#বুনোফুল
পর্ব-০৪
রুবাইদা হৃদি
‘শরতের মেঘের মতো আমার জীবনে কখনো তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ায় নি৷ সারাজীবন অন্যদের দেখেছি পরিবার নিয়ে কতো উচ্ছ্বাস করতে৷ কিন্তু আমি! প্রত্যেক দিন৷ প্রত্যেক টা রাত আমি কেঁদেছি৷ অন্য পথ শিশু কিংবা এতিম বাচ্চাদের মতো আমি বেড়ে উঠি নি৷ তাদের থেকে আমার ভাগ্যটা নেহাৎ সুপ্রসন্নই ছিলো৷’
আমি বলে থামলাম৷ হাবিব সাহেবের মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা চালালাম৷ তাকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালো৷ আমি ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
‘তবে তাদের থেকে ভালোও বলা চলে না৷’
‘হঠাৎ এমন অদ্ভুত কথা বলছেন কেনো!’
‘আমার জীবনটাই তো অদ্ভুত৷’
হাবিব সাহেব বেশ বিচলিত গলায় বললেন,
‘আমি তো বলেছি আপনার কোনো কিছুতে অপূর্ণ রাখবো না৷’
‘আপনি তো প্রথম রাতেই বলেছেন আপনি কখনো বাবা হতে পারবেন না৷ তবে কিভাবে বলছেন যে অপূর্ণ রাখবেন না?’
উনি আমার কথাতে বেশ মর্মাহত হলেন বোধহয়৷ ক্ষীণ গলায় বললেন,
‘আমার অপারগতা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছেন?’
‘খোঁটা দেবার আমি কে! তবে আমি নিরুপায় হয়ে হোক বা যেভাবেই হোক আপনার সাথে মিউচুয়াল ভাবে একটা সিদ্ধন্তে আসতে চাই৷’
‘দেখুন তালাক দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না৷ কারণ আমার মা আর ছোড় আপার তোপের মুখ পরতে হবে৷ তারা যদি বলে আমার আপত্তি নেই৷’
‘কেন বিয়েটা কি আপনার মা আর বোন করেছে? তবে আমার তালাক চাই না৷’
উনি আমার জবাবে বেশ অবাক হচ্ছেন৷ গলার স্বর কাঁপছে৷ এরপর আমাকে বললেন,
‘বিয়েটা উনারা না করলেও৷ উনাদের তো জানাতে হবে৷ আর মিতুকে দেখে মা বেশ ক্ষেপে আছে৷ আগেও মিতুকে পছন্দ করতো না৷ এখন তো দূরে থাক৷’
আমি উনার কথা শুনে হাসলাম৷ মনে মনে উনাকে গর্দভ ছাড়া কোনো কিছু ভাবতে পারলাম না৷ আমি বেশ আঁটসাঁট হয়ে বসলাম৷ আমাকে দেখে ভ্রুজোড়া উনি কুঁচকে ফেললেন৷
‘শুনেন হাবিব সাহেব৷ আমি একটা আপোষে আসতে চাই৷ আপনি মিতুকে নিয়ে সংসার করুন বা আরো দু চারটে বিয়ে করুন আমার সমস্যা নেই৷ কিন্তু…’
‘কি কিন্তু! আপনি কি চাচ্ছেন বলুন তো?’
‘আমার কলেজে রেজিষ্ট্রেশন চলছে৷ আর আমার প্রত্যেক মাসে পনেরো হাজার টাকা হাত খরচ চাই৷’
‘এতো টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন? পাগন নাকি!’
