#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২২
চোখে আলো পড়তেই আনতারা চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। কুঁচকেই দু- হাতে মুখ ঢাকলো। আলো চোখে বিঁধছে। আজকে সে ছিল দুনিয়ার ক্লান্ত। সারাদিন গেছে ঘষা মাজায়। তার মধ্যে বিকেলে সবার সাথে হাতে হাতে বানিয়েছে পিঠা। তারপর এতক্লান্ত লাগলো। কোন রকম সন্ধ্যায় কয়টা খেয়েই সে শুতে চলে এসেছিল। আসতে দেরি ঘুমিয়ে যেতে দেরি হয়নি। সেই আরামের ঘুমে ব্যাঘাত হওয়ায় সে একটু বিরক্তই হলো।
কি দরকার আলো জ্বালানোর। এমনিতেও এসেই পটাং হয়ে শুয়ে পড়বে। মাঝখান থেকে তার ঘুমের দফারফা।
সে বিরক্ত হয়েই আঙুলের ফাঁকে একটু চোখ খুললো। নিভু নিভু চোখে দেখল তার একেবারে মুখ বরাবর আজাদ দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সেই আনতারার অপছন্দের হাসি। সাথে সাথে আনতারার ঘুম ছুটে গেল। যেতেই ফট করে উঠে বসল।
সেই ঘটনার পর থেকে আজাদকে দেখলেই তার একটু অস্বস্তি হয়। অবশ্য সব সময়ের মতো আজাদের কোন বিকার নেই। না থাক! এই কয়দিনে আনতারা এইটুকু ঠিক বুঝেছে। এই লোক না কিছু ভুলে, না কিছু হজম করে।
সে বসেই অবাক কন্ঠে আস্তে করে বলল, — এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
সন্ধ্যা থেকে ঘুমের জন্য আনতারার চোখ মুখ ফোলা । এলোমেলো চুল। আজাদ এক পলকে তাকিয়ে বলল, — সেই দিনতো তুমিও দাঁড়িয়ে ছিলে আমি কিছু বলেছি?
আনতারা কি বলবে ভেবে পেল না। সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে শুধু পরপর কয়েকটা চোখের পলক ফেলল। কয়টা ফেলল আজাদ ঠিক বলতে পারবে।
— ঘুরতে যাবে আনতারা?
আনতারা সাথে সাথে মুখ গোঁজ করল। সেই দিন তার শিক্ষা হয়নি? তাই সাথে সাথেই মাথা নেড়ে সোজা বলল, — একদম না।
আজাদ হেসে ফেলল! হেসে খাটে বসল। বসে বলল, — আজকে দৌড় খাওয়াবো না। নৌকায় চড়াবো। যাবে?
আনতারার লোভ হলো। সারাদিন রাত এই ঘর আর ঐ ঘর। তাও ভালো শবনম ভাবি আছে। তা না হলে সে কি করত। সে ভাবতে লাগলো যাবে কি না?
অবশ্য ভাবার সেই সময়টুকু পেলও না। আজাদ ততক্ষণে তার হাত ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়ে ফেলেছে। আনতারা আজকে অবাক হলো না, চমকালোও না। এই লোক প্রশ্ন তো করে তবে উত্তর শোনার ধৈয্য বা সময় কোনটাই তার নেই।
আনতারা বিলের সামনে এসে অবাক হয়ে গেল। পুরো বিল জুড়ে সাদা সাদা শাপলা ফুল। চাঁদের আলোয় এতো সুন্দর লাগছে। আনতারা বাক্যহারা হয়ে গেল।
আজাদ নিজের মতোই নৌকায় গিয়ে বসলো। বৈইঠা হাতে তুলে বলল, — আমি কি চলে যাব?
আনতারা আজকে ভয় পেল না। ঘাটে দাঁড়িয়ে আজাদের মত বলল, — যান। ধরে রেখেছে কে?
