#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৩
জহিরের ব্যাপারটায় নিষেধ হওয়ার পরে ইব্রাহিমের সাথে আবসারের আর দেখা হয়নি। অবশ্য নামাজের ওয়াক্ত ছাড়া আবসার খুব একটা বেরও হয় না। তবুও তাদের বাড়ি সামনে। ইব্রাহিম গ্রামে থাকলে আসতে যেতে একটু হলেও দেখা হয়। তবে আবসারের মনে হয়েছে ইব্রাহিম নিজে থেকেই দেখা করেনি।
সম্পর্কের সুতো তাহলে ঢিলে হচ্ছে। নাকি অনেক আগেই হয়ে গেছে। যা সে বুঝতে পারেনি। কি জানি! তার জমানা আর এই জমানায় আকাশ পাতাল তফাৎ। এই জমানার মানুষ শুধু টাকা চেনে, ক্ষমতা চেনে তবে ভালোবাসা চেনা না, সম্পর্কের সুতোর টান চেনে না। অথচ সুখে থাকার জন্য এর চেয়ে আর বেশি কিছু প্রয়োজন নেই।
ইব্রাহিমের বাবা যখন মারা গেল। তখন তাদের অবস্থা বলতে গেছে খুবই শোচনীয়। বাবার মৃত্যু যেমন তেমন আর্থিক অবস্থাও। এলাকার মানুষ যে যেমন পারছে সাহায্য করছে। আবসারও গেলেন। তবে তিনি টাকা দিলেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, — যখন মনে হবে আর পারছি না। কোন রাস্তা দেখছি না, তখন আমার কাছে এসো। ইন- শা- আল্লাহ। খালি হাতে ফেরাবো না।
ইব্রাহিম অনেক কষ্ট করেছে। মুখ থুবড়ে বার বার পড়েছে। তবুও কোন সাহায্যের জন্য তার কাছে আসেনি। কিন্তু একবার হাত পেতে একজন কেই চেয়েছিল। সে দিতে পারিনি। কিভাবে দেবে? টাকা, পয়সা, ধন, দৌলত সব দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ একজন মানুষকে তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেওয়া যায় না। অন্তত আবসার পারবে না। আর পারেওনি।
ইব্রাহিমের অনেক কথাই তার কানে আসে। এমনকি আবসার আর ভাবলেন না। কিছু কিছু জিনিস তার ভাবতে ভালো লাগে না। এই ছেলেটাকে সে খুবই স্নেহ করেন। করেন বলেই বার বার ক্ষমা করেন।
আবসার মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলল। ফেলে ধীরে ধীরে এগুলো। সে আর আহমাদ যাচ্ছে ইব্রাহিমের বাসায় । বিয়ের দাওয়াত দেওয়া দরকার। এই পর্যন্ত ছোট থেকে ছোট সব অনুষ্ঠানে এই বাড়ি কি, ঐ বাড়ি কি। কখনো কারো পক্ষ থেকেই কেউ বাদ যায়নি। তো এবার যাবে কেন? তাছাড়া সে বাঁচবেই আর কদিন। যেই কয়দিন বাঁচে না হয় সেই সবাইকে টেনে রাখুক।
আবসার এসেছে শুনেই ইব্রাহিম সাথে সাথেই বের হলো। সব সময়ের মত এগিয়ে জড়িয়ে ধরল। আবসার হাসলো। যাক কিছুটা তো আছে বাঁকি।
ইব্রাহিম ধরেই আবসারকে বসালো। বসিয়ে সেও তার পাশে বসল। বসেই জামিলের দিকে তাকিয়ে বলল, — আমার ভাইজান এসেছে। নাস্তার ব্যবস্থা কর। বলেই আবসারের দিকে তাকিয়ে বলল, — আপনার শরীর ভালো তো ভাইজান।
আবসার মাথা দোলাল। দুলিয়ে বলল, — ভালো! তোমাদের বাড়ির সব ঠিক।
— ভালো।
আবসার ইব্রাহিমের হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিল। নিয়ে কোমল সুরে বলল, — বিয়ে এটা পুরোপুরি ভাগ্যের উপরে। আমরা ভাবি আমরা দেখে, শুনে চিন্তা ভাবনা করে, তারপর সব ঠিক করি। আসলে সব ঠিক করেন উপরওয়ালা। তিনি ঠিক যেভাবে যেভাবে নির্দেশ দেন, আমরা কলের পতুল ঠিক সেভাবে সেভাবেই এগুতে থাকি। তাই মনে কোন ক্লেশ রেখ না। জহিরের ভাগ্যে বিথী নেই।
