#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ০৮
নির্ঝর অসহায় চোখে আরওয়ার দিকে তাকালো তাদের আরো কতোবার ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে সে জানে না।সে শুধু জানে সে আরুকে চায়।তার আরুকে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলো।এখনো আরওয়ার জ্ঞান ফিরেনি তবে স্যালাইন চলছে।নির্ঝর একবার হাসপাতাল রুমের এখানে-ওখানে পায়চারি করছে তো আরেকবার আরওয়ার দিকে তাকাচ্ছে। কিছুতেই মন বসছে না তার। আশরাফ চৌধুরী এক পাশে বসে আছেন। নির্ঝরের মা ছেলের কাণ্ড দেখছেন শান্ত চোখে। মনে মনে তিনি বেশ ঘাবড়ে আছেন।আরওয়া সিঁড়ি বেয়ে পড়ে যাওয়ায় জন্য কে পিচ্ছিল কিছু রাখলো?কেনো রাখলো? কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।এর চেয়েও কষ্টের কথা তার নিজের পেটের সন্তান নির্ঝর তাকে দায়ী করছে।এটা মেনে নেওয়া তো বেশ কঠিন।
ঘন্টা দুয়েক পর আরওয়ার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলতেই সে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলো। একটু পাশ ফিরতেই দেখলো তার মা আর মামা আশরাফ চৌধুরী বসে আছেন। ঠিক তার পাশে নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে।আরওয়া একবার নির্ঝরের দিকে তাকাতেই দেখলো নির্ঝর স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরওয়া সাথে সাথে চোখ নামিয়ে অন্য দিকে তাকালো।আরওয়ার এমন আচরণ দেখে নির্ঝর অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।আরওয়া কি তাকে ইগনোর করছে? কিন্তু কেনো?সে তো কিছুই করেনি।
মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে দেখে আরওয়ার মা দ্রুত বসা থেকে উঠে মেয়ের পাশে গেলেন। ছোট গলায় বললেন: কেমন লাগছে মা?
আরওয়া দূর্বল গলায় বললো: ঠিক আছি আমি। তোমার টেনশন করতে হবে না। টেনশন করলে প্রেসারটা বেড়ে যাবে।
আরওয়ার মামাও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।আরওয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন: তুই খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবি। রেস্ট নে এখন। আমি আসি। কিছু কাজ আছে।
কথাটা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় ইশারায় নির্ঝরকে ডাকলেন। বাবার ইশারা পেয়ে নির্ঝর সাথে সাথে গেলো। ইমার্জেন্সি থেকে বের হতেই আশরাফ চৌধুরী বললেন: আমাকে আর্জেন্ট যেতে হবে তাই থাকতে পারছি না। তুমি এখানে থাকবে। কোনো অজুহাত দিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যাবে না।আরওয়াকে খেয়াল রাখবে। সাথে তোমার ফুফিকেও। তোমার মায়ের সাথেও বাড়াবাড়ি করবে না। আগে আরওয়া সুস্থ হোক তারপর বাকিসব।খবরদার, হাসপাতাল থেকে কোথাও যাবে না।
নির্ঝর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আশরাফ চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন: এখন ভেতরে যাও আমি আসছি।
নির্ঝর বাবার কথামতো আবারো ভেতরে গেলো।আরওয়ার মা তাকে দেখে বললেন: এখন আরওয়া অনেকটা রিস্কমুক্ত। কেবিনে শিফট করতে হবে।
নির্ঝর ফুফির কথা শুনে একবার আরওয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো:আর কিছুক্ষণ এখানে রাখলে ভালো হয়।মাত্রই তো জ্ঞান ফিরলো। একটু সময় দেওয়া উচিত।