আজাদ হাসল! হেসে বলল, — ভয় করছে না?
— উঁহু।
— কেন?
আনতারার বলতে ইচ্ছে করল। আপনি আছেন না। তবে বলল না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। নৌকার সামনে যেতেই আজাদ হাত বাড়ালো। আনতারা বিনা সংকোচে আজকে নিজেই হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরল। নৌকায় বসে বলল, — প্লেট দুটো আগে আমি ভেঙেছিলাম।
আজাদ কিছু বলল না। সে নৌকা বাইতে লাগলো। আনতারা দূরে গিয়ে বসেনি। সে নৌকার মধ্যেখানে আনতারার বাসার জায়গা করেছিল। তবে আনতারা উঠে তার সামনেই বসে পড়েছে। এখন উপুর হয়ে শাপলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
এমন কোন কাজ নেই আজাদ পারেনা। আর নৌকা চালানো, আজাদের বা হাতের কাজ। সেই বা হাতের কাজ আজকে দু- হাতে করেও হিমশিম খাচ্ছে।
আনতারা পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, — আপনি তো ঠিকঠাক নৌকা চালাতে পারেন না। একবার এদিকে নিচ্ছেন তো আরেকবার ওদিকে। আমি আগেই বলে রাখলাম। আমি সাতার জানি না।
আজাদ হেসে ফেলল! আনতারা আগের মতোই বলল, — হাসছেন কেন?
— সত্য বলব না মিথ্যা।
আনতারা সাথে সাথেই থমকালো। এর সত্য মিথ্যা খুবই বিপজ্জনক। দেখা গেল এমন কিছু বলবে, তার পানির উপর দিয়েই দৌড়ে বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করবে। তাই সোজা বসে বলল, — কোনটাই না।
আজাদ হো হো করে হেসে উঠল। পুরো নিশ্চুপ বিলে আজাদের হাসি ঝনঝন করে বাজতে লাগলো। তখনি তাদের উপরে আলো এসে পড়ল। জেলেদের নৌকা। তার মধ্যে পাঁচ ছয় জন জেলে। আনতারা ভয় পেয়ে গেল।
আজাদের মুখ নির্বিকার। সে ঘাড় কাত করে বলল, — আলো এদিকে মার।
তখনি সব টচ লাইটের আলো আজাদের মুখের উপরে পড়ল। পড়তেই লোকগুলো বলে উঠল, — আজাদ ভাই আপনে?
আজাদ আগের মতোই বলল — জ্বি আমি।
সাথে সাথেই সব লাইট বন্ধ হয়ে গেল। তার মধ্যে একজন বলল, — বুঝিনি ভাই। মাফ করে দিয়েন।
আজাদ আবার হো হো করে হাসল। হেসে বলল, — মাফ কি জিনিস রে। শাস্তি পাবি শাস্তি।
— বুঝিনি তো ভাই।
— আমার কি? তোর ভাবি যে ভয় পেল। এখন একশত শাপলা তুলে ভাবিকে উপহার দে।
লোকগুলো সাথে সাথেই নামার জন্য তৈরি হলো। আনতারা সাথে সাথে আজাদের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, — উনাদের নিষেধ করুন। এক্ষুণি করুন।
— কেন?
আনতারা মুখ ফুলিয়ে তাকালো। আজাদ সাথে সাথেই বলল, — যা মাফ করলাম। তোদের ভাবির শাপলা লাগবে না।
— বড় কাতল মাছ পেয়েছি ভাই। নেবেন?
— তোর কি ধারণা এত রাতে তোদের ভাবিকে নিয়ে মাছ নেওয়ার জন্য বের হয়েছি।
লোকগুলো এবার হাসলো। হেসে আর দাঁড়ালো না। ধীরে ধীরে চলে গেল। যেতেই আনতারা বলল, — নৌকা চালাতে পারে না, শাপলা তুলতে পারে না। অন্যের ঘাড়ে ফেলে ঢং। সেই দিন মুখ বারাবর দাঁড়িয়েছি বলে, আজকে নিজে দাঁড়িয়ে শোধবোধ। সেইদিন যে আমি নিজের হাতে মালা গেঁধে দিলাম। আজকে আমারটা কই?