ইব্রাহিম হালকা হাসলো! হেসে বলল, — এরকম কিছু না ভাইজান। ছেলে মেয়ে থাকলে পাঁচ জায়গার পাঁচজন তো সম্বন্ধ নিবেই। তাই বলে কি পাঁচজনকেই ছেলে, মেয়ে দিতে হবে? আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি মনে কোন কিছুই রাখিনি।
— যদি না রাখ। তাহলে এই ভাইজানের দাওয়াতটা কবুল কর। সহ পরিবারে আমার খুশিতে সামিল হও।
— আপনি বলেছেন। অবশ্যই কবুল। আমি আমার পুর পরিবার নিয়ে যথাসময়ে থাকব।
আবসারের মন থেকে বড় একটা পাথর নামলো। নামতেই সে হেসে ইব্রাহিমের কাঁধে হাত রেখে বলল, — সব সময় এরকমই থেকো ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম এবার হাসল না। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। সে নিচের দিকে তাকিয়েই বলল, — আপনার জন্য আমি সব সময়ই এক ভাইজান। তবে আর কারো জন্য না। কারো না।
আনতারা আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নাকফুলটা সুন্দর। এতদিন ভয়ে হাতই দেয়নি। তবে যখন পরল, তার নিজের কাছেই ভালো লাগছে। চেহেরাও অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিন যে তার বাবার ছোট্ট মেয়েটা ছিল। সেটা আর নেই। তার শাশুড়িতো দেখেই বলেছে, যাক এতদিনে মনে হলো আমার ছেলের সত্যিই বউ এসেছে। তবে কান নিয়া করবাটা কি? এক নাক নিয়াই যে খেল দেখাইলা, দুই কান নিয়া তো দুনিয়া দেখাইয়া ফেলবা।
আনতারা কিছু বলেনি তবে ভয়ে ঢোক ঠিকিই গিলেছে। আবার কান? সেই কথা চিন্তা করে সে এখনই এক ঢোক গিললো! গিলে খাটের দিকে তাকালো। সব সময়ের মতো রাতে খেয়েই আজাদ পটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে। পড়েছে তো পড়েছে হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। আনতারার শুলে অবশ্য ঠিক ভাবে শোয়। কোন নড়াচড়া নেই। সটাং হয়ে সোজা শুয়ে থাকে। ঘুমের মধ্যেও এতো সর্তক কিভাবে থাকে আনতারা বুঝতে পারে না। অবশ্য সে নিজেও নড়াচড়া কম করে। তবুও এভাবে সটাং হয়ে সোজা নিশ্চয়ই হয়ে থাকে না।
সে এগিয়ে গেল। চেয়ার টেনে ঠিক আজাদের সামনে বসলো। তার ঘুম আসছে না। আজকাল এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। তার ঘুরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। সে তো আর এই লোকের মত ঠোঁট কাটা না। তবে তার ধারণা সে অতি শীঘ্রই হয়ে যাবে। যে লোকের সাথে থাকছে, না হয়ে উপায় কি? এই যে এখনিতো পটর পটর করে কত কথা বলে। সে কি বদলে যাচ্ছে? কি জানি?
বলেই সে গালে হাত রাখল। রেখে আজাদের মুখের দিকে তাকালো। চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পুরো মুখ ছেয়ে আছে। বড়ই এলোমেলো এই ছেলে। শুধু কাজে টাজে না। নিজের বেলাও। এই চুল, দাঁড়ি, যখন একেবারে না কাটলেই না তখন গিয়ে কেটে আসে। শুধু কি এসবে তার ক্লিনিকের কাজ ছাড়া সব কিছুতে উদাসীন।
এই যে মেহমান আসবে বলে সেইদিন সবাই মিলে পিঠা তৈরি করল। শবনম ভাবি পিঠার পুলির সাথে মরিচ ও দিয়ে দিল। দিয়ে সুন্দর মতো ভেজে দিলো আজাদের হাতে। সে ফিরেও তাকায়নি। হাতে নিয়ে পটাপট খেয়ে ফেলেছে। আনতারা হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। গোটা একটা বোম্বে মরিচ ছিল। পরে যখন ঝাল লেগেছে তখন শুধু ভ্রু কুঁচকে বলল, — পিঠা ভেতরে কিছু দিয়েছিলে ভাবি?
