#বিষ_করেছি_পান(৩৫)
(কপি করা নিষেধ)
— সোহাগ? উঠুন। এটা আমার ভার্সিটি। সবাই দেখছে। কি হচ্ছেটাকি?
রিতী সোহাগকে ছোড়ানোর চেষ্টা করে। উপরি সোহাগ আরো রিতীকে চেপে ধরে নিজের সাথে। রিতী আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কেউ কিছু হয়তো বলছেনা তবে মুখ চেপে হাসতে হাসতে ক্রস করছে। রিতী রাগ দেখিয়ে সোহাগকে ধাক্কা দেয় । ধাক্কাটা ঠিক ধাক্কা হয়ে উঠেনা। রিতী খেয়াল করে রিতী রাগ ও করতে পারছেনা। রিতীর রাগটাই আসছে না। অথচ সোহাগের কাজটা প্রচুর রাগের একটা বিষয়। শেষমেষ ছাড়াতে না পেরে রিতী থেমে যায়। নিজের থেকেই আপনাআপনি হাত দুটো সোহাগের ঘাড়ের উপর উঠে আসে। ধীরে সয়ে ডাক দেয়,
— সোহাগ? এই সোহাগ?
আচমকা সোহাগ রিতীকে ছেড়ে দেয়। দুপা পিছিয়ে এসে চুলে আঙুল চালিয়ে দেয়। শার্ট নিচের দিকে টেনে নিয়ে ভদ্র ছেলে হয়ে দাঁড়ায়। রিতী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সোহাগ কেই দেখে। ছেলেটা আরো ফর্সা হয়ে গিয়েছে। তবে চোখে গালের উপরে পড়েছে ছায়া আবরণ। তবুও যেনো ভালো লাগছে। হুটহাট রিতী একটা কথা জিজ্ঞেস করে,
— মদ খাওয়া হয়?
সোহাগ মৌন থাকে। ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে অদ্ভুত হাসি। রিতীর বাজে লাগে হাসিটা। অপরপাশে ঘুরে রেলিং এ হাত রাখে। কঠিন গলায় বলে,
— মদারু গাজারু লোকদের আমি সহ্য করতে পারিনা। তারা সব সময় আমার থেকে দূরে থাকুক এটাই আশা করি।
— মদ খাওয়া ছেড়ে দিলে কি লেপ্টে থাকতে বলবে?
— আমি অতটা সস্তা নই।
— এটি টিউট দেখাচ্ছো?
— সত্যটা বললাম।
সোহাগ পাশে এসে দাঁড়ায়। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাইরের দিকে নজর ফেলে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
— পালিয়ে না গেলেও পারতে। আমি নিশ্চয় কিছু একটা করতাম। আমিও চাইনি তোমাকে বিয়ে করতে।
— সেটা আমার থেকে কে ভালো জানে?
— আমার তোমার সম্পর্কটা কেমন যেনো। একটা গানের মতো। একটুখানি গেয়ে শুনাই।
‘ মূখে বলি দূরে যা..
মন বলে থেকে যা..
দূরে গেলে বুঝি তুমি কত আপন…
পাগল তোমার জন্য রে.. পাগল এ মন.. পাগল। ‘
— আপনি আসলেই পাগল।
অভিমানে গাল ফুলিয়ে ক্লাসের দিকে হাটা দেয় রিতী। সোহাগ বড় বড় পা ফেলে ধরে ফেলে রিতীর হাত। টেনে নিয়ে যায় নিচতলার দিকে। রিতী চিৎকার করে,
— এই আমার ক্লাস আছে।
কে শুনে কার কথা। ক্যাম্পাসে দাঁড় করানো সোহাগের সাদা গাড়িটায় নিয়ে গিয়ে বসায়। রিতী বাঁধা দেবার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা।হাত দুটো সোহাগের হাতের মাঝে। মুখ খুলার আগেই সোহাগ মুখে পকেট থেকে বের করে রুমালটা বেঁধে দেয়। ভ্যাপ্সা পঁচা গন্ধে রিতীর পেট থেকে নাড়ি ভুড়ি ভেরিয়ে আসে। ওক ওক করতে থাকে। সোহাগের কান দিয়ে ঢুকে না। এক হাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিতী সোহাগের দিকে তাকিয়ে ভয়ে সিটিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? কোন বিপদে পড়বেনাতো? এই বখাটে টা কি কোনদিন মানুষ হবে না? চোখের কোনায় জল জমে উঠে রিতীর।
সোহাগ রিতীর চোখের জল দেখে মিচকে হাসে। গাড়ির পাওয়ার স্লো করে দেয়। সামনে তাকিয়েই বলে,
— পাঁচ মাস আটদিন তোমার দেখা পাইনা পিরীতি। যেখানে তুমি জানো একদিন তোমাকে না দেখলেই আমি কেমন পাগল হয়ে যাই। সেখানে আমার সাথে এতোবড় একটা কান্ড করে গাল ফুলাও! আমি পাগল বল! পৃথিবীতে তুমি একটা মানুষ যে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। তীলে তীলে বিষাক্ত ব্যথায় নুইয়ে পড়ছি আমি। এর প্রতিকার কী? মুক্তি চাই আমি। আমাকে এবার মুক্ত করো। কসম আমি তোমায় মুক্ত করে দিবো।
— ইউর টাইম ইজ ওভার। আমি কোন অনিশ্চিত জীবন চাইনা।
— আই হ্যাভ এ প্রপোজাল ফর ইউ।
— আপনি নেই তো?
— আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনা।
— কোথায় যাচ্ছি?
— তোমার শ্বশুর বাড়ি।
— নো। নেভার। যাবোনা আমি। গাড়ি থামান। এই বিশ্রি রুমাল টা মুখ থেকে সরান। আর নিতে পারছিনা আমি।
সোহাগ রিতীর হাত ছেড়ে দেয়। রিতী মুখ থেকে রুমালটা খুলে গাড়ির জানালা দিয়ে দূরে ঢিল ছুড়ে। মুহূর্তে ই গাড়িটা কোন আবাসিক এলাকার গলিতে আবিষ্কার করে। কিছু বলতে না বলতেই একটা গেইট দিয়ে গাড়িটা ঢুকে পড়ে। রিতী মুখ বাড়িয়ে দেয় জানালা দিয়ে। বিশাল তিনতলা একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামে। বাইরে থেকে দেখেই রিতীর চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ি দেখেই বুঝে যায় সোহাগরা কতটা বড়লোক! সোহাগ কিছু না বলেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে রিতী কি করবে কি করবেনা ভেবে উঠতে পারছেনা। আকাশ সম টেনশনে জমে গেছে। দু মিনিট পর সোহাগ বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে আসে।হালকা হেলে রিতীর মুখোমুখি নিজের মুখটা নেয়।
— শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পা রাখতে চলছো। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার মতো গর্দভ নয়। তারা যথেষ্ট এডুকেডেড আর সম্মানীয়। তাদের জায়গাটাকে সম্মান দিও।
— আমি পারবোনা। যাবোনা আপনার বাড়িতে। জোর করে ধরে এনে এ বাড়িতে ঢুকতে বললেই আমি শুনব নাকি? মগের মুল্লুক পেয়েছেন?
— জোর করে বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না?
