বুঝে নাও ভালোবাসি পর্ব-০২

0
6

#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা

পর্ব ০২

আর‌ওয়া থমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ভেতর ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে কেউ তাকে চুপিসারে বলছে,”তোর মতো মেয়ে আমার সাথে কখনো যায় না। তুই তোর রাস্তায় যা। আমার সামনে কখনো আসবি না।”তার উপর গতকাল রাতে নির্ঝরের প্রতিটা আচরণ আর‌ওয়াকে ভাবাচ্ছে।সে কি করে নির্ঝরকে বিয়ে করবে এতো কিছুর পর?

আশরাফ চৌধুরীর কথায় শেলী বেগম কড়া গলায় বললেন: বললেই হলো আপনার ছেলের ব‌উ করবেন?আর‌ওয়া আমার ছেলের ব‌উ। ভুলে যাবেন না আমার ছেলের সাথে আর‌ওয়ার কাবিন হয়ে গেছে দুই মাস আগে মানে তারা স্বামী-স্ত্রী। তখন আত্নীয়-স্বজনকে দাওয়াত দিতে পারিনি বলে আজকে এনগেজমেন্টের আয়োজন করলাম। তাহলে এখানে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হ‌ওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে?

আশরাফ চৌধুরী মুচকি হাসি দিলেন। এমন উত্তর আসবে তিনি আশা করেছিলেন।তাই তার ছেলে নির্ঝরের সাথে আর‌ওয়ার বিয়ে দিবেন বলেছিলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন:আমি তো বলিনি আপনার ছেলের ব‌উকে আমার ঘরের ব‌উ করে নিয়ে যাবো। আপনি তো নিজেই আমাকে বললেন আমার ভাগ্নি নষ্টা তাই আমার ভাগ্নির সাথে আপনি থাকতে পারবেন না। বিয়েটা ভেঙে দিবেন। তখন তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

শেলী বেগম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন:আসলে ভাই রাগের মাথায় একটু-আধটু বলে ফেলেছি।এমন পরিস্থিতিতে তো রাগ হ‌ওয়া স্বাভাবিক। আজকে কতো বড় একটা আয়োজন করলাম এনগেজমেন্ট বলে।সব আত্নীয়-স্বজনকে দাওয়াত দিলাম।আর আপনাদের মেয়ে গতকাল রাতে পালিয়ে গিয়ে আজ বাসায় আসছে।এমন ঘৃণিত একটা কাজ করলে তো রাগ লাগা স্বাভাবিক।তাই এসব বলেছি। আপনাদের তো বোঝা উচিত।

শেলী বেগমের কথার সাথে তাল মিলিয়ে তার স্বামী রিদুয়ান মোস্তফাও মুখ খুললেন।আর‌ওয়ার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন:ভাই আর কোনো কথা নয়। আমরা আজকে এনগেজমেন্টটা করবো।

আশরাফ চৌধুরী রিদুয়ান মোস্তফার কথায় মহা খুশি। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল বুকের উপর একটা পাথর বসানো ছিল। তিনি তার ছেলেকে একটুও বিশ্বাস করেন না। বুঝতেই পারেন না তার মতো ভদ্র-নম্র একজন মানুষের ছেলে এতোটা অগোছালো কি করে হলো? মায়ের সাথে ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলে না,সোজা রুম থেকে বের হয়ে অফিসে আর অফিস থেকে রুমে। এতটুকু তার কাজ।এমনকি খাবারটাও সে সবার সাথে খেতে বসে না।একা একা রুমে বসে থাকে।এমন ছেলের জন্য জেনেশুনে নিজের ভাগ্নিকে ব‌উ করে নিয়ে যাবেন তা অসম্ভব। সত্যি অসম্ভব।

মাঝে প্রায় অনেক সময় কেটে গেল। এনগেজমেন্ট যেহেতু হচ্ছে তাই সবাই আবারো আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ শেলী বেগম আর‌ওয়ার বাবাকে ডাকলেন।আশরাফ চৌধুরীও সাথে গেলেন শেলী বেগমের কথা শুনতে।
শেলী বেগম কড়া গলায় আদেশ দিলেন: আপনার নষ্টা মেয়েকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। আমার ছেলে এমন একটা মেয়েকে মেনে নিচ্ছে তাই তাকে পুরস্কার হিসেবে এখন ক্যাশ পাঁচ লক্ষ টাকা দিবেন।

শেলী বেগমের কথায় আকরামুল হক আরেক দফা চমকালেন। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন তিনি শেলী বেগমের দিকে। আশরাফ চৌধুরীও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো তিনিও বুঝতে পারছেন না এই মূহুর্তে কি বলা উচিত। একটু ভেবে আশরাফ চৌধুরী বললেন: আচ্ছা ঠিক আছে। ম্যানেজারকে বলি ব্যাংক থেকে উঠিয়ে আনতে।

