বিষাদ স্মৃতিচারণ পর্ব-০২

0
1

#বিষাদ_স্মৃতিচারণ (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

দুপুর থেকে কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। মা আমার কান্না বন্ধ করার চেষ্টা না করলেও, অবশেষে না পেরে খাবার নিয়ে হাজির হলো। আমার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে,“এখন না খেয়ে কান্না করে কী হবে? যখন বারণ করেছি তখন তো শুনলি না।”

“মা আমি টাকা চুরি করিনি। তুমি এভাবে আমায় অবিশ্বাস করলে? কাকী আমাকে চোর বলছে তাতেও আমার এত কষ্ট হয়নি। যত কষ্ট তুমি আমাকে ভুল বুঝে মারলে।”
আমার কথায় মা কিছুটা বিষন্ন মুখে আমার দিকে তাকায়। তারপর বলে,“আমি তোকে অবিশ্বাস করিনি। আমি জানি আমার মেয়ে চোর নয়। এমন কাজ করার আগে দুইশো বার ভাববে।”

“সত্যি? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?”
আমি কান্নারত অবস্থায় খুশি হয়ে বলেছি। এই খুশির অনুভূতি কোন ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। একজন সন্তান কাছে তার বাবা-মায়ের অবিশ্বাস যেমন কষ্টদায়ক তেমন বিশ্বাস, ভরসা আনন্দময়। মা মাথা নাড়িয়ে বললেন,“হ্যাঁ।”

”তবে মারলে কেন?”
অভিমান জড়ানো আমার কন্ঠ শুনে আমার মা ম্লান গলায় বললেন,“এসব তুই বুঝবি না। আমি জানতাম কোন একদিন এমন দিন আসবে। তাই তোকে বারণ করতাম। কিন্তু তুই তো শুনলি না। এখন কী করার? এখন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বসে থাক।”
মায়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমি ফুপিয়ে কান্না করে উঠলাম। মা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। আমার কান্না থামিয়ে খাবারটা খেয়ে নিতে বললেন। অতঃপর বলে,“আর জীবনে যদি তোকে ঐ ঘরে যেতে দেখেছি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। এই কথা মনে রাখিস।”

“আমি আর কখনো যাবো না মা। আমি কখনো যাবো না। রানীর সঙ্গে খেলবোও না৷ ও ডাকলেও খেলতে যাবো না।”
এই কথা বলে কান্না করে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা বেশ কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিলেন। ইতিমধ্যে আশেপাশে ছড়িয়ে গেল, আমি কাকীর টাকা চুরি করেছি। কাকী ইনিয়ে বিনিয়ে মানুষকে বলছে,“এই শিমু ছেড়ির জন্য ঘরে কোন ভালো জিনিস রান্না করে মনমতো খেতে পারিনি। সারাদিন আমাদের ঘরটায় পড়ে থাকে। নিজের সন্তানকে অব্দি ভালো কিছু বানালে বেশি খাওয়াতে পারিনি। খাবারের দিকে শকুনে নজরে তাকিয়ে থাকতো।
আমার খেয়ে আমার পড়ে এখন আমার টাকা চুরি করা হচ্ছে। সব হচ্ছে ওর বাবা, মায়ের শিক্ষা। দেখো গিয়ে তারাই চুরি করতে বলছে কি-না।”
এসব কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় নিলো না। আমাদের কানে আসতেও সময় নিলো না। মা এসব শুনে আমার দিকে রাগীভাবে তাকিয়ে বলে,“শুনছিস? কাকী আমাকে ভালোবাসে? আমি যাবো। তুমি ভুল ভাবছো মা। কাকী আমাকে দেখে মোটেও বিরক্ত হয় না।
এসব বলতি না? এখন দেখলি তোর কাকীর ধারণা? আরও যা ম রার টিভি দেখতে।”
আমি মায়ের কথা শুনে নিরবে কান্না করলাম। স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কাকী আমাকে নিয়ে এত খারাপ কিছু ভাবে। কাকী যা বললো তা মোটেও সত্যি না। আমি কখনো তাদের খাবারে নজর দেইনি। মাঝে মাঝে খাবার তৈরির সময় হুটহাট চলে যাওয়ায় তারা আমাকে খেতে দিতো। আমি না বলতাম তাও। সেই ছোট বয়সে এসব কথা শুনে মনটা ভীষণ ভেঙে যায়। আমি মনেমনে পন করে নিয়েছি, মরে গেলেও কাকীদের বাসায় আর যাবো না।
___
সবকিছু সেখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু না। সেটা শেষ হয়নি। রাতে বাবা বাসায় ফিরে আমার গালে কয়েকটা লাগিয়ে দিলো থাপ্পড়। বাবার থাপ্পড় খেয়ে আমি ছিটকে দূরে পড়লাম। মা শব্দ পেয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি ইতিমধ্যে হাউমাউ করে কান্না করে দিয়েছি। আমার বাবা, যে কখনো আমার গায়ে একটা টোকাও দেয়নি। সে আজ আমাকে এতগুলো থাপ্পড় মারলো। শরীরের ব্যথার থেকে মনের ব্যথা বেশি লাগলো। আমি বিষয়টি হজম করতে পারলাম না। মনে নানা প্রশ্ন জমা হয়েছে। আমার মতো মায়ের মনেও একই প্রশ্ন জমা হয়েছে। তাই সে বলে,“তুমি মেয়েটাকে এভাবে মারছো কেন?”