শবনম হেসে কান মলে বলেছে, — দিয়েছি তোমার মাথা।
আশে পাশের কোন কিছু নিয়ে এর মাথা ব্যথা নেই। এই যে আনতারা নাকফুল নাকে দিল। সবাই কত প্রশংসা করল। এই লোকের কোন বিকার নেই। খেয়ালও করেছে কিনা সন্দেহ। আবার বলে ভয়ংকর সুন্দর। তাকিয়ে দেখে কখন?
আনতারার মন ভার হলো। ভার মন নিয়েই এক আঙুল দিয়ে আজাদের বাহুতে হালকা করে একটা খোঁচা দিল। নিজের যখন ঘুম আসেনা তখন তো ঠিকিই টেনে হিঁচড়ে ঘুরতে নিয়ে যায়। তার বেলা আরামে ঘুমাবে কেন?
সাথে সাথে আজাদ খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, — বলুন আজাদের তারা বেগম।
আনতারা অবাক হয়ে গেল। আজাদ ঘুমাইনি। তো এতোক্ষণ কি ছিল? তার মানে আজাদ কখন ঘুমায় কখন জেগে থাকে সে জানেই না। সে অবাক হয়েই বলল, — আপনি ঘুমাননি?
আজাদ ঠোঁট টিপে হাসলো! তবে কিছু বলল না। চোখও খুলল না। তবে নড়ে চড়ে ঠিক হয়ে শুলো।
— আপনিতো সত্যিই খারাপ লোক।
— জানি।
— জানেন তো ভালো হচ্ছেন না কেন?
— ভালো হওয়ার কারণ নেই তাই।
আনতারা আর কথা পেল না। অবশ্য পেলেই আর লাভ কি? সে যেমন বলবে ঠিক তার মতোই উল্টো একটা জবাব আসবে। সে গাল ফুলিয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে আজাদ চোখ বন্ধ করেই বলল, — ঘুমাও আনতারা।
আনতারা তার মিহি কন্ঠে আস্তে করে বলল, — ঘুম আসছে না।
— এদিকে আস আমি ঘুম পারিয়ে দিই।
— কোথায়?
আজাদ তার হাত ছড়িয়ে দিল।
আনতারার ফোলা গাল আরো ফুললো। আজাদ এবার পুরোই হাসল। হেসে বলল, — কাল থেকে মেহমান আসা শুরু হবে। একটু সামলে থেক।
— কেন?
— তুমি অনেক কিছুই বোঝ না আনতারা।
— কি বুঝিনা?
— মানুষের চোখের ভাষা। একটা মানুষ মনের বিষ মুখের মধু দিয়ে ঢেকে ফেলতে পারে তবে চোখের টা না। তাই সবার আগে চোখের দিকে তাকাবে। তখন তুমি নিজেই বুঝবে সামনের জনের উদ্দেশ্য ভালো না খারাপ।
— আপনি বুঝেন? আপনি তো আশে পাশের কিছুই চোখে দেখেন না।
— আমার প্রয়োজন পরে না তাই দেখিনা।
— আমার বুঝি প্রয়োজন?
— হ্যাঁ।
— তাহলে উঠুন আমি আগে আপনার চোখ দেখব।
আজাদ সাথে সাথেই উঠে বসল। আসনে বসার মতো দু- হাত সটান করে হাঁটুতে রেখে আনতারার সামনে বসল। বসে সোজা আনতারার দিকে তাকালো।
আনতারা আজাদের হাবভাব দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। নিস্তব্দ এই রাতে এই হাসি আজাদের কাছে গানের সুরের মত লাগল। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, — রাত দুপুরে এভাবে হাসতে হয় না মেয়ে?
— কেন?
— ঝড় উঠে?
— কোথায়?
— আমার চোখ না দেখতে চাইলে। দেখ! তাহলেই বুঝতে পারবে কোথায়?