— বিয়ে মাই ফুট।
— তা বললে তো চলে না। বিয়ে করার বাতিক তোমার। আমার না। তুমি যেমন জোর করে বিয়ে করে রিসোর্টে নিতে পারো আমিও তেমন নিজের বউকে জোর করে ঘরে তুলতে পারি। সিন ক্রিয়েট করবেনা বেরিয়ে আসো।
— কি লাভ আপনার এসব করে?
— আমার যে এখনো তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়া বাদ পড়ে আছে।
— এই সর সর। সরে দাঁড়াও। আব্বা বউমাকে বেরোতে দাও।
মহিলার গলা শুনে ঝটপট চোখ ঘুরায় রিতী। হাস্যজ্জল লম্বা সুশ্রী একজন মাঝবয়সী মহিলাকে চোখে পড়ে। মুখে বিন্দুমাত্র বয়সের ছাপ নেই। একটু মুটিয়ে না গেলে হলফ করে বয়সটা ত্রিশের নিচে নামিয়ে আনা যেতো। সোহাগের সাথে মুখের দারুন একটা মিল। পেছনে পেছনে ছুটে আসছে আরো দুজন মেয়ে আর তিনজন ছেলে। তাদের বেশ বোশাক দেখে বুঝা না গেলেও রিতী অনুমান করে নিলো এরা এবাড়ির সার্ভেন্ট। বড়লোক বাড়ির সার্ভেন্টরা একটু পরিপাটি স্মার্ট হবেই। তবে এই মহিলা কে? সোহাগের মা? মনে হতেই রিতী জানালার বাইরে থেকে মুখ ভেতরে নিয়ে আসে। সামনে গ্লাসে দেখতে পায় স্বয়ং রমিজউদ্দিন বেরিয়ে আসছে। রমিজউদ্দিন কে রিতী চেনে। বেশ কয়েকবার দেখেছে। নামী দামী লোক তিনি। এমপি মিনিস্টার দের সাথে উঠবস। হাত পা কাঁপতে থাকে রিতীর। সেদিন তো বাবা এদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাহলে কি এতোদিন পর এর বদলা নেবার জন্য রিতীকে ধরে এনেছে? কি করবে এরা? ঘরে বন্দি করে রাখবে? অত্যাচার করবে? গলা শুকিয়ে আসে রিতীর। সোহাগের আচরণ ও ঠিক ঠাক লাগছেনা। তার চেহারায় রাগ জেদ বিরক্তি কিচ্ছু নেই। কত স্বাভাবিক! জোর করে যে একটা মেয়েকে তুলে এনেছে কেউ ভাবতেও পারবেনা মুখ দেখে। মহিলাটি সামনে দাড়াতেই সোহাগ পিছিয়ে দাঁড়ায়। সোহাগকে এখন বাধ্য ছেলের মতো ব্যবহার করতে দেখছে। ফ্যামিলির কাছে সোহাগ এতো লয়্যাল! খানিকটা অবাক হয় রিতী। মহিলাটি দরজা খুলে রিতীকে ইশারায় নেমে আসতে বলে। রিতী একবার সোহাগের দিকে আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে নেমে আসে। সোহাগী ছেলে বউয়ের মুখখানা আজলা ভরে নেয়। মুচকি হেসে কপালে চুমু দেয়। মাশাআল্লাহ বলে দোয়া দেয়। কাঁধে হাত রেখে বলে,
— অবশেষে শ্বশুরবাড়িতে পা পড়লো আমার বউমার! আমি তোমার আম্মা হই। ভয় পেওনা। ঐ যে দেখো তোমার আব্বা। তাকে তো তোমার চেনার কথা। আর এরা হচ্ছে আমার হেল্পিং হ্যান্ড। বিয়ে করেছো সেই কবে! শ্বশুরবাড়ি পা রাখতে অনেক দেড়ি করে ফেললে। এরজন্য তোমার সাথে আমার কিঞ্চিৎ পরিমাণ অভিমান টা এখনো গলেনি। তবে আমি আমার বউমার কোন অযত্ন হতে দেবো না। এই দুধ মিষ্টি দে।
একজন হাতে মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো একজন দুধ,পানি নিয়ে। শ্বশুড়ির কথার ধরনে আর ভাবসাবে রিতী অনুভূতি শূণ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউকে ঠিক যেভাবে নামানো হয় ঠিক সেভাবেই দুধ মিষ্টি জল খাইয়ে রিতীর অনামিকায় বড় সড় একটা গোল্ডের রিং পড়ানো হয়। রিংটা বের করে দেয় রমিজউদ্দিন। পরিয়ে দেয় সোহাগী। এতো বড় রাজকীয় রিং দেখেই রিতী ঢুক গিলে। ততক্ষনে সোহাগ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।
— সালাম করো।
বলেই সোহাগ ঝুঁকে পড়ে। রিতীও বাধ্য হয়ে সোহাগকে অনুসরণ করে পর পর সোহাগী এবং রমিজউদ্দিন কে সালাম করে। রমিজউদ্দিন প্রাণ ভরে রিতীকে দোয়া করে। রিতীর ভয়ার্ত মুখখানা সবার চোখেই ধরা পড়ে। রমিজউদ্দিন মাথায় হাত রেখে বলে,
— আমরা তোমার আরেক বাবা মা। নতুন এক পরিবার। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষ গুলো তোমার আপনজন। এখানে ভয় পাবার মতো কিছু নেই। তবুও আমার বউমা কেনো ভয় পাচ্ছে শুনি?
রিতী আমতা আমতা করে। কি বলবে? এতো স্বাভাবিক আচরণ রিতী কখনোই আশা করেনি। রমিজউদ্দিন বিচক্ষন মানুষ। রিতীকে পড়তে তার সময় লাগলো না।
বরং রিতীকে আস্বস্ত করলো।
— আমি তোমার বাবার সেদিনের কথা কিছু মনে রাখিনী। তুমি আমার জন্য ইমপর্টেন্ট। তুমি আমার ছেলেকে বিয়ে করেছো আমার খারাপ ছেলেটার দায়িত্ব নিয়েছো তোমার বাবা নয়। আমার বাড়ির ভবিষ্যত এর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ একদম মানায় না। মাথা উঁচু করে আমার সংসারে প্রবেশ করো। তুমি যদি চাও তোমার শ্বশুর একবার অপমানিত হয়েছে। প্রয়োজনে আবার তোমার বাবার কাছে অপমানিত হতে যাবে। তুমি শুধু আমার ছেলের দিকে খেয়াল রাখবে।
সোহাগী কে ডেকে বললো,
— সোহাগী। বউমাকে ঘরে নিয়ে যাও। তোমার হ্যাল্পিং হ্যান্ডদের রান্না চাপাতে বলো। নতুন বউকে ওয়েলকাম করার সব বন্দোবস্ত করো। আমি একটু বেরোচ্ছি।
রমিজউদ্দিন চলে গেল। সোহাগী এসে রিতীর হাত ধরলো। সোহাগীর সাথে সাথে রিতীও পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সোহাগীর পেছন পেছন সোহাগ এসে দাঁড়ালো। রিতী বাড়ির ভেতর ঢুকতেই তার দিকে গোলাপের পাপড়ি ছুড়া হলো। প্রথমে মুখের উপর পাপড়ি পড়তেই রিতী হকচকিয়ে গেলো। পরে যখন বুঝলো নতুন বউকে ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হচ্ছে তখন রিতী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সবাই রিতীকে নতুন বউ বউ বললেও রিতীর বউ বউ কোন ফিলিংস ই আসছেনা। বরং তার মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরছে। এই যে সে এই বাড়িতে ঢুকলো.. কত ঘন্টা থাকতে হবে? কত দিন? এরা যেভাবে তাকে আপন করে নিচ্ছে সহজে কি ছেড়ে দিবে? আর সোহাগ? সোহাগের কথা মনে হতেই রিতীর কান্না পাচ্ছে। এই লোকটাকে নিয়েই তার অশান্ত মনে যত অশান্তি। সোহাগের মুখের দিক তাকিয়ে রিতীর সত্যি সত্যি কান্না চলে আসে। উঠ ভেঙে কেঁদেও দেয়। আকষ্মিক বাড়িতে এতো খুশির মাঝে রিতীর কান্না সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। রিতীকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। সোহাগ ও রিতীর সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,– কি হয়েছে পিরিতি? কাঁদছো কেনো?