‘দেখুন আপনি যদি টাকা দিতে না চান৷ তবে না দিবেন আমার আপত্তি নেই৷ আমিও তাহলে আপনার সাথে সমঝোতা করবো না৷’
হাবিব সাহেব আমার কথাতে বেশ বেকায়দাতে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে৷ সে আমতা আমতা করে বললো,
‘আসলে আমার টাকা দিতে নেই৷ কিন্তু মিতু ওর জন্য আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে বলতেছে৷ ওর বাসায়ও ভালোই ঝামেলা হচ্ছে৷’
আমি উনার কথা শুনে বেশ আহত হলাম৷ একটা লোক কিভানে অকপটে নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছে? আমি গলায় তেজ ধরে রেখে জবাব দিলাম,
‘আমার হাত খরচ চাই হাবিব সাহেব৷ আর আমি আমার পড়াশোনা টাও শেষ করবো৷’
‘তা না হয় করবেন৷ কিন্তু আম্মা শুনলে ক্ষেপে যেতে পারে৷’
‘ওইটা আপনার বিষয়৷ আপনি যদি ম্যানেজ না করতে পারেন আমি তাহলে আপনার আলাদা গড়ে উঠা সংসারের কথা আম্মাকে বলতে বাধ্য হবো৷’
.
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখলাম হাবিব সাহেব ঘরে পায়চারি করছেন৷ আমাকে উঠতে দেখে কিছুটা অগোছালো গলায় বললেন,
‘আপনাকে আপাতত দশ হাজার টাকা দিচ্ছি৷ আর রেজিস্ট্রেশনের টাকা আর ফর্ম ফিলাপের জন্য আলাদা দশ হাজার৷ আপনি আজ গিয়ে কাজ সেরে আসুন৷’
‘আম্মার থেকে অনুমতি নিতে হবে?’
‘নিতে পারেন৷’
আমি বিছানা থেকে উঠে গা ছাড়া ভাবে বললাম,
‘আপনি বলে ফেলুন৷’
উনি আমার কথাতে বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন৷ কিছু একটা ভেবে বললেন,
‘আচ্ছা নাস্তা করার পরে বলবো৷’
আমি উত্তর না দিয়ে বেশ সংকোচে পরলাম৷ এইরকম চেয়ে কোনোদিন আমি কারো থেকে নেই নি৷ কলেজ পর্যন্ত এনজিও থেকে প্রত্যেক মাসে আমার জন্য নির্দিষ্ট কিছু টাকা দিতো৷ খাবার,আর স্কুল কলেজের বেতন আর বছরে কেউ আমাদেরকে জামাকাপড় দিলে সেগুলো দিয়েই কাটিয়েছি৷ তবে অনার্সে উঠার পর উনারা আর দায়িত্ব নেন নি৷ দুটো টিউশনি কতে মেসে থাকাটা বড্ড কষ্টের ছিলো৷ এমন হাজারো দিন গেছে না খেয়ে৷ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাকাটা নিলাম৷ আমার সব আত্মসম্মান বাদ দিয়েই নিলাম৷ হাবিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটা ধন্যবাদ দিতেই উনি বোধহয় বেশ বিরক্ত হলেন৷ আমাকে ঘরে ফেলেই উনি বাইরের দিকে গেলেন৷
.
আমার শাশুড়ী আম্মা বেশ গোছালো ধরণের মানুষ৷ মহিলার বেশভূষাতেই তার আত্ম অহমিকা প্রকাশ পায়৷ হাবিব সাহেব চেয়ার শব্দ করে টেনে বসতেই উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘শব্দ করে চেয়ার না টানলে হয় না৷’
আম্মার কথাতে হাবিন সাহেব ধীরে ধীরে বসলেন৷ উনার বসার ভঙ্গিমা দেখে আমার কেমন হাসি পেলো৷ এর মাঝেই ছোট আপা এসে বললেন,
‘হাবিব তোর ব্যবসায় একের পর এক লস৷ তোর দুলাভাই বললো৷’
‘কিছুটা আপা৷’
উনি হাবিব সাহেবের জবাবে বিরক্ত হয়ে আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তোমার ছেলেকে বুঝাও আম্মা৷’
‘বুঝায় আর হবে কি! যার ঘর সংসারে মন নেই৷ তার ব্যবসা তো লাটে উঠবেই৷ আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া ছেলেই কামাই আমার খেতে হয় না৷’
আম্মা কথাটা বলতেই হাবিন সাহেব মাথানিচু করে ফেললেন৷ এরপর ক্ষীণ স্বরে বললেন,
‘আম্মা কিছুটা লস হয়েছে৷ মাল আনার সময় কিছু মাল লুট হয়েছে৷’
উনি বলেই চুপ হয়ে কিছুক্ষণ পর আবার বললেন,
‘নীরা পড়াশোনা টা আবার শুরু করুক আম্মা৷’
কথাটা শোনার পর আম্মার কি ভাবভঙ্গি হবে ভাবতেই কিছুটা ভয় লাগলো৷ চালচুলো হীন আমি আসলেই বড্ড অসহায়৷
তবে শাশুড়ী আম্মা বেশ স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেন,
‘হ্যাঁ করুক৷ পড়াশোনা দরকার আছে৷ নয়তো ওই মেয়ের সাথে পাল্লা দিবে কিভাবে!’
