সবই সে।

আনতারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! এই অগোছালো ঘরটা সম্ববত ঐ লোকটার রুম। যার কোলে সে গতরাতে চড়েছিল। ভ্যানের সামনে যখন গেল, তখন শুনলো। যে কিনা বর্তমানে আনতারার বর। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আবার শবনমের দিকে তাকালো। তার সত্যিই এখন বাথরুমে যাওয়া দরকার।

সে ভাবতে ভাববেই একটু নড়েচড়ে বসল। এখন বৃষ্টি নেই। কোন পোকা ঝি ঝি করে ডাকছে। মাঝে মাঝে ব্যাঙের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। সে এর আগে কখনও গ্রামে আসেনি। তাই তার কাছে সব নতুন, সব অপরিচিত।

তখনি শবনম নড়েচড়ে উঠল! একটু চোখ খুলে আনতারাকে বসে থাকতে দেখে ফট করে উঠে বসলো। বসে চিন্তিত ভাবে বলল,
— কি হইছে?

আনতারা আস্তে করে বলল, — বাথরুমে যাব।

আনতারার আস্তে শবনমের কাছে নাই বরাবর। সে ভ্রু কুঁচকেই বলল, — কি হইছে?

আনতারার কন্ঠ সব সময়ই নিচু। কথা বলে মিহি সুরে। এর জন্য বাবা কত রাগ করত। করে বলতো, — তোর খাওয়া-দাওয়া যায় কোথায় বলতো। না আছে শরীরে শক্তি, না আছে গলায়। আমি ছাড়াতো তোর কথা ঠিকমতো কেউ বুঝবে কিনা সন্দেহ।

আনতারার অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলে গেল। খেলতে খেলতেই আবার মিলিয়ে গেল। কেননা তখনি মনে পড়েছে তার বাবা নেই। তার এই ছোট্ট জীবনে শুধু বাবা, আর বাবা। এই বাবাকে সে ভুলবে কি করে? সে মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলে আগের মতোই বলল — বাথরুমে যাব।

শবনম এবার বুঝল। ঘুম জড়ানো চোখেই হেসে ফেললো। হেসে বলল, — তো ডাকবে না? এভাবে বসে থাকলে হবে। বলেই সে খাট থেকে নামলো। নামতে নামতে বলল। এই বাসায় সবই ঠিক আছে। তবে বাথরুম নিয়ে প্যারা। এতো বড় বাড়ি। বাথরুম করেছে এক সাইডে। রাত বিরাতে জ্বালা। আর সবচেয়ে বড় জ্বালার কথা আর কি বলবো। বলেই শবনম খিলখিল করে হেসে ফেললো।

আনতারা তাকিয়ে রইল। গ্রামের দিকে বাথরুম একটু দূরে দূরে থাকে। এটা সে জানে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্বালা কি, সে বুঝতে পারল না।

শবনম আনতারর অবুঝ চেহেরার দিকে তাকালো।ইশ এতো সুন্দরও যে কেউ হয়, সে জানতো না। গ্রামের মেয়েরাও ফর্সা হয়। তবে আনতারাকে দেখলেই মনে হয় আকাশের ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের মতো। কোমল, নরম। দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করে।

সে নিচু হয়ে হারিকেন হাতে নিলো। একটু বৃষ্টি হলেই ক্যারেন্ট শেষ। আর কাল রাতে হয়েছে দুনিয়ার ঝড়। এখন কখন আসে কে জানে? এই মেয়ে মনে হয় টেরও পাইনি। পাবে কিভাবে? জ্বরে বেহুশ। অর্ধেক রাত পর্যন্ত দাদাভাই এই রুমেই বসা। একতো এতো লম্বা যাত্রা তারপরে আবার এভাবে বসা। বাবা এসে বলতে গেলে জোর করে নিয়ে গেছে ।

সে হারিকেন হাতে নিয়ে বেরুতে বেরুতে বলল, — সবচেয়ে বড় জ্বালা সেটা তুমি এমনিতেও দু- একদিনের মধ্যেই টের পাবে। এখন এতো মাথা ঘামাতে হবে না আসতো।

আনতারার গায়ে সাদা লম্বা কামিজ। ওড়না দিয়ে সে ভালো ভাবে ঘোমটা দিলো। আজ তার শরীরটা ভালো। বলতে গেলে এই কয়দিনের তুলনায় অনেক ভালো। কেমন যেন ঝরঝরা লাগছে। কেন লাগছে কে জানে? সে শবনমের পিছু পিছু গেল। এই আধো আলো, আধো অন্ধকারে বাড়িটাকে তার কাছে অন্যরকম লাগছে।