— আমি কাঁদছি না।
— আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি কাঁদছো।
— আমি কাঁদছি না। আপনি কাঁদাচ্ছেন।
সোহাগী সোহাগের বাহু ধরে সরিয়ে দেয়।
— এই সর তো দেখি।
রিতীকে সোফায় বসিয়ে টলমল করে গড়িয়ে পড়া জল গালে হাত দিয়ে মুছিয়ে দেয়।
— তোমার কি খারাপ লাগছে আম্মা? কি মনে করে তুমি কাদতাছো? সোহাগ তোমারে কিছু বলছে? ঐ সোহাগ আসার সময় কি বলছোস সত্যি করে বলতো? নয়তো যে মেয়ে তোরে জোর করে বিয়ে করছে সে কেনো এতো ভয় পায় ? সে কেনো তোরে দেখে চোখের পানি ছাড়ে?
সোহাগী ক্ষেপে উঠে সোহাগের উপর। সোহাগ একহাত কোমড়ে রেখে বলে,
— আম্মা আমি কিছু কইনাই।
— তাহলে বউমা কাঁদে কেন? যা তুই সামনে থেকে সর। যা। আমি দেখতাছি কি হয়ছে।
— আম্মা আমার সাথে এইভাবে কথা চলবে না। তোমার ঘ্যাণঘ্যানানিতে ওরে আনছি। এখানে আমার কোন দোষ নাই। তুমি ওরে জিজ্ঞেস করো কাঁদে কেন?
— কি আজব!
রিতী আঙুল তুলে বলে,
— আম্মা আপনার ছেলেকে যেতে বলেন। আমার উনাকে দেখলেই কান্না পায়তেছে। আমাকে ভার্সিটি থেকে তুলে আনছে জানেন?
রিতীর কথায় সোহাগী মুচকি হাসি দেয়।
— তাতে কি হয়ছে আম্মা? তোমার কাপড় চোপড় কসমেটিকস সব পাইয়ে যাবা। তুলে আনা তো এ বাড়ির ঐতিহ্য! তোমার আব্বাও তো আমারে তুলে এনেই বিয়ে করছে। তো তোমার আব্বার পোলা হিসেবে তুলে নিয়ে বিয়ে না করতে পারলো বাড়িতে তো আনতে পারে! ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবো না?
শ্বশুড়ীর কথায় রিতী আরো কাঁদতে লাগলো। নিজের উপর নিজেরই রাগ বিরক্তি সব ছেকে ধরেছে। কি মনে করে শ্বশুড়ির কাছে নালিশ চাপালো আর কি উত্তর পেলো! যার পরিবারই এমন সে তো এরকম হবেই। না পারছে ছাড়তে না পারছে ধরতে। বিয়া করা স্বামী যে। নিজের বোরখা খামচে ধরে ফুফাতে লাগলো। তবে রিতী একটু হলেও নিশ্চিত হয়েছে। বাড়িতে নিয়ে এসেছে অন্য কোন জায়গায় তো নিয়ে যায়নি! তারমানে অন্য কোন বিপদ ও রিতীর উপর আসবেনা। আপাতত সেসব বিপদের ভয় ও পাচ্ছেনা। সোহাগ নামের বিপদটাযে এই বাড়িতেই খাড়া।
— ভাবীসাব। জুস নেন।
আহা! অরেঞ্জ জুস উইথ বরফ! এতো আপ্যায়ণ! রিতী সময় নিয়ে কান্না থামিয়ে দিলো। একচুমুকে গ্লাস সাফ করে গলা ভিজিয়ে নিলো। অমৃত! ভালো লাগছে। শ্বাশুড়ি ও নেই। সোহাগ ও নেই। রিতী আশেপাশে তাকিয়ে প্রাসাদটা দেখতে লাগলো। রিতীর দৃষ্টি অনুসরণ করে কাজের মেয়েটাও দেখতে লাগলো। খুশিতে গদ গদ করতে করতে বললো,
— মেলা সুন্দর বাড়ি,ভাবীসাব! তাই না?
সোহাগী বেগম সোহাগকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ছেলেটাকে তো অনেক বলে কয়ে বউমাকে বাড়িতে আনলো। এবার একে আটকানোর পালা। বউয়ের জন্য তার ছেলে যে কতোটা ডেম্পারেট সেটাতো নিজের চোখেই দেখেছে এতো দিন। এখন আর ছাড়া যাবেনা। সংসারের প্রতি মায়া বাড়াতে হবে।পায়ে লাগাম পড়াতে হবে। বাউন্ডুলে জীবন তো আসলে জীবন না। বউছাড়া তো সম্ভব ও না। তাই যেই জানতে পেরেছে ছেলে রিতীর কাছে গিয়েছে ওমনি ফোন করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আল্লাহ দোহায় দিতে রিতীকে বাড়িতে আনতে রাজি করিয়েছে। কিন্তু ছেলে এখনো ত্যাড়ামি করে যাচ্ছে।
— আম্মা আমি সংসার টংসারে যাইতে পারমু না। আমারে জোড় করবানা।
— সুন্দর করে কথা বল আব্বা। বউমা আসছে ঘরে। পড়ালেখা করা মেয়ে। দেখছিস না আমি সুন্দর করে কথা বলতাছি।
— সুন্দর হয়তাছেনা আম্মা। আমিও সুন্দর করে কথা বলতে পারি।
— হ আব্বা। আমার কথাটা শোন। তুই তো ভালোবাসোস রিতীরে। তোর আব্বা আমারে ভালোবাসে। দেখছো না কত আদর সোহাগে রাখে আমারে। কোন মেয়ের দিকে তাকায়নাই তোমার আব্বা আমি ছাড়া। তোমার আব্বা পারলে তুমি কেন পারবানা?