আকরামুল হক আশরাফ চৌধুরীকে থামিয়ে বললেন:এমন মহিলাকে আমি আমার মেয়েকেও দিবো না। পাঁচ লক্ষ টাকাও দিবো না।
_এসব কি বলছো আকরাম?
_আশরাফ ভাই কেন বুঝতে পারছেন না?উনি একজন লোভী মহিলা।উনি লোভের কারণে এভাবে গিরগিটির মতো রঙ পাল্টাচ্ছে। প্রথমে বলেছিলেন আমরা পারিবারিকভাবে কাবিনটা করবো আর দুই মাস পর বড়সড় আয়োজন করে বিয়ে হবে। পারিবারিকভাবে আয়োজন করে কাবিন হলো ঠিকই দুই মাস আগে। এখন দুই মাস পরে এসে বললেন আগে একটা এনগেজমেন্টের আয়োজন করি। আত্নীয়-স্বজনকে দাওয়াত করতে হবে তারপর আবার ধুমধামে বিয়েটা হবে।আমি যখন বললাম কাবিন যখন আগে হয়ে গেছে এখন একেবারে বিয়েটা হয়ে যাক। এখন তো নতুন করে এনগেজমেন্টের প্রশ্ন আসছে না। কিন্তু উনি মানলেন না।উনি বলেন কাবিন হয়েছে তা আমার আত্মীয়-স্বজন জানে না। বাধ্য হয়ে এনগেজমেন্টের আয়োজন করলাম। আজকে আবার নতুন ফন্দি করছে।

শেলী বেগম কান খাঁড়া করে আকরামুল হকের কথাগুলো শুনছেন। একটু পর বললেন:আমি যা বলছি তাই হবে। আমার ছেলের সাথে কাবিন হয়ে গেছে মানে আপনার মেয়ে আমার ছেলের ব‌উ।জামাই থাকা সত্ত্বেও অন্য ছেলের সাথে পরকীয়া করে পালিয়ে গেলো কাল রাতে। এখন আপনার মুখে এতো কথা বের হচ্ছে?তখন যদি মেয়েকে সামলাতেন তাহলে এতো কিছু হতো না।

আশরাফ চৌধুরী বেশ ধৈর্যশীল মানুষ।তিনি চুপচাপ দুজনের কথা শুনে বললেন: আর‌ওয়ার যদি পালিয়ে যাওয়ার থাকতো তাহলে ও আগে পালিয়ে যেতো। তাছাড়া সে তো পালিয়ে যায়নি।তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।আমার তো এখন মনে হচ্ছে আপনারা প্ল্যান করে আমাদের মেয়েকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছেন।

আকরামুল হক আশরাফ চৌধুরীর কথায় সমর্থন জানিয়ে বললো: দেখেছেন ভাই,আমার‌ও এমন মনে হচ্ছে।আমি আমার মেয়েকে খুব ভালো করে চিনি।সে এসব করার মেয়ে নয়।

শেলী বেগম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন:এসব কোন ধরণের কথা?আমরা কেন আপনার মেয়েকে কলঙ্কিত করতে এমন একটা জঘন্য কাজ করবো?ও আমার ঘরের ব‌উ। অপমান হলে তো আমাদের সবার অপমান হবে।তাই না।

আশরাফ চৌধুরী শেলীর কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। আসলেই তার কথাতেও যুক্তি আছে। কিন্তু এমন জঘন্য কাজটা আর‌ওয়ার সাথে কে করতে পারে তা কেউ বুঝতে পারছে না। আকরামুল হক আবারো বললেন: দেখেন ভাবি, আপনি রিদুয়ান ভাইকে ডাকেন। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিবো।এসব আর ভালো লাগছে না আমার। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে অযথা খেলবেন না।এমনেও আমার মেয়েটা কালকে থেকে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

শেলী বেগম থেমে গেলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন:আরে ভাই আমি শুধু মজা করেছি। এখানে রিদুয়ানকে বলার কি আছে?

