#বিষাদ_স্মৃতিচারণ (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখলে কাকী টিভি বন্ধ করে দিতো। বয়স তখন সবে আট বছর৷ এই জটিল কথাটি মাথায় ধারণ করার মতো বুদ্ধি তখনও হয়নি। তাই তো আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে যেই কাকী টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলতো,“শিমু এসেছিস? কিন্তু এখন তো টিভি দেখা যাবে না। আমি রান্না ঘরে যাবো।”
“তাতে কী হয়েছে? তুমি রান্না করো, আমি বরং দেখি।”
আমার কথা কাকী অবশ্য খুশি হলেন না। তার মুখটায় বিরক্তি ফুটে উঠেছিলো। কিন্তু আমি সেটা সেই সময়ে বুঝতে পারেনি। আমার কথার জবাবে কাকী ভার মুখে বললেন,“তুই একা দেখবি? তুই ঠিকভাবে রিমোট চালাতে পারবি না? তোকে দেখতে হবে না। তুই বরং ঘরে যা। রানী মামা বাড়ি দিয়ে আসলে তখন নাহয় আসিস।”
রানী আমার কাকাতো বোন। গ্রীষ্মের ছুটি পড়ায় সে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। রানী থাকলে আমরা দু’জন একত্রে টিভি দেখতাম। তবে কাকী যে এখানে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বলছে সেটা বুঝতে না পেরে আমি নাছোড়বান্দা হয়ে পড়লাম। আমি শান্ত গলায় বললাম,“আমি পারি। আমি রিমোট ব্যবহার করতে জানি। তুমি টিভিটা ছেড়ে দিয়ে তোমার কাজে যাও তো। আমি ঠিক একা একা দেখে নিবো।”
আমি নাছোড়বান্দা বুঝতে পেরে কাকী বিরক্তি নিয়ে টিভিটা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমিও মনের আনন্দে টিভিতে কার্টুন দেখতে শুরু করি। সেই সময়ে টিভি দেখার বড্ড ঝোঁক ছিলো। আমাদের ঘরে অবশ্য সাদা কালো একটি টিভি ছিলো। কিন্তু নষ্ট পড়ে ছিলো। তাই তো কাকীদের ঘরে এসে বসে থাকতাম। এই নিয়ে অবশ্য মায়ের অনেক বকা শুনতাম। যাই হোক আমি মন দিয়ে কার্টুন দেখছিলাম। মিনিট দুয়েকের মাঝে কাকী আবার সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তিনি আমার হাত থেকে রিমোট টেনে নিয়ে অন্য একটি চ্যানেলে দিলেন। আমি এটা দেখে অবাক হয়ে বললাম,“তুমি না রান্না করতে গিয়েছিলে কাকী?”
“এখন রান্না করতে ভালো লাগছে না। ভাবছি গতকালের বাসি ভাত দিয়ে চালিয়ে দিবো। বিকালে রান্না করবো।”
একটু থেমে আবারও বলে,“তাছাড়া তুই একা টিভি দেখছিস, তোর হয়তো ভালো লাগছে না। ভাবলাম একসাথে দেখি।”
আমি অবশ্য এই কথা শুনে খুশি হলাম। যদিও মন কার্টুন দেখতে চাইছিলো তবুও কাকীর জন্য তার পছন্দের চ্যানেলটাই দেখছিলাম। কারণ যেহেতু কাকী টিভি দেখতে আসছে সেহেতু এখন তার পছন্দমতোই দেখতে হবে। নয়তো বকা দিয়ে বের করে দিবে। এতটুকু অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে টিভি দেখে অর্জন করেছি। তাই চুপচাপ কাকী যা দেখছিলো তাই দেখছিলাম। টিভি দেখার এক পর্যায়ে কাকী বলে,“তোর তো টিভি দেখার ভীষণ ঝোঁক। তা বাবা, মাকে বলে নিজেদের টিভিটা ঠিক করলেই তো পারিস।”
”বলছিলাম গো কাকী। কিন্তু মা রাজি হচ্ছে না। টিভিটা এখন ঠিক করলে পরে ডিস লাইন নেওয়ার বায়না ধরবো। মাস শেষে এরজন্য টাকা দিতে হবে। সেজন্য রাজি হচ্ছে না।”
আমার এই কথায় অবশ্য কাকী খুশি হলেন না। তিনি বিরক্তি নিয়ে বিরবির করে বললেন,“তা ঠিক করবে কেন? আমাদের ঘরে জ্বালাতে তাহলে আর পাঠাতে পারবে? এক নাম্বারে শ য়তান মহিলা।”
আমি কাকী কথা শুনতে না পেলেও তার বিরক্তি বুঝতে পারছিলাম। আসলে একেবারে যে তার বিরক্তি বুঝি না তা নয়। কিন্তু ঐ যে মনের সাধ৷ টিভি দেখার ঝোঁকটা এতটাই প্রবল ছিলো যে কাকীর বিরক্তি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে বসে থাকতাম। তাই তো তার সকল কটু কথা শুনেও তার ঘরে বারবার আসতাম। একটু টিভি দেখার নেশায়। তাই তো আমাকে দেখে কাকীর টিভি বন্ধ করে দেওয়া, রান্না অজুহাত দেওয়া, মাঝে মাঝে রিমোট আড়ালে রেখে তা খুঁজে পাচ্ছি না বলা সব বুঝেও বেহায়ার মতো বারবার ছুটে আসলাম। আমার বেহায়গিরি যখন কোনকিছুতে কাকী ছাড়াতে পারলো না তখন সে ভয়াবহ এক কাজ করে বসলো। ভয়াবহ! হ্যাঁ ভয়াবহ। আমার জন্য সেটা ভয়াবহ ঘটনাই ছিলো।
দিনটি ছিলো,
২০০৯ সালের ২ জুন। রোজ মঙ্গলবার। সেদিন দুপুরে কাকী হন্তদন্ত হয়ে আমাদের ঘরে আসে। আমার উপর চড়াও হয়। কাকী রাগান্বিত গলায় যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,“আমার টাকা কই। চোরের বাচ্চা চোর, আমার টাকা কোথায় সরিয়েছিস?”
