বিষাদ স্মৃতিচারণ পর্ব-০৩

0
1

#বিষাদ_স্মৃতিচারণ (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

অতঃপর একদিন বাবা আমাদের ঘরের নষ্ট টিভিটা নিয়ে চলে গেলেন। এটা দেখে আমি মায়ের কাছে জানতে চাইলাম,“মা বাবা টিভি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?”

“মেকানিক দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। তুই সারাদিন ঘরে থাকিস। সময় কাটে না। তাই ভাবলাম টিভিটা ঠিক করা যায় কি-না দেখি।”
মায়ের এই কথায় আমি খুশি হতে পারলাম না। এখন এই টিভি শব্দটা শুনলে খুশি আসে না। বরং কষ্ট হয়। এই এক নেশার জন্য আমার কত বদনাম হলো। আমার বাবা-মাকে কত কথা শুনতে হলো। দোষ অবশ্য আমারও। তাদের বিরক্তি উপলব্ধি করেও বারবার যেতাম। আসলে এই বয়সে এটা এত নেশার মতো কাজ করছিলো। যে সব বুঝেও মন মানছিলো না। তাই বলে কাকী এভাবে চোর অপবাদ দিবে। এই বিষয়টি হজম হচ্ছিলো না। সে প্রয়োজন পড়লে আমাদের সঙ্গে তর্ক করতো। আমাকে দেখে বিরক্তি প্রকাশ না করে সরাসরি বলতো যাস না। তাহলে হয়তো কিছুটা সুধরে যেতাম।

অতঃপর সময় কেটে যায়। আমাদের ঘরে ডিস লাইন আসে। আমি এখন ঘরে বসেই টিভি দেখি। ছোট অবুঝ হৃদয়টা নিয়ে ঘরে বসে যখন যা খুশি দেখতে পারি এই আনন্দ বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছিলাম। সেখানেও কষ্টই পেলাম। আমার কথা শুনে বন্ধুরা বলতো,“হ্যাঁ শুনেছি। তুই তো টিভি দেখার ছুতোয় অন্যদের বাড়ি চুরি করতে যেতি।”

“মানে?”
আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকালাম। তারা আমাকে দেখে হাসতে থাকলো। অতঃপর বলে,“আমাদের সামনে ভালো সাজার অভিনয় করিস না। আমরা সব জানি। রানী আমাদের সব বলেছে।”
তাদের কথা শুনে বুকটা কষ্টে ফেটে গেল। যে স্কুলে আমি আনন্দের সঙ্গে যেতাম সেই স্কুল জীবন আর আমার ভালো লাগছিলো না। বাসায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে এসব বললে মা আর নিতে পারে না। আমার কান্নারত মুখ দেখে মা কাকীর কাছে যায়। প্রথমে শান্ত গলায় বলে,“তোমরা কী চাও বলো তো? আমার মেয়ে চুরি করেছে তার কোন প্রমাণ আছে? নাই তো। তারপরও আমরা তোমাদের টাকা দিলাম। পাঁচশত টাকা আমাদের জন্য অনেককিছু। সেটা তোমাদের দিলাম শুধু শুধু। তাও তোমরা পাড়ায় রটাচ্ছো আমার মেয়ে চোর। এটা এই অব্দি থাকলে ভালো হতো। এখন নিজের মেয়েকে দিয়ে স্কুলে অব্দি বলে বেড়াচ্ছো। কেন করছো এমন?”
মায়ের এই কথা শুনে কাকী ক্ষেপে গেল। সে কঠিন গলায় বললো,“ভাবী নিজের চোর মেয়ের হয়ে ওকালতি না করে ঘরে যান। এসবে আপনারই মান যাবে। মেয়েকে যেমন চোর বানিয়েছেন তেমন তো লোকের কথাও শুনতে হবে।”

