#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপূর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৪
জামিল মুখে পান পুরে ইব্রাহিমের হোটেল থেকে বেরোলো। বেরুতেই আজাদকে একটা গালি দিল। এই শালার জন্য যত দৌড়াদৌড়ি। এই দৌড়াদৌড়িতে সব কাজ গুছাতে গুছাতে দুনিয়ার রাত হয়ে গেছে। রাস্তা ঘাট সব প্রায় ফাকা। এখন এত রাতে খালি বাসায় ফিরে সে করবেটা কি? তার চেয়ে ভালো রহিমার দোকানে যাওয়া যাক। অনেক দিন পেটে বাংলা পরে না।
সে রাস্তায় নেমে একটু এগিয়ে সাইডে একটু নিচু হয়ে পিক ফেললো। ফেলে সোজা হতে না হতেই মাথায় কালো কিছু একটা পেঁচিয়ে গেল। পেঁচাতে না পেঁচাতেই কেউ তাকে গাড়ির ভেতরে ছু্ঁড়ে ফেলল।
জামিল গাড়িতে বসে কোন ছটফট করল না। এখন তার সাথে কি হবে সে জানে। না জানার কিছু নেই। জীবনে আয়ুর চেয়ে শত্রু বানাইছেই বেশি। তার মৃত্যু এমন কোন ভাবেই হবে সে জানে। তাছাড়া এমন কাজ সে অহরহ’ই করেছে। নিশ্চুপ রাত, এখন এ গাড়ি যাবে সোজা বুড়িগঙ্গায়। ব্যস গলার নিচ থেকে ছোট্ট একটা টান। তারপর বস্তায় ভরে কয়েকটা ইটের সাথে বেঁধে টুপ করে ফেলা দেওয়া। খোঁজ নেই, লাশ নেই, খুনিও নেই।
তার ধারণা মতো সত্যিই সত্যিই গাড়ি নদীর পারে এসে থামলো। মুখের উপরে কালো পলিথিন থাকলেও গায়ে শীতল বাতাস লাগতেই সে বুঝল। আহা শরীর! কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হবে লাশ। তার না থাকবে বোধ, না থাকবে শক্তি।
সে সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করল। আর আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল। মনে করার মত তার কোন স্মৃতি নেই। আহারে একটা জীবনই বৃথা গেল।
তখনি মুখের উপর থেকে কালো পলিথিন সরে গেল। জামিল চোখ খুলল। খুলতেই সে অবাক হয়ে তাঁকালো।
তার একটু দূরে একটা অল্প বয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। টিংটিয়ে লম্বা চিকন শরীর। দৃষ্টি নদীর দিকে। নদীর মৃদু বাতাসে তার এলোমেলো চুল উড়ছে।
এই ছেলেটাকে সে চেনে। কামাল উদ্দিন স্যারের ছেলে। ক্লিনিকের জায়গা নিয়ে অনেক কে’ই সে দমন করেছে। তার মধ্যে বেশি লাফালাফি করেছিল কামালউদ্দিন। এমন কি তারাই যে গেঞ্জাম লাগিয়ে তাদের লোক দিয়েই মাথা ফাটিয়ে, তাই নিয়ে এই বদ পুলিশের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছিলো। তাই দিছে সোজা ঝুলিয়ে। তো এই ছেলে এখান পর্যন্ত কিভাবে এলো?
সে সাথে সাথেই ডানে বামে একবার তাঁকালো। বেশ কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বিকার ভাবে। এদের বয়স এই ছেলের মতো অল্প না । বরং ভালোই বড়। আজাদ কাছাকাছি বা সমবয়সী হতে পারে। এদের অবশ্য সে চিললো না। তবে বুঝলো এরা শহরের না, গ্রামের ছেলে পেলে।
জামিল তার অবাক কন্ঠেই বলল, — শহরের ঠিকানা তুমরা কই পাইলা?