নির্ঝরের কথায় আরওয়ার মা সম্মতি দিলেন। দুজনেই দুটো চেয়ারে বসে পড়লেন।আরওয়া জেগে আছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ শুয়ে আছে সে। নির্ঝর আর আরওয়ার মায়ের মধ্যে টুকটাক অন্য বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। নির্ঝর কথা বলার পাশাপাশি একটু পর পর আরওয়ার দিকে তাকাচ্ছে।আরওয়া চোখ বন্ধ করে থাকায় সে নির্ঝরকে দেখতে পাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর আরওয়াকে কেবিনে শিফট করা হলো। এখন নির্ঝরের মা মিসেস রুমানা আর রিস্তা সহ আছে সাথে।আরওয়ার স্যালাইন চলছে এখনো।আরওয়াকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে সারাটা দিন কেটে গেলো। প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে কিন্তু এখনো কেউ কিছু খায়নি। বাড়ি থেকে খাবার পাঠানো হয়েছিল কিন্তু কেউ না খাওয়ায় এসব আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন পরিস্থিতি খারাপ থাকায় কারো খেতে ইচ্ছে করেনি। এখন সবাই অনেকটা টেনশন মুক্ত।এখন তো কিছু খেতে হবে।তাই নির্ঝর বের হয়ে সবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসলো।
রাত প্রায় দশটার দিকে আশরাফ চৌধুরী আসলেন।আরওয়ার বাবাও সন্ধ্যার দিকে এসেছিলেন। আরওয়ার মা এবার ভাইকে বললেন তখনের কথা। শান্ত গলায় বললেন: ভাইয়া, আমাদের বাসায় ঠিক কোন কাজে কেরোসিন তেলের ব্যবহার হয়?না মানে জানতে চাচ্ছিলাম।
বোনের এমন কথায় আশরাফ চৌধুরী অবাক হলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন: আমাদের বাসায় কেরোসিন তেল দিয়ে কি হবে? তুই কি কখনো আমাদের বাসায় কেরোসিন তেল ব্যবহার করতে দেখেছিস?
আরওয়ার মা মেকি হাসি দিলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন:আমি কখনো দেখিনি বলেই তো বুঝতে পারছি না।আরওয়ার পায়ে কেরোসিন তেল আসলো কি করে?সে কি সকালে কোনো কেরোসিন তেলের গোডাউনে ঘুরতে গিয়েছিল?
আশরাফ চৌধুরী বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন বোনের দিকে। নির্ঝর ঠিকই বুঝতে পারছে তার ফুফি কি বলতে চাইছেন।সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে মায়ের কথাগুলো বাবাকে বলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ভয়ও লাগছে আবার। একজন সন্তান হয়ে কি মায়ের দোষগুলো বাবাকে আর অন্যদের বলে দেওয়া যায়? কিন্তু তার মা তো দোষী।আর প্রত্যেক দোষীকে শাস্তি পেতে হয়। মনকে শক্ত করলো নির্ঝর।
আশরাফ চৌধুরী বোনকে প্রশ্ন করলেন:আরওয়ার কেরোসিনের গোডাউনে যাবে কি করে?এসব কি বলছিস? বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বল।
আরওয়ার মা দম নিলেন। তারপর বললেন: নির্ঝর যখন আরওয়াকে হাসপাতালে আনে তখন আমি ওর পায়ে কেরোসিন তেল পেয়েছি। মানে কেউ আগে থেকে আরওয়ার রাস্তায় কেরোসিন তেল ফেলেছিল যাতে সে পড়ে যায়।আর কেরোসিন তেল টাইলসে ফেললে তো টাইলস পিচ্ছিল হয়ে যায়। তাছাড়া এমন জায়গায় ফেলেছে যাতে একেবারে উল্টে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পড়ে যায়।
বোনের কথায় আশরাফ চৌধুরী চোখ বড় বড় করে তাকালেন। তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না এসব কথার অর্থ।তার বাসায় এমন কে আছে যে আরওয়াকে মারতে চায়?সবাই তো আরওয়ার কাছের মানুষ। তাহলে কে মারবে?
আশরাফ চৌধুরী একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি এসব জানো?
