বুঝে নাও ভালোবাসি পর্ব-০৭

0
6

#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা

পর্ব ০৭

আর‌ওয়া বের হয়ে একটু যেতেই খুব জোরে কিছু একটার শব্দ হলো। নির্ঝর কয়েকটি চিৎকার শুনে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেলো।

আর‌ওয়া দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে নিচের তলায় ফ্লোরে গিয়ে পড়লো।আর‌ওয়া ফ্লোরে পড়ে ছটফট করছে।তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝরের খালা, খালাতো বোন মিতা ও ভাবি। নির্ঝরের মা মিসেস রুমানা আর‌ওয়াকে ধরে বসানোর চেষ্টা করছেন।নির্ঝর এমন পরিস্থিতি দেখে অনেকটা দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো।আর‌ওয়ার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। সিঁড়ির পাশে থাকা ফুলদানিটা ভেঙে তার হাতে ঢুকে আছে। শরীরের বিভিন্ন অংশেও ঢুকে গেছে। রক্তে একাকার হয়ে আছে শরীরের অনেকটা অংশ। নির্ঝর দ্রুত আর‌ওয়ার পাশে বসে তাকে ডাকার চেষ্টা করছে। ছোট গলায় বলছে:আরু!আরু!

আর‌ওয়া একবার চোখ তুলে তাকালো নির্ঝরের ডাকে।অবাক হয়ে এক পলক তাকিয়ে থাকলো সে। সেই চিরচেনা ডাকটা শুনতেই চোখ বেয়ে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো তার। একটু পর সে নিস্তেজ হয়ে গেল।আর‌ওয়া চোখ বন্ধ করতেই নির্ঝর জোরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকছে:আরু!চোখ খোলো। প্লিজ তাকাও। প্লিজ প্লিজ তাকাও।

নির্ঝর এতো করে ডাকার পরেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আর‌ওয়াকে দ্রুত কোলে নিয়ে হাঁটা দিলো।নির্ঝরের মা পেছন পেছন আসছে‌। বাড়ির বাকি সদস্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। ‌হঠাৎ আর‌ওয়ার প্রতি তার এমন ফিলিংস দেখে সবার অবাক হ‌ওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রায় চার বছর ধরে নির্ঝরের জন্য মেয়ে খুঁজছিল কিন্তু সে বিয়েতে রাজি হয় না।গতকাল‌ও তাকে তার বাবা এটা-ওটা বলে বিয়েতে বসালো। বিয়ের পরেও সে আর‌ওয়ার সাথে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু এখন হঠাৎ এতো পাগলামি! বাড়ির সবাই অবাক এক কথায়।মিতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে।

নির্ঝর আর‌ওয়াকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। নির্ঝরের সাথে তার মা আর রিস্তা যাচ্ছে।সবাই আর‌ওয়াকে ডাকছে বারবার কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ড্রাইভার গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে চালিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালো। নির্ঝর আর‌ওয়াকে কোলে নিয়ে ইমার্জেন্সির ভেতর গেলো। মিসেস রুমানা আর রিস্তা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস রুমানা বুঝতে পারছেন না কি থেকে কি হলো?তার ভীষণ ভয় লাগছে। হঠাৎ করে আর‌ওয়া সিঁড়ি থেকে পড়তে যাবে কেনো? বুঝতে পারছেন না তিনি। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে। একটাও উত্তর পাচ্ছেন না তিনি।এসব ভাবতে ভাবতে বসে পড়লেন এক জায়গায়। হাসপাতালটা নির্ঝরের দাদার।আর‌ওয়ার মা পেশায় ডাক্তার হ‌ওয়ায় তার বাবার হাসপাতালে রোগী দেখেন। আজকে তিনিও আসবেন। হতে পারে এতোক্ষণে চলেও এসেছেন। মিসেস রুমানা ফোনটা নিতে ভুলে গেছেন।তাই একটা ফোন দিয়ে জানাতেও পারছেন না আর‌ওয়ার মাকে।

মিসেস রুমানা অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর রিস্তাকে বললেন: তুমি ফোন এনেছো?
_না চাচি।ফোন নিতে ভুলে গেছি।
_তাহলে ভেতরে গিয়ে নির্ঝরকে ডেকে আনো একটু।

