#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৭
আনতারা দুপুরের খাবার পরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। ভেজা হালকা সোনালি রঙের চুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে বালিশে মাথা রাখল। পা কিছুটা খাটের বাইরে। সবুজ শাড়ির সোনালি পাড়টা ফ্যানের বাতাসে পায়ের কাছে আপন মনে আঁকিবুঁকি করছে। তার চোখে হালকা ঘুমের তন্দ্রাভাব। তবুও সে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। সবুজ গাছগাছালির পাতার পাকে চড়ুই পাখি উড়াউড়ি করছে। দেখতে তার ভালো লাগছে।
তখনি ধরাম করে দরজা খোলার শব্দ হলো। আনতারা আজকে চমকে উঠল না, ফিরেও তাকালো না। সে জানে কে এসেছে। এই বাড়িতে ভেঙে চুরে এমন কাজকারবার একজনই করে। সবার মত দেখতে দেখতে সেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
আজাদ ঘরে ঢুকলো খুবই ব্যস্ত ভাবে। আনতারা নামক কোন প্রাণী এই রুমে আছে সে খেয়ালও করল না। সে তার হাতের জিনিসপত্র টেবিলে ছুঁড়ে গায়ের শার্ট খুলল। খুলে গামছা হাতে আবার বেরিয়েও গেল। গোসল করবে সে।
আনতারা রান্না শেষ করে একেবারে গোসলে গিয়েছে। অবশ্যই যে রকম ভয় পেয়েছে সে রকম কিছুই হয়নি। শবনম ভাবি সব দেখিয়ে দিয়েছে। সে শুধু বসে বসে রান্না করেছে। বাড়ির ছেলেরা খাবার পরে তারা খেয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে আজাদ ছিল না। সে তখন বাসায় ফেরেনি। কাল রাতে রুমে এসে আনতারা সোজা বলেছে সে তার পাশে শোবে না। এতদিন তো হাবভাব বুঝেনি। এখন ঠিক জানে মনে মনে কত শয়তানি।
আজাদের মধ্যে কোন ভাবান্তর হয়নি। সে মশারির ভেতরে ঢুকে হাই তুলে বলেছে, — আপনার যা ইচ্ছা মহারাণী। বলেই আয়েশ করে খাটে শুয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়েও গিয়েছে।
আনতারার তখন এতো খারাপ লাগলো। কেন লাগলো আনতারা জানে না। সে কি এটা আশা করেছিল, আজাদ তাকে জোর করবে? কেন করবে? তার সব ইচ্ছা, সব আবদার মাথায় তুলে রাখতো তার বাবা। এখানে তার তো কেউ নেই। আর এই লোকটা তো আরো আগে নেই।
বলেই সে চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেছে। এই ঘরে নিচে শোবে এমন কিছু নেই। তবে চাদর আছে। ইচ্ছে করলে চাদর বিছিয়ে শোয়া যায়। তবে তার ইচ্ছে করল না। সে চেয়ারে বসে টেবিরের উপর হাতে মাথা রাখল। তখনি কাগজের স্তুপের দিকে চোখ পড়ল। কিছু হিসেব লেখা। প্রথম কিস্তি, দ্বিতীয় কিস্তি। কবে কবে এসেছে গুছিয়ে হিসেব করা। সম্ববতো কোন ঔষুধ টষুধ হবে। ঝকঝকে নিখুঁত হাতের লেখা। কোন কাটা ছেঁড়া নেই। নিজে অগোছালো তবে বাকি সব কিছুতে পরিপূর্ণ গোছানো।
সে সেখানে চোখ বুলাতে বুলাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভেঙেছে একেবারে সকালে। ভেঙে আর আজাদকে রুমে দেখেনি।
কি খারাপ লোক। একটা মেয়ে বসে বসে কত কষ্ট করে ঘুমালো তার কোন হেলদোলও হলো না। আরামছে খাটে হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমালো। যখনি একটু ভাল মনে করে তখনি খারাপের আরেক রুপ দেখিয়ে দেয়।
আজাদ গোসলে যেতেই আনতারা ফিরে তাকালো! গায়ের শার্ট আলনার ধোয়া কাপড়ের উপরেই ছুঁড়ে ফেলেছে। পলিথিনে করে কি যেন এনেছে। টেবিলে উপরে ছুঁড়ে ফেলেছে। জুতো দুটো দুদিকে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই উঠে দাড়ালো। জুতো গুছিয়ে রাখল, শার্ট আলাদা করল, টেবিলের উপরের ব্যাগ গুছিয়ে সাইডে রাখল। রেখে বেরিয়ে এলো। আজাদের গোসল আর কাকের গোসল, এক’ই। ঝলক পলক পানি ছিটিয়ে দু- মিনিটের মাথায় আবার ফিরে আসবে। আসলেই আবার মাথায় কোন গিট্টু লাগিয়ে দেবে কে জানে। তাই সরে যাওয়াই ভাল।
আনতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, — এটা কি গাছ নানা ভাই?