ছেলেটা ফিরে তাঁকালো। অল্প বয়েসি ছেলে তবুও চোখ মুখ কি শান্ত। সে সেই শান্ত শীতল কন্ঠে বলল, — আজরাইয়েল ঠিকানা লাগে না। সময় হলে তারা নিজের গন্তব্যে ঠিক সময়ে ঠিক মতোই পৌঁছে যায়। যেমন আগে আপনি পৌঁছাতেন।
জামিল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তার কাছে এখন সব পরিষ্কার। এর পেছনে একজনই। আজাদ। গোডাউন তো বাহানা। শুধু মানিক জোড়া আলাদার বাহানা ছিল। কাউকে শেষ করতে চাইলে আগে তার শক্তি ভাঙো। ভাইজানের ডান হাত সে, স্বাভাবিক তাকেই তো ভাঙবে আগে।
জামিল বড় একটা শ্বাস ফেললো। গ্রামের ছেলে লেখাপড়া করেছে শহরে। দু- সাইডেই সমান তালে ছড়িয়ে আছে। অথচ কত সহজ ভেবেছে তারা। আরামছে জাল বিছিয়ে জেলে গিয়ে বসে আছে। আত্মহত্যার কেস। জোরালো প্রমাণ নেই। কিছুদিন পরে অনায়াসেই বেরিয়ে যাবে। এখন যা হোক, যাহা হোক তার নাম আগেও ছিল ফকফকা এখনো ফকফকা।
সে বিরক্তে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, — এতো কাহিনী ভালো লাগছে না। মারতে চাইলে মার। এতো ঢং কিসের?
ছেলেটা এবার হেসে ফেললো! হেসে পকেট থেকে কয়েকটা ব্লেড হাতে নিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে করতেই বলল, — মৃত্যু এতো সোজা নাকি রে জামিলা। মৃত্যু সে তো অনেক সাধনার।
জামিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ছেলেটা তার চেহেরা দেখে বলল, — উঁহু এতো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে তুই এমনিতেই বুঝতে পারবি। মানুষ বাঁচার জন্য ছটফট করে। তুইতো করবি মরার জন্য। হেসে হেসে মানুষকে লাশ বানিয়েছিস। নিজে এতো সহজে লাশ হলে হবে?
জামিল একবার ছেলেটার হাতে, একবার মুখের দিকে তাঁকালো। তাঁকিয়ে ঢোক গিলল। এতক্ষণ ভয় না পেলেও এখন তার গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো।
ছেলেটা জামিলের ভয় মাখা মুখ দেখে আবার হাসলো! এ হাসিকে অবশ্য মানুষের হাসি বলা যায় না। জামিল এক সময় ভাবতো আজরাইল হয় দেখতে খুবই ভয়ংকর। আসলে ভয়ংকর আজরাইল হয় না, হয় যার যার কর্ম। আর এই কর্মের কারণেই এই সাধারণ চেহেরার ভয়ংকর আজরাঈল আজ তার সামনে।
ছেলেটা হাসতেই তার দু- সাইডে দাঁড়ানো ছেলেগুলো তাকে জাপটে ধরল। তাদের মধ্যে থেকে একজন তার মুখ জোর করে হা করালো। জামিল ছটফট করতে লাগলো।
কামালউদ্দিনের ছেলে টুকরো করা ব্লেডগুলো হাতে নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, — আমার বাবাকে যখন গাছে ঝুলিয়েছিস তখন নিশ্চয়ই সেও এভাবে ছঠফট করছিল। তারপর আমার মা, আমি, আমার পরিবার। সবার ছটফটানির আজ সমাপ্তি হলো।
জামিলের নিখোঁজ সংবাদ ইব্রাহিম পেল তারপরের দিন বিকেলে। শহর থেকে তার আরো কিছু লোক এসেছে। তাদের ভাষ্যমতে সব কাজ টাজ গুছিয়ে বাসার উদ্দ্যেশ্য রাত দেড়টার দিকে সে হোটেল থেকে বেরিয়েছে। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ইব্রাহিম কিছুই বলল না। তবে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। তার ধ্যান ভাঙালো ইকবাল এসে। বাসায় পুলিশ এসেছে।
ইব্রাহিম বসার রুমে এসে বসতে বসতে বলল, — মারা গেছে ক্লিনিকে, মারা যাওয়ার প্রমাণ আপনাদের হাতে, কারণ আপনাদের কাছে। তো এখানে আসার কারণ আমি বুঝতে পারলাম না দারোগা সাহেব ?