এই অন্যরকম অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। রাতে ঝড় হয়েছে। বাথরুমে যেতে হয় এই বাড়ির লম্বা টানা বারান্দায় দিয়ে। অবশ্যই এই বাড়ি এমন ভাবেই করা হয়েছে। যেন সব রুম থেকে সহজেই বাথরুমে যাওয়া যায়। বারান্দায় হাফ ওয়াল বাকিটুকু লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো। তাই বারান্দা ভরা এখানে ওখানে পানি। বৃষ্টির ঝাপটা এসে জমা হয়েছে। সে পানিই অন্ধকারে আনতারা খেয়াল করেনি। পা রাখতেই ধপাস করে পড়ল।

পড়তে দেরি তবে শবনমের আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিতে দেরি হয়নি। তার চিৎকারে বাড়ির সবাই ধড়ফড়িয়ে উঠেছে। সবার আগে বেরিয়ে এলো আজাদ। রাতে সে ঘুমিয়েছে দাদার রুমে। দাদার রুম বাথরুমের সবচেয়ে কাছে। বৃদ্ধ মানুষ যাতে সহজেই আসা যাওয়া করতে পারে।

সে বাইরে এসে দেখলো। শবনম আনতারাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। আনতারা কোমরে হাত রেখে চোখ, মুখ কুঁচকে আছে। হাঁটার মধ্যে ধপাস করে পড়েছে। মনে হয় ভালো ব্যথা পেয়েছে।

মুর্শিদা বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো। এসে সেও ধরল। ধরতে ধরতে বলল, — চোখের মাথা খাইছো। নিচের পানি চোখে দেখ নাই। কি পুতের বউ তার কপালে রাখছে। আজকে এইডা ধপাস করে পড়ে কালকে ঐটা ধপাস করে পড়ে।

শবনম সাথে সাথে লজ্জা পেল। অবশ্য পাওয়ারি কথা। সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য দূরে। বাড়ি ভরা মানুষ, ফরজ গোছল করতে হলে উঠতে হয় ভোরে। আসাদ তো তাকে জীবনেও কোন কিছুতে সাহায্য করবে না। সেই দিন গোছলে এসেছে আর ক্যারেন্ট গেছে। সেও অন্ধাকারে ধপাস করে পড়েছে। মুর্শিদা হয়তো নামাজের জন্য উঠেছিল। তার কুঁকানির শব্দে দৌড়ে এসেছে। এসেই টেনে তুলছে। আর তার সাথে করেছে ইচ্ছেমতো তুলোধুনো ।

আনতারাকে তুলে মুর্শিতা বিরবির করতে করতে চলে গেল। তার সাথে সবাই’ই গেল। শুধু আজাদ বাদে। মুর্শিদা যেতেই শবনম আজাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বেচারা ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসেছে। তাও ভালো এসেছে, তার জনতো এই সাইড দিয়ে গায়ের হয়ে গেলেও নিজের দরকার ছাড়া বের হবে না। এই যে সবাই বের হয়েছে, তার খবরও নেই।

সে মুচকি হেসেই আনতারাকে ছেড়ে এগিয়ে আজাদের হাতে চিমটি কাটলো। আস্তে না বেশ জোরেই। এর গন্ডারের চামড়া। টু শব্দও করবে না। সে কেটে যেতে যেতে বলল, — নিন দেবরজি নিজের বউয়ের ঠেলা নিজে সামলান। অনেক হয়েছে আরামের ঘুম। বলেই সে চলে গেল।

আজাদ স্বাভাবিক ভাবেই হাই তুললো। আনতারা কোমরে হাত দিয়েই চোখ, মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। কোন দিকে যাবে বলে দিলেই হতো। সে নিজেই চলে যেত। বলেই সে আজাদের দিকে তাকালো। এই প্রথম সে এই লোকটাকে স্পষ্ট দেখলো। লম্বা গড়নের কঠিন চোয়ালের একটা মুখ। অবশ্য কঠিন নাও হতে পারে। তার কাছে তার বাবা ছাড়া বাকি সবাইকে কঠিন মনে হয়। গায়ের রং কালো। মাথায় এলোমেলো এক গুচ্ছ চুল। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। আনতারা যদি এই লোককে হঠাৎ দেখতো তাহলে ভয় পেয়ে যেত। অবশ্য সে প্রায় সব কিছুকেই ভয় পায়। এর জন্য বাবা কত হাসতো।

বাবার কথা আবার মনে পড়তেই তার মন আবার আদ্র হয়ে এলো। অবশ্য প্রকাশ করল না। আদ্রতা ভেতরে দমিয়েই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আনতারা অবশ্য জানে না। তার ভেতরে দমানো আদ্রতার কারণে তার চিকন নাক ফুলেছে, ফর্সা মুখ গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে।

আজাদ সেই গোলাপি বর্ণ মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হারিকেন হাতে উঠিয়ে সাইড কেটে এগিয়ে গেল। কল চেপে নিজেই বালতি ভরলো। ভরে হারিকেন, বালতি বাথরুমের সামনে রেখে চলে গেল।