আবসার হাসলেন! হেসে বললেন, — হিজল গাছ। এই যে চাদরের মতো বিছিয়ে আছে, এগুলো হিজল ফুল।
আনতারা নিচু হয়ে কয়েকটা ফুল হাতে তুলে নিলো। তার সাদা শুভ্র হাতে গোলাপি ফুলগুলো এতো সুন্দর লাগলো। সে নিচু হয়ে আরো কয়েকটা তুলতে লাগল। তখনি অলি আবসারের উঁচু কন্ঠ শোনা গেল, — ইব্রাহিম.. কোথা থেকে এলে?
আনতারা ফিরে তাকালো। সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি পরা একটা লোক। এই লোকটাকে সে চেনে। সেই মৃত বৃদ্ধর ছেলে। এই গ্রামের লোকগুলো এতো পাষাণ কেন? এক তো আজাদ। এতো অসভ্যমার্কা ছেলে সে কখনো দেখেনি। আর এক এ, মা মারা গেছে এক ফোটা চোখের পানিও ফেলেছে কিনা সন্দেহ। ঠিক আছে ছেলেদের চোখে পানি সহজে আসে না। তবে চোখে মুখে দুঃখের ছাপ তো পড়বে। এই লোকের মুখে তেমনও ছিল না। কি পাষাণ লোক।
সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিজের মতো আবার ফুল নিতে ব্যস্ত হলো। আজাদও খারাপ এই লোকটাও খারাপ। খারাপ মানুষদের তার ভালো লাগে না। তবে নানা ভাই ভাল। তার শ্বশুর বাবা ভালো। মা ছাড়া কখনো কথাই বলে না। এই যে আজকে সে রান্না করল। কত প্রশংসা করল। তবে চাচা শ্বশুর লোকটাকে সে বুঝে না । সব সময় মুখ কেমন কালো করে থাকে। তবে ছোট মা খুব ভালো।
ইব্রাহিম হেসে এগিয়ে এলো। জামিল তার মাথায় ছাতা ধরা। সে ইশারায় চলে যেতে বলল। বলে এগুতে এগুতে বলল, — ক্লিনিকের কাজে হাত দেবো ভাইজান। সেখানে গিয়েছিলাম। আপনি এই সময় এখানে? বলেই সে এক পলক আবসারের পেছনে তাকালো। সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা যে তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে দেখেছে। অবশ্য দেখবেই না কেন? এখানে আসতেই সবার আগে নজন তার উপরেই পড়েছে। অবশ্য তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই কাজ করত। সবুজ গাছগাছালির মাঝে সবুজ বরণ কন্যা। কারো নজর না পড়ে উপায় কি?
— ঘরে নাকি আমার বুবুর ভালো লাগছিল না। তাই হাঁটাতে নিয়ে আসলাম। বলেই আবসার ডাকলো। আনতারা..
আনতারা এগিয়ে এলো। তার আঁচল ভর্তি ফুল। সেই ফুল দু- হাতে আঁকড়ে ধরে আবসারের পাশে এসে দাঁড়ালো।
আবসার হেসে বলল, — এটা তোমার আরেকটা নানাভাই। সেই দিন এর বাড়িতেই গিয়েছিলে। ব্যস্ত ছিল তাই পরিচয় করাতে পারিনি। বিপদে আপদে আমি যেমন তোমার দাদির পাশে ছিলাম, ঠিক তেমনি এই মানুষটাও ছিল। বরং বেশি’ই ছিল।
আনতারা চোখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে তার ভেতরে অপরাধ বোধ হলো । এই মানুষটাকে সে খারাপ ভেবেছিল। সে তার মিহি সুরে সালাম দিলো। দিয়ে একটু হেসে বলল, — ভালো আছেন আপনি?
