বুনোফুল পর্ব-০৫

0
26

#বুনোফুল
পর্ব-০৫
রুবাইদা হৃদি

সাভারের রাস্তা পুরোটাই আমার অপরিচিত৷ কোথায় থেকে বাসে উঠবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ রাস্তার পাশে এক ফল বিক্রেতা কে জিগ্যেস করতেই উনি বললেন সামনে হেটে গিয়ে বা পাশের রাস্তা ধরে ডান পাশে গেলেই ঢাকাগামী বাস দেখতে পাবো৷ আমি উনার কথামতো গিয়েও বাসের হদীস পেলাম না৷ আরেকজন কে জিগ্যেস করতেই বললো,’আপনি উল্টো রাস্তায় এসেছেন৷ নতুন হলে সিএনজি ধরে চলে যান৷’
লোকটার কথা আমার মনে ধরলো৷ সামনে সিএনজি দাঁড়ানো৷ তবে ভাড়া জিগ্যেস করার পর আমি বেকুব হয়ে রইলাম৷ এতো টাকা চায়! আমি বড়জোড় ব্যাগ হাতড়ে কলেজের টাকা বাদে চারশো টাকা বের করতে পারবো৷ আমি সিএনজি রেখে উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ আবার একজন কে বাসের কথা জিগ্যেস করতেই লোকটা অদ্ভুত ভাবে বললো,’নতুন আইছেন আফা?’
উনার প্রশ্ন শুনে আমি পাশ কাটিয়ে সামনে আগাতেই লোকটাও আমার পিছু পিছু আসছে৷ সকাল হবার জন্য লোকারণ্য খুবই সামান্য৷ কোনো দোকানপাট ও খুলে নি৷ এইজন্যই ভয় টা জেঁকে বসলো৷ আমি কিছুটা ভয়ে ভয়েই হাবিব সাহেবকে কল করলাম৷ কল করার উদ্দেশ্য সাহস জোগাড়৷ কিন্তু লোকটা বারবার আমার কল কেটে দিচ্ছে৷ ওইদিকে ওই লোকটা আমার পেছনে হাত ধুয়ে পরে আছে৷ পেছন থেকে উষ্কানি মূলক কথাবার্তা বলে চলেছে৷
এর মাঝে হাবিব সাহেব আমার কল টা রিসিভ করলেন৷ তবে ধরে কোনো কথা না বলে বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

‘আপনি এতোবার কল করছেন কেনো?’

‘দরকার আছে বলেই তো করছি৷’

‘দ্রুত বলুন৷’

উনার বিরক্ত কন্ঠ আমার ভেতরে কেমন উত্তাল সমুদ্রের মতো ঢেউ উঠলো যেন৷ আমি আমার বিপদের কথাটা এড়িয়ে বললাম,

‘দরকার ছিলো৷ এখন নেই৷’

উনি এরপর বোধহয় কিছু বললেন৷ তবে আমি না শুনেই কল কেটে দ্রুত হাঁটছি৷ আমি ঢাকা থাকাকালীন কখনো এতোটা মুখথুবড়ে পরে থাকা মেয়ে ছিলাম না৷
অনেক বিপদ মোকাবেলা করেছি৷ তবে মাঝে বোধহয় মানুষের উপর নির্ভর হতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি৷ এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি সত্যিই কেঁদে ফেললাম৷ ওই লোকটা আমার কান্না দেখে বেশ মজা পাচ্ছে৷ কয়েকটা অশোভন কথা ইতিমধ্যে বলেও ফেলেছে৷
তবে এতো সব কিছুর মধ্যে একটা ভালো ঘটনা আমার সাথে হুট করে ঘটে গেলো৷ একজন ভদ্রলোক এসে খুব শান্ত কন্ঠে আমাকে প্রশ্ন করলেন,

‘আপনি কোনো প্রবলেমে পড়েছেন?’

আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম ফর্মাল শার্ট পরা একজন লোক মোটা ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে শান্ত চোখে আমার দিকে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে আছে৷
লোকটাকে দেখে আমার ভরসা হলো৷ আমি হড়বড় করে বললাম,

‘এইখানে আমি নতুন৷ মোহাম্মদ পুর যাবো৷ কিন্তু বাস খুজে পাচ্ছি না৷ সেই থেকে ওই অসভ্য আমার পেছনে পরে আছে৷’

আমি ওই লোকটাকে দেখাতেই ও একপ্রকার দৌড়ে পালালো যেন৷ ভদ্রলোক সামান্য হেঁসে বললো,

‘ওরা এমনই৷ মানুষকে অবর্জাভ করেই বুঝে ফেলে কার কাছে গেলে কামাই করতে পারবে৷’

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না৷ তবে লোকটা নিজ থেকে আবার বললো,

‘কান্না করবেন না প্লিজ৷ আমিও মোহাম্মদপুর যাবো৷’

‘আমাকে নিয়ে যেতে হবে না৷ বাস কোথা থেকে যায় ওইটুকু বললেই হবে৷’

‘আমার সাথে আসুন৷’