মিসেস রুমানার কথায় রিস্তা গেলো নির্ঝরকে ডাকতে। একটু পর রিস্তা আর নির্ঝর ইমার্জেন্সি থেকে বেরিয়ে এলো‌। নির্ঝর ইমার্জেন্সি থেকে বের হতেই মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো।তার মা মিসেস রুমানা শান্ত কন্ঠে বললেন: তোমার ফুফিকে একটা ফোন দিয়ে বিষয়টা জানাও আর তোমার বাবাকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে আসতে বলো।
নির্ঝর কোনো জবাব না দিয়ে আবার চলে যাচ্ছিল। তখনি মিসেস রুমানা জিজ্ঞেস করলেন:কি বলেছে ডাক্তার?
মায়ের প্রশ্নে নির্ঝর রেগে গেলো। চিল্লিয়ে বললো:আপনার লাগবে? ওহ্ হ্যাঁ!আপনার লাগবে। ইম্পরট্যান্ট নিউজ না শুনলে কি হয়?
মিসেস রুমানা ছেলের আচরণে অবাক হয়ে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন:এসব কি বলছো তুমি? এভাবে কথা বলছো কেনো?
_আপনাকে কিভাবে বলতে হবে আমার?এসব কেন করলেন? আরুকে আমার জীবনে পাঠিয়ে আবার ছিনিয়ে নিতে চাইছেন? তাহলে পাঠালেন কেনো আবার? আমার যন্ত্রনা বাড়াতে নাকি আমাকে সান্তনা দিতে?

মিসেস রুমানা ছেলের কথায় অবাকের চরম পর্যায়ে আছেন। শান্ত কন্ঠে বললেন: আমি কি করলাম আবার?আর‌ওয়া নিজে নিজে পড়ে গেছে হয়তো। আমার দোষটা কোথায় এতে?
_আমি আপনাকে আগে না চিনলেও এখন খুব ভালো করে চিনি।সব দোষ আপনার। একজন সুস্থ সবল মানুষ কোনো কারণ ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড় গেলো।
নির্ঝরের কথায় রিস্তা গম্ভীর স্বরে বললো: ভাইয়া, এক্সিডেন্ট তো যেকোনো সময় হতে পারে। হয়তো আর‌ওয়া খেয়াল করেনি।

রিস্তার কথায় নির্ঝর তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বললো:সব করেছে তোর চাচি। উনি সবকিছু করতে পারেন। আমি চিনি উনাকে। আমি কখনো বলবো না এটা একটা এক্সিডেন্ট।ওর পা পিচ্ছিল হয়ে আছে।তাহলে বোঝার চেষ্টা কর,কেউ ইচ্ছাকৃত ওকে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে মেরে ফেলতে চেয়েছে।

মিসেস রুমানা ছেলের কথা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে আছেন।এই কোন ঝামেলায় পড়লেন তিনি? ছেলেকে বললেও সে বিশ্বাস করবে না।আসলে তো তিনি কিছুই জানেন না। রিস্তাও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মিসেস রুমানা অসহায় মুখ করে বললেন: তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়তো আর‌ওয়া কোথাও হেঁটেছে সেখান থেকে কিছু লেগেছে পায়ে। আমাদের বাসায় এমন কে আছে যে ওকে মারতে চাইবে?
নির্ঝর সাথে সাথে জবাব দিলো: কেনো?আপনি আছেন তো। আপনি সব করেছেন।
রিস্তা নির্ঝরকে থামিয়ে বললো: বারবার চাচিকে দোষ দিচ্ছো কেনো ভাইয়া?
_তোর চাচি মহৎ মানুষ তাই।

নির্ঝর আবার মায়ের দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো:আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। আমি কি আপনাকে একবারের জন্যও বলেছি আমি আরুকে চাই? আপনি যেদিন আমাকে বলেছিলেন আর‌ওয়ার সাথে সব কমিউনিকেশন অফ করে দাও আমি সেদিন সব যোগাযোগ অফ করে দিয়েছিলাম। আর কোনোদিন তার সাথে একটা কথাও বলিনি। আমার কষ্ট হলেও আমি আপনার কথাটা সবসময় মাথায় রেখেছিলাম।আজ আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটা করেছেন।আই হেইট ইউ,জাস্ট হেইট ইউ।

