#বিষাদ-বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১১
ক্যারেন্ট কখন গিয়েছে আনতারা জানে না। একটু চোখ লাগতেই গরমে নেয়ে ঘেমে ঘুম ছুটে গেল। চোখ খুলতেই সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। রুমের এক কোণে টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছে। যাক তবুও ভালো। একতো গরম তার মধ্যে অন্ধকার হলে তার দম বন্ধ হয়ে আসতো।
সে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলেই একটু নড়েচড়ে শুলো। আঁচল দিয়ে কপাল, গলার ঘাম মুছলো। বলতে গেলে সে সারা রাতই জেগে। অস্বস্থিতে তার চোখে ঘুম’ই আসে নি। অবশ্য অস্বস্থির মতো এই লোক কিছুই করে নি। চুপচাপ শুয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেছে। তবুও তার ঘুম আসে নি। জেগে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগে গেছে। সে বুঝতে পারেনি।
তখনি আযানের শব্দ ভেসে এলো। আনতারা আর ঘুমানের চেষ্টা করল না। সে ঠিক করেছে আজ থেকে নামাজ পড়বে। তার বাবা, মায়ের জন্য দোয়া চাইবে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সে ঘুমিয়েছে ভেতরের দিকে। খাটটা বলতে বেশ বড়। তিন সাইডে কাঠের কারুকাজ করা। নামার রাস্তা এক সাইড দিয়েই। আর সেই সাইডেই আজাদ শুয়ে আছে। সটান লম্বা হয়ে। এমন গরমে এত নিশ্চিন্তে কিভাবে ঘুমাচ্ছে তার বুঝ এলো না।
সে সেভাবেই কিছুক্ষণ বসে রইল। কি করবে বসে বসে কিছুক্ষণ ভাবলো। এখনো আলো ফুটেনি। বাথরুমে একা যেতে পারবে কিনাও সন্দেহ। তবে সে এই লোককে ভুলেও ডাকবে না। লোকটার সব কিছুতে হেঁয়ালির একটা ভাব আছে। যেটা আনতারা ভালো লাগছে না।
সে আস্তে করে কুঁজো হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাপড় হালকা একটু উঁচু করে আজাদকে ডেঙিংয়ে নামতে চাইল। কিন্তু কাত হয়ে মশারি তুলতে গিয়ে নিজের ভারসাম্য আর রাখতে পারল না। মশারি টশারি নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যেতে নিলো।
তখনি আজাদ ফট করে উঠে আনকারার হাত ধরে টেনে বসালো। এই মেয়ে নির্ঘাৎ মাথা মোটা। তা না হলে অন্তত এইটুকু ভাবতো হারিকেনটা কে ধরালো।
আনতারা ভয়ে শেষ। সে বুকে হাত রেখে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। সে ভয়ে খেয়ালই করল না। সে আজাদের কোলে বসে আছে।
আজাদ তো আজাদই। আনতারা খেয়াল না করুক। আজাদ আছে না মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে হাই তুলে বলল, — এ নিয়ে তিনবার। ফ্রিতে ফ্রিতে আজাদ কখনো কিছু করেছে বলে মনে পরে না। তবে থাক! বোবা, রোগা বউ। কি আর করার।
আনতারা আজাদের দিকে তাকালো। সে কি বলছে আনতারা বুঝতে পারল না।
— পারলে একটু দয়া করে নড়েচড়ে বসেন । হঠাৎ বসেছেন তো একটু বেকায়দায় পড়েছে । তাছাড়া দেখতে তো হাওয়া হাওয়াই লাগে। ওজন তো কম না।
আনতারা এই গরমেও বরফের মতো জমে গেল। এখন বুঝেছে যে আজাদ কিসের কথা বলছে। আর বোবা! বোবা কে? সে আর একটুও ভাবল না। তড়িঘড়ি করে মশারি তুলে খাট থেকে নামল। ডানে, বামে দেখল না। হারিকেন হাতে নিয়ে এক প্রকার ছুটে রুম থেকে বেরুলো।