উনার কথাতে আমি বেশ অবাক হলাম৷ হাবিব সাহেব মুখ তুলে বললেন,
‘আম্মা সব কথাতে মিতুকে টেনো না৷’
‘তোমার ওই মিতুর কথা উঠলেই মুখের বুলি ফুটে৷’
ছোট আপা হাবিব সাহেবকে তাচ্ছিল্য করে কথাটা বললো৷ হাবিব সাহেব চুপ করে খাবার চিবুতে লাগলেন৷ শাশুড়ী আম্মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আমার বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে হলে সব করে করতে হবে৷ আর ভালো রেজাল্ট না হলে তোমাকে সব টাকা ফেরত দিতে হবে৷’
‘এইটা কি ধরণের কথা আম্মা!’
‘এই মেয়ে গলা নিচু করে কথা বলো৷ তোমার পেছনে দু টাকা খরচ করার মতো আহামরি কিছু না তুমি আমাদের৷ হাবিন তো ফিরেও তাকায় না৷ আজকে ঘর থেকে বের করে দিলে কোই যাবা তার ঠিক নেই৷ নেহাৎ দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে তাই এই সব মেনে নিচ্ছি৷’
মহিলা কথা গুলো এতোটাই তীর্যক ভাবে বললেন ছোট আপা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন৷ আমি কোনো জবাব দিলাম না৷
ভেতরে দাবানলের মতো আগুন জ্বলছে৷ মানুষ বোধহয় এমনি৷ দূর্বল জায়গায় বারবার আঘাত করে৷
.
হাবিব সাহেবদের বাড়ি সাভার নবীনগর৷ আমার কলেজ টা ঢাকা মোহাম্মদপুর৷ মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ৷ আমি খুব ভোরের দিকেই বাসা থেকে বের হবার পরিকল্পনা করলাম৷ যেন হাতে সময় থাকে৷ তবে অবাক করার বিষয় হলো আমার সাথে হাবিব সাহেব ও উঠলেন৷ উনাকে রেডি হতে দেখে আমার মন কিছুটা পুলকিত হলো৷ আমি শাড়ি পাল্টে সালোয়ার কামিজ পরতেই উনি বললেন,
‘আপনি যেতে পারেবেন?’
‘কেনো আপনি যাচ্ছেন না!’
আমি অবাক হয়ে প্রত্যুত্তর করলাম৷ উনি বিচলিত গলায় বললেন,
‘আমাকে ইমার্জেন্সি মিতু ডেকে পাঠিয়েছে৷ ওর কাছে যেতে হবে৷’
উনার কথা শুনে আমার গলা ধরে এলো৷ ধরা গলায় বললাম,
‘আমি তো সাভার থেকে কখনো একা যাতায়াত করি নি৷’
‘আপনাকে আমি সিএনজি করে দিচ্ছি৷’
আমি কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বললাম,
‘লাগবেনা৷ আমি পারবো৷’
‘মেয়ে মানুষের যে কি হয়! এই বললেন চিনেন না৷ আবার বলেন একা পারবো৷ আচ্ছা আপনার হয়ে গেলে আপনি চলে যাবেন৷ আমি আসলাম৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’
উনি এই বলে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন৷ উনার যাবার পথে আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ এই বুঝি লোকটা ফিরে এসে বলবে,
‘চলুন নীরা আমরা একসাথে যাই৷’
চলবে