#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_১০
নীলাঞ্জনা থানায় প্রবেশ করতেই দেখলো অফিসার রাশেদ চিন্তিত হয়ে বসে আছে। নীলাঞ্জনা বলল, “কেমন আছেন অফিসার?”
অফিসার রাশেদ বলল, “আর কি ভালো থাকা যায়। তোমার কথাই সঠিক হলো। নুরুল ইসলামের বডির অংশ ছিল। দুইজনের শরীরের সব অংশ খুজে পাওয়া যায় নি। পুলিশের মনে দুটো টিম গঠন করা হয়েছে। একদল শরীরের অংশ খুজতে গেছে।অন্য দল সন্দেহের তালিকায় যেসকল মানুষ আছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেছে।”
নীলাঞ্জনা বলল , “আপনি কাকে কাকে সন্দেহ করছেন?”
অফিসার রাশেদ বলল, “লিস্টে অনেকেই আছে। আচ্ছা সেলিম রহমান কোথায়?”
নীলাঞ্জনা বলল, “সে তো কাজে গেছে। এইমাত্র আমাকে থানার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল”
অফিসার রাশেদ বলল, “কি কাজ?”
নীলাঞ্জনা বলল, “এমনি ব্যবসার কাজে গেছে। নির্বাচনের জন্য অনেক দিন ব্যবসার কাজে নজর দিতে পারছে না।আপনি কি ওকে সন্দেহ করছেন?”
অফিসার রাশেদ বলল, “আরে না।এমনি জিজ্ঞেস করলাম। ইদানিং অনেক মানুষ গুম হচ্ছে। সতর্ক থাকা ভালো”
নীলাঞ্জনা বলল, “নুরুল ইসলাম খান কে নিয়ে আপনাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই। কথাটা গোপন রাখলে বলতে পারি?”
অফিসার রাশেদ বলল, “বলো। আমি গোপন রাখবো”
“নীলাঞ্জনা বলল, “আমার বিয়ের আগের কথা। আয়ান চৌধুরী নিখোঁজ হওয়ার পর আমি তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেদিন অফিসে পৌঁছানোর পর একটি মেইল পেলাম, যা ছিল নুরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে। সেখানে অনামিকা নামের এক ছদ্মনাম ব্যবহার করে এক মেয়ে মেইলে পাঠায়।বলেছিল নুরুল ইসলাম মেয়েদের চাকরি দেয়ার জন্য অনৈতিক কাজ করে। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি বোঝাতে চেয়েছি”
অফিসার রাশেদ বলল, “এরপর তুমি কি করলে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “এরপর আমি অনামিকা কে খুঁজে বের করলাম। তারপর তার আনা অভিযোগ সত্য কিনা যাচাই করলাম। আমি ভেবেছিলাম এইসব পুলিশকে জানাব কিন্তু যেদিন পুলিশ কে জানাব সেইদিনই তো নুরুল ইসলাম নিখোঁজ হয়।পরে আমার অফিসের লোকজন বলল এই সময়ে পুলিশের কাছে গেলে উল্টো আমাদের ফাঁসিয়ে দিবে।বলবে আমরা নিখোঁজ করেছি”
অফিসার রাশেদ বলল, “এই বিষয়ে তোমার আমার সাথে কথা বলার দরকার ছিলো। এমন ও তো হতে পারে অনামিকাই এই খুন করেছে”
নীলাঞ্জনা বলল,”অনামিকা খুন করবে না।করলে অনেক আগেই করতো। তাছাড়া একই সাথে আয়ান চৌধুরী খুন হয়েছে”
অফিসার রাশেদ বলল, “আয়ান চৌধুরীর কথা বাদ দেও। তুমি বলো নুরুল ইসলাম খানের কথা। অনামিকা এতদিন পর কেন তোমাকে মেইলে করলো। শুরুতেই যখন চাকরি নিতে গিয়েছিল তখন দিলো না কেন? নুরুল ইসলামের আপত্তিকর প্রস্তাবে রাজি হয়ে চাকরি না নিয়ে তোমাকে অভিযোগ করতে পারতো এখন যেই রকম করছে”
নীলাঞ্জনা বলল, “ও বলল নুরুল ইসলামের কাছে তার কিছু আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও আছে। এইগুলো দিয়ে ব্লাকমেইল করছে”
অফিসার রাশেদ বলল, “এই কারনে রাগের মাথায় খুন করে ফেলতে পারে”
নীলাঞ্জনা বলল, “আপনার যুক্তি ফেলে দেয়ার মতো না”
অফিসার রাশেদ বলল, “অনামিকার আসল পরিচয় বলো?”
নীলাঞ্জনা বলল, “তাসনিম জারা”
অফিসার রাশেদ বলল, “অফিসের সবার সাথে কথা বলতে হবে। বিশেষ করে তাসনিমের সাথে। তুমি অফিসে যাচ্ছো কবে”
নীলাঞ্জনা বলল, “আপাতত যাচ্ছি না। সেলিম কিছু বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় আছে।আপাতত বাড়ির ঝামেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাবো না। সেলিমের কিছু কাজে আমার হেল্প লাগবে”
অফিসার রাশেদ বলল, “কি কাজ?”
