বুনোফুল পর্ব-০৯

0
25

#বুনোফুল
পর্ব-০৯
রুবাইদা হৃদি
পরীক্ষার দুদিন আগে থেকে আমার হাত পা ঠান্ডা হবার উপক্রম হলো যেন৷ আমি আম্মার ঘরে দিন রাত এক করে পড়ে যাচ্ছি৷ সব নিয়ম অমান্য করে৷ গত দেড় মাস আমি হাবিব সাহেবের মুখ দর্শন করি নি৷ অবশ্য উনার কথা ভাবনা কোনোটাই আমার মাথাতে আসে নি৷ আমি শুধু ভেবেছি কিভাবে এখান থেকে বের হবো৷
আমার শাশুড়ী আম্মার মাঝে পরিবর্তন টা বেশ পীড়া দিচ্ছে আমায়৷ মহিলা এখন আমাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসায় সিক্ত করে রাখছে৷ এইযে আমি অনিয়ম করছি৷ উনি নিয়ম করে আমার খাবারের খেয়াল রাখছেন৷ মাঝেমধ্যে নিজে হাতে তুলে খাবার খাওয়াতে চায়৷ আমি খাই না৷ বেশি ভালোবাসা আবার আমার কপালে সহ্য হয় না৷
আমার ভাবনার সুতো ছিড়লো ছোট আপার ডাকে৷ উনি আমার পাশের চেয়ার টেনে বসে বললেন,

‘নীরা তোমার প্রিপারেশন কেমন?’

‘আপা স্পিকিং টা মোটামুটি ভালোই হয়েছে৷ কিন্তু আমার ভয় লিসেনিং নিয়ে৷ আমি ভালো ভাবে খেয়াল করতে পারি না৷ ‘

‘পারবে৷ তোমার দূর্বলতাকেই সবলতা বানাও৷ আর সব আমাকে জানিয়ে রেখো৷ তোমার দুলাভাইয়ের তো এজেন্সি আছে৷’

আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম৷ এরপর বললাম,

‘আপা বড় আপা বোধহয় রাগ আমার সাথে৷’

‘শত হোক হাবিব আমাদের ভাই নীরা৷ ওর প্রতি টান তো থাকবেই৷ তুমি চিন্তা করো না৷ তোমাকে এতোটুকু সাহায্য আমরা করবো৷ কারণ হাবিবের অন্যায় ঢাকতে হলেও আমাদের তোমার পাশে দাড়াতে হবে৷ নয়তো মনুষ্যত্ব দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবে৷’

এই বলে আপা আমাকে তিন লাখ টাকার একটা চেক হাতে গুজে দিলেন৷ মৃদু হেসে বললেন,

‘নিজের সব দিয়ে চেষ্টা করো নীরা৷ আমরা চাই তুমি তোমার মতো বাঁচো৷ কিন্তু আমার ভাইটাকে বদদোয়া দিয়ো না৷ ও যেন নিজের মতো ভালো থাকে সেই দোয়াটুকু যেন তোমার মন থেকে আসে৷’

আমি কিছু বললাম না৷ আমার বলার কোনো সুযোগ উনারা রাখছেন না৷ তবে আমি বদদোয়া না দিলে কি হাবিব ভালো থাকতে পারবেন? জানি না!

.
পরীক্ষা দিয়ে এসে আমার চিন্তার মাত্রা বাড়লো৷ চিন্তার থেকে এই বাড়ি থেকে বের হবার জন্য কান্না আসতো৷
হাবিব সাহেব গতকাল ফের মিতুকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে৷ এই নিয়ে সমাজে সালিশ ও বসেছে৷ তবে হাবিব সাহেব সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে,

‘দুইটা কেনো চারটা বউয়ের দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা আমার আছে৷ এইযে আমার ছোট বউ নীরা ওরে আমি পুরো স্বাধীনতা দিয়েছি৷ ও কিছু দিন পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে৷ এই টাকা কে দিবে? আপনারা?’

