#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা
পর্ব ১৬
নির্ঝর কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো।তার গন্তব্য রুমের দিকে। পেছন থেকে মিতার বাবা বললেন, নির্ঝর আমি তোমাকে দেখে নিবো। তুমি খুব বেশি ভুল করছো। আমার মেয়ের প্রতি অন্যায় করেছো তা আমি সুদে-আসলে নিবো।
নির্ঝর হেসে বললো: আগে মেয়েকে নিয়ে ভাবুন তারপর আমাকে নিয়ে ভাবতে আসবেন।
নির্ঝর ধীর পায়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে গেলো।সে যেতেই তার পেছন পেছন তার দাদাভাই আর আরওয়ার মা উঠে গেলেন।তারা বাবা-মেয়ে দুজনেই আরওয়া-নির্ঝরের রুমে গেলো।আরওয়া বিছানায় শুয়ে ছিল। তাদের সবাইকে একসাথে দেখে আরওয়া বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলো।মারওয়া তাকে ধরে বসালো।নির্ঝর আর তার দাদা একপাশে বসলো।আর আরওয়ার মা অন্যপাশে বসলেন।আরওয়ার মা তখনি বললো: আমি এতো দিন আরওয়াকে দেখতে আসিনি শুধু এই প্রসঙ্গে কথা হবে আর আমার কিছু বলতে হবে এটা ভেবে।আজ আসলাম আর আজকেই মিতার বাবা-মা আসলো।আমি ওদের সাথে মুখোমুখি হতে চাই না।আমার পক্ষে এতো কাহিনী করা সম্ভব নয়।আমি চাই না আরওয়ার সাথেও মিতার ব্যাপারে কোনো কথা হোক।আমি যাওয়ার সময় ভাবিকে আর ভাইয়াকে বলে যাবো।
নির্ঝর চুপ করে আছে। নির্ঝরের দাদাভাই বললো:তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।এটা আমার বাড়ি।আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথামতো চলতে হবে।আমি যা সিদ্ধান্ত নিবো তাই মেনে নিতে হবে সবার।আমার বাড়িতে থেকে আমার নাতনির সাথে মিতার পরিবারের কোনো সদস্য বা এই বাড়ির অন্য কেউ অধিকার ফলাতে আসবে তাকে আমি সহজে ছাড়বো না।
চারজনেই কিছুক্ষণ গল্প করে আরওয়ার মা আর নানাভাই নিচে নেমে গেলো।
প্রায় তিন দিন কেটে গেলো মাঝে।আরওয়া এখন অনেকটা সুস্থ।নিজে নিজে হাঁটার চেষ্টা করছে সে। এই তিনদিনে নির্ঝরের সাথে টুকটাক কথা হয়। যদিও সম্পর্কটা এখনো আগের মতো হয়নি। আরওয়া সকাল থেকে একা একা বসে আছে। এখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে।রিস্তা অফিসে আর তিস্তা ভার্সিটিতে গেছে এখনো ফেরেনি।নির্ঝরও অফিসে গেছে সেই সকালে।তার ছুটি শেষ হয়েছে দুদিন হলো। কাজের প্রেসার থাকায় তারও আসার নাম নেই।আরওয়ার ইচ্ছে করছে নির্ঝরকে একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে কখন আসবে সেটা। কিন্তু মনে মনে আনইজি লাগছে।তাই ফোনটা হাতে নিয়ে অসহায় মুখ করে বসে আছে সে।একা একা আর কতোক্ষণ থাকা যায়? নির্ঝর আসলে হয়তো অনেকটা ভালো লাগতো।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর নির্ঝর আসলো। চোখে মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। রুমে ঢুকতেই আরওয়াকে দেখে সে মুচকি হাসলো। আরওয়া তাকে দেখতেই বললো:এতো দেরি করে আসতে হয়?
আরওয়ার কথায় নির্ঝরের মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। শান্ত কন্ঠে বললো: আমাকে মিস করেছিলে বুঝি? বাহ্!ভালোই তো।একটা ফোন দিলে আমি সকল ব্যস্ততা বাদ দিয়ে চলে আসতাম।
_ঢং দেখলে বাঁচি না।
নির্ঝর হাসলো আবারো। ধীর পায়ে আরওয়ার পাশে গিয়ে বসলো।আরওয়ার হাতটা ধরতে যাবে তখনি সে হাত সরিয়ে নিলো। নির্ঝর একবার আরওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো: তোমার অভিমানী মুখটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে।তাই তুমি অভিমান করলে আমার খুব ভালো লাগে।
_এই ভালো লাগা এতোদিন কোথায় ছিল?