নীলাঞ্জনা বলল, “এই আমাদের ব্যক্তিগত আরকি”
অফিসার রাশেদ বলল, “বুঝতে পেরেছি”
নীলাঞ্জনা বলল, “আমি সেলিমের জন্য অপেক্ষা করবো।সে বিশেষ কাজে গেছে বললামই তো। যাওয়ার সময় বলবো সে হয়তো আর বাড়ি ফিরে আসবে না”
অফিসার রাশেদ বলল, “চারদিকে মানুষ গুম হচ্ছে তো তাই ভয়ে আছে স্বাভাবিক ব্যাপার।”
নীলাঞ্জনা বলল, “আমি একটু ওই বাড়ি যাব। আয়ান চৌধুরীকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলাম।তখন অনেকেই বলেছিল আয়ান চৌধুরী ইচ্ছে করেই নিখোঁজ হওয়ার নাটক করছে। এখন ওই ডকুমেন্টারি টা আনতে যাব। আমি আয়ান চৌধুরীর খুনের রহস্য টা বের করবো। আমার মনে হয় এতে অনেক নিখোঁজ মানুষের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে”
অফিসার রাশেদ বলল, “যাও। আমার সাথে যোগাযোগ রেখো।যেকোন সাহায্যে আমাকে পাবে”
নীলাঞ্জনা থানা থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
একটা অন্ধকার রুমে বসে আছে সেলিম।তার সামনে বসে আছে একজন লোক। লোকটির মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। সেলিম নিজেও তার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। লোকটি বলল , “এখানে ২৩ জন সদস্যের নাম আছে।”
সেলিম বলল, “ওদের গ্রুপের সবার তথ্য এখানে আছে?”
লোকটি বলল, “জ্বী স্যার”
সেলিম বলল, “আশাকরি এবার আমরা গুম হয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ পাবো”
লোকটি বলল, “আপনার জন্য একটা খারাপ খবর আছে। আপনার ভাই এই গ্রুপের মেইন সদস্যের একজন।এই গ্রুপের লিডার বলতে পারেন পাঁচ জন।তার মধ্যে আপনার ভাই সরোয়ার ও আছে”
সেলিম বলল, “আমি অবাক হবো না। আমি আগে থেকেই তাকে সন্দেহ করেছিলাম।আয়ান চৌধুরীর নিখোঁজ হওয়ার পরেই আমার মনে সন্দেহ হয়।”
লোকটি বলল, “আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে।আমরা সবাই বেশ গোপনীয়তা বজায় রেখে চলছি।ওরা তেইশ জন আর আমরা মাত্র পাঁচজন”
সেলিম বলল, “তাতে কিছু যায় আসে না।শোনো আমি হয়তো যখন তখন নিখোঁজ হয়ে যাব। আমি নিখোঁজ হয়ে গেলে আমার স্ত্রী নীলাঞ্জনা তোমাদের আমার জায়গায় সহযোগিতা করবে। আমি সবকিছু ওর কাছে বলে রেখেছি। তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। আমাদের যেকোন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়লে চলবে না।যদি শোনো আমি নিখোঁজ হয়েছি তবে তোমরা তোমাদের কাজ বন্ধ করো না”
লোকটি বলল, “আমি ভয় পাচ্ছি না। আমাদের আপনার জন্য ভয়। সাবধানে থাকবেন। আমাদের প্রজেক্ট কে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই এর ব্যবস্থা নিতে হবে”
সেলিম বলল, “শোনো আমার একটা গোপন প্লান আছে । যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যেতে চাই।যদি করতে পারো তবে অনেক উপকার হবে আমাদের”
লোকটি বলল, “কি কাজ?”
সেলিম বলল, “প্রজেক্ট কে এর ঔষধ বানানোর কোম্পানিতে আগুন লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।পারবে তো?”
লোকটি বলল, “কাজটা কঠিন তবে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অনেক ঔষধ ও ঔষধের ফর্মুলা হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে।”
সেলিম বলল, “হ্যা। ফর্মুলা তো নষ্ট হবে না। ফর্মুলা যত্ন করেই রাখবে। তবে নতুন করে ঔষধ বানাতে অনেক সময় লাগবে”
লোকটি বলল, “আজ রাতেই কাজ হয়ে যাবে”
সেলিম বলল, “আমি গেলাম”
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সেলিম শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হঠাৎ সরোয়ারের ফোন আসলো। সেলিম ফোন রিসিভ করলো। সরোয়ার বলল, “ভাইয়া কোথায় আছো?”
সেলিম বলল, “তোমার ভাবী তার বাপের বাড়ি গেছে। সেখানে যাচ্ছি তাকে আনতে”
সরোয়ার বলল, “খুব বিপদে পড়েছি।একটু এইদিকে আসতে পারবে?”
