বিষাদ_বৃক্ষ পর্ব-২৯

0
30

#বিষাদ_বৃক্ষ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৯

রাফিয়া বিয়ে বাড়ি থেকে আর ফিরে যাইনি। এতো ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে এতো রাতে তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। তাই রাতে ইব্রাহিম লোকটার বাসায় ছিল। তাছাড়া এই গ্রামের পাট তার এখানেই শেষ। ক্লিনিকে তার কিছু দরকারি জিনিস ছিল। সেগুলোই নিতে এসেছে।

সে তার সব কিছু গোছগাছ করল।রবিবার ছাড়া ক্লিনিকে তেমন ভির থাকে না। আজও নেই। তাছাড়া রোগী দেখার চেম্বার এক পাশে হওয়ায়, এই পাশটা এখন বলতে গেলে পুরোই নীরব। প্রায় দু- বছরের উপরে এই রুমটায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়ার পরও আজ কেমন অচেনা লাগছে।

আজাদের সাথে তার পরিচয় তার ভাইয়ের মাধ্যমে। তার বড় ভাই, আর আজাদ একই ভার্সিটিতে ছিল। গলায় গলায় সম্পর্ক না থাকলেও ভালো বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে বাসায় আসতো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো আজাদের মধ্যে তেমন কিছু নেই। বলতে গেলে গ্রাম থেকে উঠে আসা গেঁয়ো ভূত বলা যেতে পারে। সে প্রথমে ভেবেছিল গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে টেলে হতে পারে। যারা একটা শার্ট, একটা রংচটা জিন্স নিয়ে পরিবারের দিন ঘুরাতে জান প্রাণ ছেড়ে শহরের ভার্সিটিতে পড়তে আসে। শুধু একটা ভালো চাকরির আশায়।

তবে তার ধারণা ভুল ছিল। আজাদ আসলে ছিলোই এমন। সাধারণ চেহেরার সাধারণ দেখতে একটা ছেলে। কোন বারতি রং নেই, ঢং নেই। শুধু আছে মন ভোলানো একটা হাসি। যে কথাই বলো ফিক করে হেসে ফেলবে। যেন সব কিছুতেই কতো মজা। প্রথম দেখায় প্রেমে না পড়লেও তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যার কারণে তার সাথে মিশে, কথা বলে প্রেমে না পড়ে সে থাকতেই পারেনি। তাই সে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল।

তার আর আজাদের সম্পর্ক শুরু হলো বিনা অনাড়ম্বর ভাবে। দু- জনের দুনিয়া ছিল ভিন্ন। ওই মাঝে মাঝে শুধু একটু দেখা আর কথা বলা। কখনো ইচ্ছে হলে হাতে হাত রেখে বসে থাকা।

সেই অনাড়ম্বর জীবনে হঠাৎ করেই পরির্বতন এলো তার মেডিকেলে পড়ার সময়। হঠাৎ করেই মনে হলো আজাদ তার সাথে বড়ই বেমানান। ততদিনে আজাদের ভার্সিটির পাঠ প্রায় শেষ। সে গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাবে। সে শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, – তুমি গ্রামে যাবে কেন?

আজাদ তার স্বভাব মতো হেসে বলেছিল, — আমার কি এখানে থাকার কথা?

রাফিয়া ডানে বামে যাইনি। সোজা করে বলেছিল, — তুমি গ্রামে ফিরে গেলে আমার এই সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না।

আজাদ তখনও আগের মতোই হেসেছিল। হেসে বলেছিল, — এই সম্পর্ক তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। যখন তুমি সুন্দর, স্মার্ট, পরিপাটি মাহতিম স্যারকে দেখেছো।

রাফিয়া তখন চমকে উঠেছিল। আজাদকে সে সব সময় বোকাই ভেবে এসেছে। যা বলে সব সময় এক কথাই হ্যাঁ। দিন দুনিয়ার কোন খেয়াল নেই। এই ছেলে তার মেডিকেলের ভেতর পর্যন্ত কিভাবে গেল তার মাথায় এলো না।

বিনা অনাড়ম্বরে যেমন এই সম্পর্ক শুরু হয়েছিল, বিনা অনাড়ম্বরেই এই সম্পর্ক শেষ হলো। মাঝে কয়েক বছর কোন যোগাযোগ ছিল না। ততদিনে রাফিয়া এতটুকু ঠিকিই বুঝেছে। কি হারিয়েছে সে।

তারপরই হঠাৎ করে আবার আজাদের সাথে দেখা। সেই আগের মতো, তার ভাইয়ের মাধ্যমে। এই কয়েক বছরেও এই ছেলের কোন পরিবর্তন নেই। সেই আগের মতোই এলোমেলো, অগোছালো। দিন দুনিয়া কোন খেয়াল নেই। রাফিয়ার সাথে কথাও বলল খুব স্বাভাবিক ভাবে। তার সাথে চিট করেছে, এমন কোন হাবভাবও দেখা গেল না। রাফিয়া তো একবার জিজ্ঞেসই করে বসলো, — তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো তো?