— আমি কাউরে ভালোবাসিনা।
— এসব কয়না আব্বা। এমনে এমনে তো আর ঘুর নাইকা। সংসার করতে করতে ভালোবাসি ফেলবা।
— দেখো আম্মা। পিরীতিরে কেনো আনছি তুমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছো। তোমাদের বংশের নিয়ম নিতী নাকি আছে সব পালন করো। তারপর ওরে ওর হোস্টেলে দিয়া আসবো।
— এমন করে না আব্বা। সংসার জীবন খারাপ না। পিরিতি মেয়েটাও খারাপ না।
— আমি খারাপ আম্মা। পিরিতি আমারে সহ্য করতে পারেনা। আমিও তারে ছাড়তে পারিনা। ইচ্ছা হলে ধরতেও পারিনা। আমি খারাপ বলে ঐ মেয়ে আমারে নিজে থেকে ধরতেও দেয়না। আমার ভেতর অসহ্য যন্ত্রনা হয় আম্মা। এইযে ওরে না দেখতে পেয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করলাম। আজকে ওরে দেখতে পেয়ে ইনসিকিউরিটি তে ভূগতাছি। ঐ মেয়ে সোজা মেয়ে না। আমারে ভেঙে দেবার মতো তার আছে অদ্ভুত ক্ষমতা।
— ঐগুলা তোমার বাজে চিন্তা ধারা। আব্বা! নিজে সহজ হও। বউরেও সহজ করো। দুইটা দিন অন্তত আম্মার কথা শুনো। সংসার এ মন দেও। বউয়ের যত্ন নেও। দেখবা এতোটা ইনসিকিরিটি আর থাকবো না।
কাজের মেয়েটার চিৎকার শোনা গেলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে,
— আম্মা! আইলেন না! রক্ততে বন্যা বয়ে গেলো গা।
সোহাগী সোহাগ দুজনেই দৌড়ে এলো। ড্রয়িংরুমে রিতীকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো। ড্রয়িংরুমে রিতী নেই। চিৎকার আসছে দুতলা থেকে। সোহাগ পিরিতী? বলে দৌড় লাগায়। একেবারে এসে থামে নিজের রুমের সামনে।
— ভাবীসাব!
— সর সামনে থেকে।
দরজা থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে সোহাগ রুমে ঢুকে পড়ে। রিতীকে কোমড় বাঁকিয়ে পা ধরে কাঁতরাতে দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ফ্লোরে পা থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ে গোল হয়ে আছে। সারা ফ্লোর মদের বোতল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। সোহাগী ধমক দিতেই কাজের মেয়েটা ভয়ের চোটে বলে উঠে,
— আমার কোন দোষ নাই আম্মা। ভাবীসাব বাড়ি দেখতে দেখতেই বলে ভাইজানের ঘরে যাবে। আমিও নিয়ে আসছি। খালিপায়ে পা দিতেই ভাবীসাব চিল্লায়ে উঠে। আমি কি জানতাম নাকি ভাইজান মদ খাইয়া সারা ঘর বোতল ভাইঙা রাখছে?
সোহাগ ঝটপট করে রিতীর কাছে গিয়ে পাঁজাকোলা তুলে নেয়। কাজের মেয়েটার উপর চেঁচিয়ে বলে,
— হাসানরে এক্ষন বলবি আমার রুম পুরো সাফ করতে।
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~
#বিষ_করেছি_পান(৩৬)
(কপি করা নিষেধ)
তুলোতে ঐষধ লাগিয়ে কাটার উপর রক্ত পরিষ্কার করছে সোহাগ। রিতী যন্ত্রনায় আহ! ইহ! অস্ফুট আওয়াজ করছে। সোহাগ রিতীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার পায়ের দিকে নজর দেয়। মাথাটা নিচু করে ক্ষতের উপর ফু দিতে থাকে। আবার মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে,
— খুব জ্বলছে?
— বরফ দেবো?
— কমেছে একটু?
— ব্যাথা কমেছে?
রিতীর উত্তর আসেনা। অভিমানে গাল ফুলে টম হয়। ব্যান্ডেজ করে দেবার পর। পা টা হাঁটুর উপরেই রেখে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেয়। সোহাগী এসে হায় হায় করতে করতে টিস্যু দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি মুছে দেয়।
— ইসস!! কি করেছে আমার আম্মাটা কেঁদে কেটে। বোরখা খুলোতো আম্মা। ফ্রি হও। ইসস রে…
রিতীকে একটু তুলে বোরখাটা নিজেই খুলে দেয় হিযাপ সহিত। ওড়না ছাড়া রিতী লজ্জায় কুকরে যায়। হিযাপের ওড়নাটা টেনে ধরতে গিয়েও ফসকে যায়। সোহাগী তো নিজের মতে মতে বোরখা নিয়ে বেরিয়ে যায় নেড়ে দেবার উদ্দেশ্যে। এদিকে রিতী চট করে সোহাগের দিকে তাকায়। দেখে সোহাগ তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। রিতী আরেকটু কুকরে যেতেই সোহাগ রিতীর কাচুমাচু করার কারণটা বুঝে যায়। চোখ নেমে আসে রিতীর বুকের উপর। দুষ্টু সোহাগ বাঁকা হাসে। রিতীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এমন ভাব করছো মনে হয় ফাস্ট টাইম! পুরোনো বউকে নতুন বউ করার প্রক্রিয়া,এই যা!
রিতী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। এখন আর কাচুমাচু করছেনা। বরং স্বাভাবিক অবস্থায় মুখ ফিরিয়েছে। অপমানে মুখ লালচে বর্ণে পা দিয়েছে। না হয় নিজে আগ্ৰাসী পণা দেখিয়েছিলো রিসোর্টে সেদিন তাই বলে এভাবে বলবে! আর পুরোনো বউ মানে কি? নতুনের স্বাদ না পেয়েই পুরোনো হয়ে গেছে? একটাও বাদ রাখবেনা। শ্বশুড় শ্বশুড়ি যত আপ্যায়ণ করতে পারে করুক। সব আদর যত্ন লুটে নিবে। এই সোহাগ টাকেও মুঠোয় নিবে। তারপর যা হবার দেখা যাবে।
পায়ের উপর আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায় রিতী ঘাড় ফেরায়। সোহাগ চুমু দিচ্ছে পায়ের ঠিক মাঝখানে। রিতী ঝটপট পা সরিয়ে নেয়।
— এতো সাহস!
সোহাগ ফের বাঁকা হাসে।
বিকেলের মধ্যেই খালি বাড়িটা একদম পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সোহাগের চাচা মামা খালা ফুপু কাজিনদের ফ্যামিলি বাচ্চা কাচ্চায় ভরে যায় ড্রিয়ং রুম। সকলের মধ্যমনি হলো রিতী। একে একে সবাই আসছে আর রিতীর মুখ দেখে হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার হাতে গলায় সোনা পরিয়ে দিচ্ছে। রিতীর এভাবে বসে থাকতে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। তবুও রিতী উঠছেনা। ঐ যে এক চুল ছাড় দিবে না…..!
রিতী সাবধানে পা ফেলে হাটে। তাকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটা রুমে। সেখানে অরেজ্ঞ কালার একটা বেনারসী হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে রিতীর মামী শ্বশুড়ি। বিছানায় আরো কয়েকটি ব্যাগ। রিতীকে টেনে বসিয়ে দেয় রিতীর এক ননদিনী। রিতী জিজ্ঞেস করতেই বলে,
— নতুন বউ থ্রি পিচ পড়ে থাকবে নাকি? শাড়ী পড়াবো তোমাকে। দেখবে আমাদের হাতের জাদু। এতো সুন্দর করে সাজাবো যে সোহাগ ভাই চোখ ই ফেরাতে পারবেনা। এমনিতেও যা শুনেছি ভাই তো এমনিতেই তোমার নেওটা।
সবাই মুখ টিপে হাসে। হাসেনা শুধু রিতী। সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। গহনা গুলো মেচ করার সময় কোনটা কোনটা পরবে প্রশ্ন করা হলে রিতী একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর বলে,
— সব গুলোই পড়ানো হোক।
একেবারে ফাইনাল টাচ দেবার পর একে একে সবাই এসে রীতীর সাথে সেলফি তুলে নেয়। নিজেদের পার্সোনাল একাউন্টে আপলোড করে, সেলফি উইথ মামনি, সুন্দরী ভাবী, কিউট বউমা! আরো কতো কী!