আনতারা ঠোঁট টিপে হেসেই আজাদের চোখের দিকে তাকালো। তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। ঘুম ক্লান্তিতে আজাদের চোখ লাল হয়ে আছে। পরে পরে শুয়েও ঘুমাইনি কেন এই লোকটা?
তখনি আনতারার ছোট্ট হ্নদয় কোণে কিছু একটা হলো। আনতারা বুঝল না। চোখও ফেরাতে পারল না। সে চোখে চোখ রেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠল। উঠে আজাদের ঠিক সামনে গিয়ে বসল। চোখের জাদুতে আনতারার কি হলো কে জানে। সে হাত বাড়িয়ে আজাদের কপালে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিল।
আজাদ চোখ বন্ধ করে ফেলল। ফেলে বলল, — আমিতো খারাপই আনতারা। এখন যদি আমি আরেকটু খারাপ হই। তুমি কি তোমার নানা ভাইকে বিচার দেবে?
আনতারা আজাদের কথার অর্থ বুঝল না। অবশ্য বোঝার সময়টুকুও সে পাইনি। আজাদ ততক্ষণে আনতারাকে জাপটে ধরেছে।
আজাদের সব কাজই হঠাৎ ঝড়ের মতো। তাই আনতারা ঝড়ের এই হঠাৎ তান্ডবে ভারসাম্য রাখতে পারেনি। পড়ে খাটের কার্নিশে মাথা লাগতে যাচ্ছিল।
আনতারা মাথা পড়ার আগেই আজাদ হাতের তালু ফেলল। আনতারা ভয়ে শেষ। সে থরথর করে কাঁপছে। অবশ্য সেটা পড়ার জন্য না আজাদের জন্য সে জানে না। আজাদের হাতের উপরে আনতারার মাথা, আর আজাদ আনতারার খুব কাছে।
আনতারার গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। সে ভয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে আবার আজাদের চোখের দিকে তাকালো। সেই চোখে আনতারা শুধু একজনকেই দেখল। আর সেটা আনতারা নিজে।
সে আর কিছু বলতে পারল না। কিছু করতে পারল না। এমনি তার মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হলো না। শুধু দেখল নেশা ধরানো একটা চোখ। সেই নেশা নিয়েই নাকফুলটার উপরে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সেই ছোঁয়া সেখানেই থামলো না। বরং ধীরে ধীরে পুরো আনতারায় ছড়িয়ে গেল। যেতেই আনতারা তার নিজের হুঁশ জ্ঞান সব হারালো।
আর যখন হুঁশ এলো। তখন সে চোখে অন্ধকার দেখল। সেই অন্ধকারে চোখ পুরোপুরি অন্ধকার হওয়ার আগে নিভু নিভু চোখে দেখল একটা মুখ, একটা মানুষ। যে তাকে পরম যত্নে বুকে আগলে নিয়ে, ফিসফিস করে বলছে, — ভয় নেই। আমি আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
চলবে…….
#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৪
গাঁও গ্রামের বিয়েতে সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই বিয়ের ধুম লাগে। আর এখানে তো বাকিই কয়েকদিন। অলি আবসারের বাড়িতেও যেন লেগে গেল আরও জাঁকজমক ভাবে। আত্মীয়- স্বজন, গ্রামের মানুষজন, হাসি – মজা, বাচ্চাদের হইহুল্লোড়ে পুরো বাড়ি মুখরিত। রান্না ঘরের উনুন চলছে অবধারিত ভাবে। হাড়িতে হাড়িতে খাবার নামছে। বিয়ের আয়োজন থেকে সব কিছু করা হয়েছে বাইর বাড়িতে। আত্মীয়- স্বজনদের কোলাহল শুধু ভেতর বাড়িতে।
আর এই এত এত হই হুল্লোড়ের মাঝে আনতারা খাবার ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। কেউ অবশ্য জানে না, সে বসে আছে সেই ভোর থেকে। তার জ্ঞান ফিরতেই একটা টু শব্দও সে করেনি। আজাদ বেশ কয়েকবার ডেকেছে। সে ঘুমের ভাব ধরে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে ছিল। আজাদ একটু বেরুতেই সে টুপ করে বেরিয়ে এসেছে।
শবনম বাড়ির বড় বউ। দু- দন্ড বসার তার সময় কই, তবুও তার নজর আনতারার উপরে ঠিক পড়ল। আনতারা এমনিতেই চুপচাপ, তবে আজকের থাকা তার কাছে অন্যরকম মনে হলো। আর তখনি সে খেয়াল করল, আনতারা সেই সকাল থেকে এখানে বসা। আর নড়েই নি। না রুমের দিকে গেছে না অন্য কোথাও। আজাদ অবশ্য তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, — ভাবি আনতারাকে দেখেছো?