আজাদ তার স্বভাব মতো হেসে ফেলেছে। তবে কিছু বলে নি। রাফিয়া আবার নতুন করে আজাদের প্রেমে পড়ল। আজাদের ক্লিনিকের কথা শুনে এক কথায়ই রাজি হয়ে গেল। সে জানে ভাঙা সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে সময়তো লাগবেই। তাই সে ভেবেছে ধীরে ধীরে আজাদকে আবার তার প্রেমে মাতোয়ারা করবে। তবে তার সব চেষ্টায় পানি ফেলল এই বিয়ে। মানবে কি করে?

তখনি পরিমল বাবু উঁকি দিলেন। রাফিয়া চমকে উঠল। সে দরজা লাগায়নি। দু- মিনিটের কাজ ছিল। ক্লিনিকের কিছু দূরে জামিল লোকটা আছে। তার দায়িত্ব নিরাপদে তাকে শহরে পৌঁছে দেওয়া। তাই ভেবেছে যাবে আর আসবে। সে চমকেই বলল, — স্যার আপনি?

পরিমল বাবু হাসলেন। হেসে এগিয়ে বললেন, — হ্যাঁ আমি! তুমি চলে যাচ্ছো নাকি?

— হ্যাঁ।

— সব ফর্মালিটি কমপ্লিট?

— না তেমন কিছু হয়নি। তবে আজাদ বলেছে আমার ইচ্ছে হলে আমি চলে পারি।

— হুম! আজাদ যখন বলেছে তাহলে অবশ্যই পার।

— ভালো থাকবেন স্যার। হয়ত আর দেখা হবে না।

— এটা একদম সত্য, আর দেখা হবে না।

— মানে?

পরিমল বাবু আবার হাসলেন! হেসে বললেন, — অভিনয় ভালো ছিল রাফিয়া।

রাফিয়া আবারো চমকালো। পরিমল বাবুরতো কিছু জানার কথা না। তখন আনতারা যেতেই রাফিয়া সরে দাঁড়িয়েছে। সে ভেবেছিল আজাদ তাকে কিছু বলবে। তবে সে রকম কিছু হয়নি। কেন করেছি জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি। সে নিজের মতো সিগারেট ধরিয়েছে। পরে রাফিয়া আর দাঁড়ায়নি। তার কাজ এইটুকুই ছিল। আনতারাকে দেখানো। অবশ্য কাজও না। সে শুনে নিজেই রাজি হয়েছে। আজাদ তাকে হেয় করে সুখের সংসার করবে এটা তার সহ্য হচ্ছিল না। তাই ইব্রাহিম লোকটা বলতেই সে অনায়াসেই রাজি হয়েছে।

সে নিজেকে সামলে বলল, — কিসের অভিনয়?

পরিমল বাবু উপরের ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে একবার তাঁকালেন। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে রাফিয়ার সামনে দাঁড়ালেন। তার দুটো হাত’ই প্যান্টের পকেটে রাফিয়া চমকে উঠার কারণে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন করল! করে কিছু বলবে তার আগেই পরিমল বলল, — স্যরি রাফিয়া। তোমার শুধু এই গ্রামের পাট চুকেননি, বরং এই দুনিয়ার পাটই চুকে গেছে।

বলেই হঠাৎ করে রাফিয়ার মুখে রুমাল চেপে ধরল। রাফিয়া ছাড়ানোর জন্য কিছুক্ষণ ছটফট করল। তবে হাই ডোসের কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

পরিমল বাবু কিছুক্ষণ রাফিয়ার মুখের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন। তারপর রাফিয়ার গায়ের ওড়না টেনে গলায় পেঁচিয়ে ধরলেন।

আসাদ রুমে এসে দেখল। শবনম শুয়ে আছে। মাথায় সম্ভবতো পানি দেওয়া হয়েছে। আর পুরো ঘর প্রায় বমিতে মাখামাখি। সেই বমি আনতারা ধীরে ধীরে পরিষ্কার করছে। সে এগিয়ে এসে বলল, — কি হয়েছে?

আনতারা নিজেও ভয়ে শেষ। ভাবি যে এতো অসুস্থ সে তো জানতোই না। রুমে এসে দেখে অবস্থা কাহিল। কাকে বলবে, কাকে ডাকবে সে দিশেই পেল না। পরে নিজেই পানি এনে ভাবির মাথায় পানি দিয়েছে, চোখ মুখ মুছিয়েছে। লেবু চিপড়ে একটু শরবত করে দিতেই কেমন ঢকঢক করে খেলো। আনতারার এতো মায়া লাগলো।

এই বাড়িতে এসেছে পর থেকে বিনা স্বার্থে এই মানুষটাইতো তাকে আগলে রেখেছে। আর সে একটু খেয়াল রাখতে পারল না। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,– ভাবির কি হয়েছে?