সোহাগী এসে বলে,
— এই দেখি তোমরা ভিড় কমাও। মুরুব্বিরা আসবে।বসার জায়গা দাও বিয়ে পড়ানো হবে।
সোহাগী কথায় রিতী আকাশ থেকে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে ডাক দেয়,
— আম্মা!
রিতীর ডাকে সোহাগী রিতীর পাশে এসে বসে। হাসিমুখে রিতীকে বুঝিয়ে বলে,
— দেখো আম্মা! ঐ বিয়ের সময় তো আমরা ছিলাম না। বিয়ের কিভাবে না কিভাবে পড়িয়েছে, নিয়ম কানুন ঠিকঠাক পালন করেছে কিনা তাও জানিনা। তাই ঘরের বউ হয়ে যখন এ বাড়িতে এসছো শুনলাম তখনি তোমার শ্বশুর আব্বা আবার বিয়ের ব্যবস্থা টা করতে বললো। আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে সল্প আয়োজনে একটা ফ্যামিলি টুগেদার করে ফেললাম। কাজী আসছে সুন্দর ভাবে কবুল বলবে। কনে সাঝে আমার আম্মাটাকে কি যে সুন্দর লাগছে!
সোহাগী রিতীর থুতনী ধরে চুমু খায়। নয়টার মধ্যে বিয়ে পড়ানো খানাপিনা শেষ করা হয়। কয়েকজন কাজিন থেকে গিয়ে বাদ বাকি সবাই দশটার মধ্যে যার যার বাসায় চলে যায়। রিতীর ননদিনীরা সারাবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছে। আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে মেতেছে তারা। সোহাগী এসে ধমকে দিতেই ওরা চুপ হয়ে যায়। ইশারা পেতেই রিতীকে সোহাগের রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সবচেয়ে বড় যে ননদ সে প্রশ্ন করে,
— ভাবী এটাকি তোমাদের ফার্স্ট নাইট?
— হ্যা।
— এরজন্য ভয় পাচ্ছ তাইনা? তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
— ভয় পাচ্ছি না।
— তাহলে কি কিউরিসিটি ফিল করছো? ফাস্ট নাইট উইথ আমাদের ভাই! কিভাবে মধুর মধুর বাক্য কুড়াবে! কিভাবে প্রথমে পাশাপাশি বসবে! কিভাবে হাতে হাত রাখবে! কিভাবে হাগ!! উপপপসসস…
— তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে বুঝছো?
— প্লিজ ফুপিকে আমার হয়ে একটু বলে দিও না ভাবী। আমার বয়ফ্রেন্ড টা যে আর কতো ওয়েট করবে….!
— তোমাদের ভাই কোথায়?
রিতীর ঝটপট বিরক্তি মাখা প্রশ্নে মেয়েগুলো রিতীর মুখের দিকে তাকায়। রিতীর চেহারা দেখে তাদের মসকরা করার মুডে নোনতা জল পড়ে।
— ভাবী কি আমাদের সাথে থাকতে বিরক্ত হচ্ছো?
রিতী ঝটপট নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। এদের সাথে রাগ ঝেড়ে কি লাভ? শুরু শুরু খারাপ লোকের তকমা নেওয়া হবে। রিতী মুচকি হেসে টানিয়ে টানিয়ে বলে,
— না… ঐ আর কি! তোমাদের ভাই থাকলে ভালো হতো।
— আরে ইয়ার… ভাবীর তো দেখি তর সইছে না। আমরা আরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। রুক জারা, সবুর করো। আসবে আসবে। তোমার জামাই আসবে। তারপর তাকে আমরা খসাবো। তারপর তোমরা এক হবে।
— তেমন কিছু না।
— জানি জানি। এই ভাবী… ভাইয়া সামনে এলে তুমি কি লজ্জা পাবে? নাকি এতোক্ষনের বন্ধুবীনা প্রাণ বাঁচে না দহনে গিয়ে হ্যান্ডসাম ভাইটার উপর ঝাপিয়ে পড়বে?
— সেটা তোদের ভাবী ভালোই পারে। কিভাবে জামাইকে সিডিউস করতে হয়। টিপস লাগলে নিয়ে নিস। যখন তোদের লাগবে।
পেছন থেকে সোহাগের কথায় রিতী থেমে যায়। অপমানে আবার গা রি রি করে উঠে। ননদিনী দের ছেড়েই হন হন করে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখনের নোংরা রুমটা এখন একদম পরিষ্কার। তাজা ফুলে সাজানো। বিছানার গোলাপ গুলোর উপর গিয়ে বসে।
রিতীকে এভাবে চলে যেতে দেখে সোহাগ ও যেতে নেয়। কিন্তু কাজিনরা আটকে দেয়।
— কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া? এতো সুন্দর করে রুম সাজিয়ে দিলাম আমাদের পাওনাটা না বুঝিয়েই কি ভাবীর আদর খেতে যেতে পারবে? তা তো হতে দেবো না। আগে আমাদের আবদার মেটাতে হবে তারপর ভাবীর আবদার।
— কি চাই?
— তেমন কিছু না। জাস্ট একবার ক্রেডিট কার্ড।
— বুঝছি। কাল মিনিসো তদের জন্য ফ্রি। গিয়ে আমার কথা বলে যা ইচ্ছা নিয়ে নিবি।
— ইয়েএএএএএএ… সবাই লাফ দিয়ে উঠে। যে যার রুমে চলে যেতেই সোহাগ রুমে ঢুকে। দরজা বন্ধ করে রিতীর দিক এগিয়ে আসে। কনের সাঝে তিতকরলার মতো মুখটা করে বসে আছে। এতেও যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছে। রিতীর ফোনে বারবার টুং টাং সাউন্ড হচ্ছে। মেসেঞ্জার ভরে গেছে পরিচিতদের মেসেজে। অনেকক্ষন থেকে রিতী আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে ক্রল করতে করতে। চার পাঁচ জন কনগ্ৰাচুলেশনস জানিয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে আরো বাড়ছে। রিতীর মনে পড়ে তখন ছেলে মেয়েরা তার সাথে সেলফি নিয়ে আপলোড দিয়েছে। বিয়ে পড়ানো থেকে সব কিছু ইন্টারনেটে জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো তাদের সাথে দু একজন পরিচিত এড আছে। তাতেই একেরপর একজন একজন করে নিউজটা ছড়াচ্ছে। রিতীর ডান পাশে ফুল পাওয়ারে এসি চলছে। রুমটা হিম ঘর হয়ে আছে। তবুও রিতী ঘামছে। মাথাটা চিনচিনে ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে আসছে বাবার মুখ। রিতীর খবর কি বাবা জেনে যাবে? জেনে গেলে কি হবে? বাবা কি রিতীকে ক্ষমা করবে? একেরপর এক প্রশ্নে রিতী জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। রিতী চোখ খুলে ফেলে। সামনে দেখে সোহাগ দাঁড়িয়ে। রিতীকে মুগ্ধ চোখে পলকবিহীন দেখে যাচ্ছে। চোখ খুলতে দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে বলে,
— আমার পিরিতীর এতো রূপ! সব মুভমেন্টেই সুন্দর লাগে।
থুতনিতে আঙুল ছোঁয়াতেই রিতীর ভালোমানুষীর বাধ ভেঙে যায়। ধাক্কা দিয়ে সোহাগকে ফ্লোরে ফেলে দেয়। সমস্ত রাগ তার উপর আছড়ে ফেলে। ফুলের স্তুপের বিছানা টেনে নামিয়ে সোহাগের মুখে ছুড়ে ফেলে। রাগে দিশেহারা হয়ে চেঁচায়,
— কি চাই কি আপনার? আর কতো খেলবেন আমাকে নিয়ে? কি দোষ করেছি আমি ? কেনো করছেন আমার সাথে এরকম?