সে তখন ব্যস্ত! ব্যস্ত ভাবেই বলেছে, — এদিকেই হয়তো আছে দেখো।
তার মনে কু ডাকলো! এই ভাবে সেও বসে থাকে। আজাদ ভাইও কি আসাদের মতোই হলো? সে চিন্তিত ভাবে এগিয়ে গেল। বাড়ি ভরা মানুষ। এমনিতেই বউদের যে দোষ। এভাবে বসে থাকতে দেখলে কানাকানি হতে সময় লাগবে না।
সে এগিয়ে গিয়ে বলল, — আনতারা একটু আস তো আমার সাথে।
আনতারা বিনা বাক্যকেই উঠল। শবনম খেয়াল করল, আনকারা উঠতে গিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলেছে।
শবনমের ভেতর ধক করে উঠল। সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না। আজাদ ভাই কি আনতারার গায়ে হাত তুলেছে? সে হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর কোনরকম টেনে আনতারাকে নিজের ঘরে আনলো। ঘরে দুনিয়ার পুলাপান। হুটোপাটি খাচ্ছে। তাদের সুন্দর করে শবনম বলল, — তোমরা একটু বাইরে যাওতো।
তারা যেতেই শবনম দরজা লাগালো। আনতারাকে খাটে বসিয়ে জড়িয়ে ধরল। বাবা, মা ছাড়া এতিম সন্তান। ভাগ্যর গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে এখানে ভেসে এসেছে। শবনমের স্বামীর বাড়ির কেউ না থাক। বাবা আছে, মা আছে, সুখ দুঃখ বলার মত ভাইবোন আছে। এই মেয়েটার আছে টা কে? যাবে’ই বা কোথায়?
শবনম ধরতেই আনতারা ফুঁপিয়ে উঠল। শবনমের এত খারাপ লাগল। আজাদ রে আজাদ! তোরে তো আমি ভালোই ভাবছিলাম। তুইও বংশের মতো খাটাশই বের হলি। বলেই সে সাথে সাথেই সব সময়ের মতো তওবা কাটলো। এর মধ্যে তো আবার তাদের দাদা ভাইও পরে গেল। ধুর, ধুর বকতে গিয়েই শান্তি নেই।
সে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। কিছুক্ষণ যেতেই শবনম আনতারাকে উঠালো। চোখ, মুখ মুছালো। এতোটুকুতেই লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। এই মেয়ের গায়ে হাত তুলতে আজাদের হাত কাঁপলো না? আজাদরে তোরে তো আমি দেখছি দাঁড়া। কপালগুনে এমন বউ পাইছোস। তা না হলে কালা কাউকা কোন কমলা আনতি আমিও তো দেখতাম।
মনে মনে আজাদের গুষ্টি উদ্ধার করে শবনম আনতারাকে কোমল সুরে বলল, — কি হয়েছে? আমাকে একটু খুলে বলতো।
আনতারা আবার শবনমকে জড়িয়ে ধরল। তবে কিছুই বলল না। জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে রইল। তখনি দরজায় টোকা পড়ল। শবনম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই বাড়িতে দু- মিনিট একটু শান্তিতে বসা যায় না। সে আনতারাকে আবার সোজা করল, করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল।
আজাদ দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই শবনমের গায়ে কেউ যেন লবণ, মরিচের গুড়া ছুঁড়ে মারলো। সে রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঝাঁঝিয়ে বলল, — কি চাই?
আজাদ হেসে ফেলল। হেসে উঁকি দিয়ে শবনমের পেছনে আনতানাকে দেখল। সে চোখ, মুখ শক্ত করে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাঁকিয়ে আছে। সে হেসেই বলল, — ভাবি দু- মিনিট সময় দাও।
শবনম আগের মতোই রাগ নিয়ে বলল, — দু- মিনিট কেন আধা সেকেন্ডও না।
— কেন?