ইব্রাহিম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর সালামের উত্তর নিয়ে বলল, — ভালো।
— আপনাদের পুকুরটা খুব সুন্দর।
ইব্রাহিম হালকা হাসলো!
— আপনি তো আমার দাদিকে দেখেছেন না?
ইব্রাহিম মাথা নাড়ল।
— নানা ভাই বলে আমি নাকি দেখতে একেবারে তার মতো। সত্যিই?
ইব্রাহিম আবারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর একটু হেসে বলল, — ভাইজান কখনো মিথ্যা বলে না। তাই না ভাইজান? বলেই ইব্রাহিম আবসারের দিকে তাকালো।
আবসার শান্ত চোখে কিছুক্ষণ ইব্রাহিমকে দেখল। তারপর বলল, — মানুষ মানুষ’ই হয় ইব্রাহিম। সে হাজার চেষ্টা করলেও ফেরেশতা হবে না।
— আমার চোখে তো আপনি তাই ভাইজান।
আবসার হাসল! হেসে ইব্রাহিমের কাঁধে হাত রেখে বলল, — এখন থেকে গ্রামেই থাকবে?
— থাকবো তা না। তবে কিছুদিন আছি। ক্লিনিকের কাজটা গোছগাছ করে যাব।
— আমাদের হাই স্কুলের শিক্ষক। কামালউদ্দিন স্যার। গত রাতে মারা গেছে শুনেছো?
— আমি গ্রামের ছেলে হলেও এখন অনেক কে’ই চিন্তে পারিনা ভাইজান। তেমন ভাবে কিছু শুনিনি। তবে গঞ্জে অনেকেই বলাবলি করছিল। কিছুটা কানে এসেছে।
আবসার বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ফেলে বলল, — আসাদ আর সে এক সাথেই চাকরি করত। অনেক ভালো লোক ছিল। তার লাশ সকালে তাদের বাইর বাড়ির এক গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
আনতারার সাথে সাথেই হাত ফসকে গেল। সে এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে এদের কথা শুনছিল। যখন লাশের কথা শুনল। চোখের সামনে ভাসতেই হাত ফসকে সব ফুল নিচে গড়িয়ে পড়ল। আবসার, ইব্রাহিম দু- জনেই ফিরে তাকালো।
— মৃত্যু চিরন্তর সত্য। একে যত সহজ ভাবে নিবে ততই ভাল বুবু।
আনতারা ঢোক গিলে বলল, — লোকটা গাছে ঝুলন্ত ছিল কেন?
— আমি তো জানি না বুবু। তবে শুনেছি সে আত্মহত্যা করেছে।
— কেন?
আবসার হাসলো! হেসে বলল, — বাদ দাও বুবু! তোমার ফুল তো সব পড়ে গেল । আরো নেবে?
আনতারা বড় একটা শ্বাস ফেলল! ফেলে উপর নিচে মাথা নাড়ল।
আজাদ প্রথম লোকমা মুখে নিতেই শবনম গালে হাত রেখে মুচকি হাসলো। আজাদ দেখলো! দেখে বলল, — আমার খাওয়া কি আমার ভাইয়ের চেয়েও সুন্দর ভাবি?
শবনম ভ্রু কুঁচকে বলল, — কেন?
— এই যে খাবার মুখে নিতেই ভাবিজানের মুখ থেকে মুক্ত ঝরে পড়ল।
শবনম এবার খিলখিল করে হেসে ফেললো। এই বাসায় একমাত্র আজাদের সামনেই প্রাণ খুলে বিনা দ্বিধায় কিছু বলা যায়, হাসা যায়। সে হেসেই বলল, — আমার দেবর যে লাখে একটা। হাসি ফুটবে না তো কি ফুটবে?
— আর দেবরানী?
— সেটা তো গনার বাইরে।
আজাদ হাসলো! হাসতেই শবনম ভ্রু নাচিয়ে বলল, — খাবার কেমন?