এই প্রশ্ন করতেই অনেকে হাবিব সাহেবের দিকে চলে এলেন যেনো৷ কেউ কেউ বললেন,’ঠিকি তো চালচুলো ছাড়া মেয়েটাকে এতো ভালো কে রাখতো৷’

এই ভালো থাকার জন্যই সালিসি টা সেখানেই সমাপ্তি ঘটলো৷ এতে যেন মিতুর দৌরাত্ম্য বাড়লো৷ আমার শাশুড়ী আম্মার রাগ কিছুটা উবে গেলো৷
আমি ভয়ে থাকতাম৷ এক রেজাল্টের ভয় আরেক আম্মা যদি আমার টাকা না দেন সেই ভয়৷
ছোট আপার তিন লাখ টাকা দিয়ে কিছু হবে না৷ সেই ভয়ে আমার জ্বর উঠলো৷
.
সন্ধ্যা পেরুতেই আমার জ্বরের মাত্রা বাড়লো৷ আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে থাকলেও বুঝতে পারলাম ঘরে কেউ এসেছে৷ তবে তাকিয়ে দেখার মতো অবস্থা আমার নেই৷ সে এসে আমার পাশে বসলো৷ এরপর কাঁথা টেনে বললো,

‘তোমার মতো কাঙাল আমি দুটো দেখি নি৷ আহারে মেয়েটা৷’

মিতু বলেই হাসলো৷ সেই হাসির শব্দ আমার কানে লাগছে৷ আমি চোখ বুজে বললাম,

‘তবুও তো আমি কাঙাল৷ আর তুমি চচরিত্রহীনা,লোভী মেয়ে৷ যার কোনো ঘরেই ঠাঁই হয় না৷’

আমার কথা শুনে মিতু বেজায় চটলো৷ আমার গায়ে থাকা কাঁথা টেনে ফেলে দিলো৷ আমার হাত চেঁপে ধরে বললো,

‘এই জন্যই তো হাবিব কে বশে রাখতে পেরেছি৷ তুমি তো শরীর বিলিয়েও পারো নি৷’

মিতুর কথা শুনে আমার ইচ্ছে হলো উঠে একটা চড় মারি৷ কিন্তু সেই শক্তি জোগাড় করতে পারলাম না৷
মিতু আমার পাশে থেকে উঠে যাবার পাঁচ মিনিট পরেই হাবিব সাহেব আমার রুমে আসলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,

‘মিতুকে নিয়ে কোনো কথা বলার অধিকার আমি তোমাকে দেই নি৷ এই বাড়িতে থাকতে হলে মিতুকে কিছু বলা যাবে না৷’

‘উনি যে আমাকে বলে গেলো৷’

আমার প্রশ্নের উত্তর হাবিব দিলেন না৷ তবে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বললাম,’আল্লাহ তুমি তোমার বান্দার সুবুদ্ধি দাও৷’

.
ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন হলো যেন৷ রেজাল্ট পাবলিশড হতেই আমার বুকের উপর থেকে পঞ্চাশ ভাগ দুশ্চিন্তা নেমে গেলো৷ সাত পাওয়াটা আমি আশা করি নি৷ ফোনের স্ক্রিনে পয়েন্ট দেখে আমি ঝরঝর করে কেঁদেছি৷
আম্মাকে বলার পর উনিও খুশি হয়েছেন৷ উনি রাতের বেলা আমার ঘরে এসে বসলেন৷ খুবই নম্র কন্ঠে বললেন,

‘আমার বয়স হচ্ছে৷ হাবিব আমার ছেলে ও যতোই অপরাধ করুক মায়ের মন তো মানে না৷ তবে আমি তোমাকে ঠকাবো না৷ এতে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবে৷ তোমার কতো টাকা লাগবে তুমি আমাকে বলো৷ আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে কেউ বাধা দিবে না৷’

আম্মার কথা শুনে আমি ফের কেঁদে ফেললাম৷ উনার হাত ধরে বললাম,

‘আমিও আপনার মেয়ের দায়িত্ব পালন করবো আম্মা৷’

উনি আমার কথা শুনে হাসলেন৷ তবে সংকোচ আর ভয় দুটোই আমাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগলো৷
ভয় আর সংকোচ নিয়েই আমি সব প্রসেস শুরু করলাম৷ ভার্সিটি থেকে অফার লেটার পেতেই আমার আকাশে ডানা মেলে উড়ার স্বপ্ন ডানা মেললো৷
স্কলারশিপ টা পেতেই আমি খাবার টেবিলে আম্মাকে বললাম৷ আম্মা শুনে বোধহয় খুশি হলেন৷ তবে খুশিটা হাবিবের সামনে প্রকাশ করলেন না৷ হাবিব আমাকে দেখে বললেন,