_নির্ঝর বলেছিল একটু করে।আমি জানি না।
_এসব কে করলো? নির্ঝর, এদিকে আসো।
বাবার কথা শুনে নির্ঝর বাবার দিকে এগিয়ে আসলো। মনে মনে ভাবছে এখন মায়ের সব কীর্তি ফাঁস করে দিবে। কিন্তু কেন জানি গলা কাঁপছে। অসহায় চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর আবার বাবার দিকে তাকালো। আরেকবার আরওয়ার দিকে তাকালো।সে বুঝতে পারছে না সত্যিটা বলবে কি করে?ভাবলো আগে বাবার কথাটা শোনা জরুরি। শান্ত চোখে বললো:জি বলেন
_বাসায় গিয়ে সিসি ক্যামেরা চেক করো।সব আপডেট আমাকে জানাবে। এক্ষুনি যাও বাসায়।
নির্ঝর ছোট গলায় “ওকে” বলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো, এখন মায়ের কথাটা কাউকে বলবে না।আগে সিসি ক্যামেরা চেক করে সিউর হোক কে এমন জঘন্য কাজ করেছে। তারপর পরিস্থিতি বুঝে মুখ খুলতে হলে তবেই সে কথাগুলো সবাইকে বলবে।
নির্ঝর নিজে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।সে সব ভাবছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। এখন নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে।আরওয়া অনেকটা সুস্থ। বাসায় গিয়ে সিসি ক্যামেরা চেক করলো।সিসি ক্যামেরায় পুরো ঘটনাটা দেখে সে পুরো অবাক। কাউকে কিছু না বলে নির্ঝর আবার বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।তার ভাবি আর বড় ভাই অনেক করে বলেছিলেন একটু রেস্ট নিতে। কিন্তু সে কারো কথা শুনেনি।সোজা বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে কথাগুলো বলতে হবে তার।আগে কখনো কোনো কথা বাবাকে বলার জন্য এতো উদগ্রীব হয়ে থাকেনি সে। তবে আজ মনে হচ্ছে তার বাবাই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ঠিক ছয় বছর আগে যদি এভাবে বাবাকে সব কথা শেয়ার করতো তাহলে তাকে এতোটা কষ্টে থাকতে হতো না।জীবন থেকে ছয়টা বছর অনায়াসে শেষ হয়ে যেতো না। মনে মনে ভাবছে সে কতো বোকা। আসলেই বোকা।তার বাবা বেশ গম্ভীর মানুষ।তাই বাবা-ছেলের মাঝে একটা দূরত্ব ছিল। আজ মনে হচ্ছে এই দূরত্ব রেখে চলাটা তার পথটা জটিল করে দিয়েছিল।
নির্ঝর হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামালো। একপাশে গাড়ি পার্ক করে সে আরওয়ার কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। কেবিনে ঢুকতেই আরওয়ার দিকে তাকালো একবার। তারপর আবার বাবার দিকে তাকালো।তার বাবা বেশ চিন্তিত। কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন তিনি।তার পাশে নির্ঝরের মা।নির্ঝরকে দেখে তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে তার।এক দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।নির্ঝরকে দেখা মাত্র তার বাবা জিজ্ঞেস করলেন:চেক করেছো সিসি ক্যামেরা?
_জি করেছি।
_কে করেছে এসব জানতে পেরেছো?
_জি পেরেছি।
_কে করেছে?
_আম্মু করিয়েছেন নিশ্চয়।আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর।
নির্ঝরের কথায় তার বাবা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো: তুমি কি বলছো তুমি জানো? তোমার আম্মু এসব করতে যাবে কেনো?
নির্ঝর চুপ করে আছে।আরওয়ার মা অবাক চোখে নির্ঝরের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। নির্ঝরের মায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি জানতেন তার ছেলে এমন কিছু বলবে।তাই অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই। নির্ঝরের বাবা আবারো গম্ভীর গলায় বললেন: নির্ঝর, তুমি ভেবেচিন্তে কথা বলো। আমি তোমার সাথে জোকস করছি না। মাথায় রাখবে সেটা। অযথা অযৌক্তিক কথা বলে সময় নষ্ট করবে না।
নির্ঝর শান্ত গলায় বললো:আমি আম্মু করেছে বলিনি।করিয়েছে বলেছি। আপনি বুঝতে পারছেন না।
চলবে….