খালিদ হাসলো! হেসে শরীর এলিয়ে আরাম করে বসতে বসতে বলল, — কি করব চাচাজি। আপনারা দু- দিন পর পর কাজই এমন করেন। কিছুদিন আগে জমি নিয়ে করলেন। তারপর করলেন স্যারকে নিয়ে। এখন আবার কি শুরু করছেন কে জানে?
— যাই করি তোমাদেরতো খুশি করেই করছি। তো এখন এখানে কি?
— রাফিয়ার হ্যান্ড রাইটিংয়ের সাথে চিঠির হ্যান্ড রাইটিং মিলে নি। মিলেছে আপনার ডান হাত জামিলের সাথে। জমি নিয়ে সব ঝামেলা সে’ই তো হ্যান্ডেল করল। তার হাতের লেখার অনেক কিছুই আমাদের কাছে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন আগেই নাকি রাফিয়া খুশি মনে নিজে থেকে ইস্তফা দিয়েছে। তার সব ডকুমেন্ট আজাদের ক্লিনিকের ডিউটি ডাক্তার পরিমল বাবু আমাদের দিয়েছেন। তো চাচাজি, মৃত্যুর আগের দিন রাফিয়ার আপনার বাসায় কি কাজ ছিল? এমনকি সারা রাত এখানেই ছিল। সকালে আপনার ডান হাত জামিলের সাথেই সে বের হয়েছে এবং ডান হাতের সাথেই ক্লিনিকে গিয়েছে। ক্লিনিকের আশে পাশে দোকানের অনেকেই দেখেছে। তো তার সাথে এতো মাখামাখির কারণটা যদি একটু খোলাসা করতেন, আমাদের আপনাদের বড় সুবিধা হতো।
ইব্রাহিম হাসলো! হেসে বলল, — কত টাকা খেয়েছো খালিদ?
খালিদও হাসলো! হেসে বলল, — গলা পর্যন্ত টাকা খাওয়ানো পার্টি এই গ্রামে শুধু আপনারাই। এরা খেল খেলতে উস্তাদ। দু- বছরের উপরে এই এলাকায় আছি। আপনাদের কাছে খবর না থাকলেও আমাদের কাছে ঠিক থাকে। আরো দু- বছরের মতো এখানেইতো থাকতে হবে। তো, পাঙ্গা নেব কোন লাভে?
— সোজা কথা বলো খালিদ।
— সব তো সোজাই বললাম।
— এখন কি করতে বলছো?
— কিছু করে লাভ হবে বলে মনে হয় না। আজাদকে ছাড়তে হবে। রাফিয়ার ভাই নিজে এসেছে, আর সে নিজে সাক্ষী দিয়েছে। আজাদের সাথে বর্তমানে রাফিয়ার কোন সম্পর্ক ছিল না। শুধু কাজের সম্পর্ক। সে তার বোনের খুনিদের চায়? যদি এখানে না হয় সে শহর থেকে ব্যবস্থা নেবে। এখন আমাদের কি? চাকরিতো বাঁচাতে হবে নাকি?
— তার বোনের খুনি কি আমি?