‘দোয়া করি স্বপ্ন পূরণ হোক৷’

‘দোয়াটা বোধহয় আর লাগবে না৷’

‘যাবি তো আমার শাশুড়ীর টাকায়৷ আবার এতো দেমাক৷’ মিতু কটাক্ষ করে কথাটা বললো৷ আম্মা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ওর প্রাপ্যটা ও নিচ্ছে৷ নীরার দেনমোহর তো আট লাখ৷’

আম্মার উত্তর শুনে মিতু কিছু বলার সাহস পেলো না৷ হাবিব আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে৷ সে চোখে কোনো অনুভূতি নেই৷ তবে হাজারো বিস্ময় উঁপচে পরছে৷

.
আমার পাসপোর্টে যখন ভিসার সিল লাগলো ওইদিন টা সবচেয়ে কষ্টের আর আনন্দের মাইলফলক ছিলো আমার জন্য৷ আমি কোনোদিন চিন্তা করি নি আমার সাথেও কিছুটা ভালো হতে পারে৷ ফ্লাইটের ডেট পরতেই আম্মা খুবই মন খারাপ করলেন৷ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘নীরা তোমাকে বোধহয় ভালো কিছু দিতে পারি নি৷ তবে আমার মন থেকে তোমার জন্য দোয়া রইলো৷ তোমার জন্য আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা৷’

আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম৷ বললাম,

‘আল্লাহ আপনাকে অনেকটা বছর বাঁচিয়ে রাখুক আম্মা৷’

আম্মা ছোট আপা আমার সমস্ত শপিং এ সাহায্য করলেন৷ মিতু সব কিছু তে খুঁত ধরছে৷ এমনকি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, বিদেশ বিভূঁইয়ে মেয়ে মানুষ আর কি করতে যায়! চরিত্র ঠিক থাকলে কি বিদেশে যেতো৷

ওর সমালোচনায় আমার খুবই হাসি পায়৷ আমি দূর থেকে ওকে হিংসেয় জ্বলতে দেখি৷ তবে ওর হিংসার আগুন আমাকে ছুতে পারে না৷
.
আর দুদিন বাকি আমার চলে যাবার৷ তবে যাবার আগে আমি একটা অসম্ভব কাজ করে বসলাম৷ হাবিব কে সবার সামনে বললাম, আমাকে তালাক দিতে৷
আমার কথায় আম্মা বেশ মর্মাহত হয়েছে৷ তবে ছোট আপা বললেন,

‘নতুন জায়গায় যাবার আগে অতীত ছুড়ে ফেলাই ভালো৷’

তবে হাবিব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তালাক কেনো চাই?’

আমি গলায় জোর এনে বললাম,

‘একটা অসুস্থ সম্পর্ক আমি বয়ে নিয়ে যেতে পারবো না৷ আর আপনি তো মিতুর সাথে ভালো আছেন৷’

মিতু পাশ থেকে হাবিবের উদ্দেশ্য বললেন,

‘হাবিব তুমি কি ভাবছো?’

হাবিব সাহেব মিতুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না৷ তবে আমাকে বললেন,

‘আইনী ভাবেই আমি তালাকনামা পাঠিয়ে দিবো৷’

‘আমার জীবনের এতোটুকু উপকার করার জন্য খুবই ধন্যবাদ হাবিব সাহেব৷’

হাবিব মৃদু হাসলেন৷ সেই হাসিতে বোধহয় কোনো প্রাণ নেই৷

.
টার্মিনালের গেইটের কাছে আসতে পিছু ফিরে কাউকে দেখলাম না৷ আম্মা সাথে আসতে চেয়েছিলেন তবে হঠাৎ করেই উনার গ্রামে যেতে হয়৷ আর ছোট আপার সামনে মাসেই ডেলিভারি ডেট৷
হাবিব বোধহয় আসতে চেয়েছিলেন তবে তার কি আর সেই সাধ্য আছে?
তবে আমি মন খারাপ পাশে রেখেই উড়াল দিলাম অজানার পথে৷ সেখানে হয়তো আমার ভাগ্যে টা ঠিক হবে৷

চলবে