#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ১২
নির্ঝর এখনো মাথা নিচু করে আছে।রুমানা বেগম অর্ধেকটা বলে থামলেন।এতো কথা বললেন যে গলার পানি শুকিয়ে গেছে।তাই এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। তারপর বলা শুরু করলেন: আরওয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে নির্ঝর ডিপ্রেশনে ছিল। খাওয়া-দাওয়া,অফিস সবকিছুতে অনিয়ম করছিল।কাউকে বলতেও পারছিল না আবার সহ্যও করতে পারছিল না।এমন একটা অবস্থা।আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এমন উল্টা-পাল্টা করছো কেন?সে কোনো জবাব না দিয়ে চলে গিয়েছিল। তখন আমি নির্ঝরের মনের ভাব বোঝার জন্য মিথ্যা বলে ওকে যাচাই করেছিলাম। একদিন হুট করে বললাম,আরওয়ার বিয়েটা ভেঙে গেছে। জানো আশরাফ?আমার কথাটা শোনা মাত্র আমার ছেলেটা কতো খুশি হয়ে গিয়েছিল। তখনি সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়েটা আমাকে ভাঙতে হবে।তাই লোক ঠিক করলাম আর আরওয়ার এনগেজমেন্টের আগের দিন ওকে কিডন্যাপ করলাম যাতে বরপক্ষ বিয়েটা ভেঙে দেয়। আমি জানতাম তুমি ঠিকই পরিস্থিতি খারাপ দেখলে বিয়েটা নির্ঝরের সাথে দিয়ে দিবে। যদি তুমি না দিতে তাহলে আমি তোমাকে বলিয়ে পরে বিয়েটা দিতাম। এটাই আমার প্ল্যান ছিল। আমি জানতাম, কথাগুলো সবাই জানতে পারলে আমাকে খারাপ বলবে যেমনটা নির্ঝর জানার পর থেকে বলছে। কিন্তু দেখো, আমার আর কিছুই করার ছিল না।
মিসেস রুমানা কাঁদছেন। নির্ঝরের চোখের পানি চিকচিক করছে। আশরাফ চৌধুরী বোকার মতো নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।তিনি ভাবতেই পারেননি তার আড়ালে স্ত্রী-সন্তান কতো কি করে ফেললো।অথচ তিনি বিন্দুমাত্র কিছুই বুঝতেই পারেননি।রুমানা কান্না থামিয়ে বললেন: আমার আর কি করার থাকতে পারে বলো?যখন জানতে পারলাম মিরাজ আর নির্ঝর রোজ ঝগড়া করছে আরওয়াকে নিয়ে তখন তাদের সমস্যা সমাধান করা আমার দায়িত্ব ছিল।ভেবেছিলাম নির্ঝরের সাথে আরওয়ার বিয়েটা হলে মিরাজ সারাজীবন নির্ঝরের সাথে হিংসা করবে। এখন দুজনেই আরওয়াকে না পেলে আর ওদের মধ্যে শত্রুতা থাকলো না।যখনি দুজনের দেখা হয় মারামারি করে এখনো।আমি শান্তিমতো বাপের বাড়ি যেতে পারি না।নির্ঝর তখন থেকে নানার বাড়ি যায় না।এমনকি ঈদে সহ সে আমার বাবা-মাকে একটু সালাম করতে যায় না। শুধু কারণ একটাই মিরাজের সাথে দেখা হয় সেটা।মামাতো-ফুফাতো ভাইয়ের মধ্যে এতো শত্রুতা হয়ে গেলো শুধু আরওয়ার জন্য।তাই দুজনকে বাঁচাতে এমনটা করেছি।
নির্ঝর কিছু না বলে ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো রুমে। ছেলে চলে যাওয়ার পর আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীকে সামলালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন:যা হয়েছে ভুলে যাও।এসব নিয়ে আর কান্নাকাটি করতে হবে না। মানুষ মাত্রই ভুল।আমি আরওয়ার সাথে আর ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে নিবো। তোমার এসব ভাবতে হবে না।আর কান্না করিও না।যাও এবার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও কিছুক্ষণ।
আশরাফ চৌধুরী স্ত্রীকে ধরে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। স্বামী হিসেবে আশরাফ চৌধুরী যেন একশোতে একশো। সবসময় স্ত্রীর পাশে থাকেন, সাপোর্ট দেন,আগলে রাখেন। মানুষ হিসেবেও আশরাফ চৌধুরী খুব ভালো মনের তার অনেকটা হালকা লাগছে আজকে। এতোদিন মনের
মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল আরওয়ার আর নির্ঝরকে নিয়ে। ছেলেকে জোর করে বিয়েটা দিয়েছেন তিনি তাও বোনের মেয়ের সাথে।যদি দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয় তাহলে দোষটা তার হতো। কিন্তু এখন সব জানার পর টেনশন হওয়ার কারণ নেই। যেহেতু আরওয়া আর নির্ঝর দুজন দুজনকে ভালোবাসে তাহলে আশরাফ চৌধুরীকে আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।তারা তাদের মতো মিলেমিশে থাকবে এটাই এখন তার চাওয়া। মনে হচ্ছে তিনি অনেকটা সফল।
নির্ঝর রুমে যেতেই দেখলো আরওয়া ঘুমিয়ে আছে।আরওয়ার ঘুমন্ত মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নির্ঝর।কতো মায়াবী, সহজ-সরল একটা মুখ। মনে হচ্ছে অনেক যুগ পরে আরওয়ার ঘুমন্ত মুখটা দেখছে সে।যাক,এখন তো রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুমন্ত মুখটা দেখবে। আসলেই তার মা একটা ভালো কাজ করেছে। মায়ের কারণেই তো সে আজ আরওয়াকে পেলো। কিন্তু সে কি করলো? মাকে ধন্যবাদ না দিয়ে উল্টো দোষারোপ করলো। নির্ঝর ভাবছে এসব।কাকে দোষ দেওয়া যায় সে বুঝতে পারছে না।মা মায়ের জায়গায় ঠিক আছে কিন্তু অপরাধ তো অপরাধ।আর নির্ঝর মাকে দোষারোপ করে সে তার জায়গায় ঠিক আছে। কারণ অপরাধী যেই হোক না কেনো অপরাধীকে ক্ষমা করতে নেই। নির্ঝর আর ভাবলো না এসব। শুধু শুধু মাথা নষ্ট হচ্ছে তার। সব হয়েছে শুধু মিরাজের জন্য। মিরাজের মতো মামাতো ভাই যার জীবনে আছে তার জীবন শেষ। মিরাজের জন্য তার ভালোবাসাটা নষ্ট হয়ে গেলো।আপাতত মিতাকে নিয়ে ভাবতে হবে। মিতাকে সাইজ করতে পারলেই শান্তি।
ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবলো কি করা যায়। স্থানীয় থানার এএসপি মনিরুজ্জামানকে ফোন দিলো।সে আর্মিতে থাকায় দুজনের মাঝে বেশ সখ্যতা আছে।তাকে পুরো ঘটনাটা বলতে হবে। তারপর দুজনেই সিদ্ধান্ত নিবে কি করা যায়। মনিরকে ফোন দিয়ে সে বেলকনিতে চলে গেলো। রুমে বসে কথা বললে আরওয়ার ঘুম ভেঙে যাবে তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বললো মনিরের সাথে।মনিরকে সব খুলে বলতেই সে বললো মিতার বিরুদ্ধে মামলা করতে। নির্ঝর একটু ভাবলো তারপর বললো বাবার সাথে একবার পরামর্শ করে মনিরকে জানাবে সে।
মনিরের সাথে কথা শেষ করে নির্ঝর বিছানায় গিয়ে বসলো।আরওয়া এখনো ঘুমিয়ে আছে। নির্ঝর আরওয়ার মাথার পাশে বসলো।আরওরার মাথায় হাতটা রাখতে যাবে তখনি সে থামলো।হাত কাঁপছে তার।সাহস পাচ্ছে না আরওয়ার মাথায় হাতটা রাখতে। অযথা মেয়েটাকে কতো অপমান করেছিলো সে।আজ বেহায়ার মতো তার মাথায় হাত রাখাটা যে অধিকারের মধ্যে পড়ে না এমন মনে হচ্ছে। আসলেই তো। ভালোবেসে আগলে রাখতে না পারলে আস্তে আস্তে অধিকারবোধটা হারিয়ে যায়।একসময় ধীরে ধীরে ভালোবাসায় মরীচিকা ধরে আর ভালোবাসাটাও হারিয়ে যায়।যেমনটা হয়েছে তাদের দুজনের মধ্যে।আরওয়াকে ছোঁয়ার অধিকারটা নির্ঝর হারিয়ে ফেলেছে।নয়তো হাত কাঁপছে কেনো তার? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।
নির্ঝর শান্ত চোখে আরওয়ার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে তাদের রিলেশনশিপের শেষ দিনটার কথা।আরওয়াদের বাসার পেছনের গলিটায় তারা শেষ দিন কথা বলেছিল।
আরওয়া প্রাইভেট থেকে আসছিল তখন আর নির্ঝর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।আরওয়া প্রতিদিনের মতো নির্ঝরকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু নির্ঝর? নির্ঝর তখন ব্রেকআপ করার অজুহাত খুঁজছে। কোনো এক অজুহাতে তার এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।মাকে কথা দিয়েছে আর সেটা অমান্য করার সাধ্য তার নেই।আরওয়া আসতেই নির্ঝর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো:এতো দেরি হলো কেনো আসতে?