শবনম আকাশ থেকে পড়ে বলল, — তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো?
আজাদ আবারো হাসলো। তখনি আমজাদ ডাকলো। বাবুর্চি এসেছে। কোথায় রান্নার আয়োজন করবে দেখিয়ে দিতে। আজাদ আর দাঁড়ালো না। আরেকবার আনতারার দিকে তাঁকিয়ে শবনমের হাতে কিছু গুঁজে চলে গেল।
শবনম ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে তাঁকালো। এই ঔষুধের পাতা তার পরিচিত। হালকা, জ্বর ব্যাথার জন্য ভালো। সে মুখ বাঁকালো। গুরু মেনে জুতো দান। বলতেই তার টনক নড়লো। নড়তেই সে আনতারার দিকে ভালো ভাবে তাকালো। গোড়া থেকে সব একটু ভাবলো। ভেবে বড় বড় চোখ করে আনতারার দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই হেসে ফেলল।
আনতারার ঘুম ভাঙল দুপুরের পরে। ভাবি খাবার ঔষুধ খাইয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেছে, আমি সবাইকে বলে দেব তুমি একটু অসুস্থ । কেউ এসে বিরক্ত করবে না। তুমি ঘুামাও।
আনতারা আর কিছু বলেনি। তার নিজেও কিছু ভালো লাগছিল না। কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। সে উঠল! খাটের বাইরে পা ঝুলাতেই অবাক হয়ে তাকালো। তার পায়ে নূপূর। নূপুরটা রুপার, তবুও তার শুভ্র পায়ে ঝিকিমিকি করছে। নূপূরটা দেখতে একেবারে বুকুল ফুলের মালার মতো। শেষে গিয়ে শুধু ছোট্ট তিনটা ঝুমকা। সেটাই হালকা করে রিনঝিন করে বাজচ্ছে ।
সে ইচ্ছে করেই কয়েকবার পা ঝুলালো। তার দেখতে ভালো লাগছে। তখনি দরজা ঠেলে ভাবি, মিথি, তাদের আরো খালোতো, মামাতো ননদরা এসেছে। সবাই ঢুকল। সবার হাতেই অনেকগুলো ব্যাগ। সেই ব্যাগই খাটে ধপাস করে রাখল। ব্যাগ ভর্তি গায়ে হলুদের কাপড়। মুর্শিদা মেয়ের বিয়ের খুশিতে সবাইকে একটা করে দিয়েছে। সেই নিয়েই তাদের যত আমোদ। কে কিভাবে পরবে, কে কিভাবে সাজবে। রুমের মধ্যেই কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজার মিলে গেল।
আনতারা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তার ঠোঁটের কোণে হাসি। অন্যদের খুশি দেখতেও তো ভালো লাগে। তখনি ধপ করে শবনম আনতারার সাইডে বসল। বসে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল, — কি খবর দেবরেররাণী?
আনতারা তার স্বাভাব মতো মাথা কাত করে আস্তে বলল, – ভালো। তাকে যে দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করা হয়ে সে বুঝেও নি।
শবনম হেসে ফেলল। হেসে বলল, — গাধী।
আনতারা নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলে, উত্তর দিলেও যে গাধী হয় তার জানা ছিল না।
শবনম আগের মতোই হাসলো! বলেই আনতারা টেনে বলল। আস! বাড়ি ভর্তি মেহমান। এখন বের না হলে, কথা শুনতে শুনতে তোমার জান বেরিয়ে যাবে।
আনতারারা বেরুলো। রুম থেকে বের হতেই আজাদের সামনে পড়ল। যেন আশে পাশেই ছিল। আনতারা তাঁকালো না। সে অন্য পাশে তাঁকিয়ে রইল।
আজাদ তার স্বভাব মত হাসল। হেসে বলল, — শুধু দু- মিনিট ভাবি।
শবনম মুখ বাঁকাল। বাঁকিয়ে বলল, — দু- মিনিট, দু- মিনিট করে করে তো মাথা খেয়ে ফেলছো। দু- মিনিটে করবেটা কি? বউয়ের ফুলো গাল চিমসা করতে করতেই তো তোমার ঘন্টা পেরিয়ে যাবে।
আজাদ আবারো হাসলো। আনতারা এতক্ষণ গাল না ফুলালেও এখন ঠিক ফুলালো।
শবনম আর তাঁকালো না। সে চলে গেল, যেতে যেতে আজাদের হাতে চিমটি কাটতে ভুললো না। শবনম যেতেই আনতারাও যেতে চাইল। তবে আজাদ সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
আনতারা কথা বলল না। সে তার ফোলা গাল নিয়েই আরেক সাইড দিয়ে যেতে চাইল। আজাদ আবার সে সাইডেও গিয়ে দাঁড়ালো। আনতারা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে এবার আজাদের দিকে তাকালো।
আজাদ তাকিয়েই ছিল। চোখে চোখ পড়তেই স্বাভাবিক ভাবে বলল, — কি হয়েছে?