”আমার মেয়ে চোর নয়। আমরা তোমাদের মতো খারাপ শিক্ষা দেই না বাচ্চাদের।”
আমার মায়ের এই কথাটা যেন কাকীর কাছে বিঁষের মতো লাগলো। সে তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,“চোরের মায়ের বড় গলা। তোর মেয়ে চোর বলেই তো টাকা ফেরত দিয়েছিস। চোর নাহলে দিতি? রাতে তোর মেয়ে টাকা কোথায় রেখেছে সেটা বলেছিস, তাই ফেরত দিয়েছিস। আবার বড় বড় কথা বলতে আসছিস। চোরকে সবাই চোর বলছে, এখানে কষ্টের কী আছে? আবার নিজের চোর মেয়ের জন্য পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে আসছিস। বাহ্। চোরের মায়ের বড় গলা ইচ্ছায় বলে।”
শুরু হলো তুলকালাম। কাকী তার মুখ দিয়ে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে। মা প্রথমে তাকে থামতে বললেও পরে না পেরে সেও তর্কে জড়ায়। তর্কের মাধ্যমে মাও তাদের সন্তানদের আমার মা কেমন চোখে দেখতো। কিভাবে খাওয়াতো সেসবের খোঁটা দেয়। এক কথায় কাকী যেভাবে আমাকে খাবার খাইয়ে লোকের কাছে উল্টো বলে বেড়িয়েছে তেমনটা মাও করে। কিন্তু সে লোকের কাছে নয় বরং কাকীর কাছেই তর্কের মাধ্যমে এসব বলে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক চললো। মা কাকীকে এক কথায় শাসিয়ে বললো,“এরপর তোমাদের যেন আমাদের আশেপাশেও না দেখি।”

“আমাদের তো বয়ে গেছে যে তোমাদের কাছে গিয়ে বসে থাকবো। তোমরা আমার ত্রি-সীমানায় ঘিরবা না।”

“আসবো না।
আমার মেয়ে যদি ভুলক্রমেও আসে তবে পা ভেঙে খোড়া করে রেখে দিবো।”
এই কথা বলে মা চলে আসে। কিন্তু কাকীর মুখ আর থামে না। সে চিৎকার চেঁচামেচি করে আমাদের কথা শোনাতে থাকে। এক কথায় পায়ে পা লাগিয়ে তর্ক করতে যায়।
___
সেই ঘটনার পর অনেক মাস কেটে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আমার টপিক ছেড়ে অন্য টপিক খুঁজে নেয়। অর্থাৎ আমার চোর কথাটা এখন আর শুনতে হয় না। তবে যদি কারো সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে তাহলে অপরপক্ষ যখন যুক্তি খুঁজে পায় না ঠিক সেই মূহুর্তে অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি চোর সেই কথা বলে। এভাবেই দিন কেটে যায়। কাকীরা যদিও সেই ঝগড়া ভুলে গিয়ে আমাদের ঘরে আসা-যাওয়া করে। মাও তাদের সাথে স্বাভাবিক কথা বলে। কিন্তু একমাত্র আমিই পারি না সেই ঘটনা ভুলতে। তাই তো রানীর সঙ্গে কথা বললেও কাকা, কাকীর সঙ্গে কথা বলিনি। তো এমন এক সময় রানীদের ঘরের টিভিটা নষ্ট হয়ে যায়। সেবার দশদিনের মতো রানীদের টিভিটা নষ্ট পড়ে থাকে। সেই দশদিন রানী আমাদের ঘরে এসে টিভি দেখতো। না। পুরনো কথা মনে রেখে কখনো রানীকে আমি টিভি দেখতে বারণ করিনি। বরং ও এসে নিজের হাতে টিভি অন করে যখন যা খুশি দেখতো। আমরা বাধা দিতাম না। আমার মায়েরও কড়া নির্দেশ ছিলো,“রানীকে কখনো কিছু বলতে দেখলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। লোকে আমাদের সাথে যা করেছে তা আমাদেরও করতে হবে? একদমই না।”
মায়ের কথায় আমি ভালো মেয়ের মতো মাথা নাড়ালাম। তো টিভি দেখার সময় দেখা যেতো রানী মাঝে সাজে আমাদের ঘরে রাতের খাবারও খেয়ে যেতো। আমরা এই নিয়ে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করিনি। এভাবে দশদিন পর তারা তাদের টিভি ঠিক করে। যার জন্য রানীরও আসা কমে যায়।