এরপর আমি উনার সাথেই একই বাসে মোহাম্মদপুর আসি৷ তবে এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে লোকটা আর একটাও কথা বলে নি৷ তবে আমার গন্তব্য আসার পর পরেই সে নিজের সিট থেকে উঠে এসে আমাকে বলেছে,

‘আপনি এখানে নেমে যান৷ এরপর থেকে ওই রোড আসলে বাস পেতে বিলম্ব হবে না৷’

আমি মাথা নেড়ে শুধু ধন্যবাদ টুকু জানিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পরেছি৷

বহুদিন পর নিজেকে একটু খোলা জানালার মতো লাগছে৷ অর্ধপরিচিত কলেজে পা রাখতেই কিছুটা প্রশান্তি লাগছে৷ জীবনটা অদ্ভুত ভাবে ঝিমিয়ে গিয়েছিলো বোধহয়৷ তবে আজকে সব ফর্মালিটিস শেষ করার পর কিছুটা শান্তি লাগছে৷
পরিচিত কেউ নেই বললেই চলে৷ আমার সেশনের বোধহয় টেস্ট চলছে৷ আমি ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক নিজ মনেই ঘুরলাম৷
কোনো কারণ ছাড়াই৷ মুক্ত পাখির মতো৷

.
বাসায় ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো৷ আমি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার দরজায় টোকা দিলাম৷ কিন্তু কেউ কোনো সাড়াশব্দ করলো না৷ আরো দু তিন বার দিতেই আমার শাশুড়ী ভেতর থেকে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

‘কে এসেছে? হাবিব তুই?’

‘আম্মা আমি৷’

‘আসছো কেন নবাবের বেটি৷ কলেজেই রাত থাকতা৷’

‘আম্মা গেইট টা খুলে এরপর কথা বলেন৷ আশেপাশের মানুষ শুনবে৷’

‘শুনুক৷ সবাই শুনুক৷ জামাই বউ যে তামশা করতাছো৷ মান সম্মান তো এমনিতেই রাস্তায়৷’

আমি গত আধাঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে থেকে৷ সারাদিন না খেয়ে থেকে মহিলার বকবজ শুনে বেশ ক্লান্ত৷ আমি তবুও অনুরোধ করলাম,

‘গেইট খুলেন আম্মা৷’

‘এইটা আমার বাড়ি৷ আমার উপর কারো জোর চলবে না৷ বাইরে দাঁড়ায় থাকো৷ আমার মর্জি মতো খুলবো৷’

উনার কথা শুনে আমার মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠলো৷ আমি একটা সিঁড়িতে বসে হাবিব সাহেবের ফোনে আবারো কল করলাম৷ তবে এবারে আমাকে আর অপেক্ষা করতে হয় নি৷
লোকটা সাথে সাথে কল ধরে বললো,

‘কি বলবেন৷’

‘আপনার মা আমি এসেছি শুনেও আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷’

‘আপনি আম্মাকে একটু নরম সুরে বলুন৷ আম্মা খুলে দিবে৷’

আমি উনার কথা শুনে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বললাম,

‘আপনার মা৷ আপনি বলুন৷ আর আমি এতো তালবাহানা নিতে পারবো না৷ আমাকে এতো হেনস্তা করা হলে আমি পুলিশের কাছে যাবো৷’

উনি আমার কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেলেন৷ এরপর বললেন,

‘আপনি দাঁড়ান৷ আমি দেখতেছি৷’

উনি কল কাটার পর দুই মিনিট পরেই শাশুড়ী আম্মা দরজা খুলে দিলেন৷ এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘ওই মেয়েকে আমি ঘরে ঠাই দিবো না বলেই তোমাকে ঘরে তুলছি৷ নয়তো তোমার মতো মেয়ে আমার চৌকাঠের বাইরে গড়াগড়ি খায়৷’

উনার কথাতে আমার পেটের ভাত হজম হবার জোগাড়৷ তবে আমি সব গিলে ফেললাম৷ আমি জানি মহিলা আমাকে রাখবেন৷ কারণ উনি সত্যিই চান না মিতু এই বাড়িয়ে আসুক৷

ঘরে ঢুকে আমি কিছুটা সময় হাসলাম৷ মন খুলে৷ আমি জানি হাবিন সাহেবের আমাকে মেনে নেবার কারণ৷ উনি ভিসার জন্য এদিক ওদিক ছুটছেন৷ তার ধারণা সে বিদেশ মিতু সমেত যেতে পারলে আমাকে তার মায়ের কাছে বউ হিসেবে রেখে যাবে৷ আর মিতুর ব্যাপার টা অগোচরেই থাকবে৷
কারণ হাবিব সাহেবের কিঞ্চিৎ পরিমাণের নিজস্ব অর্থ জমানো নেই৷ তার অর্থের উৎস তার মা৷ আর মাকে অসন্তুষ্ট করা মানে সব হারাবে৷
আর আমাকে শান্ত রাখছেন মামলার ভয়ে৷ নিজের ক্লিন ইমেজ হাবিব সাহেব বরাবরই ধরে রাখতে চাইছেন৷
তবে আমার পায়ের নীচে মাটি নেই বলেই আমি হাবিব সাহেবের ইমেজটাকে ক্লিন রাখার সময় আর সুযোগ দিচ্ছি৷

চলবে