#বিষাদ_স্মৃতিচারণ (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
পরবর্তী দিন কাকী এসে আমাদের ঘরে উপস্থিত হলো। মায়ের কাছে আমার খোঁজ করলো। আমি ঘর থেকে বের হলে কাকী হাসিমুখে আমার দিকে একটি বাটি এগিয়ে দিলো। আমি সেটা হাতে না নিয়ে বললাম,“কী এটা?”
“এটায় তোর পছন্দের মিষ্টি রয়েছে। তোর কাকাকে বলে সকাল সকাল আনিয়েছি।”
কাকী হাসিমুখে কথা বললেও আমার তেমন ভালো লাগলো না। তবুও ম্লান হেসে নিলাম। কাকী আমার হাতটা ধরলেন। মনমরা গলায় বলে,“তোর এই হতভাগী কাকীকে ক্ষমা করে দিস মা।”
আমি ভীষণ অবাক হলাম। কাকী আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। কিন্তু! এটাও সম্ভব। কাকী এরপর শান্ত গলায় বলে,“সেদিন তোরা টাকা ফেরত দেবার পর ঘরের এককোনে টাকাটা পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে কিভাবে সবাইকে বলবো ভেবে বলা হয়নি। আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
এখানে আমি কাকীকে কিছুই বললাম না। এতদিন ভাবতাম হয়তো অন্যকেউ টাকাটা নিয়েছে। তবে আজ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলাম, টাকাটা কেউ নেই। কাকী নিজে টাকাটা সরিয়েছে। এখন সরাসরি সেই কথা না বলতে পেরে বলছে, পরবর্তীতে টাকাটা খুঁজে পেয়েছে। যদি তার কথা সত্যিও হয় তবে খুঁজে পাওয়ার পরও আমার নামে মিথ্যা অপবাদ রটালো কেন? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছিলো। তার জবাব কাকী দিলো। সে বলে,“চোর বদনাম বড় কষ্টের রে শিমু। আজ আমার ছেলেটা একই বদনামের ভাগিদার। তাই সবটা বুঝলাম। সেজন্য তোর কাছে ক্ষমা চাইতে আসলাম।”
”বেশ। সমস্যা নাই কাকী।”
আমি এই কথা বলে ঘরের মধ্যে চলে গেলাম। কাকীও তার ঘরে চলে যায়। কেন জানি না সেই মিষ্টিটা আর খেতে পারলাম না। পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছিলো খুব। কাকী একা অপমান করে খ্যান্ত হননি। যখন ঐ ঘটনার রেশ কমে গিয়েছিলো তখন রানী স্কুলের বিরতিতে সবার সঙ্গে খেলার সময় সে যখন সেই খেলায় অংশ নিতে যাইতো। তখন রানী বলতো,“না ভাই তোকে নেওয়া যাবে না। মা বলেছে চোরদের সঙ্গে না মিশতে।”
তার এই কথায় সবাই হেসে দেয়। একজন তো বলেই বসলো,“এখনই তো সুবর্ণ সুযোগ। তুই এখন চুরি করতে যাবি। এখন কেন আমাদের সাথে খেলতে আসছিস?”
এসব কথা বলে সবাই মজা নিচ্ছিলো। সেই ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আজ কাকী যে ক্ষমা চাইলো সে কি কোনদিন লোকের সামনে নিজের দোষ বলবে? কখনো বলবে না। যেভাবে সবার কাছে তাকে চোর প্রমাণ করেছিলো সেভাবে কখনোই সবার সামনে তাকে নির্দোষ বলে বেড়াবে না। এই কথাগুলো মাথায় আসতে খুব রাগ হলো। রাগের মাথায় সেই মিষ্টিগুলো ফেলেই দিলাম। বাবা এটা দেখে ধমক দিতে চাইলে মা থামিয়ে দিয়ে বলে,“ওগুলো ফেলুক। ওর এত মিষ্টি খাওয়া লাগবে না।”
”তাই বলে এভাবে খাবার ফেলবে? এটা তো ভালো কাজ নয়।”
”আমরা সবাই কী সাধু নাকি? দুনিয়াতে কি কোন পাপ করি না? একদিন এই সামান্য পাপ করলে ক্ষতি হবে না।”
মায়ের কথার মাধ্যমে মায়ের রাগটা বাবা উপলব্ধি করতে পারে। সেজন্য কথা বাড়ায় না। শুধু বলে,“যে যেমন করবে তেমনটা ফেরত পাবে। দেখলে তো। এখন সবাই তো তাদের পরিবারকেও চোরের পরিবার বলছে।
তাই মনে আর রাগ পুষিয়ে রেখো না।”
বাবার কথায় মা মাথা নাড়ায়। আমিও বাবার কথা বুঝতে পারি। ঠিকই তো। যার যার কর্মফল সে সে ভোগ করবে। তবে খারাপ লাগছে। কাকীর দোষে আজ রাজীব ভাইকে চোর অপবাদ পেতে হলো। হ্যাঁ আমরা বিশ্বাস করি রাজীব ভাই এমন কিছুই করেনি। তাকে আমরা সবাই চিনি। তার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়। আমাদের মনে হয় কাকীর অপরাধের শা স্তি তার ছেলেটার উপর পড়লো।