— পিরিতি! আস্তে প্লিজ! আমরা আমাদের বাড়িতে।
— আমিতো সেটাই বলছি। কেনো নিয়ে এসেছেন আমাকে আপনার বাড়িতে? হোটেল রুমের অভাব পড়েছে? টাকা নেই আপনার কাছে? আমাকে বলতেন। আমি দিতাম। আমার জীবনটা ছাড়খাড় না করে চলছিলো না তাইনা? বাড়িতে এনে আত্ত্বীয় স্বজন ঢেকে বিয়ে করলেন। বউ সাজালেন। বাসর ঘর সাজালেন। এখন বাসর করতেও এসেছেন। আপনার আসলে উদ্দেশ্য কি?
— তুমি।
— আমি না। আপনি আমার সাথে কোনদিনো যান না। আপনি একটা এডিক্টেড, জুয়ারু, মূর্খ, বখাটে মাতাল। অসুস্থ মস্তিষ্কের লোক। আমাকে এনে এসব করে বাঁধতে চাইছেন তাই না? সবাইকে এমনভাবে জানাতে চাঈছেন যেনো আমি আপনার নামের সাথে নিজের নামটা কোনদিনো ছাড়াতে না পারি। আপনি তো আমাকে এক রাতের জন্য ই চান। ঠিকই ছুয়ে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিবেন। আপনার এই চাওয়া আমি পূর্ণ করিনি? করেছিতো। তাহলে কি চান আবার আপনি।
— পিরিতি.. আমার তোমাকে এখনো ছুয়ে দেওয়া বাকি।
— সেটা আপনার ব্যর্থতা। আপনার অপারগতা। আমার নয়। আগে নিজেকে ঠিক করুন তারপর কথা বলুন।
— তুমি আমাকে এতো বড় অপবাদ দিতে পারোনা পিরিতী।তুমি নিজেও জানো এই সোহাগ কি।
— জানিনা। জানতেও চাইনা। আপনার সাথে কথাও বলতে চাইনা। দূরে থাকুন আমার থেকে।
রিতী ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়। দরজা বন্ধ করে রেলিং মাথা রেখে অঝোড়ে কাঁদতে থাকে। সোহাগের কানে কান্নার আওয়াজ যেতেই সোহাগ এসে দরজায় প্রেস করে। লক করা দেখে ঘাবড়ে যায়। বারান্দায় হাটু অব্দি রেলিং। তার উপর ফাঁকা। সোহাগ রিতীকে ডাকতে থাকে।
— পিরিতি! দরজা খুলো। পিরিতি! এই বউ ! এই!
মাথা তুলে চেঁচিয়ে উঠে রিতী।
— একদম আমাকে বউ ডাকবেন না।
— কি ডাকবো বউ! দরজা লাগিয়েছো কেনো? দরজা খুলো বউ !
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~
#বিষ_করেছি_পান(৩৭)
(কপি করা নিষেধ)
রাত দুটো। বারান্দায় দু একটা ঝি ঝি পোকার আলো জ্বলছে। বাগানের লাইটের কিছুটা আলো বারান্দায় এসে পড়েছে। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে পা মেলে বসে সোহাগ। তার বুকে মাথা রেখে বিভোরে ঘুমুচ্ছে রিতী। শরীরটা অর্ধেক সোহাগের উপর অর্ধেক ফ্লোরের উপর। কাঁদতে কাঁদতে এখানেই চোখ বুজে রিতী। সোহাগের ডাক কানে আসেনি। অনেক বার ডেকে সোহাগ রুমে চলে যায়। রিতীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি চোখ লেগে আসে। হুট করে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আওয়াজটা বারান্দা থেকেই আসে। রিতীর কথা মনে পড়তেই সোহাগ বিছানা ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় আসে। বারান্দার দরজা এখনো খুলা হয়নি। পর্দা সরিয়ে উকি দিতেই দেখে রিতী ফ্লোরে কোমড় বাঁকিয়ে ধনুকের মতো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার নড়ে চড়েও উঠছে। পাশেই দেখে একটা ফুলের টব নেই। সামান্য মাটি পড়ে আছে। রিতীর হাত লেগে নিশ্চয় টবটা পড়ে গেছে। রিতী আবার নড়ছে। মশার গুন গুন আওয়াজ হচ্ছে। সোহাগ ফোনের ফ্লাশ দিয়ে রিতীর উপর ধরে। নগ্ন ফর্সা হাতে টকটক করছে মশার কামড়ে লাল হয়ে যাওয়া অংশ। সোহাগ মশার স্পে টা ব্যান্টিলিটারের উপর দিয়ে বারান্দায় ফেলে। রিতীকে কয়েকবার ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায়না। অগত্যা সোহাগ রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বাসার ছাদে গিয়ে দেয়াল বেয়ে বারান্দায় আসে। রিতীকে আবার ডাকে। রিতী গভীর ঘুমে। হু হা কোনো সাড়াশব্দ নেই। সোজা করে বসিয়ে দিতেই আবার হেলে পড়ে। আবার সোজা করার চেষ্টা করতেই সোহাগের শার্ট চেপে ধরে বুকে হেলে পড়ে। সোহাগ উঠতে পারেনা। রেলিং এ পিঠ লাগিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে দেয়। রিতী আরেকটু চেপে সোহাগের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। সোহাগ রিতীকে দু হাতে আগলে নেয়। কিছু সময় রিতীর দিকে তাকিয়ে থেকে মুখটা সোজা করে আজলে তুলে নেয়। গালের উপর ঠোঁটের উপর বেবী হেয়ার গুলো একদম লেপ্টে গেছে। অভিমানী অভিমানটাও ঠিক ভাবে করতে পারেনা। যার উপর অভিমান করলো তাকে শাস্তি না দিয়ে নিজেকে এই ঠান্ডায় মশার শহরে শক্ত ফ্লোরে শুয়ে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু মুখটা দেখো! কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। সোহাগ বিরবির করে,
— কিন্তু তোমার কষ্ট আমাকে কেনো পোড়ায় পিরিতি? তুমি কি জানো সেকথা? তাই বুঝি সব সময় কাঁদো? যাতে আমারো কষ্ট হয়!
