#বুনোফুল
রুবাইদা হৃদি
পর্ব সংখ্যা-০৩
খুব রাতের বেলা হাবিব সাহেব ঘরে ফিরলেন৷ গত দুই দিন তার কোনো হদীস ছিলো না৷ তবে আগ বাড়িয়ে আমি যে খুব একটা খোজ করেছি এমন টা নয়৷ উনি ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি বজায় রেখে বলল,
‘অফিসের একটা কাজে সিলেট গিয়েছিলাম৷’
‘বাসায় জানিয়ে যেতে পারতেন৷’
‘আম্মা তো জানে আমার হুটহাট যেতে হয়৷’
‘আপনার আম্মা জানেন সেটা হাবিব সাহেব৷ আমি তো আর জানি না৷’
আমার কথাতে উনি কিঞ্চিৎ অবাক হলেন৷ তবে সেটা প্রকাশ না করে বললেন,
‘আমার জানামতে আপনি আমার খোজ করেন না নীরা৷’
‘আমি খোজ করলেও বোধহয় আপনি আপনার খোজ দিতেন না৷’
‘মানে!’
‘মানে হলো আপনার খোজ নেবার জন্য সে আছে৷’
আমার কথাতে উনি বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠলেন৷ নিজেকে গুছিয়ে এরপর বললেন,
‘আপনি ভুল ভাবছেন৷’
‘আমি তো সব ক্ষেত্রেই ভুল ভাবি আপনাকে৷ তবে আপনি কি সঠিক মানুষ হাবিব সাহেব? আপনি আমার অসহায়ত্ব জেনে নিজ ইচ্ছাতে বিয়ে করলেন৷ এরপর আপনার অপরাগতা জেনে যে স্ত্রী আপনাকে ফেলে চলে গিয়েছে৷ কিন্তু আপনি কি করলেন! সেই বউ আবার আসতেই আপনি সব রাগ দুঃখ ভুলে গেলেন৷ আপনার যদি এতোটাই ভালোবাসা তার উপর থাকে তবে এই দুই বছরে তাকে ফিরিয়ে আনলেন না কেন!’
‘আমি শত চেষ্টা করে মিতুর খোজ পাই নি৷ তার পরিবার আমার থেকে তাকে লুকিয়ে রেখেছিলো৷’
হাবিন সাহেব অসাবধানে কথাটা বলে ফেললেন৷ আমি শুনে বেশ মর্মাহত হলাম৷ আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম,
‘তবে আমাকে বিয়ে করলেন কেনো!’
‘মায়ের চাপে পরে৷ মাকে যখন তোমার ব্যাপারে বলেছিলাম ওইদিন থেকেই মা তোমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকলো৷ মা জানতো তুমি রাজি হবে৷’
হাবিব সাহেবের কথা শুনে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো৷ এতো কষ্ট আমি হাজার কষ্টে থেকেও পাই নি৷ আমিই বা কতো বোকা! একটা লোকের মিষ্টি কথাতে ভুলে গেলাম৷
উনি আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে হাত জোর করে বললেন,
‘আমি যদি জানতাম মিতু আমার কাছে ফিরতে চাইবে আমি কোনোদিন আপনাকে বিয়ে করতাম না নীরা৷ আপনি জানেন! মিতুকে এতোদিন ওর পরিবার আমার সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নি৷’
‘মিতু তো বাচ্চা হাবিব সাহেব৷’
‘বাচ্চা না হলেও ও খুবই নাজুক৷’
হাবিন সাহেবের বিশ্লেষণ শুনে আমি হেসে ফেললাম৷ আল্লাহ! লোকটা কতোটা অন্ধ৷ আমি হাসতে হাসতেই বললাম,
‘তাহলে মিতুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন৷’
‘আম্মা মানবে না নীরা৷ আম্মা জানিয়েছে মিতুকে আনলে সে বি’ষ খাবে নয়তো ফা!সিতে ঝুলবে৷ আর আমি আম্মাকে চিনি৷ উনি এক কথার মানুষ৷’
উনার প্রত্যেকটা কথাতে প্রমাণ হচ্ছে লোকটা আমার না৷ তবে কোন আশায় আমি থাকবো? এই প্রশ্ন টা মনের মাঝে উঁকি দিতেই উনি আমার উত্তরটা খুজে দিলেন৷ আমতা আমতা করে বললেন,
‘আপনি চাইলে আমরা মিউচুয়াল ভাবে থাকতে পারি৷’
‘কি বলতে চাইছেন?’
‘মিতুকে তো আম্মা এই বাড়িতে আসতে দিবে না৷ আর আপনাকেও ছেড়ে দিতে দিবে না৷ আমি নাহয় মিতুকে আলাদা ফ্ল্যাটে রাখলাম৷ আর আপনি এখানে থাকলেন৷’
কথাটা হাবিব সাহেব যতোটা সহজ ভাবে বলে ফেললেন৷ আমি ততোটা সহজ ভাবে নিতে পারলাম না৷ আমার বুক ভার হয়ে আসলো৷ গলায় মনে হচ্ছে একদলা কষ্ট আটকে আছে৷ যার জন্য আমি শ্বাস নিতে পারছি না৷
.