“তো কী করবে? ওকে আমরা এসব শিক্ষা দিয়েছি? চুরির করার শিক্ষা দিয়েছি? ছিহ। ভরা বাজারে আমার ভাই যখন আমাকে বললো ও চুরি করতে গিয়ে আজ ওর কাকীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে তখন লজ্জায় আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি। কিসের অভাব তোমার মেয়ের? কোন অভাবটা রেখেছি যে সে চুরি করছে।”
বাবার কথা শুনে মা এবং আমি বুঝতে পারলাম ঘটনাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে এখন প্রচার চলছে। বাবা আবারও রাগী গলায় বললো,“আজ আমি ওকে মেরেই ফেলবো। কোন সাহসে ও লোকের ঘরে গিয়ে টাকা চুরি করছে। এতবড় কলিজা ওর হলো কিভাবে?”
এটা বলে বাবা আমার দিকে তেড়ে আসলে মা তাকে থামায়। তাকে ধরে বলে,“তুমি ভুল শুনেছো। এসব কিছু হয়নি।”

“কী হয়নি? তুমি জানো বাজারে কী হয়েছে? ভাইয়া আমাকে ভরা বাজারে আমার শিক্ষা নিয়ে অপমান করেছে। সবাই সাক্ষীও দিলো তারাও শুনেছে আজ শিমু চুরি করতে গিয়ে কাকীর হাতে ধরা পড়েছে।
ছিহ। চোর হয়েছে। তোমার মেয়েকে খাইয়ে পড়িয়ে চোর বানাচ্ছি।”
বাবার মুখে এসব কথা শুনে আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেলে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে ভেসে উঠলো,“আমি চুরি করিনি।”

“হ্যাঁ। শিমু চুরি করেনি। ভাবীর কোথাও ভুল হচ্ছে। অন্যকেউ নিয়েছে কিন্তু ভাবী ভাবছে শিমু নিয়েছে।”
এই কথা বলে মা পুরো বিষয় খুলে বললো। বাবার রাগ তাও কমলো না। সে আমার দিকে একটি লাথি মারার চেষ্টা করে থেমে গেলেন। তারপর বলেন,“অন্যের ঘরে ওর এত কী? যখনি ঘরে আসি দেখি শিমু নেই। সে কাকাদের ঘরে। কেন রে, ঘরে কী নেই যে অন্যের ঘরে গিয়ে পড়ে থাকে ও। আজ যদি ও ঐ ঘরে না যেতো তাহলে তো এতবড় অপবাদ শুনতে হতো না।”
বাবার রাগের মাথায় আমাকে কথা শোনাচ্ছে। অবুঝ আমি মায়ের মতো বাবাকেও ভুল বুঝলাম। বাবার রাগের কারণটা উপলব্ধি না করে শুধু তার রাগটাই দেখলাম। সেই যে আমার শিক্ষা হলো, তারপর এ জন্মে আর কাকাদের ঘরে কখনো যাইনি।

পরিশেষে সেদিন রাতে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন সে কাকাদের পাঁচশত টাকা দিয়ে দিবেন। আর এটা নিয়ে যাতে আর বাড়াবাড়ি না করেন সেটা বলবেন। এই কথা শুনে মা বললো,“আমরা যদি টাকা দেই তাহলে তো ওদের কথাই সত্যি হলো। ওরা তো বলবে শিমু টাকা নিয়েছে বলেই আমরা দিয়েছি।”

“সেটা টাকা না দিলেও বলবে এবং বলছে। বরং এখন টাকা দিলে যদি মুখটা একটু কম খোলা রাখে। তাই টাকা দিয়ে দেই। টাকা হারিয়েছে, টাকা হাতে পেলেই তো হলো। তাহলে তো আর কোন কথা থাকে না।”
বাবা এই কথা ভেবে সেদিন রাতেই টাকা দেয়। তবে সত্যি হয় মায়ের কথা। ঠিকই টাকা হাতে পেয়ে কাকী সবাইকে বলে বেড়ায়,“শিমু টাকা নিয়েছিলো তার বাবা, মা ফেরত দিয়েছে। চোর মেয়ে ধরা পড়ে গেছে বলে নয়তো এই টাকা জীবনে ফেরত দিতো না।”
কাকী নিজে এই কথা বলে বেড়াচ্ছে না শুধু তা নয়। বরং নিজের ছেলে মেয়ের মাথাও এটা ভরে দিয়েছে৷ আর তারাও সবার কাছে এটাই বলছে। সাময়িক সময়ের জন্য এভাবেই মানুষের চোখে আমি খারাপ হয়ে গেলাম।

সেই ঘটনার পর, লজ্জায় কয়েকদিন ঘর থেকে বের হইনি। টিভি দেখার সাধ একেবারে মিটে গেছে। নিজের বেহায়াপনার বহুত শিক্ষা পেয়েছি। এখন ঘর থেকে বের হলেই শুনতে হয় চোর বদনাম। আমার পরিবার শান্ত, শিষ্ট তাই লোকের সঙ্গে মুখ লাগাতে পারে না। মুখ লাগাতে পারে না বলেই লোকজন যা নয় তাই বলে। আমি দেখেছি এই দুনিয়ায় যাদের মুখ খারাপ, লোকের কথায় জবাব সঙ্গে সঙ্গে দেয়, বাজে গা লি দেয় তাদের বদনাম মানুষ ছড়াতে পারে না। তাদের মুখের ভাষার ভয়েই সবাই চুপ থাকে। কিন্তু যারা আমাদের মতো নিরীহ। লোকের সঙ্গে তর্কে জড়াতে ভয় পায় তাদের নিয়েই মানুষ বেশি আজেবাজে কথা বলে বেড়ানোর সুযোগ পায়। বিষন্ন মন নিয়ে ঘরের কোনে মুখ লুকিয়ে বসে থাকলাম বেশ কয়েকদিন। অতঃপর এলো সেদিন যেদিন……


চলবে,