_সবসময় ছিল কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছু মনের মধ্যে জমিয়ে রাখতে হয়।আর যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসো তাহলে এসব বুঝে নিবে। আসলেই কি আমাকে ভালোবাসতে?
_সেটা বলতে আমি বাধ্য নই।
_আমার মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবাসতে না।তাই এখনো বুঝতে পারছো না।
_আমি তোমাকে ঘৃণা করি।জাস্ট ঘৃণা করি। তোমার মতো ছেলেরা মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করো। খেলা শেষ তো দূরে ঠেলে দাও। তোমরা কখনো ভালোবাসার যোগ্য হও না। তোমাদের মতো ছেলেদের তাই শুধু ঘৃণা করতে হয়।
_আরু,বোঝার চেষ্টা করো একটু।আমি বাধ্য হয়ে তোমার সাথে সেদিন ব্রেকআপ করেছিলাম।আর কোনো ইস্যু ছাড়া তো হুটহাট একটা সম্পর্ক শেষ করা যায় না।তাই অজুহাত খুঁজলাম আর মনে হলো যদি তোমাকে অযোগ্য বলি তাহলে তুমি আর আমাকে নিয়ে ভাববে না, আমাকে এভয়েট করবে।তাই এসব বলেছিলাম।
_আরো কতো বানানো কথা শুনবো কে জানে!
_আমার কথাগুলো তোমার বানানো মনে হচ্ছে? তুমি যদি সত্যি অযোগ্য হতে তাহলে কি এখন বিয়ে করতাম? তুমি বুঝতে চাইছো না কেনো?আমি তোমাকে ভালোবাসি। এখানে অবিশ্বাস করার কিছু নেই আরু। ট্রাস্ট মি প্লিজ।
_তুমি আমাকে সেদিন সব খুলে বলতে। তুমি বলতে মামি বলেছে রিলেশনশিপ কন্টিনিউ না করতে।আমি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতাম না। মিথ্যা কথা বলেছিলে কেনো?
_যদি সেদিন সত্যি কথাটা বলতাম তাহলে আম্মুকে তুমি ঘৃণা করতে। এখন আমাকে ঘৃণা করছো তা আমি ইজিলি মেনে নিতে পারছি কিন্তু আমার মাকে ঘৃণা করবে সেটা আমি কি করে মেনে নিতাম?তাই এমনটা করেছি। অনেক সময় সত্যি কথাটা বলা যায় না।আমি সন্তান হয়ে কি করে তোমার কাছে মায়ের নালিশ করবো?
আরওয়া চুপ করে আছে। নির্ঝরের সাথে এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার।সেও তো নির্ঝরকে ভালোবাসে। শুধু রাগ করেই কথাগুলো বলছে।আরওয়া চুপ করে আছে দেখে নির্ঝর আরওয়ার হাত ধরে ফেললো। শান্ত কন্ঠে বললো:আমি জানি,আমি ভুল করেছি। তোমাকে সব খুলে বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি স্বার্থপরের মতো সব নিজের মনে জমিয়ে রেখেছিলাম। তোমাকে বলে দুজনেই মিউচুয়ালি সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। কিন্তু দেখো, তখন আমাদের বয়স কতো? কিশোর বয়স।এতো অল্প বয়সে বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একটু ডিফিকাল্ট ছিল।তাই হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।আ’ম সরি এগেইন। প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে তোমার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি।
আরওয়া এখনো কিছু বললো না। নির্ঝর এক পলক তাকিয়ে থেকে আবারো বললো: প্লিজ কিছু তো বলো। আমাকে ক্ষমা করবে কিনা!
_দেখা যাবে ভবিষ্যতে।
_প্লিজ আমাকে একবার বোঝার চেষ্টা করো।
আরওয়া রাগী গলায় বললো:এতো বুঝতে পারবো না।যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর নাস্তা করে নাও।
নির্ঝর হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দুষ্টু গলায় বললো:বউয়ের কথা উপেক্ষা করার সাধ্য কোনো পুরুষের নেই। আমি কি করে উপেক্ষা করি।যায় ফ্রেশ হয়ে আসি। তুমি রেস্ট নাও।
নির্ঝরের কথায় আরওয়া মনে মনে হাসলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না। নির্ঝর ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
নির্ঝর ফ্রেশ হয়ে এসে আবার শুরু করলো:চলো, একসাথে নাস্তা করি।
_আমি ভাবিদের সাথে করবো। তুমি টায়ার্ড তাই আগে গিয়ে করে নাও।
নির্ঝর কিছু বলতে যাবে তখনি তার অফিস থেকে ফোন আসলো।সে ফোনটা রিসিভ করে কথা বললো। তারপর ফোন রেখে আরওয়াকে বললো:একটা ইমার্জেন্সি কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। তুমি নিচে যাবে?চলো তোমাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে আসি।
_আমি একা যেতে পারবো। তুমি যাও।
_আরে আবার কোথাও পড়ে যাবে।চলো,আমি ধরে নিয়ে যায়।
আরওয়া জানে নির্ঝরকে না করলেও সে শুনবে না।তাই বাধ্য হয়ে সে নির্ঝরের সাথে গেলো। নির্ঝর তার হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটছে।আরওয়া যেতে যেতে বললো: যাওয়ার আগে নাস্তা করে যাও। অফিসে গেলে আর খাওয়া হবে না।
_আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।দেরি হয়ে গেলে আবার সব উল্টাপাল্টা করে ফেলবে ওরা। তুমি থাকো আমি গেলাম।
নির্ঝর আরওয়াকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।আরওয়া নিচে এসে বসতেই মিসেস রুমানা আসলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন:দুপুর থেকে মাথাটা ব্যাথা করছে।তাই তোমার রুমে যাওয়া হয়নি। দুপুর থেকে একা একা বসে ছিলে বুঝি?
_হ্যাঁ। আপনার মাথাব্যথা এখন কমেছে ?
_হুম অনেকটা কমেছে। তুমি দুপুরে ঔষুধ খেয়েছো?
_জি খেয়েছি।
মিসেস রুমানা চারপাশে একবার পর্যবেক্ষণ করলেন। দেখলেন আশেপাশে কেউ নেই। দ্রুত আরওয়ার পাশে গিয়ে বসলেন তিনি। শান্ত গলায় বললেন: তুমি তো আমার মেয়ের মতো।তাই না?
আরওয়া কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ালো। মিসেস রুমানা আরওয়ার হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দেখে শুকনো হাসি দিয়ে বললেন: তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করো।
_জি বলেন।
_আসলে আমি কিছু ভুল করেছি। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন থেকে নির্ঝর তোমাকে অনেক কেয়ার করতো, চোখে চোখে রাখতো। ভাবতাম, তোমাকে বোনের মতো আগলে রাখছে যেহেতু তার কোনো বোন নেই। কিন্তু তোমরা একটু বড় হওয়ার পর মিরাজ একদিন আমাকে এসে বললো তোমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। জানো,আমি প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারিনি। পরে নির্ঝর থেকে জিজ্ঞেস করতেই সে সব স্বীকার করে নিয়েছিল। তখনি আমি নির্ঝরকে বারণ করলাম। বললাম তোমার সাথে যেনো আর কোনোদিন যোগাযোগ না করে, তোমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেয়। একজন মা হিসেবে তখন আমার এটা যৌক্তিক মনে হয়েছিল।তাই ওকে জোর-জবরদস্তি করলাম।সেও বাধ্য হয়ে তোমার সাথে সব ধরণের সম্পর্ক শেষ করে দিলো।
_জি আমি এসব জানি।
_কে বলেছে?
_ভাবি বলেছেন সবটা।
_সবটা জানার পর আমাকে ঘৃণা করো না?
_না।
_আচ্ছা ঘৃণা করো কি করো না সেটা তোমার ব্যাপার। এখন আমার কথা শুনো।
_জি বলেন।
_আমি ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল করেছি। আমার ভুলের শাস্তিস্বরূপ আমার ছেলেটা ছয় বছর কষ্ট পেয়েছে।আমি চাই না সে আরো কষ্ট পাক। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আর আমার ছেলেটাকে মেনে নাও। আমার ছেলেটাকে আগের মতো ভালোবাসো, আগের মতো আগলে রাখো সবসময়। দুজনেই আগের মতো হয়ে যাও।এটা আমার রিকোয়েস্ট।যদি আমার ছেলেটাকে মেনে নিয়ে নতুন করে সব শুরু করো তাহলে বুঝবো তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো।
আরওয়া চুপ করে আছে।সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অসহায় মুখ করে মিসেস রুমানার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।
চলবে…