মানুষ কতোটা নির্দয় হতে পারে তা বোধহয় মানুষ হয়ে না জন্মালে বুঝতাম না৷ আমার বড় ননাস বাসায় আসতেই আমার শাশুড়ী আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো৷ ভদ্রমহিলা স্বভাব নাক উঁচু৷ আমাকে দেখেই নাক মুখ কুঁচকে বললেন,
‘রুপ দিয়ে করবা কি? জামাই তো ধরে রাখতে পারতেছো না৷’
‘আহ! সালমা৷ ওর সাথে ওভাবে কথা বলিস কেন৷’
‘আর কিভাবে বলবো আম্মা৷ তোমার বাড়ির কেচ্ছা কাহিনি আমার শশুর বাড়িতে হাসাহাসির কারবার৷ হাবিবের বিয়েতে আমি এইজন্যই আসি নি৷ আমি আগেই জানতাম ওই ধরিবাজ মেয়ে ঠিক ফিরে আসবে৷’
এর পর সালমা আপা আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিনয়ের সুরে বললো,
‘শুনো মিতু এসেছে টাকা পয়সার জন্য৷ তুমি শক্ত হয়ে হাল ধরো৷’
‘আপা যে লোকটা আমার না তাকে আমি কিভাবে ফেরাবো?’
‘সব কি বলে দিতে হয়? একটু রঙ ঢং করো৷’
আমি উনার কথাতে প্রত্যুত্তর করলাম না৷ উনারা কি জানেন! হাবিব সাহেব ফের মিতুর সাথে সংসার পেতেছে?
তবে আমি তা জানানোর চেষ্টা করলাম না৷ তবে মনে মনে একটা জেদ ঠিকি চেপে বসলো৷ আমিও এই সংসার ছেড়ে যাচ্ছি না৷ তবে হাবিব সাহেব কে নিজের আপন করেও নিবো না৷
.
বিয়ের প্রায় দুইমাস৷ এর মাঝেই ন্যাশনালের ফোর্থ ইয়ারের ভর্তি নোটিশ দিয়েছে৷ ব্যাপার টা আমাকে আমার বান্ধবী সুমনা ফোন করে জানিয়েছে৷ যেহেতু আমার রেজিস্ট্রেশন এর মেয়াদ আছে আমি চাইলেই ভর্তি হতে পারবো৷ তবে ব্যাপার টা সম্ভব হবে টাকার জোরে৷ আমি আজ আঁটসাঁট বেঁধে নিজের মনকে জোরালো করলাম৷ স্ত্রীর অধিকার আমি ছাড়বো না৷
দুপুর গড়াতেই আমি খাবার টেবিলে বসে সবার সামনে বললাম,
‘আমি আবার কলেজে ভর্তি হবো৷’
আমার শাশুড়ী গড়িমসি করে উঠলেন৷ বললেন,
‘কি দরকার! সংসারের ঠিক নেই৷ আবার পড়াশোনা৷’
উনার কথা শুনে আমার ছোট ননাস কিছুটা রেগে গেলেন৷ এরপর জোর গলায় বললেন,
‘পড়াশোনা করুক৷ তোমার ছেলের তো আর টাকার অভাব নেই৷ টাকা তো সব পরনারীর পেছনে ঢালছে এখন৷’
উনার কথাতে আমার শাশুড়ী গললেন না৷ নিজের জেদ বজায় রেখে বললেন,
‘ভিটে মাটি নাই৷ স্বামী সুখ ও তো নাই৷ পড়ালেখা দিয়ে করবে কি? দুইবেলা খেতে পরতে দিচ্ছি এই তো ঢের৷’
উনি কথাটা এতোটাই বিকৃত ভাবে বললেন৷ একটা দানা ভাত ও আমি আর মুখে তুলতে পারলাম না৷ আমি বুঝি এতোটাই অবলা?
কান্না গিলে বললাম,
‘পড়াশোনা আমি শুরু করবোই আম্মা৷’
‘আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে এইসব করবা৷ ছেলে ছেড়েছি৷ বউ ছাড়তে এমন আর কি!’
মহিলার কথা শুনে আমার ছোট নানাস ও রাগ করে খাবার ফেলে উঠে গেলেন৷ আমার শাশুড়ী নিজেও রাগ করে উঠতে উঠতে বললেন,
‘এক পাপা দুর হয়েছে৷ আরেক পাপ ঘাড়ে উঠেছে৷ যতো যন্ত্রণা হয়েছে আমার ছেলেটার জন্য৷’
উনি উঠে যেতেই আমার অশ্রু বাঁধ ভাঙলো৷ আমার জায়গাতে অন্য কোনো মেয়ে থাকলে হয়তো চলে যেতো নয়তো ম’রে যেতো৷ কিন্তু আমি তো মরতে চাই না৷ এতো লড়াই করে দুনিয়াতে টিকে থাকলাম কেনো? মরে যাবার জন্য তো নয়৷
.
গোধূলির আলো পশ্চিম আকাশে কিঞ্চিৎ দেখা যাচ্ছে৷ আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাবিন সাহেবের ফেরার প্রহর গুনছি৷ লোকটার সাথে আমার সম্পর্কের সুতো তলানিতে৷ মাঝে মধ্যে উনি ভুলে যান আমি নামক একটা প্রাণী এই দুনিয়াতে আছি৷ কিন্তু এই লোকটাই বউ ফিরে আসার পূর্বে আমাকে অনুনয় করেছিলো আমি যেনো তাকে ফেলে চলে না যাই৷
পুরোনো কথা ভেবে আমার বেশ হাসি পেলো৷ নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালাম৷ তবে আমার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো না৷ হাবিন সাহেব তার লাল রঙের মোটর বাইক নিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকছেন৷ আমি তাকে দেখে মনে মনে সব কথা একের পর এক সাজিয়ে নিলাম৷
চলবে