যে উত্তর দিবে সে এখন স্বামীর উম পেয়ে শান্তির ঘুমে রাজ্য পাড়ি দিচ্ছে। সোহাগের একটু অসুবিধা ই হচ্ছে। স্পে টা টেনে নিয়ে রিতীকে ধরে কমফোর্টেবল করে নেয় নিজেকে। সামান্য স্পে করে রিতীকে আরো ভালোভাবে বুকে টেনে নেয়। কপালে ছোঁয়ায় নিজের শুষ্ক ঠোট। মিনিট খানেক চেপে ধরে রাখে। যেনো কি শুষে নিচ্ছে। ঘুমন্ত রিতীকে মন ভরে দেখতে থাকে। সৌন্দর্যের মাঝে প্রত্যেকটা লোমকূপ যেনো একেকটা সৌন্দর্য। আঙুলের ডগায় ছুঁইয়ে কপাল থেকে গাল , গাল থেকে চিবুক, চিবুক থেকে গলা… আরেকটু নিচে নামতেই ঢুক গিলে। এতো কাছ থেকে দেখে যেনো তৃষ্ণা কমার পরিবর্তে আরো বেড়ে যায়। হুরহুর করে বাড়তে থাকে। বুকের খাঁজে কালো তিলটার উপর তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সোহাগের গলা শুকিয়ে উঠে। চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁসফাঁস করে। শিরশিরানি বাতাসে মুক্ত বারান্দায় মাঝরাতে সদ্য বিবাহিত বধু বুকের উপর লেপ্টে থেকে এভাবে দৃষ্টি টেনে নিলে কোন পুরুষ ই ঠিক থাকতে পারবেনা। তার উপর যদি হয় বউটা তার নেশা! শ্বাস প্রশ্বাসের অক্সিজেন! মরুভূমির মাঝে এক ফোঁটা জল! সোহাগ রিতী কানে ঠোঁট চেপে গভীরভাবে চুমু খায়। ফিসফিসিয়ে বলে, — একটুখানি দেবে তো জল!
বেচারা রিতী ঘুমের মাঝেই নড়েচড়ে উঠে।হালকা শীতে কাঁপছে সে। সোহাগ শরীরের নিচ থেকে শাড়ীর আঁচল টেনে কাঁধে তুলে পেঁচিয়ে নেয়। আটপৌরে করে পড়া শাড়ি অনেকটাই ছড়িয়ে গিয়েছে।পায় দুটো গুটিয়ে নেবার জন্য হাত দিতেই দেখে বামপাটা হাঁটু অব্দি বেরিয়ে আছে। শাড়ি ছায়া দুটোই একপাশ হয়ে উপরে উঠেছে। সেদিকে পাশের বড় গাছটার ছায়া পড়েছে। তবুও আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে এই প্রথম রিতীর কোমল পা ছুঁয়ে দেয় সোহাগ। মুহুর্তেই নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। অদ্ভুত এক অনুভূতি। যা এযাবৎ কারো শরীরে হাত দিয়ে ফিল করেনি। হাত তুলে নিয়ে শাড়ী দিয়ে চটপট ঢেকে দেয় পা খানা। আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলে। নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। তার প্রবল আকাঙ্খা লোভ ছিলো রিতীর উপর। এমন ভাবতো একবার হাতের মুঠোয় পাক তৃপ্তি মিটিয়েই ছাড়বে। ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে এই রুপ। যেনো দ্বিতীয় বার কোন আকর্ষন না জম্মে। অথচ মেয়েটা এখন তার বউ! আর দ্বিতীয় রাত মেয়েটার সাথে। অথচ তাকে আঘাত করতে পারছেনা। চেপে ধরতে পারছেনা নিজের সাথে। মনে হচ্ছে এ সেই চোখ জ্বালানো মোড়ের পাশ দিয়ে যাওয়া যুবতী পিরিতি নয়! এই পিরিতি সোহাগের রাজ্যের কোমল সাদা পায়রা খানি। যাকে ছুঁতে গেলেই হাত দুটো নরম হয়ে আসে। আজলা ভরে বুকে চেপে রাখতে ইচ্ছে করে। নরম আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মুগ্ধ হয়ে দিনরাত তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সোহাগ চোখ ফেরায় না। এ চোখ ফেরাবারও না। সারারাত তাকিয়ে রইলেও এই তৃষ্ণা মিটবে না।
ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙ্গে যায় রিতীর। পূর্বাকাশে লাল সূর্য উদয় চোখে পড়তেই চমকিত হয়। চোখ নামিয়ে নিতেই নিজের অবস্থান দেখে। ফর্সা লোমশ বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। একবার দুবার চোখের বল এদিক সেদিক ঘুরিয়েই মাথা তুলে। চোখাচোখি হয়ে যায় সোহাগের সাথে। সোহাগ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সারারাত না ঘুমিয়ে পাহারা দিয়েছে নিজের বউকে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় রিতী। সোহাগের দিকে একবার তাকিয়েই ঝটপট দরজা খুলে দৌড় দেয় অন্দরে। রিতীর এরকম হকচকানো ঝংকার তুলে সোহাগের ঠোঁটে। প্রাণ ভরে একচোট হেঁসে নেয়। যেনো মজার কোন ঘটনা ঘটেছে। সোহাগের জন্য ঘটনাটা বোধহয় মাজারই ছিলো!
ডাইনিং এ বসেছে বাড়িতে উপস্থিত সবলোক। নাস্তা রেডি করেছে হ্যাল্পিং হ্যান্ড। রিতীও হাত লাগাচ্ছে। এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে পাউরুটিতে জ্যাম মাখিয়ে প্লেটে সাজিয়ে রাখছে। মাথায় বড় ঘোমটা টানা। আঁচলের নিচ দিয়ে চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। রমিজউদ্দিন রিতীকে দেখে প্রসস্ত হাসলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। রিতীর উদ্দেশ্য বললেন,
— বাহ! আজ তাহলে আমার বউমার হাতের নাস্তা খেয়ে সকালটা শুরু করবো। খুব ভালো লাগলো।
রিতী সৌজন্য মূলক হাসলেন। সোহাগী বললেন,
— আম্মা! তোমার আব্বা বেরোবে। তার সামনে প্লেটটা দেও।
রিতী নাস্তা সাজিয়ে প্লেট সামনে দেয়। একে একে সবাইকে দেয়। ততক্ষনে কোথাথেকে এসে দাঁড়ায় সোহাগ। চেয়ারে টান দিয়ে বসে রিতীর দিকে তাকাতেই একহাতে বুক চেপে ধরে। সবার হাসি হাসি মুখ দেখে বিরবির করে,
— কিছুইতো করলাম না। এতো সকালে গোছল করেছে কেনো?