আজাদ বুঝতে পারল না। খাবার টাবার নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। যাই দেওয়া হয়। টপাটপ খেয়ে দৌড়। একবার ভাবি দুষ্টামি করে চিনির বদলে লবন দিয়ে শবরত করে দিলো। সে তাও বুঝেনি। হাতে দিতেই ঢকঢক করে খেয়ে ফেলেছে। তবে এসব ব্যাপারে বড় ভাই খুব খুঁতখুঁতে। সে সাথে সাথেই আরেক লোকমা মুখে পুরে বোঝার চেষ্টা করল। আজকের কাহিনী কি। তবে তেমন কোন পরিবর্তন ধরতে পারল না। সব তো ঠিকঠাকই আছে।
তার অবস্থা দেখে শবনম আরো খিলখিল করে হাসলো। হেসে তালের পাখা তুলে মাথায় হালকা করে দিলো একটা বাড়ি। বাড়ি দিয়ে বলল, — আজকে সব আনতারা রেঁধেছে গরু।
— পাকের ঘর সহি সালামত আছে?
শবনম ভেংচি কাটলো। কেটে বলল, — আমি মনে ভুল শুনলাম ছোট ভাই। পাকের ঘরের জায়গায় আনতারা শোনার কথা।
আজাদ আবারো হাসলো। তবে আর কিছু বলল না। তখনি উঠানে কথার শব্দ হলো। শবনম উঁকি দিলো। দাদা ভাই, ইব্রাহিম ভাই, পাশে আনতারা। সে ইব্রাহিম ভাইয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। শবনম একটু অবাকই হলো। এই বাসায় সে এতদিন হলো এসেছে। অনেকবারই দেখা হয়েছে। তবে কখনও সালামের উত্তর ছাড়া বাড়তি কোন কথা এই লোকের মুখে শুনেনি, এমন কি কখনো চোখ তুলেও তাকায়’ই। ওরে বাবা এখন দেখো, কি মনোযোগ দিয়ে আনতারার কথা শুনছে।
সে আজাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, — তোমার বউ সামলে রেখো গো দেবরজী। দু- দুটো নানা সাথে নিয়ে ঘুরছে। কার সাথে উড়াল দেয় কেন জানে।
আজাদ হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার বিষম উঠে গেল। শবনম তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, — বউ যাওয়ার কথা শুনে এত খুশি আমি জীবনেও কাউকে দেখেছি বলে মনে পরে না।
আজাদ পানি খেলো। একটু শান্ত হতেই বলল, — দেখবে ও না ভাবি। আজাদ আজদ’ই। আর এই আজাদ কাওকে ধরে, বেঁধে রাখে না। বশ করে! আর এই বশ থেকে ছোটা এতো সোজা না।
— ওরে বাবা! দেবর যে আমার কালো জাদুর কারিগর তা তো জানতাম’ই না। কই আমাগো একটু জাদু টাদু শেখাও। যদি একটু বশ করতে পারি।
— বশতো আগেই হয়ে আছে। নতুন করে আবার কি করবে।
— কচু হয়ে আছে। ছাই জানো তুমি।
— জানা, দেখার বাইরেও অনেক কিছু আছে ভাবিজান।
— জানা যায় না, দেখা যায় না এমন জিনিস দিয়ে হবে টা কি?
তখনি আনতারা এলো। হেসে বলল, — ভাবি নানা ভাই কিছু নাস্তা দিতে বলেছে। বলেই সে হকচকালো। সে জানতো না আজাদ সবে মাত্র খাবার খাচ্ছে। সে ভেবেছে এতক্ষণে খাবার টাবার খেয়ে ঘুমে তলিয়ে গেছে। এই লোকের অসম্ভব সব কারবারের মধ্যে যখন তখন ঝট করে ঘুমিয়ে যাওয়ারও গুনও আছে।
শবনম সাথে সাথেই উঠল। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, — আমি দেখছি! তুমি দেখতো ছোট ভাইয়ের কিছু লাগবে কি না।
আনতারা মুখ গোঁজ করল। যেন এখানে এসে মহাবিপদে ফেঁসে গেছে। আজাদ দেখে হাসলো। তার খাওয়া প্রায় শেষ তবুও বলল, — খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? প্লেটে ভাত নেই চোখে দেখ না। আর কি ছাতার মাথা আজকে রেঁধেছে। মুখেই তো, তোলাই যাচ্ছে না।
চলবে……