আনতারা উত্তর দিল না। তার ভালো না লাগলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
আজাদ আগের মতোই বলল, — আমার নীল জিন্স কোথায় রেখেছো? সকাল থেকে পুরো ঘর তামাতামা। আমি বেরুবো। তাড়াতাড়ি খুঁজে দাও।
আনতারা এবার হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছিল আজাদ অন্য কিছু বলবে। সে মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলল। ফেলে চোখ ঘুরিয়ে আজাদের পেছনে তাকালো।
আজাদও আনতারা সাথে সাথে পেছনে ফিরলো। সে ভেবেছে কেউ এসেছে। কিন্তু আজাদ জানে না। সে পেছনে ফেরার সাথে সাথে আনতারা এই সাইড দিয়ে চলে এসেছে। সে বুঝল একটু পরেই। বুঝতেই হাসলো। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আজাদকে এই সাদাসিধে মেয়ে মাঝে মাঝে কি সুন্দর বোকা বানিয়ে ফেলে।
শবনম এতক্ষণ রান্না- ঘরে ছিল। এত মানুষের তিনবেলা রান্না কম তো না। অবশ্য সবাই হাতে হাতে করছে। করলেও বাড়ির মানুষ তো বাড়ির মানুষই। কাজের শেষ কোথায়?
সে রান্না ঘর থেকে বের হতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে সাথে সাথেই বারান্দার গ্রিল ধরে নিজেকে সামলালো। খাওয়া, দাওয়া ঠিক মত হচ্ছে না। আবার এতো দৌড়া দৌড়ি। জানে আর কত সইবে। সে কিছুক্ষণ সেই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
মুর্শিদা দেখে বলল, — হইছে কি তোমার? এমন খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে আছ ক্যা? একদিকে এ আরেক দিকে ঐ জন। সে তো পটের বিবি। রুম থেকেই বের হইল আধা বেলা পাড় কইরা। এহন আবার তুমি শুরু করছ। আল্লাহ আমার কপালে পুতের বউগো সুখ তো লেখে নাই, লেখছে শুধু জ্বালা।
শবনম কোন কথাই গা করল না। নতুন কি? শুনতে শুনতে সয়ে গেছে। সে স্বাভাবিক ভাবে বলল, — কোন কাজ আছে মা?
— কাজের কি আর শেষ আছে? সন্ধ্যা পইড়া আইল। এতো মানুষ শুইবো। বালিশ তোষকতো বাইর করা লাগবো।
— আমি দেখছি।
— হ হ তাড়াতাড়ি দেখো। বলেই তিনি ব্যস্ত ভাবে চলে গেলেন।
সে যেতেই শবনম এলো কল পারে। মুখে মাথায় একটু পানি দেবে। কলে হাত রাখতেই আসাদ বলল, — আমি দিচ্ছি।
আজকাল শবনম কিছুতেই চমকায় না। তার ভাবও আজাদের মতো হয়ে গেছে। যা হাবার হোক, যা করার করুক গে। তাই আসাদকে দেখেও তেমন ভাবান্তর হলো না। সে সরে দাঁড়ালো। আসাদ কল চাপ দিতেই সে নিচু হয়ে চোখে, মুখে মাথায় পানি দিল।
আসাদ নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, — কি হয়েছে?
শবনমও তার মত শান্ত স্বরে বলল — কিছু না।
— খেয়েছো কখন?