— তোমার শাপলা লাগবে?
এবারো আনতারা হ্যাঁ, না বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই আজাদ পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছে। আনতারা ভয়ে শেষ। পুরো নৌকা দুলে উঠেছে। সে ঝাপটে দু- হাতে দু- পাশ ধরে বলল, — আপনাকে সবাই সাধে গরু বলে। শাপলা তুলতে পানিতে ঝাঁপ দিতে হয় কে বলল?
আজাদ কিছু বলল না। সে ততক্ষণ অনেকগুলো শাপলা তুলে ফেলেছে। সেই শাপলাই গুছিয়ে আনতারার পায়ের কাছে রাখল।
আনতারা শাপলার দিকে তাকিয়ে আজাদের দিকে তাকালো। এলোমেলো চুল এখন ভিজে পুরো লেপটে চোখে মুখে পড়ে আছে। আনতারার একবার ইচ্ছে করল হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দিতে। তবে সে সেরকম কিছুই করল না। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, — দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উঠুন।
— তুমি ভিজে যাবে।
— গেলে যাব আসেন বলেই আনতারা হাত বাড়ালো।
আজাদ আবারো হাসলো।
আনতারা বিরক্ত নিয়ে বলল, — আবার হাসছেন কেন?
— সত্য বলব না মিথ্যা?
আনতারা আবারো একটা বড় শ্বাস ফেলল। এত পাগল মানুষ সে জীবনে দেখে নি। সে শ্বাস ফেলেই বলল, — বলুন! সত্যই বলুন।
— তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আনতারা। যেন তেন সুন্দর না। ভয়ংকর সুন্দর। আর এই ভয়ংকর সুন্দরে আমার ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।
আনতারা সাথে সাথেই হাত গুটিয়ে নিল। আজকে সে স্তব্ধ হয়নি। সে জানতো এমন কিছুই বলবে তবে খুব লজ্জা পেল। অবশ্য প্রকাশ করল না। অন্য পাশে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, — আপনি পানিতেই থাকুন।
আজাদও তার মত বলল, — জো হুকুম মহারাণী।
বিথীকে দেখতে আসলো ঠিক শক্রবারেই। যেহেতু আগেরই ইষ্টি তাই দুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছে। মেহমানদের সাথে মুর্শিদার ভাই বেরেদারও এসেছে। তবে তাদের মুখ কালো। আজাদের বিয়ে নিয়ে তারা বড়ই নারাজ। তবে বোনের শ্বশুরের উপরে কিছু বলতে পারছেন না। কেননা বোন জামাই, বোনের শ্বশুর নেহাতই ভদ্রলোক। তাদের বোনকে বিয়ের করেছেন বিনা যৌতুকে। কোন রকম কষ্ট কখনো দেয়নি। বরং সোনায় সোহাগা করেই রেখেছে। এমনকি তাদের বিপদে আপদে সবার আগে তারাই এগিয়ে যায়। বিনা বাক্যে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করে। আর এমন বোন জামাই, জামাইয়ের পরিবারকে চাইলেই চট করে কিছু বলা যায় না। তার মধ্যে তাদের অবস্থান আবার এদের চেয়ে নিচু। তাই পছন্দ না হওয়া সত্বেও মুখে কুলুপ এটে বসে আছেন।
আনতারা আর শবনমের আজকে বের হওয়া নিষেধ। ফর্সা একবার চোখে লাগলে কালোরে মনে ধরে না । তাই মুর্শিদার কড়া করে বলছে। তাদের বের হওয়ার কোন দরকার নেই। মুনিয়া আছে সে এদিকে সামলে নেবে।