আজাদ যেতেই আনতারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। তার গা ছমছম করছে। একতো অচেনা জায়গা, তার মধ্যে অন্ধকার। সে যেতে যেতেই কেন জানি আবার পেছনে ফিরে তাকালো। আলো ফুটছে, অবশ্যই খুবই অল্প। তবুও সেই স্বল্প আলোতে বাড়ির মেইন দরজার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। আনতারার চিনতে সমস্যা হলো না। সে তার নিজের অজান্তেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

শবনম নিজের রুমের দরজায় এসে আস্তে করে হাত রাখলো। চাপিয়ে রাখা দরজা হাত রাখতেই খুললো। সে আস্তে করে ঢুকে আস্তে করে দরজা লাগালো। সবাই বলে স্বামীর বাড়িই মেয়েদের বাড়ি, স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর। সত্যিই কি তাই? এ যে এই রুম, কত কিছু এই রুমে। সে কি কোথাও আছে? এই রুমে তার প্রতিটি নিশ্বাস ফেলতে হয় গুণে গুণে। হাসতে হয় মেপেমেপে, কথা বলতে হয় দশবার চিন্তা করে। তাহলে নিজের হলোটা কিভাবে ? এই ঘরে বাকি সব আসবারপত্র যেমন দরকারি, সেই আসবার পত্রের মতোই সেও দরকারি। দরকার ছাড়া তার আর কোন প্রয়োজন নেই।

সে আস্তে করেই আসাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ছোট বেলা থেকে সে ছিল খুবই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। আকারণে পুরো বাড়ি দৌড়ানো, খিলখিল করে হাসা, মজা করা সবই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। আর বিয়ের পরে সবই দীর্ঘশ্বাস।

সে দীর্যশ্বাস ফেলেই আসাদের দিকে তাকালো। শ্যামলা বরণের মায়াবী একটা মুখ। তবে শুধু দেখতেই মায়াবী। মায়ার ছিটেফোঁটা ও নেই। সারাক্ষণ পারে শুরু চোখ রাঙাতে, আর এটা করেছো কেন, ঐটা ওভাবে রেখেছো কেন। এভাবে হাঁটলে কেন? এভাবে বসলে কেন? তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই লোকের চোখ আর মুখ বেঁধে দিতে। দিয়ে বলতে, — তুই মানুষকে বিয়ে করেছিস কেন? তুই বিয়ে করবি একটা কাঠের তৈরি পুতুল। চাবি দিবি যেমনে ইচ্ছা তেমনি নাচবে। বলেই সে নিঃশব্দে ভেংচি কাটলো।

শুধু যে এর মুখ চলে তা না। পুরো গুষ্টির চলে। বাচ্চা হবে কখন, বাচ্চা হবে কখন, বিয়ের তিন বছর হতে চললো। বাচ্চা হয় না কেন? আরে বাবা বাচ্চা কি তার হাতে? যে বাচ্চা দেবে সেই তো বাচ্চা চায় না। সে একবার অনেক সাহস করে বলল। বলবে না কেন? কথা তো আর তার শুনতে হয় না। তাই জান, প্রাণ হাতে নিয়ে বাসার সবার ইচ্ছার কথা জানালো।

আল্লাহ! এমন ভাবে তাকালো। শবনম উলটো দৌড়। দৌড় দিতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেলো। খেয়েও তার দাঁড়ানোর সাহস হয়নি। দৌড় মানে দৌড়।

এমন রাক্ষুসে জামাই আর কারো ঘাড়ে না পড়ে। বলেই সে আবার ভেংচি কাটলো। ভালো ভাবেই কাটলো। কেটে ফিসফিস করে বলল, – খবিশের বাচ্চা। সাথে সাথে সে তওবা কাটলো। আল্লাহ মাফ কর, মাফ কর। তার শ্বশুর মাটির মানুষ। মা ডাক ছাড়া তার সাথে কখনো কথাই বলেনি। তাই শুধু খবিশ। খবিশের খবিশ।

তখনি আসাদ তার ভারী হাত শবনমের পেটের উপরে রাখলো। শবনম ভয়ে খিঁচে গেল। আল্লাহ এই লোক জেগে আছে নাকি?

আসাদ এক টানে শবনমকে কাছে টানলো। । টেনে শবনমের ঘাড়ে মাথা গুজতে গুজতে বলল, — বাঁদরামি ছুটিয়ে ফেলবো বেয়াদব কোথাকার।

শবনম না নড়লো, না চড়লো। সে শক্ত হয়ে সোজা শুয়ে রইল। আর খুব আস্তে করে ঢোক গিললো। গলায় কাছে মুখ গুজে শুয়ে আছে। আবার না ঢোক গেলার জন্যও ধমকে উঠে। হুহ্!

চলবে……