শেলী বেগমের কথায় আশরাফ চৌধুরী আর আকরামুল হক দুজনেই বোকার মতো তাকিয়ে আছেন। তখন থেকে তাদের সাথে এসব কি হচ্ছে তা তারা বুঝতেই পারছেন না। আকরামুল হক অসহায় মুখ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ চিন্তিত।এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত তিনি জানেন না। হয়তো বুঝতেও পারছেন না। মনে মনে শেলী বেগমকে নিয়ে ভাবছেন।তার মন বলছে শেলী বেগম মানুষ হিসেবে পারফেক্ট নয়। ধীর পায়ে আর‌ওয়ার মা মিসেস সাবিনার কাছে গেলেন। মিসেস সাবিনা কাজে ব্যস্ত। স্বামীর এমন অসহায় মুখ দেখে অবাক চোখে বললেন: আবার কি হয়েছে?এমন লাগছে কেন তোমাকে?
_বুঝতে পারছি না। মেয়েটাকে এই বাড়িতে বিয়ে দেওয়াটা আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না।
_আবার কি হলো?
_রাশেদের মা আমার কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা চাইছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি আমার মেয়েকে নয়, টাকাকে লোভ করছেন।
_তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম।এই পরিবারটা আমার কাছে আগে থেকেই খারাপ মনে হয়েছিল। তুমি বলেছিলে,”না,আমার কলিগ রিদুয়ান সাহেব। খুব ভালো মানুষ”। এখন বোঝো ভালো মানুষ নাকি খারাপ মানুষ। এখনো সময় আছে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। মনে রাখবে,এটা তোমার মেয়ের জীবন।
_তুমি বলো কী করতে পারি।আমি বুঝতে পারছি না।
_এখনো কাবিন হয়েছে।শরীয়াহ মোতাবেক আকদ হ‌ওয়ার আগে বিয়েটা ভেঙ্গে দাও। আমার এটাই ভালো মনে হচ্ছে।
_আমার‌ও তাই মনে হয়।দুই মাস ধরে তারা আমাদের কতো জ্বালা দিচ্ছে!না জানি সামনে আরো কতো কি করবে। একবার আশরাফ ভাইয়ের সাথে কথা বলি।দেখি উনি কি বলেন।
_ঠিক আছে।

আকরামুল হক আবারো অসহায় মুখ করে আশরাফ চৌধুরীর কাছে গেলেন। আশরাফ চৌধুরীর মুখভঙ্গিও ঠিক নেই। দুজনেই কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে হবে। আজকে সবার সামনে তাদের ছেলের ব‌উ পরকীয়া করছে বলছে, কালকে আরেকটা বলবে। কাবিন হয়ে গেছে মানে আর‌ওয়া সেই বাড়ির ব‌উ কিন্তু তারা কতো সুন্দর করে মেয়েটাকে পরকীয়া বলে অপমান করছে। একটু বুঝতেও চাইছে না কেউ আর‌ওয়াকে নিজ ইচ্ছাতে গতকাল তুলে নিয়ে গেছে। পুলিশ অলরেডি তদন্ত করছে বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু শেলী বেগম এক এক সময় এক এক কথা বলছেন।

আশরাফ চৌধুরী আর আকরামুল হক একসাথে রিদুয়ান মোস্তফার কাছে গেলেন। আকরামুল হক বললেন:ভাই, আমাদের এই সম্পর্কটি এখানেই শেষ করা উচিত।আমরা অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
_কি বলছেন এসব? আমার সব আত্নীয়-স্বজনের সামনে এভাবে ছোট করতে পারেন না।
_আমরা আপনাকে ছোট করছি নাকি আপনারা আমাদের ছোট করছেন?একেক সময় এক এক অজুহাত দিচ্ছেন। আর এসব ভালো লাগছে না। আপনারা আসুন এবার।

রিদুয়ান মোস্তফা একবার ছেলে রাশেদের দিকে তাকালেন।রাশেদ কিছু শুনতে পায়নি মতো করে বসে আছে।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিয়েতে তার কোনো আগ্রহ নেই। উল্টো বিয়েটা ভেঙে গেলে সে খুশি হবে।রিদুয়ান মোস্তফা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রাশেদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো:বাবা,উনারা যখন চাইছেন বিয়েটা আমার সাথে দিবে না তো দিবে না। আমার জন্য মেয়ের অভাব নেই। তাছাড়া একজনের সাথে কাবিন হ‌ওয়ার পর‌ও যেই মেয়ে পরকীয়া করে পালিয়ে যায় তাকে আমি কখনো বিয়ে করতে চাই না। শুধু তোমাদের জোরাজুরি দেখে রাজি হলাম।

আকরামুল হক রাশেদের কথায় রেগে গেলেন।”এই ছেলে, আমার মেয়েকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না।”
_আপনার মেয়ে বাজে কাজ করতে পারে আর আমি বললেই দোষ? আগে মেয়েকে ঠিক করেন তারপর আমার সাথে কথা বলতে আসবেন।
_তোমাকে আমি কখনো আমার মেয়ে দিবো না।জাস্ট বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।
_আমিও আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো না।চলো বাবা। এখানে এক মূহুর্ত‌ও দাঁড়াবো না।

এই বলে রাশেদ হনহন করে বেরিয়ে গেলো।রিদুয়ান মোস্তফা তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনিও ছেলের পেছন পেছন বেরিয়ে গেলেন। শেলী বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আশরাফ চৌধুরী পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাকে যেন ফোন করলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন: তুমি কোথায়? তোমার সাথে কথা আছে। আর‌ওয়াদের বাসায় আসো।

চলবে..