_প্রতিদিন এই টাইমে আসি।দেরি হয়নি তো।
_দেরি হয়নি মানে কি?আমি তো দেখছি দেরি হয়েছে।
_না দেরি হয়নি।দেখো, ঠিক পাঁচটা।
নির্ঝর রাগী গলায় বললো: আমাকে টাইম শেখাচ্ছো তুমি?একে তো দেরি করে আসলে তার উপর আবার উল্টোপাল্টা কথা বলছো। বাহ্!
আরওয়া শান্ত গলায় বললো: তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো?
_আমার ইচ্ছা করছে তাই আমি এভাবে কথা বলছি।শুনতে ইচ্ছা করলে শুনো আর যদি শুনতে না পারো তাহলে বিদায় হও।
_দেখো নির্ঝর,আমার এমনে শরীর খারাপ লাগছে। তুমি এভাবে কথা বললে আমি কথা বলবো কি করে?
_তোমাকে কথা বলতে বলেছে কে?আমি বলেছি?যাও কথা বলতে হবে না।
_তুমি আজকে এমন করছো কেনো?
_আমি এমনই করবো। তোমার মতো মেয়ের সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করে না।
_আগে তো কথা বলার জন্য পাগল হয়ে যেতে। আজকে এমন করছো কেনো?আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।
_শোন,আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না।আমি জাস্ট ব্রেকআপ চাই।
_ব্রেকআপ করার কারণ?
_কারণ তোমাকে বলতে হবে কেনো?
_আমার সাথে ব্রেকআপ করবে আর আমি জানবো না তা কি করে হয়?
_না জানবে না।
_কারণ তো বলো।আমি শুধরে নিবো নিজেকে।
নির্ঝর থামলো।সে বুঝতে পারছে না ঠিক কি বলবে? কোনো কারণ তো তার জানা নেই।সে কি বলবে? একটু ভেবে বললো: তোমার মতো মেয়ের সাথে আমার যায় না।কখনো যাবে না।তুমি শুধরালেও যাবে না।তাই ব্রেকআপ চাই।জাস্ট ব্রেকআপ।
আরওয়া থেমে গেলো। নির্ঝরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে।তার চোখ দুটি ছলছল করছে। ভালোবাসার মানুষ যদি অযোগ্য বলে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?আরওয়ার আজকে জঘন্য রকমের কষ্ট লাগছে। কাউকে বোঝাতেও পারছে না তার কষ্টটা। চুপচাপ হাঁটা দিলো সে। নির্ঝরের সাথে আর কোনো কথা বলতে চায় না সে। নির্ঝর আরওয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।আরওয়ার কষ্টটা সবাই বুঝলেও নির্ঝরের কষ্টটা কেউ বুঝবে না।সবাই তাকেই অপরাধী বলবে। কিন্তু সে নিরুপায়।
আরওয়া সেদিন চলে গিয়েছিল।দুজনের মাঝে আর কখনো কথা হয়নি। আজকে ছয় বছর পর ভাগ্যের খেলায় দুজনেই এক ঘরে, একসাথে সংসার করছে। নির্ঝর কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঝিমুচ্ছে।আর সে ঘুমের ঘোরে আরওয়ার ঘাড়ে নিজের মাথাটা রেখে শুয়ে পড়লো। নির্ঝর শুতেই আরওয়ার ঘুম ভেঙে গেলো। সে চোখ খুলতেই দেখলো নির্ঝর তার পাশে।
চলবে…