____
সময় কেটে যায়। ধীরে ধীরে আমি বড় হলাম। আমার বিয়ে হলো। সন্তান হলো। আজ আমার ঘরে সব রয়েছে। বড় টিভি, ফ্রীজ, এসি সব রয়েছে। মাঝে মাঝে ঘরের টিভিটার দিকে চোখ পড়লে মায়া হয়। এতবড় টিভি আমাদের ছোটবেলায় আমরা চোখেও দেখিনি। তবুও সেই টিভি দেখার অনেকটা নেশা ছিলো। কিন্তু আজ আর এই টিভি দেখার কোন আগ্রহ নেই। নেশা কাজ করে না। তবে মাঝে মাঝে ছোটবেলার সেই দুঃখের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। কিছুতেই ভুলতে পারি না। কাকীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও কোথাও গিয়ে স্বাভাবিক নয়। আমি আজও সেসব স্মৃতি ভুলতে পারি না। যেমনভাবে আজ মনে পড়লো। আমরা যেখানে ভাড়া থাকি সেখানে এক ঘরের ছোট মেয়েটা ভাড়াটিয়ার ঘরে টিভি দেখতে যাওয়ায় মেয়েটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। মেয়েটা সেই ঘটনায় মনে দুঃখ পেয়েছে খুব। সে প্রচন্ড কান্না করছে। তার মা কান্নারত তাকে নিয়ে আমাদের ঘরে এসে বলে,“ভাবী আপনাদের টিভিটা একটু দেখা যাবে। আমরা দুই একদিনের মাঝে টিভি কিনবো। আপাতত মেয়েটার কান্নাটা একটু বন্ধ করি।”
আমি মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলাম। তারপর বললাম,“আপনার টাকায় সমস্যা থাকলে এখন কেনা লাগবে না। আপনি বরং মেয়েকে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েন। ও যখন খুশি আমাদের ঘরে এসে টিভি দেখে যাক।”
”না ভাবী। তা বললে হয়। এভাবে যখন খুশি এসে লোককে বিরক্ত করা ঠিক নয়। তাছাড়া কষ্ট হলেও মেয়ের জন্য একটু মানিয়ে নিতে হবে। আসলে আমাদের এখানে নতুন সংসার। আগে তো বাড়িতেই ছিলাম। তাই সেভাবে সব কেনা হয়নি। কিন্তু সমস্যা নাই। আমরা তাড়াতাড়ি কিনে নিবো। যতই হোক ভাবী, কোন একসময় আপনিও বিরক্ত হয়ে যাবেন।”
শেষ কথাটিতে জড়ানো কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারি। তার মেয়েকে টিভি দেখতে দিবে না বলে কেউ বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, এটা এক মায়ের জন্য অনেক কষ্টের। সেই কষ্ট থেকেই সমস্যা হবে জেনেও নিজেদের ঘরে টিভি কেনার কথা ভাবছে তারা। তার এসব কথায় ছোটবেলার সেই দূর্বিষহ স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেল। আমি আর ভাবীকে কিছুই বললাম না। এখানে আমার বলাটা সাজে না। কারণ এটা এক মায়ের আত্মসম্মানের বিষয়। এখানে আমার কথা বলা মানায় না।
পরিশেষে, দিনশেষে সবারই সব হয়। কিন্তু কিছু মানুষের কিছু ব্যবহার, এক কথায় খারাপ ব্যবহারের কথা হৃদয়ে থেকে যায়। সেই কষ্টের কোন ব্যখা হয় না। যদি বলি, শিমুর ছোটবেলার ঘটনাটা নিয়ে। তবে বলতে হয় সেখানে শিমুরও কিছুটা দোষ ছিলো। সে বুঝতো তার কাকী তাকে দেখে বিরক্ত হয়। তাকে দেখেই টিভি বন্ধ করে। নানা ছুতো দেয়। তাও বেহায়ার মতো গিয়ে তাকে বিরক্ত করেছে। এটাই তার ভুল। তবে একটু মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবলে বলা যায়, বাচ্চারা একটু বেহায়াই হয়। তার মাথায় কোন একটির নেশা ঢুকে গেলে সেটার নেশা কাটানো খুবই জটিল হয়ে পড়ে। সেজন্যই শিমু বারবার একই জায়গায় যেতো। আর তার কাকী। নিজের বিরক্তি থেকে মুক্তি পেতে একটি ভুল পথ বেছে নিলেন। সে সরাসরি মেয়েটিকে চোর বানিয়ে দিলেন। শিমু নাহয় একটি বাচ্চা ছিলো কিন্তু কাকী তো বাচ্চা ছিলো না। তার মস্তিষ্ক তার বিবেক যদি তাকে এই কাজে না আটকায় সেখানে বলতে হয় সে মানুষ হিসাবে খুবই জঘন্য। দিনশেষে একটা সময় পর সবার ঘরেই সব হয়। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালো লাগা বদলে যায়। তাই তো আজ শিমুর টিভি আছে কিন্তু তার দেখার আগ্রহ নেই। ছোটবেলার মতো দেখার আনন্দটা নেই। বরং এই টিভির দিকে তাকালে তার মনে পড়ে যায় তার বিষাদ স্মৃতিগুলো। যতই সম্পর্ক ভালো হোক। শিমু জীবনেও তার কাকীকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে না। আর না পারবে ঐ ঘটনা ভুলতে।
(সমাপ্ত)