বের তো হলো তবে বাথরুমে সামনে আসতেই তাকে আবার ভয় জেকে ধরল। সে ফিরে যাবে তখনি দেখলো কালকের মতো দরজার সামনে আজাদ এসে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি অবশ্য অন্য দিকে। আনতারার ভালো লাগল, সাথে স্বস্থির একটা নিশ্বাস ফেলল।
দুপুরের পরে জাহিদের নামে দোয়া পড়ানো হবে। বেশি না ছোট্ট আয়োজন। মসজিদের ইমাম সাহেব, সাথে আশে পাশের কিছু মানুষ। আনতারা সকালের খাবারের পর আর বের হয়নি। রুমেই ছিল। এখন হাটুতে মাথা রেখে জানালার পাশে চুপচাপ বসে আছে।
কিছুক্ষণ আগে শবনম ভাবি এসেছিল। বেচারী দিনভর থাকে দৌড়ের উপর। তবুও কি লাগবে না লাগবে খোঁজ নিয়ে গেছে। এই বাড়ির একেক মানুষ একেক রকম। আনতারা কাউকেই ঠিক বুঝতে পারে না। অবশ্য সব কিছুই সে একটু কম বোঝে। বাবা এ নিয়ে কত হায় হুতাশ করত। মাঝে মাঝে বলত, — আমার কিছু হলে তোর কি হবে রে তারা। এত বোকা কেন তুই।
বাবার সেই বোকা মেয়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিবেশে কি সুন্দর মানিয়ে নিচ্ছে। আনতারার চোখের কোন ভিজে এলো। টুপ করে পড়বে তার আগেই সে কেঁপে উঠল। এতটাই যে সাথে ভীষণ ভাবে চমকে উঠল। চমকে মাথা তুলতেই দেখল, আজাদ খাটের আরেক কোণে দু -হাত ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। এতো আজব মানুষ সে তার জীবনে দেখেনি।
আনতারা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলেও আজাদ ফিরেও তাকালো না। সে আনতারাকে পুরো অদৃশ্য করে, নিজের মতো কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে নিজেকে ঠান্ডা করল। তারপর ঝট করে উঠে আলমারিতে কোন গুপ্তধন খুঁজলো কে জানে। তবে পুরো আলমারির কাপড় একবার বাইরে স্তুপ, আরেক বার চালের বস্তার মতো একবারে উঠিয়ে আলমারিতে ছুড়ে মারল। মেরে ধরাম করে লাগিয়ে একটা সাদা কুঁচানো পাঞ্জাবি আর গামছা হাতে বেরিয়ে গেল।
আর আনতারা হা করে যে ভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। তার বসে থাকতে থাকতেই আবার আজাদ এল। তার গায়ে এখন সেই পাঞ্জাবি, নিচে লুঙ্গি। মাথা ভেজা, ঘাড় বেয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। সেই পানিতে পিঠের পাঞ্জাবি অর্ধেক ভেজা। এর মধ্যে গোসলও শেষ?
গোসল তো যেমন তেমন আলমারিতে তার আবার সেই বিখ্যাত তল্লাশি শুরু হয়েছে। আনতারা ঢোক গিলল। সে এই রুমে থাকলেও কোন কিছুতেই সে হাত টাত দেয়নি। দিলে আবার কি মনে করে কে জানে। তার নিজের জিনিসপত্র এখনো ব্যাগে। এসেছে পর থেকে সেগুলোর কিছু তেমন প্রয়োজন পরেনি। তাই বের করাও হয়নি। টুকটাক যা আছে তা আলনায় রাখছে। তখনি শবনম এলো। তার হাতে শাড়ি। তার শাশুড়ি দিয়ে পাঠিয়েছে। সে এসেই চোখ তুলে বলল, — আল্লাহ হচ্ছে কি এখানে?
আজাদের হাত থামলো না। দাদাভাই আজকে সবাইকে দুপুরের আগে বাসায় থাকতে বলেছে। আজাদ বেরিয়েছিল সকালে। ফিরল এখন। দেরি হয়ে গেছে।
শবনম এগিয়ে ধাক্কা দিয়ে আজাদকে সরালো। এই গরুর রুম গুছিয়ে কূল পাওয়া যায় না। গুছিয়ে যাবে দু- মিনিট পরে এসে দেখবে যা ছিল তাই। মা তো হাল ছেড়েই দিয়েছে। বিয়ের পরে নতুন নতুন সে এসে টুকটাক গোছগাছ করত। পরে সেও হাল ছেড়েছে। আসাদ আবার এমন না। এক ভাই তাল গাছ আরেক ভাই কচু গাছ। সে চোখ পাকিয়ে বলল, — কি হয়েছে?