কাকীর এই কথা শুনে আমার পায়ের মাটি নড়ে উঠে। আমি হতবাক নয়নে তার দিকে তাকাই। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। মা আমাদের কথা শুনে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। কাকীকে শান্ত গলায় বলে,“কী হয়েছে ভাবী?”
“কী হয়েছে? সেটা তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। কী শিক্ষা দিয়েছো মেয়েকে? চুরি করার? চুরির উদ্দেশ্য দৈনিক আমাদের ঘরে পাঠাতে তাই না? এটাই আসল উদ্দেশ্য ছিলো?”
কাকীর এসব কথা মা এবং আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অতঃপর কাকী বললো, তার এই সপ্তাহের কিস্তির টাকা বিছানার উপর লাগছিলো। সেই টাকা খুঁজে পাচ্ছে না। কাকী এই পর্যায়ে রাগান্বিত গলায় বলে,“আমি জানি এই টাকা শিমুই নিয়েছে। শিমু ছাড়া কেউ আমাদের ঘরে যায়নি। ও টিভি দেখছি বিছানায় বসে। তার পাশেই টাকাটা রাখা ছিলো। পুরো পাঁচশত টাকা।”
”না।”
আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি আবার কাঁপা গলায় বললাম,“আমি কোন টাকা নেইনি। বিছানার উপর কোন টাকা ছিলো না। আমি দেখিনি। আমি কোন টাকা নেইনি।”
“চোর কী কখনো স্বীকার করে সে চুরি করেছে?
ভাবী মেয়েকে কেমন শিক্ষা দিচ্ছেন এসব? চুরি করার? টিভি দেখার ছুতোয় আগে ঘরের ছোটখাটো জিনিস নিয়ে আসতো। ছোটখাটো জিনিস হওয়ায় তেমন ভাবান্তর দেখাইনি। কিন্তু দেখানো উচিত ছিলো। আজ বুঝতে পারছি, কোন ভাবান্তর দেখাইনি বলেই আজকে এই দিন দেখতে হলো। আজ টাকা চুরি করার মতো সাহস দেখাচ্ছে।”
কাকীর এসব কথায় মা রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকায়। কঠিন গলায় বলে,“তুই কোন টাকা নিয়েছিস?”
“না মা। আমি কোন টাকা নেইনি। আমি চোর নই। আমি রাস্তায় পড়ে থাকা কোন জিনিসই ধরি না, সেখানে কাকীর টাকা। অসম্ভব।”
আমার কথা শুনে কাকী আমার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। অনেকটা জোর গলায় বলেন,“আমি জানি টাকাটা তুই নিয়েছিস। তুই নিয়েছিস। তুই ছাড়া ঘরে কেউ যায়নি।”
কাকীর এসব কথায় মা শান্ত গলায় বলে,“ভাবী হয়তো টাকাটা ঘরের কোথাও পড়ে গিয়েছে। একটু খুঁজে দেখেন। শিমু এমন করার মেয়ে না। আপনি একটু ভালোভাবে খুঁজে দেখুন।”
“তন্নতন্ন করে খুঁজেছি ভাবী। ঘর না খুঁজে কী আমি পরকে দোষ দিতে আসছি? জীবনেও না৷ এই স্বভাব আমার নেই। যাই হোক নিজের মেয়েকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করুন, টাকাটা কোথায়। টাকাটা বিকালের মাঝে ঘরে দিয়ে আসবেন।”
এটা বলে কাকী চলে যায়। মা আমার দিকে রাগী চোখে তাকায়।আমি ইতিমধ্যে কান্না করে দিয়েছি। না আমার গালে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে চুলের মুঠি ধরে বলে,“জানো য়ার। তোকে কতবার বলেছি কারো ঘরে যাস না। যাস না। এত টিভি দেখার শখ কেন তোর? ঘরে টিভি নেই তুই লোকের ঘরে যাবি কেন? কুত্তা র বাচ্চা। এখন এই কথা তোর কাকী সারা এলাকা করবে। ছিহ৷ আমার মান সম্মান রাখলি না। তোকে কতবার বারণ করছি যাস না।”
মা আমার পিঠে একের পর এক কিল থাপ্পড় মারতে থাকে। আমি চিৎকার করে কান্না করে দিয়েছি। আমি কান্নারত অবস্থায় বলি,“আমি টাকা নেইনি মা। আমি কোন টাকা নেইনি।”
“টাকা নিসনি তবে ঐ ঘরে ম রতে গিয়েছিলি কেন? এখন চোর বদনাম শুনছি কেন? ম রতে গিয়েছিলি কেন?”
মায়ের কথায় অনেকটা রাগের সঙ্গে কষ্টও দেখা যাচ্ছে। কষ্ট দেখা যাওয়ার কথা স্বাভাবিক। তার মেয়েকে তারই সামনে কেউ বলছে,“চোরের বাচ্চা চোর।” কথাটি অনেক যন্ত্রণার ছিলো। তবে ছোট আমি সেটা উপলব্ধি করতে পারিনি। তাই তো মা আমাকে বিশ্বাস না করে মারছে ভেবে কষ্টে কান্নায় ভেঙে পড়েছি। কিন্তু সেদিন আমার জন্য আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছিলো।
’
’
চলবে।