— সেটা আপনি জানেন, আমি জানি বাকি সবাইতো দেখবে প্রমাণ।
ইব্রাহিম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসল। বসে ইকবালের দিকে তাঁকালো। তাঁকাতেই ইকবাল ভেতরে গেল। ফিরে এলো ভারি একটা ব্যাগ নিয়ে। সেটা দারোগার সামনে রাখলো। রাখতেই ইব্রাহিম বলল, — রাফিয়া কে আমরা চিনি না। এতক্ষণ যা বলেছো এমন কিছু হয়ই নি।
দারোগা হাসলো! সে ব্যাগে হাত দিল না। দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, — চাচাজি এই চার দেয়ালের ভেতর থেকে একটু বের হন। এলাকায় একটু কান পাতেন। পুরো এলাকায় আপনি এখন মহানায়ক। যে এই শেষ বয়সে এসে হাঁটুর বয়সি একটা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে করেছেন। সারা রাত একসাথে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমন করতে তাকেই খুন করেছেন। তাই আজ যাচ্ছি! বাঁচতে চাইলে এলাকা থেকে কেটে পড়েন। আবার আসলে খালি হাতে ফেরা যাবে না।
ইব্রাহিম হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে বসে রইল। তার অবস্থা দেখে মিথির অনেক দিন পরে হাসি পেল। তার হাসি হাসি মুখ দেখে জহির বড় একটা শ্বাস ফেললো। এলাকায় আর টেকা যাবে কিনা সন্দেহ। কিছুদিন আগে গেল তার কাহিনী, এখন আবার তার চাচার কাহিনী। এজন্যই বলে নিজের ঘরের দেয়াল পুক্ত না করে, পরের ঘরে পাটকেল ছুঁড়তে নেই।
অলি আবসারের বাড়ি বর্তমানে পুরোপুরি নিশ্চুপ। নিশ্চুপ হলেও স্বাভাবিক জীবনের কিছুটা ছন্দ ফিরে এসেছে। আজকে সময় মতো উনুনে হাড়ি চড়েছে, সন্ধ্যার বাতি জ্বলেছে। রাতে খাওয়া – দাওয়ার পরে সময় মতো সবাই ঘুমোতেও গেছে। আজাদও কাল পরশুর মধ্যে ছাড়া পাবে। তবে এতো কিছু মধ্যে কারো মধ্যে যদি ছন্দ পতন একেবারেই ঘটেছে তা হলো আনতারা।
সে নিজের রুম থেকে আর বের হয়নি। তাকে কেউ জোরও করেনি। শবনম কিছুক্ষণ পর পর এসেই খবর নিচ্ছে, সময় মতো খাবার টাবার দিচ্ছে। এমনকি রাতে এখানেই থাকতে চেয়েছিল। আনতারা নিজেই নিষেধ করেছে। শান্ত ভাবে বলেছে, — আমি থাকতে পারব ভাবি আপনি যান।
পুরো ঘর অন্ধকার। দরজা – জানালা সব বন্ধ। যে মেয়ের অন্ধকারে থাকার কথা ভাবতেই অস্থির লাগতো। সেই মেয়েই আজ অন্ধকারে চুপচাপ পড়ে আছে। তখনি খুট করে শব্দ হলো। পুরো বাড়ি ঘুমে তলিয়ে, তাছাড়া সব রুমেই ফ্যান চলছে। এই শব্দ কারো কান পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব না। তবে আনতারা শুনলো। শুনে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। কোন কিছু নিয়ে তার মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করছে না।
শুনলো রমিজও! ভাই না ফেরা পর্যন্ত তার রাতে ঘুমানো নিষেধ। সে শুনতেই ধড়ফড়িয়ে বেরুলো। বারান্দায় প্রধান ফটকের কাছাকাছি আসতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। ফটকের একটা পাল্লা খোলা। কেউ কি বের হয়েছে। সে সাথে সাথেই এগিয়ে গেল। পায়ে কিছু একটা ঠেকতেই সে নিচু হলো। ভাঙা তালা।
সে সাথে সাথেই চিৎকার দিয়ে কিছু বলবে, তখনি মাথায় ভারী কিছুর এক বাড়িতে সে থমকে গেল।
আনতারার দরজায় টোকা পড়ল। আনতারা বড় একটা শ্বাস ফেললো। নিশ্চয়ই শবনম ভাবি। তার উঠতে ইচ্ছে করল না। তবুও অসাড় হওয়া শরীরটা টেনে উঠালো। একটা মানুষ নিজের শরীরের দিকে না তাঁকিয়ে তার পেঁছনে দৌড়াচ্ছে। তার ডাকে সারা না দিয়ে থাকা যায়?
সে উঠে বাতি জ্বালালো। জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই কেউ মুখে কিছু চেপে ধরলো। আনতারা চমকে উঠারও সময় পেল না। তবে নিভু নিভু চোখে শুধু দেখলো কালো কাপড়ে নাক, মুখ বাঁধা কিছু লোক আর তাঁদের পেছনে ঐ যে বারান্দায় শুরুতে রমিজ ভাই পড়ে আছে, রক্তে মাখামাখি হয়ে।
চলবে……