শবনমের চোখ পাকানি দেখে আজাদ হেসে ফেললো। হেসে তার মতোই বলল, — এই পাঞ্জাবির পায়জামা পাচ্ছি না ভাবি।
— এক পায়জামার জন্য রুমে এমন ঝড় তুলতে হবে?
— জ্বি ভাবি সাহেবা। আমি গরির মানুষ। আমার সব ঝড় তুফান সামান্য একের জন্যই হবে। যদি একটু খুঁজে দিতেন। বড় উপকার হত।
শবনম হেসে ফেলল! হেসে আশে পাশে তাকালো। আনতারার দিকে চোখ পড়তেই, আনতারা সাথে সাথেই হাত উঁচু করল। আলনার দিকে আঙুল তাক করে দেখালো।
শবনমের হাসি দেখে কে। আলনার মধ্যে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। এই গরুর মনে হয় এদিকে ফিরেও তাকায়নি। সে এগিয়ে পায়জামা হাতে নিয়ে আজাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। মেরে বলল, — না দেখে বউ, না কোন জিনিস। কানা!
আজাদ পায়জামা হাতে নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হাসলো। হেসে বলল, — কানা, বোবার সংসার। খারাপ না। বলেই বেরিয়ে গেল।
শবনম অবাক হয়ে বলল, — বোবা কে?
আনতারা কিছু বলল না। তবে ঠোঁট টিপে হালকা হাসল। হেসে সে নিজেই অবাক হলো। কতদিন পরে সে হাসছে।
আমেনার শরীর আজকে মোটামুটি ভালো। তাই কিছুক্ষণ পাকের ঘরে সবার সাথে বসে ছিল। এই মাত্রই এলো। সোহাগী গিয়ে বলল, — ছোট চাচা আইছে আপনেরে ডাকে।
আমেনা রুমে এলো। আমজাদ নামাজের জন্য তৈরি হচ্ছে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। তাকে দেখে কেউ বলবে না, এক নাতির নানা সে। বরং তার মনে হলো আমজাদের বয়স দিনদিন কমছে। সে তাকিয়ে রইল। আগে মাঝে মাঝে রাতে বাইরে থাকত, আর এখন মাঝে মাঝে বাড়িতে থাকে। কতো কিছু তার এই অসুস্থ মনে উঁকি দেয়। সাথে সাথেই নিজেকে সে দমায়। তার শ্বশুরের মতো মানুষের ছেলে প্রতি এমন চিন্তা আসায় তার নিজের প্রতি নিজেরই তিরস্কার আসে।
আমজাদ গায়ে আতর মাখতে মাখতে আমেনার দিকে একবার তাকালো। চোখ ফিরিয়ে আবার আয়নার মধ্যে নিয়ে বলল, — আজকে শরীর কেমন?
আমেনা এগিয়ে খাটে বসল। বসে বলল, — ভালো।
— যেই তেল আনতে বলেছিলে এনেছি। ওখানে আছে দেখ।
আমেনা টেবিলের দিকে তাকালো। তাকিয়ে তার মন ভালো হয়ে গেল। ডাক্তার টাক্তার তো কম দেখালো না। দুদিন ভাল থাকে তিনদিনের দিন যা তাই। নাহার এক কবিরাজের কথা বলল। তার তেলে এমন নাকি রোগ নেই ভালো হয়নি। তার তো আর যাওয়া সম্ভব না। তাই আমজাদকে বলেছিল। সে মনে করে আনতেই তার সব অভিমান গলে পানি হয়ে গেল।
তখনি মিথি এলো রুমে। সে চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। ভালো করে হাঁটলেও মনে হয় নেচে উড়ে হাঁটছে। তার বাবা বাসায় থাকেনা বললেই চলে। তাই মায়ের রুমে সে যখন তখন আসে। এখন তার বাবা যে এসেছে সে জানে না। তাই তাকে দেখে মিথি হকচকিয়ে গেল।
আমজাদের সারা মুখে বিরক্তি ছেয়ে গেল। সেই বিরক্তি নিয়েই প্রায় ধমকে বলল, — এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছো কেন?