মিসেস রুমানা ছেলের কথায় কাঁদছেন। নির্ঝরের‌ও গলা কাঁপছে কথাগুলো বলার সময়।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা তার। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করছে সে। মিসেস রুমানা ছেলেকে কি বলে সান্তনা দিবেন বুঝতে পারছেন না। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন: এখন এসব কথা রাখো। তোমার ফুফিকে একটা ফোন দাও। হাসপাতালে আসতে বলো।

মিসেস রুমানা কাঁধে হাত রাখতেই নির্ঝর শান্ত চোখে তাকালো। মায়ের স্পর্শ যেন তার সমস্ত রাগ ভুলিয়ে দিলো। ছোট গলায় বললো:ফুফি হাসপাতালে আছে। উনি ভেতরে আছেন আর‌ওয়ার সাথে।

মিসেস রুমানা ছেলেকে আবারো প্রশ্ন করলেন। তোমার বাবাকে বলেছো?
_আমি বলিনি।ফুফি বলেছে। হয়তো এতোক্ষণে চলে আসবেন।
নির্ঝর আবারো ভেতরে গেলো। মিসেস রুমানা বাইরেই আছেন। সাথে রিস্তাও আছে। একটু পর আশরাফ চৌধুরী আসলেন।তিনি বেশ ঘাবড়ে আছেন। স্ত্রীকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন: হঠাৎ এসব কি করে হলো?
_আমি কিছুই জানি না।

পেছন থেকে নির্ঝর বলে উঠলো:উনি সব জানেন।
নির্ঝর আর‌ওয়ার জন্য কিছু ঔষুধ নিতে যাচ্ছিল।তখনি কথাটা বলে সে হনহন করে চলে গেলো। আশরাফ চৌধুরী ছেলে আর ছেলের মায়ের কথা কিছুই বুঝলেন না। বোকার মতো একবার ছেলের দিকে তো আরেকবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মিসেস রুমানা ছেলের কথা শুনে স্বামীর দিকে ভীত চোখে তাকালেন। আজকে হয়তো তার সবকিছু ফাঁস হয়ে যাবে এই ভেবে ঢোঁক গিললেন। আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীর ভয়ার্ত মুখ দেখে বললেন: এভাবে ভয় পেয়ে আছো কেন?আর নির্ঝর এসব কি বললো?
মিসেস রুমানা চুপ করে আছেন। কোনো উত্তর না পেয়ে আশরাফ চৌধুরী ছেলের কথাটা ভাবছেন। নির্ঝর কখনো মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথাও বলে না।সে কিনা আজকে মায়ের বিপক্ষে গিয়ে এমন বললো কেনো? আশরাফ চৌধুরী হিসাব মিলাতে পারছেন না।

একটু পর নির্ঝর ঔষুধ আর স্যালাইন নিয়ে আসতেই আশরাফ চৌধুরী ছেলের পেছন পেছন গেলেন।আর‌ওয়াকে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। এখন স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে কেবিনে শিফট করা হবে তাকে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি তার।আর‌ওয়ার মা তার পাশে বসে আছেন। ভাইকে দেখতেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আশরাফ চৌধুরী বোনের কান্না দেখে মাথা নিচু করে থাকলেন। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে ‌সেই সাথে অসহায়‌ও লাগছে। নির্ঝর চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর পর সে আর‌ওয়ার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটার এমন পরিস্থিতি‌ও দেখতে হবে তা সে জানতো না। সবসময় আর‌ওয়ার ভালো চেয়েছিল বলে দূরে থেকেছিল। হয়তো এতে আর‌ওয়া কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সেও তো কম কষ্ট পায়নি। গতকাল বাবার কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাবটা শুনে সে বেশ খুশি হয়েছিল। অতীতের ভালোবাসা জীবনে আবারো নতুন করে ফিরে আসবে ভেবে কতো আশায় ছিল। কিন্তু আজকে সব উল্টে গেলো‌। নির্ঝর অসহায় চোখে আর‌ওয়ার দিকে তাকালো ‌তাদের আরো কতোবার ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে সে জানে না।সে শুধু জানে সে আরুকে চায়।তার আরুকে।

চলবে…