#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৪
বাহিরে বৃষ্টির তুমুল শব্দ আর ঘরের ভেতর ফ্যানের ক্ষীণ শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সাথে কত জানা-অজানা অনুভূতির মিশ্রণে একদম চুপ হয়ে গেলো বিজলি। রূপমাধুরী তখন আরামকেদারায় বসে দোল খাচ্ছে নিজ আনন্দে৷ আঁধার মাঝে কেদারার অদ্ভুত শব্দটা ঠিক শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিজলিই বললো,
“আপ্পা, পুনম চলে গিয়েছে আর সেটা আপনার ইচ্ছেতেই। কিন্তু কোথায় গেলো!”
রূপমাধুরী এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। বরং গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“সিগারেট দে তো একটা।”
বিজলি তৎক্ষনাৎ আঁধার হাতড়ে টেবিলের উপর দেখে সিগারেটের বক্স এবং দেশলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে আসলো। রুমটার সব কিছু তার মুখস্থ তাই আঁধার টপকে জিনিস গুলো খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয় নি।
আঁধার ঘরে ক্ষীণ আগুনের ফুলকি দেখা গেলো সাথে পাওয়া গেলো নিকোটিনের গন্ধ। বোঝা গেলো রূপমাধুরী তার পছন্দের কাজ করতে ব্যস্ত। বিজলিও কথা বললো না। কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে ধোঁয়া উড়ানোর পর রূপমাধুরী রহস্য করে বললো,
“তুই ই তো বললি কার প্রতি যেন দুর্বল হয়ে গিয়েছে পুনম, তাহলে দুর্বলতার কাছেই যাবে।”
বিজলি অবাক হলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে ঐ বাবুটার কাছে গেছে? যে রোজ রোজ আসতো?”
রূপমাধুরী উত্তর দেওয়ার আগেই টেলিফোন বেজে উঠলো। রূপমাধুরীর আদেশে বিজলি গিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে কৃতজ্ঞতার কণ্ঠে একজন লোক বলে উঠলো,
“আপনাকে ধন্যবাদ সাহেবা। পুনমকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল কিন্তু আপনার ভয়ে দুজনেই বলতে পারি নি। আজ আমার কাছে পুনমকে তুলে দিয়েছেন তাই আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি ওর অযত্ন করবো না। আমি ভুলে যাবো ও কোথা থেকে এসেছে। ওর অতীত বলতে কিছু থাকবে না। ভালো থাকবেন।”
এত কথার বিপরীতে বিজলি উত্তর দিতে পারলো না। নিজের কথা শেষ হতেই অপর পাশ থেকে কলটা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ততক্ষণে। তবে বিজলি কণ্ঠের মালিককে চিনলো। এটাই সে ব্যাক্তি যে পুনমের সাথে ঘন ঘন থাকতে আসতো। তবে আপ্পাই আজ পুনমকে ওর হাতে তুলে দিলো!
বিজলির অবাক ভাবটা ছড়ানোর আগেই কাঠের দরজায় তুমুল শব্দ হলো, বাহির থেকে ক্ষীণ স্বরে একটা মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো কথা,
“বিজলি, আপ্পাকে বলিস আজ নাকি নতুন খদ্দের আসবে। অনেক টাকার মালিক। মিতালি মেম কল দিয়ে জানিয়েছেন। আপ্পাকে বলেছে বিশেষ ব্যবস্থা করতে।”
বিজলি পিছনে ফিরে আঁধারের মাঝেও রূপমাধুরীর অবয়বটার দিকে চাইলো। ততক্ষণে আগুনের ফুলকির আর দেখা মিললো না হয়তো সিগারেট টানা শেষ। বিজলির আলাদা করে আর কিছু বলতে হলো না কারণ রূপমাধুরী সব নিজ থেকেই শুনেছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“তুই তাহলে এখন যা, আমার গল্প পরে শোনাবো। আপাতত খদ্দেরের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যা।”
বিজলি অনুমতি পেতেই দরজার ছিনকিনি খুলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো।
–
যুগ বদলের পৃথিবীতে কিছুটা উন্নয়ন চা বাগানেরও হয়েছে। আগের মতন সেখানে আর ছন, খড়,বাঁশের তৈরি ঘর দেখা যায় না। শান্ত, নিবিড় রাস্তাও দেখা যায় না। ছনের জায়গায় সিমেন্ট এসেছে, কুঁড়েঘরের জায়গায় দালান। তবে মানুষ গুলো আগের মতনই সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত। সকলের মাঝে কোমল একটা টান রয়েই গেছে।
চা বাগানের ঘন পরিবেশে রাত তখন শুরু। এত বছরের বন্ধ প্রজেক্ট টা শুরু করার জন্য শহর থেকে আবার লোক এসেছে। এখানে এলকোহলের ফ্যাক্টরি তৈরী করাই তাদের লক্ষ্য। আর এতে চা বাগানের সহজ সরল পরিবেশ এবং মানুষ দু’টোই তুমুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিন্তু ঐ যে চা বাগানের মানুষ বড্ড সহজ সরল, তাই তারা নিজেদের ক্ষতি জেনেও কিছু করতে পারবে না। ক্ষমতার কাছে সবকিছুই যে ফিঁকে।
চা বাগানের কটেজের বড় রুমটায় বসে আছে শহুরে লোকজন। আপাতত চারজন এসেছে এখানের হালচাল দেখতে। আর তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে জায়গা খানা। সকলের বয়সই ত্রিশের এপাড়-ওপাড়। সকলে একসাথে বসে কার্ড খেলছে। বাহিরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতিতে বাতাসের বিচরণ। লোক গুলোর মাঝে সুঠাম দেহী লোকটা সিগারেট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালো। বাকিরা ভ্রু কুঁচকালো, অবাক কণ্ঠে বললো,
“কই যাচ্ছিস?”