কয়েকদিনের মাঝে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়ে নিলো। আমরা আমাদের সঙ্গে হওয়া ঘটনার কোন প্রতিশোধ না নিলেও প্রকৃতি ঠিকই নিয়ে নিলো। একদিন খবর আসে আমার কাকাতো ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কাকাতো ভাই সঙ্গে আরও কিছু ছেলেকে। তারা একটি দোকানের তালা ভেঙে চুরি করেছে, এই অপবাদে। এই খবর আসলে কাকী তো কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ তার কান্না শুনে মা ঘটনা জানতে যায়। সব শুনে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। এখন কাকাতো ভাইকে থানা থেকে কিভাবে ছাড়াবে? সেই বিপদে আমার বাবা, কাকার সঙ্গে থানায় যায়। বাবাই কথা প্রসঙ্গে বলে,“দোকানদারের সঙ্গে মিটমাট করে নেই কথা বলে। তাকে তার টাকা ফেরত দিলে হয়তো মামলা তুলে নিবে।”
কাকাও মাথা নাড়ায়। বাবা এবং কাকা থানার উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়। এদিকে কাকী তো সারাদিন কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা অনেক কষ্ট করে কাকীর মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়। কিন্তু কাকী খেতে একদমই রাজি হচ্ছিলো না। সে তো মা। সন্তান জেলে , মায়ের মন কি খেতে চায়। তবুও মা কষ্ট করে খাওয়ালো।

এভাবে একটা গোটা দিন কেটে যায়। পরেরদিন কাকাতো ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফেরে বাবা, কাকা। থানায় অনেক ঝামেলা হয়েছিলো। তারপর অনেক কেচ্ছা শেষে সবাইকে ছাড়ে। দোকানদারের যা হারিয়ে গেছে সেই পরিমান অর্থ দিতে হয়েছে। কাকার কাছে ততটা কাকা ছিলো না তখন বাবাই সাহায্য করেছে। এসবে কাকা আমার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে বাবা বলে,“আরে রাজীব তো আমারও ছেলে। আমাদের রক্ত। তাকে বাঁচাতে আমরা এগিয়ে না আসলে কে আসবে?”
এসব কথাবার্তা বলে রাজীব(কাকাতো ভাই) তাকে ডেকে চুরি করার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। এখানে জানা যায়, রাজীব চুরি করেনি। সে জানতো না ঐ ছেলেগুলো কারো দোকানে চুরি করেছে। তাদের সঙ্গে একসাথে থাকার জন্য পুলিশ তাকেও ওদের সঙ্গী ভেবে ধরে নিয়ে যায়। এখানে কথা বলতে গিয়ে ভাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাকী তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। রাজীব ভাই বলে,“আমার সব শেষ। চুরি না করেও এখন সারা পৃথিবীর কাছে চোর হয়ে থাকতে হবে। আমি তো শেষ মা। এই লজ্জা থেকে আমি কিভাবে বাঁচবো? আমার তো ম রে যেতে ইচ্ছা করছে।”
কাকী ভাইকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়। আমি এবং মা তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। মা না পেরে বলেই ফেলে,“পৃথিবীতে অনেক বাবা, মা থাকে যারা না চাইতেও এমন কিছু করে ফেলে যে তাদের কাজের ফল সন্তানদের ভোগ করতে হয়।”
এই কথায় বাবা অবশ্য মাকে ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তবে কাকী ঠিকই বুঝেছে কথাটা তাকে বলা হয়েছে। মা এবং আমি আমাদের ঘরে চলে এলাম। পরেরদিন…..


চলবে,