আসাদ হতম্ভব হয়ে আছে। আসলে এতো কিছু হলো এই দিকের তার কোন খেয়ালই ছিল না। সে হতম্ভব হয়েই এগিয়ে গেল। শবনমের মাথার কাছে বসে কপালে হাত রাখল। প্রথম বার নরম সুরে বলল, — কি হয়েছে শবনম? দেখি চোখ খুলোতো। আমাকে বলো সমস্যা কি?

শবনম চোখ খুললো না। কেননা খুললেই সে কেঁদে ফেলবে। আসলে এই কয়দিনের দৌড়দৌড়ি নানান ঝামেলায় খেয়াল না করলেও, কিছুক্ষণ আগে যখন চোখ মুখ উল্টিয়ে বমি করল। তখনি তার টনক নড়ল। তার শেষবার তারিখ গেছে কবে? এতো এতো ঝামেলায় সে মনেই করতে পারল না। তখন থেকেই তার ভেতর কাঁপছে।

এতো এতো বিষাদের মাঝেও আসাদ হাসলো! সে ভুলেই গেল রুমে আনতারা আছে। সে নিচু হয়ে আলতো করে শবনমের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

আনতারা তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সে লজ্জা পেয়েছে তবে একটু স্বস্তিও লাগছে। হয়ত ভাবি বেশি অসুস্থ না। মনে হচ্ছে চিন্তার তেমন কোন কারণও নেই। সে বেরিয়ে চলে এলো একেবারে আবসারের রুমে। নানা ভাই আর রুম থেকে বের হয়নি।

আবসার আনতারাকে দেখে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো। আনতারা এগিয়ে গিয়ে পাশে বসল। বসতেই আবসার নরম সুরে বলল, — কাল কি হয়েছিল বুবু?

আনতারার মুখটা মলিন হলো। মলিন মুখেই মুখটা নিচু করল। তবে কোন শব্দ উচ্চারণ করল না।

আবসারও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাঁকিয়ে রইল। তবে এই ব্যাপারে কিছু আর জিজ্ঞেস করল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, — কিছু বলতে এসেছিল?

আনতারা উপর নিচে মাথা দোলালো।
— কি?

— আমি মিথিকে একটু দেখতে যাই?

আবসার আবারো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসল। নিশ্চুপ বসলেও এবার তার চেহেরার রং বদলেছে। আনতারা বুঝেনি। তাই আগের মতোই বলল, — একটু যাব। গিয়েই চলে আসবো।

আবসার বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বলল, — একা যেও না। রমিজকে বলছি তাকে নিয়ে যাও।

আনতারা মাথা নাড়লো। নেড়ে বেরুবে আবসার আবার তাকে ডাকল, — আনতারা?

আনতারা ফিরে তকালো। আবসার আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। আনতারা এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এখন করল। নানা ভাই কিছু নিয়ে খুবই চিন্তিত। যেন কিছু বলতে চায়, তবে বলতে পারছে না।

আবসার ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করল। করে আস্তে করে বলল, — চোখের দেখা সব সময় সত্যিই হয় না আনতারা আর… আবসার থেমে গেল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, — যাও সন্ধ্যায় আগে ফিরে এসো।

আনতানাও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা সে বুঝতে পারে না। তবে আজ এইটুকু বুঝল নানা ভাই আজাদের কথা বলেছে আর বাকিটুকু?

আনতারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। সেইদিন এইটুকু রাস্তা হাঁটতেই তার কাহিল অবস্থা হলেও, আজ সে হেঁটে এলো নির্ধিদ্বায়। রমিজ ভাই অবশ্য তার সাথে সাথে হাঁটছে না। সে হাঁটছে একটু পিছনে। মাথা নিচু করে। আনতারার একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, — আপনার ছোট ভাই কোথায়? তবে কেন জানি গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। সেটা অভিমান থেকে, না রাগ থেকে নাকি অন্যকিছু আনতারা বুঝতে পারল না।

আনতারাকে দেখেই মিথি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। এতদিনে যে মেয়ে আনতারার ধারেরও কাছে আসে নি। আজ তাকেই সবচেয়ে আপন ভেবে আঁকড়ে ধরতে চাইল।

আনতারা কিছু বলল না, বরং মিথিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা এমন থরথরিয়ে কাঁপছে কেন? কি হয়েছে তার সাথে?

আনতারা জহিরের দিকে তাকালো! জহির মাথা নিচু করে বলল, — মিথি পুরো না খাওয়া ভাবি। এই বাড়ির এক ফোটা পানিও সে এখন পর্যন্ত গলা দিয়ে নামাইনি। আপনি কি ওকে একটু বুঝাবেন?

আনতারার বড়ই দিশেহারা লাগল। এতো এতো ঝামেলা এতো এতো সংসারের মারপ্যাঁচে সে তো কখনো পরেনি। কি করবে সে?

সে মিথির মাথায় পরম মমতায় হাত বুলালো। আর তখনি আশ্চর্য হয়ে সে খেয়াল করল। এতো কিছুর পরেও এই দিশেহারা অবস্থায় শুধু একজনের কথাই তার মনে পড়ছে। আজাদ! সে দিশেহারা ভাবেই মনে মনে বলল, — আজাদ আপনি কোথায়?

চলবে…….