“পেট খালি করতে৷ তোরা খেল, আমি আসছি।”
কথা শেষ করেই সিগারেট টানতে টানতে লোকটা কটেজ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কটেজের ভিতরে তখন তিনজন খেলায় মগ্ন। বাহিরে আসা লোকটার নাম সম্রাট। সম্রাট যখন বাগানের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের কাজ সেরে ফিরে আসতে নিলো তখনই বাগানের গাছপালা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। সম্রাট দাঁড়িয়ে গেলো। তার কপালে আপনা-আপনি ভাঁজ পড়লো। সে আবার পেছনের দিকে তাকিয়ে গাছপালাকে আরেকটি বার পরখ করে নিলো৷ নেই কেউ, তবে শব্দ কিসের হলো! সম্রাট আবার ফিরে আসতে নিলে আবার মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে। আচমকাই শরীর শিরশির করে উঠলো সম্রাটের। ভীত দৃষ্টি নিয়ে সে পেছনে তাকালো কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। সম্রাট পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। কিন্তু ফোনের ফ্লাশ জ্বালানোর আগেই তার পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া লাগলো। চমকে উঠার কারণে সম্রাটের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। সম্রাট পেছনে ফিরে দেখে লাল শাড়ি পরে বিশাল এক ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারী। হাতের চামড়া কেমন কুঁচকে আছে। সম্রাট চিৎকার দিয়ে কটেজে ছুটে গেলো। সম্রাটের চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলো বাকি তিনজনও। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? চিৎকার করিস কেন? কোনো পশু দেখেছিস নাকি?”
ভয়ে সম্রাটের শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বাগানে, বাগানে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের চামড়া যেন কেমন। চা বাগানে লোক মুখে শুনেছিলাম একজন মহিলা নাকি অশরীরী হয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সে-ই বোধহয়। ঐ যে বটগাছটার সাথে দেখ।”
সম্রাটের কথা শুনে বাকিরা কপাল কুঁচকালো। কথাটাকে তেমন গ্রাহ্য না দিয়ে বললো,
“আরে ওসব ভূয়া কথা। তুইও এসব ভূয়া কথা বিশ্বাস করিস? আচ্ছা দাঁড়া আমরা গিয়ে দেখি।”
সম্রাট তখনও অস্বাভাবিক কাঁপছে। বাকিরা চলে গেলো বাহিরে। ঠিক দুই তিন মিনিট পর ঘরের ভেতর থেকে আবার চিৎকার ভেসে এলো। ছেলে তিনজন ভেতরে গিয়ে দেখলো সম্রাট জ্ঞান হারিয়ে পরে আছে মাটিতে।
–
নিষিদ্ধ পল্লীর বিরাট আলিশান আঁধারীয়া রুমটার মাঝে নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় অপেক্ষারত সেখানের মালকিন, রূপমাধুরী। চুলের ভাঁজে থাকা তাজা বকুল ফুলের মালাটা থেকে মোহনীয় সুঘ্রাণ পরিবেশটাকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মায়াবি করেছে। স্লিভলেস ব্লাউজের উপর জড়ানো পাতলা টিস্যুর ন্যায় সাদা শাড়ি এবং ঠোঁটে লাগানো লাল টকটকে রঞ্জকে তাকে আবেদনময়ী কোনো অপ্সরা মনে হচ্ছে। রুমের চারপাশে নিভু নিভু আলোয় জ্বলতে থাকা মোমবাতির কারণে তার শরীরকে কোমল মাখনের সাথে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যাবে। একটু পর পর সে তার শরীরে মিষ্টি সুগন্ধীটা মেখে নিচ্ছে। নিজেকে আকর্ষণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। আজকের খদ্দের টা বেশ পয়সাওয়ালা কিনা। একবার তার চোখে পরে গেলে টাকার বিছানায় দিবানিশি নিদ্রা যাপন করা যাবে। তাই তো সে অন্যান্য মেয়েদের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই আদর-যত্নের ব্যবস্থা করেছে।
রূপমাধুরীর ভরা টসটসে আবেগের সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন খদ্দের টা রুমের ভেতর প্রবেশ করলো। চোখ-মুখে কামুক এক হাসি দিয়ে রমণী যখন তার খদ্দেরের দিকে তাকালো, অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে সে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মোমের আবছা আলোয় বহু পরিচিত প্রেমিকের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অনেকগুলো বছর পর, প্রিয় প্রেমিকের বিছানার সঙ্গী হওয়ার জন্যই বুঝি এত আড়ম্বর পূর্ণ আয়োজন ছিলো! রূপমাধুরী দু’পা পেছনে চলে গেলো। অবাক ভাব তার শরীরের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ এর বেগে ছুটে গেলো।
শুধু রূপমাধুরী নয়, তার সামনের মানুষটাও কম অবাক হয় নি। চোখ দু’টো যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। কণ্ঠে শব্দ দের আন্দোলন। তবুও লোকটা কোনো মতে উচ্চারণ করলো,
“বীরাঙ্গনা!”
রূপমাধুরী টান টান কণ্ঠে বললো,
“বীরাঙ্গনা না, আমি বারাঙ্গনা।”
#চলবে