তারা বের হয় ও নেই। কি দরকার। বরং তারা খুশি মনেই শবনমের রুমে বৈঠক বসিয়েছে। তাদের সাথে আজকে মিথিও যোগ দিয়েছে। তাকে অবশ্য কেউ নিষেধ করেনি। তবুও সে নিজে থেকেই আছে। কি দরকার ভাই। যে মেয়ে কিছু হলে ছিলে মরিচ ডলে দিবে।
তাই সে এক ডিব্বা আচার নিয়ে বসেছে। আরাম করে বসে বসে সেগুলোই হালাল করছে। আর শবনম পড়েছে আনতারার নাক নিয়ে। সুতোটা কাটা দরকার। এই মেয়ের হাত পা ঘেমে শেষ। অথচ শুকনো খড়খড়ে, সুতো লাটিমের মতো ঘুরছে। একটু কোনা কেটে টান দিলেই বেরিয়ে আসবে।
শবনম করলও তাই। একটু কেটেই দিলো টান। আনতারা চিৎকার দেবে তখনি মুখ চেপে ধরল। ধরে বলল, — রাতে তো কোন চিৎকার চেঁচামেচি শুনি না। আর আমরা একটু ধরতেই হুঁশ জ্ঞান নেই।
আনতারা ভয়ে আঙুল ঝেড়ে ঝেড়ে আস্তে আস্তে নাকে হাত রাখল। না কোন ব্যথা নেই। সে হেসেই বোকার মতো বলল, — রাতে চিৎকার কেন দেব ভাবি। তখন তো কোন ব্যথা থাকে না।
মিথি আচারের বয়াম বুকে চেপেই হেসে খাটে গড়াগড়ি খেলো। শবনমও হাসলো! তবে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে রইল। বিয়ের এতদিন হলো। আজাদ ভাই আনতারার কাছে যাইনি?
মিথি সামনে তাই শবনম তার কিছু বলল না। তবে তার মনে খটকা লেগে রইল। আজাদ ভাই কি মন থেকে বিয়েটা মানেনি? দেখতে তো সব কিছু স্বাভাবিকই লাগে। তবে? এই দুটো ভাই তো দেখা যায় তলে তলে খাটাশের খাটাশ। একটা সব করবে বাচ্চা নেবে না। আরেকটা বাইরের সব করবে বউর কাছে যাবে না। দেখেতো কান্ড। সে মনে মনে দু- ভাইয়ের গুষ্টি উদ্ধার করে হাতে নাকফুল নিলো। নিতেই আনতারা ভয়ে লাফিয়ে উঠল।
শবনম সাথে সাথেই নিজের কপাল চাপড়ালো। এই ব্যাঙের লাফালাফি দেখে যে কেউই ভাগবে। আর আজাদ ভাইয়ের দোষ দিয়ে কি লাভ ? ছুঁতেই তো মনে হয় ভয় পায়।
বিথীকে তাদের পছন্দ হলো। অবশ্য পছন্দ না হয়ে উপায় কি। বিথীর মামা আগেই কান ভরেই নিয়ে এসেছে। এক মেয়ে দু- হাত ভরেই দেবে। তাই তাদেরও কোন সমস্যা নেই। বিয়ের দিন তারিখ পড়ল এই সপ্তাহের শেষে। ছেলের ছুটি কম। তাই শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সমাধা করা যায়, ততই ভালো।
পাত্র পক্ষ যেতেই মুর্শিদা পাড়া প্রতিবেশী সবার মধ্যে মিষ্টি দিলেন। দিলেন চেয়ারম্যার বাড়িতেও। জহির সেই মিষ্টা দেখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে শান্ত চুপচাপ।
ইকবাল বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ইব্রাহিমেরও কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। তবে জামিল টপাটপ মিষ্টা মুখে পুরে বলল, — খাঁটি সানার মিষ্টা। স্বাদ ভালো। নেও জহির বাবা একটা খাইয়া দেখ।
চলবে…..