সেলিম বলল, “কোথায় আসবো?”
সরোয়ার বলল, “তালতলায়।”
সেলিম বলল , “আমি অনেক দুরে আছি।আসতে সময় লাগবে”
সেলিম হঠাৎ করে কি ভেবে ডকুমেন্টের ছবি তুলে তার বাড়ির পিসিতে মেইলে করে পাঠিয়ে দিল। এরপর ডকুমেন্টের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিল।
তালতলায় পৌঁছাতেই সেলিম দেখলো সরোয়ার দাঁড়িয়ে আছে।জায়গাটা বেশ নির্জন। সন্ধ্যা হলেও মানুষের আনাগোনা খুব একটা দেখা যায়না। সেলিম গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সরোয়ার বলল, “তোমার বউ আবার বাপের বাড়ি গেল কবে?”
সেলিম বলল, “আজ সকালেই গেছে।খুব জেদ করছিল।বলল সন্ধ্যায় গিয়ে আবার নিয়ে আসতে”
সরোয়ার বলল, “আচ্ছা চলো আমার সাথে তোমার এক জায়গায় যেতে হবে”
সেলিম বলল, “কোথায় যাবে? আমার আবার নীলাঞ্জনার কাছে যেতে হবে।সে আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে”
সরোয়ার বলল, “তুমি এখন নীলাঞ্জনার কাছে যেতে পারবে না। তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে”
সেলিম কিছু বলতে চাইলো তার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়। সেলিম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সরোয়ার সেলিমের গাড়িটা রাস্তার একপাশে ফেলে রেখে তাকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।তাকে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সরোয়ার গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ি টর্চার সেলের দিকে রওনা দিল। সরোয়ার বলল, “খুব তো আমার প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিলে টাকার গরম দেখিয়ে। এখন দেখবো তুমি কীভাবে নীলাঞ্জনার কাছে যাও। আমি আগে নীলাঞ্জনা কে বিয়ে করি। এরপর তোমাকে মেরে ফেলবো”
পাল থেকে একজন বলল, “খুব এসেছে আমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে। কিন্তু গাডিতে তো কিছু খুঁজে পেলাম না।”
সরোয়ার বলল, “সে হয়তো নামের তালিকা খুঁজে পায়নি”
পাশের লোকটি বলল, “এত সহজ নাকি আমাদের খুঁজে বের করা।আমরা সিক্রেট ভাবে কাজ করি”
সরোয়ার কোন জবাব দিল না। সরোয়ার নীলাঞ্জনা কে ফোন দিল।নীলাঞ্জনা রিসিভ করতেই সরোয়ার বলল, “ভাইয়ার কি হয়েছে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “কই কিছু হয়নি তো?”
সরোয়ার বলল, “ভাইয়া কোথায় আছে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “ও তো কাজে গেছে”
সরোয়ার বলল, “দশ বিশটা ফোন দিয়েছি । রিসিভ করছে না কেন?”
নীলাঞ্জনা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।বলল, “আমাকে তো একটু আগে বলল বাসায় আসছে?”
সরোয়ার বলল, “তুমি বাড়িতে আছো?”
নীলাঞ্জনা বলল , “না।আব্বুর বাড়িতে বেড়াতে আসছি।ও বলল সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবে।হয়তো গাড়ি চালাচ্ছে আর ফোন সাইলেন্ট করে রাখা।তাই রিসিভ করছে না”
সরোয়ার বলল, “আমি কি ওই বাড়ি আসবো?”
নীলাঞ্জনা বলল, “তোমার ভাই আসছে। তোমার আসার কোন দরকার নেই”
সরোয়ার কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল।মনে মনে বলল তুমি আর কোনদিন সেলিম রহমান কে চোখের দেখা দেখতে পারবে না।
নীলাঞ্জনা সরোয়ারের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়লো। সেলিম কে ফোন দিল কিন্তু কোন রেসপন্স পেল না। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপ এ একটা মেসেজ নীলাঞ্জনার নজরে পড়লো।এক ঘন্টা আগের মেসেজ। সেলিম পাঠিয়েছে আমি যদি আজ রাতে বাড়ি ফিরে না আসি তবে ভেবে নিও আমি নিখোজ হয়েছি।
নীলাঞ্জনা বেশ চিন্তিত হয়ে অফিসার রাশেদ কে ফোন দিল।দুই তিন বার কেটে যাওয়ার পর অফিসার রাশেদ ফোন রিসিভ করলো। নীলাঞ্জনা বলল, “সেলিম কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।ওকে কেউ কিডন্যাপ করেছে হয়তো।”
অফিসার রাশেদ বলল, “কি ভাবে বুঝলে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “আমি থানায় আসছি।সব বুঝতে পারবেন। আপনি তাড়াতাড়ি পুলিশের টিম পাঠান ওকে খুঁজে বের করার জন্য”
অফিসার রাশেদ বলল, “ঠিক আছে”
(চলবে)