খাওয়া শেষে সোহাগ রিতীর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে আসে। মেয়েরা শিষ দিতেই সোহাগীর ধমকে চুপচাপ খাওয়া ছেড়ে উঠে। এভাবে রুমে আনায় রিতীর একটু একটু লজ্জা লাগছে। শিষটা কানে যেতেই বেশী বেশী লজ্জা পেতে লাগলো। শেষে সোহাগীর কথাটা কানে এলো,
— আমার পোলা আর পোলার বউ আলহামদুলিল্লাহ সব মান অভিমান শেষ করে সংসার শুরু করেছে। এবার আমার পোলা আর বাইরে থাকবোনা ইনশাআল্লাহ। বউয়ের জন্য ঘর সংসারে মন বসবো।
রিতী সোহাগের দিকে তাকালো। মনের ভেতর প্রশ্ন উঠলো। সে কি সত্যিই সংসার শুরু করলো? মান অভিমান ই বা কোথায় ছিলো? এই লোকটার সাথে কিভাবে সংসার সম্ভব? সব কিছুই বা কেনো রিতী মেনে নিচ্ছে? মানবে নাইবা কেনো? বিয়েতো ঝোঁকের মাথায় নিজেই করেছে। এ বাড়িতে আছে বলে নিজেকে নিয়ে ভয়টাও নেই। তার উপর সোহাগের আচরণে বিস্তর পরিবর্তন! সোহাগ তো নাটকীয় নয়। তাহলে কি সত্যিই পরিবর্তন দেখছে? রিতীর চোখদুটো জলজল করে উঠলো। সোহাগকে কিছুই বললোনা। বরং সোহাগ ঘরে নিয়ে গিয়ে রিতীকে মেঝেতে দাড় করিয়ে চেয়ারের উপর মেলে দেওয়া টাওয়েল টা নিয়ে এলো। একটানে ঘোমটা খুলে ভেজা চুলের উপর টাওয়েল পেঁচিয়ে ধরলো। নম্র সুরে বললো,
— ঠান্ডায় গোছল করে চুল না মুছেই এতোক্ষন আছো। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
রিতী উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হুট করে অনুভব করলো পিঠের উপর ব্লাউজের হুক গুলো একটা একটা করে খুলে যাচ্ছে। রিতী দু হাতে চেপে ধরলো।
— ব্লাউজ তো ভিজিয়ে ফেলেছো। তাড়াতাড়ি খুলো।
রিতী সরে দাঁড়ায়। সোহাগের দিকে তাকিয়ে রাগি লুক দেয়। লোকটা যতই নরম হবার চেষ্টা করুক এর স্বভাব কখনো পাল্টাবেনা। আসলেই ব্লাউজটা ভিজে গেছে। রিতী ছোট্ট করে ভেংচি কেটে আরেকটা ব্লাউজ নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। সোহাগ হাসি হাসি মুখে আয়নার সামনে গিয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে সেট করে নিলো। রিতী আশেপাশে থাকলেই মনটা ফুরফুরা লাগছে। বিড়াল বউয়ের ডাইনি লুক! বাড়িতে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি মুভমেন্ট গুলো যাস্ট পাগল করে দিচ্ছে!
আজ আবারো আত্ত্বীয় এসেছে। রিতীর সাথে কথা বলে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। সবাই রিতীর প্রশংশায় পঞ্চমুখ। কেউ একবারো রিতীকে বাড়তি কোন প্রশ্ন করছে না। একবারো রিতীর পরিবারের কথা তুলছেনা। তাঁদের যেনো রিতীকেই প্রয়োজন ছিলো। রিতীকে পেয়ে গেছে। আর কিছুই লাগেনা। প্রত্যেকটা আত্ত্বীয় কি মিষ্ট!
রিতীকে সোফায় বসিয়ে দুই ননদে দুই হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। আর দুই ননদে দুই পায়ে মেহেদী লাগাচ্ছে। গতকাল রিতীকে মেহেদী পড়ানো হয়নি। আজ ভাইয়ের ট্রিটে শপিং করে আসার সময় এক বক্স মেহেদী নিয়ে আসছে। এখন রিতীকে চেপে ধরে হাত পা নিয়ে বসেছে। আর দুজন রিতীর কোথায় কি অসুবিধা হচ্ছে কোথায় চুলকাচ্ছে সেদিকে নজর রাখছে। এই মুহূর্তে নিজেকে বন্দীদশা এক রাণী মনে হচ্ছে। সবকিছুর মাঝেই এক প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে। অস্থিরতার লেশ টুকু নেই। সব অনিশ্চয়তা অস্থিরতা ভুলে রিতী প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে। সোহাগ নেই। কোথায় গেছে রিতী জানেনা। জানাতেও ইচ্ছা করছেনা। শুধু ইচ্ছা করছে এখান থেকে উঠতে। একঘন্টার বেশী হবে এক ভাবে বসে আছে। কোমড় লেগে গেছে। উঠতে হবে। কিন্তু এদের মেহেদী পড়ানো শেষ হয়নি।
— কি করছিস তোরা?
সোহাগ এসেছে। পেছনে শ্বশুরকেও দেখা যাচ্ছে। ননদিনীরা হেসে বলে,
— মেহেদী পড়াচ্ছি ভাইয়া। দেখো দুই হাতেই তোমার নাম লিখেছি কত সুন্দর করে।
সোহাগ এগিয়ে এলো। কিন্তু হাতে নিজের নামে মেহেদী টা দেখলো না। তাড়া দিয়ে বললো,
— যা রুমে গিয়ে মেহেদী পড়া। ড্রয়িং রুমে এভাবে বসছিস কেনো? যেখানে মানুষের আনাগোনা!
— আমরাতো…
— বুঝছি। আর যেনো না হয়। উঠ। রুমে গিয়ে পড়া।
রিতী সোহাগের কথায় অনেক খানি অবাক হয়। নিজের দিকে একবার দেখে নেয়। শাড়িটা পায়ের বেশ উপরেই উঠানো হয়েছে। মাথায় ঘোমটাও নেই। তবে সুশীল আছে যতটুকু থাকা যায়। এইটুকুতেই এতো তাড়া! এতো পসেসিভনেস! রিতী ঘোর সন্দেহে সোহাগের দিকে তাকায়। সোহাগকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।করার কথাও না। যার মনে প্রত্যহ এতো এতো তাকে নিয়ে খারাপ ভাবনা সে লোকের ওভাব পসিসেভনেস মেনে নেবার কথাও না। হারামীটার প্রেম একেবারে উথলে পড়ছে। একবার ভোগ করবে তারপর প্রেম সাগরে গিয়ে পড়বে। চোখ দুটো ভরে আসে রিতীর। সেই চোখের জল আবার সোহাগ ই মুছে দেয় টিস্যু দিয়ে।
আজকেও ডিনারের পর আত্ত্বীয়রা চলে যায়। আজকের ডিনার রিতীই তৈরী করেছে। তার আনএক্সপার্ট হাতে পাঁচটি পদ রান্না করেছে। সব গুলো ঠিকঠাক হলেও গরু মাংসে একটু ঝাল বেশি দিয়ে ফেলেছে। গরু মাংসা কেউই খেতে পারেনি। শুধু খেয়েছে সোহাগ। সোহাগ যে একটা ঝালখোর রিতী আগে জানতো না। জানার কথাও না। সবাই প্রশংশা করলেও রমিজউদ্দিন মুখে কিছু না বলে হাতে তিনটা হাজারের নোট গুঁজে দেয়। সোহাগের খাওয়ার ধরন ই রিতীর নি:শ্বব্দে প্রসংশা করে গেছে। রান্নাঘরে থাকতে থাকতে রিতী ঘেমে গেছে। এখন ঘাম শুকিয়ে শরীর আঠা আঠা করছে। কাবার্ড থেকে শাড়ি নিয়ে রিতী হট সাওয়ার নিয়ে নেয়। রুমে এসে চুল মুছতে মুছতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফোনের টুন পেয়ে একদিন পর তার ফোনের কথা মনে পড়ে। দৌড়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। বাড়ি থেকে কল! ধরতে ধরতেই কেটে যায়। গতকাল সকালে হয়েছিলো বাড়িতে কথা। এখন রাত! এতোক্ষণ! একশত আটটা মিসকল! কলিজা শুকিয়ে যায় রিতীর। আবার দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে বাড়ির নাম্বারে একহাতে বুক চেপে কল লাগায়।
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা