বুঝে নাও ভালোবাসি পর্ব-১৮

0
142

#বুঝে_নাও_ভালোবাসি।
#ফাহমিদা_তানিশা

পর্ব ১৮

আর‌ওয়া বিছানায় বসে ছিল ‌। নির্ঝর রুমে ঢুকতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নির্ঝর মেজাজ কন্ট্রোল করে আর‌ওয়ার পাশে গিয়ে বসলো। শান্ত কন্ঠে বললো: নিজের শরীরের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হয়। অন্যের উপর রাগ করে নিজেকে কষ্ট দিবে তা হতে পারে না।
_এসব জ্ঞান তোমার দিতে হবে না।
নির্ঝর আর কোনো কথা বললো না। বেচারা মহা বিপদে আছে। মায়ের কাছে গেলে মায়ের লেকচার শুনতে হয় আর ব‌উয়ের কাছে গেলে ব‌উয়ের লেকচার শুনতে হয়।তাই সিদ্ধান্ত নিলো চুপচাপ থাকতে হবে তাকে।

অনেক্ষণ দুজনে কোনো কথা বললো না। নির্ঝর আড়চোখে বারবার আর‌ওয়াকে দেখছে কিন্তু আর‌ওয়ার কোনোদিকে দৃষ্টি নেই।সে তার মতো করে আছে। ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে পড়লো আর‌ওয়া। নির্ঝর গম্ভীর গলায় বললো: রাতের ঔষুধ খাওনি কেনো?
নির্ঝরের কথা শুনে আর‌ওয়া এক লাফে শোয়া থেকে উঠলো। সবসময় ঔষুধ খেতে সে ভুলে যায়।একটা বদ-অভ্যাস বলা চলে।আর‌ওয়া বিছানা থেকে নামতে যাবে তখনি তাকে নির্ঝর থামিয়ে দিলো। গম্ভীর গলায় বললো:আমি এনে দিচ্ছি। তোমার যেতে হবে না।
নির্ঝর গিয়ে আর‌ওয়ার ঔষুধ আর পানি আনলো।নিজেই ঔষুধ খাইয়ে দিলো।আর‌ওয়া চুপচাপ ঔষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।এই মূহুর্তে তার ঘুমটা খুব প্রয়োজন।এতো মজার ঘুমের সময়টা নির্ঝরের সাথে কথা বলে শেষ করতে চায় না সে।

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই আর‌ওয়া দেখলো রুমে কেউ নেই। হয়তো নির্ঝর বাসায় নেই। বাসায় থাকলে তো রুমে বসে থাকতো আর আঠার মতো আর‌ওয়ার পেছনে পড়ে থাকতো। নির্ঝর কি তাকে ভালোবাসে?আর‌ওয়া মুচকি হাসলো। পরক্ষণে মনে পড়লো যদি সত্যি ভালোবাসতো তাহলে ছয়টা বছর ধরে এভয়েট করলো কেনো? ভালোবাসার মানুষকে কি অবহেলা করা যায়? কোনো উত্তর পায় না আর‌ওয়া।

বিছানা থেকে নেমে সে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো।নিচে গিয়ে নাস্তা করে আবারো রুমে আসলো সে।এই কদিন ধরে তার অবস্থাও নির্ঝরের মতো। শুধু নিজের রুম আর খাওয়ার টেবিল। এতটুকুই তার গন্তব্য।অন্য কোথাও যাওয়া হয় না তার। কারো ইচ্ছা করলে রুমে এসে আর‌ওয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে। রিস্তা-তিস্তা আর বড় ভাবি রোজ তার রুমে আসে,গল্প করে,তার সাথে সময় কাটায়।তার মামা আশরাফ চৌধুরী আর নানাভাই আসে মাঝেমাঝে। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে আবার চলে যায়। কিন্তু মামি একবারের জন্য‌ও তার খোঁজ নেয় না। হয়তো তিনিও তার মতো সঠিক। তবে এসব নিয়ে আর‌ওয়ার মাথাব্যথা নেই।

হঠাৎ আর‌ওয়ার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নির্ঝরের নম্বরটা ভাসছে।আর‌ওয়া আবারো মুচকি হাসি দিলো। হতে পারে ঔষুধ খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন দিয়েছে সে।আর‌ওয়া ফোনটা রিসিভ করে চুপ করে আছে।ওপাশ থেকে নির্ঝর বললো: আরু,ঘুম থেকে উঠেছো?
_হ্যাঁ।
_নাস্তা করেছো?
_হ্যাঁ।
_ঔষুধ খেয়েছো?
_হ্যাঁ।
_এই তুমি কি হ্যাঁ ছাড়া কোনো কথা বলবে না?
_না। তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই আমার নেই।
_কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করে সারাটা দিন তোমার সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিই।
_তো আমি কি করতে পারি?
_তুমি শুধু আমার সাথে কথা বলবে। তাহলেই হলো।আর কিছুই করতে হবে না।
নির্ঝর কথা শেষ করার আগেই কারো গলার আওয়াজ শুনলো আর‌ওয়া। নির্ঝরকে বলতে শোনা গেলো “বসুন”।আর‌ওয়া বুঝতে বাকি রইলো না নির্ঝরের রুমে কেউ এসেছে। নির্ঝর গম্ভীর গলায় বললো: তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি আমি। এখন কিছু কাজ আছে।

আর‌ওয়া নিজেই ফোনটা কেটে দিলো। সারাদিন ব্যস্ত থাকে আর এদিকে সে ব‌উয়ের সাথে কথা বলে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে। মানুষের যে কতো রকমের ইচ্ছা থাকে।

আর‌ওয়া একা একা কি করবে বুঝতে পারছে না। ধীর পায়ে আবারো নিচে নামলো সে।নিচ তলার বাম পাশের রুমটায় তার নানাভাই থাকেন।তার রুমে গিয়ে দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে তিনি বললেন: ভেতরে আয়।
আর‌ওয়া বুঝতে পারলো না তার নানাভাই বুঝলো কি করে সে এসেছে সেটা।রুমে ঢুকতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো: আপনি জানলেন কি করে আমি এসেছি সেটা?
_দিনের বেলায় তুই ছাড়া আমার রুমে এসে আমার খবর দেওয়ার মতো মানুষ এই বাড়িতে আর কেউ নেই।যাই হোক, এদিকে আয়।এখানটায় বস।

আরমান চৌধুরী আর‌ওয়াকে ইশারা করে একটা চেয়ারে বসতে বললো।আর‌ওয়াও তার কথামতো সেখানে গিয়ে বসলো।নানা-নাতনি তাদের মজার আলাপে ব্যস্ত আছে। অনেক কথাবার্তা হলো দুজনের মধ্যে। কিভাবে যে সময়টা চলে গেলো দুজনেই বুঝতে পারলো না।তার চেয়েও বড় কথা কাছের মানুষদের সাথে কথা বললে যেন মূহুর্তটা অন্যরকম হয়ে যায়।সময় শেষ হয়ে যায় কিন্তু কথা শেষ হয় না। জমানো থেকে যায়।প্রায় দুই-তিন ঘন্টা পর রুমে কেউ আসলো।দুজনেই সেদিকে তাকাতে দেখলো নির্ঝর এসেছে।সে দুজনকে একসাথে দেখে হেসে দিলো।চেহারাটা দুষ্টু দুষ্টু করে বললো: দাদাভাই, তুমি কিন্তু ঠিক করছো না। এভাবে আমার ব‌উটাকে নিজের রুমে আটকিয়ে রেখেছো।জানো, আমি কতোবার ফোন দিয়েছি ওকে।রিসিভ করেনি।

আরমান চৌধুরী নির্ঝরের কথায় খিলখিলিয়ে হাসলেন যদিও আর‌ওয়া বেশ লজ্জা পেয়েছে নির্ঝরের আকস্মিক এমন কথায়। নির্ঝর কথা শেষ করে আর‌ওয়ার পাশে গিয়ে বসলো। তারপর বললো: দাদাভাই তোমার শরীর কেমন এখন?ভালো আছো?
আরমান চৌধুরী গম্ভীর মুখে বললেন:আজ কি মনে করে আমার রুমে আসলে আমার খবর নিতে? সারাদিন তো নিজের রুমে বসে থাকো।এই বুড়োকে একটু সময় দিতে হবে তা এই বাড়ির কারো মনে থাকে না।

দাদার কথায় নির্ঝর এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শান্ত কন্ঠে বললো: দাদাভাই, তোমার তো শুধু এই বাড়িতে একটায় অসুবিধা।কেউ তোমাকে সময় দিচ্ছে না সেটা নিয়ে তুমি আপসেট হয়ে আছো। কিন্তু আমি তো এর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক জীবন পার হয়ে আসছি। আমাকে সবাই সময় দিতে চাইতো কিন্তু আমাকে তাদের উপেক্ষা করতে হতো। সুস্থ মস্তিষ্কে নিজ থেকে কাছের মানুষদের উপেক্ষা করার কষ্ট কতোটা সেটা শুধু আমি বুঝি।তাই তো বাধ্য হয়ে নিজেকে একটা রুমে বন্দী করতে হলো। তখন কি করে তোমার খবর নিই,বলো?

আরমান চৌধুরী নির্ঝরের কথায় হাসলেন।তার হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয় বলে নির্ঝরকে তার কাছে ডাকলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন: আমার নাতনিকে এতো ভালোবাসতি সেটা আমাকে বললেই হতো। আমি সবকিছু নয়-ছয় করে মিলিয়ে দিতাম। আমার উপর বিশ্বাস ছিল না বলে এমনটা হয়েছে।
নির্ঝর হাসলো। শান্ত গলায় বললো: তখন আমরা চোর ছিলাম।চোর কি কখনো বলতে পারে আমরা চুরি করেছি। আমাদের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।
আরমান চৌধুরী বললেন: আচ্ছা যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে। এখন জীবনটাকে উপভোগ করো।
_তোমার নাতনিকে একটু বোঝাও দাদাভাই।ও তো বুঝতেই চাইছে না।

আরমান চৌধুরী আর‌ওয়ার দিকে তাকালেন। হাসতে হাসতে বললেন: বুঝতে পারছি আমার নাতিটা ভুল করেছে। এবার কি ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?
_না যায় না।
নির্ঝর মুখটা খারাপ করে বললো: থাক, দাদাভাই ওর সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে না।
আরমান চৌধুরী থেমে গেলেন। ধীর কন্ঠে বললেন: আসলেই ঠিক বলেছো।এটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসবে আমি নিজেকে ইনভল্ব করতে চাই না। তোমাদের সমস্যা তোমরাই সমাধান করো।

নির্ঝর শান্ত কন্ঠে বললো: আচ্ছা আমি আসি এখন। টায়ার্ড লাগছে বেশ। রুমে গিয়ে রেস্ট নিবো কিছুক্ষণ।
নির্ঝর কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো। নির্ঝর বেরিয়ে যেতেই আরমান চৌধুরী আর‌ওয়াকে ডাকলেন। গম্ভীর গলায় বললেন: তোর মামির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবি।যাতে আমার তোদের নিয়ে কোনো কথা শুনতে না হয়।ঝগড়া করবি তো তোর মাকে সব বলে দিবো। সচেতন থাকবি সবসময়।আমার কথা যেনো মনে থাকে।
আর‌ওয়া ছোট গলায় “আচ্ছা” বললো। আরমান চৌধুরী একটু থামলেন। তারপর বললেন: এবার রুমে যা‌‌।নির্ঝর একা একা বোর হবে। বেচারাকে আর কষ্ট দিস না।

আর‌ওয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো নির্ঝর বিছানায় শুয়ে আছে।আর‌ওয়াকে দেখে সে হাসি দিয়ে উঠে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো: নিশ্চয় দাদাভাই পাঠিয়ে দিয়েছে।
আর‌ওয়া রাগী দৃষ্টিতে তাকালো নির্ঝরের দিকে। তারপর বললো:মোটেও না।
_তাহলে চলে আসলে কেনো? আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাও বলে দাদাভাই থেকে পালিয়ে এসেছো?
_আমার বয়ে গেছে তোমার সাথে সময় কাটাবো।

নির্ঝর হেসে বললো:আমি সব বুঝি। বাসায় কি একা একা বোর হচ্ছো? কোথাও ঘুরতে যাবে?
_তোমার সাথে আমি কোথাও যাবো না।
_ফুফিকে দেখতে যেতে পারো।
নির্ঝরের কথায় আর‌ওয়া এক লাফে নির্ঝরের পাশে গিয়ে বসলো। খুশি মনে বললো: বাসায় নিয়ে যাবে আমাকে?
_ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি তো বলছো তুমি আমার সাথে কোথাও যাবে না।
_না না যাবো। আমাদের বাসায় হলে যাবো।
_ওকে দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি হয়ে নাও।
_ওকে।

আর‌ওয়া যেতে যেতে অনেক সময় আছে কিন্তু সে এখন থেকে রেডি হ‌ওয়া শুরু করলো। নির্ঝর হেসে বললো: এখন থেকে রেডি হয়ে যাচ্ছো?এর বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট যদি আমাকে দেখাতে এতো কিছু হতো না।
_তুমি আমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলবে না।

চলবে…