মিথি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাবাকে সে জমের মতো ভয় পায়। তার শক্ত চেহেরা দেখে আমেনা বলল, — পুলাপান মানুষ।
— কিসের পুলাপান? মুনিয়া বড় হয়নি? এই বয়সে তার বিয়ে হয়েছে।
— সবাই তো আর এক না।
— লায় দেবেনা আমেনা। লায় দিলেই পরে পস্তাবে। এক বেয়াদব বড় ভাই বানিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয় বেয়াদব যেন এই বাড়িতে আমি আর না দেখি।
মিথির চোখে পানি চলে এলো। আমেনা দেখল! দেখেই তার ভাল মনে নিমিষেই বিষাদ নেমে এলো। মুনিয়া একটু আকটু আদর পেলেও মিথি তার বাবাকে পায়নি বললেই চলে। ছেলের আশা করেছিল, হয়েছে মেয়ে । শুনে মুখটাও দেখেনি।
আমেনা বিষাদ মাখা কন্ঠেই বলল, — যাতো মা। দেখতো নাহার কি করে। আমার গোছলের পানি ঠিক করতে বল। শরীরটা যখন ভালো নামাজটা পড়ে ফেলি।
মিথি আর দাঁড়ালো না। তার ইচ্ছে করল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। তবে তার বাবা সামনে সেটা সম্ভব না। সেটাও তিনি বেয়াদবি ধরবেন। তাই মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বেরুলো। মিথি যেতেই আমজাদও বেরুলো। নামাজে যাবে সে। বসে রইল শুধু আমেনা। তার শূন্য দৃষ্টি বাইরে। দূর আজানায়। সেখান থেকে চাইলেই ফিরে আসা যায় না।
মিথি ঘর থেকে বের হয়ে তাদের বাইর বাড়িতে এলো। এখানে দুনিয়ার গাছগাছালি। সেই গাছগাছালির মধ্যে বিশাল বড় কড়ই গাছের শেকড়ের ভেতরে তার আর বিথীর বসার জায়গা আছে। সে সেখানেই চুপচাপ বসে রইল।
তখনি জহির উঁকি দিল। সে এই বাড়ির আশে পাশেই থাকে। সময় অসময় হাঁটাহাঁটি করে। আজ অবশ্য এই বাড়িতে দাওয়াত”ই আছে। তার বাবা চেয়ারম্যান দ্বিতীয় প্রতিবেশি আর সবচেয়ে বড় কথা তার চাচার সাথে বিথীর দাদার সম্পর্ক। তাই ছোট হোক বড়, দু- বাড়ির সব অনুষ্ঠানে দু- বাড়ির মানুষকে বলাই হয়।
সে উঁকি দিয়েই বলল, — মিথি নাকি?
মিথি বিরক্তি নিয়ে তাকালো। ঝাজের সাথে বলল, — চোখের গুটি বাসায় রাইখা আইছেন?
— না তা রাখব কেন?
— তাহলে জিগাইতাছেন ক্যা?
— আচ্ছা ভুল হইছে। এখন বলো মানিক জোড়ার আরেক মানিক কই?
মিথি বড় একটা শ্বাস ফেলল! ফেলে বলল, — আপনের মানিক বাড়ির ভেতরে আছে। আপনি দয়া করে সেখানে যান।
— যাব। নামাজটা শেষ হোক।
— নামাজটা শেষ হোক মানে কি? আপনি নামাজে যাবেনা না?
জহির মাথা চুলকে হাসলো। মিথি তাকিয়ে রইল। শয়তানের চেলাপেলা। তারপর আগের মতোই বিরক্তি মুখে বলল, — যা খুশি করেন তবে আমার সামনে থেকে যান।
জহির চলে যেতে নিল। আবার ফিরে এসে বলল, — তোর কি হয়েছে?
— আর যাই হোক ছেলে হয় নাই। এখন যাইবেন না ইটা মেরে আপনার চান্দি ফাটামু।
জহির তড়িঘড়ি করেই চলে এলো। এদের ভরসা নেই। দেখা গেল সত্যি সত্যিই মেরে দিয়েছে।
চলবে……