শবনম এবার হেসে ফেলল। অবশ্য সাথে সাথেই নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। তার হাসিতো আবার এই লোকের সহ্য হয় না। আর ধমক খাওয়ার মত মনমানসিকতা এখন তার নেই। সে ফিরিয়েই আঁচল দিয়ে মাথা মুখ মুছলো। মুছে আসাদকে সাইড কেটে বেরুলো চাইল। কাঁথা বালিশ বের করতে হবে।
আসাদ হাত টেনে ধরল। শবনম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এই বাড়ির মানুষদের হয়েছেটা কি? নতুন নতুন রুপ দেখাছে। এই যে তার আজবগজব দেবর। যার কোন কিছুতেই কোন ভাবান্তর হয় না। আজ সেই দেবরই সকাল থেকে তার রুমে চক্ককর’ই কেটেছে হাজার বার। আনতারা ঘুমে ছিল তাই সে জানেনা । আর এই দিকে তার জন। জীবনেতো বউর খোঁজ খবরও নেয় নি। রুম থেকে বের হলেই কাজ ছাড়া বউকে চেনেই না। তো আজ কি হলো? সে ভ্রু কুঁচকেই বলল, — কিছু লাগবে ?
— আমি বালিশ কাঁথা বের করছি। তুমি যাও কিছু খেয়ে নাও।
শবনম এবার সত্যিই অবাক হলো। মাগো! সে আবার স্বপ্ন টপ্ন দেখছে নাকি। নাকি মাথা ঘোরার কারণে উল্টা পাল্টা দেখছে। সে অবাক চোখেই কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইল। ভর সন্ধ্যা! বাথরুমের সাইড। এটা সত্যিই তার শাশুড়ির গুনধর বড় পুত্র তো?
আসাদ শবনমকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রায় ধমকে বলল — কি হয়েছে?
শবনম থতমতো খেল। এই তো চলে এসেছে তার শাশুড়ির পুত্র। সে মনে মনে মুখ বাঁকিয়ে চলে এলো। এই বাড়ির মানুষের কত রুপ দেখার বাকি আছে কে জানে। জীবন তো না সিনেমা। দিন যাইতেছে একেক জনের একেক নতুন নতুন রুপ বের হচ্ছে।
সে যেতে যেতেই মিথিকে দেখল। সে এক কোলে মুহিন আরেক হাতে ব্যাগ নিয়ে এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। রোগা পটকা মেয়ে। মুহিন, ব্যাগ নিয়ে তার বড়ই করুন অবস্থা। তবুও সারাদিন কোল থেকে নামাবে না। তার এতো হাসি পেল। সাথে সাথেই সে খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই তার চোখ আসাদের উপর পড়ল। আসাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত হলো। এই বুইড়া ব্যাটার হঠাৎ করে হলোটা কি?
মিথি এসেছে দরজির দোকানে। তার জামা ব্লাউজ হয়েছে দুনিয়ার ঢিলা। দিয়েছে এক মাপ, করেছে আরেক মাপের। সে ঠিক করতে দিয়ে বেরুতেই জহিরের সামনে পড়ল। আগের জহির ভাইয়ের সাথে এই জহিরের কোন মিল মিথি খুঁজে পেল না। এই অল্প কদিনেই একেবারে অপরিচিত লাগছে। সে মুহিনকে কোলে নিয়েই এগিয়ে গেল।
জহির তাকে দেখল। দেখে কোন কথা বলল না। সাইড কেটে চলে গেল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। মিথি অবাক হলো। পছন্দ করেছে নিজে, প্রেমে পড়েছে নিজে, তার পছন্দের সাথে তার বিয়ে হয়নি। এখানে মিথির দোষ কিরে বাবা?
আজবতো? কত উপকার করল। উপকারের আজকাল দামই নাই। হুহ্! এই মিথি সাদা মনে কালো দোয়া দিল। বিনা দোষে বিরক্ত দেখালি তো। এই জীবনে এই ছ্যাঁকাই তোর শেষ না। ছ্যাঁকা খেতে খেতে ভুট্টার খই হবি। আর জীবনে যদি বিয়ে করিস, বউর পিছনে পিছনে লাটিমের মতো ঘুরবিরে ব্যাটা তবুও মন পাবি না। সারা জীবন কই মাছের মতো মাথা পাছা নিয়ে একসাথে তড়পাবি তবুও পানির দিশা পাবি না।
চলবে…….