#বৃষ্টিভেজা_সন্ধ্যায়_তুমি_এসেছিলে
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১
মোবাইলে কথা বলার সময়ে অনাকাঙ্খিতভাবে ধ্রুবর সাথে ধাক্কা লাগল লাবণ্যর। স্বাভাবিক ধাক্কা লাগলেও মানা যেতো। ধাক্কাটা ছিল অস্বাভাবিক একমাত্র লাবণ্যর কাছে। কেননা ধাক্কাটা লাবণ্যর বুকের নরম অংশে গিয়ে লেগেছে। চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার প্রয়াস করলো লাবণ্য। ধ্রুব ততক্ষণে লাবণ্যের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। সেও ব্যথা পেয়েছে তবে লাবণ্যের মতো বুকে নয়, পিঠে। লাবণ্য বুকে ব্যাগ চেপে ব্যথা সহ্য করতে থাকলো কিন্তু কতোক্ষণ সহ্য করবে? ব্যথাটা তো লেগেছে শরীরের এমন অঙ্গে যেখানে জনসম্মুখের সামনে ছোঁয়া অসম্ভব। বাড়িতে থাকলে এতোক্ষণে মেঝেতে শুয়ে কান্না করতো লাবণ্য।
লাবণ্য ব্যথার কথা তখনই ভুলে গেল যখন দেখলো ধাক্কা খাওয়ার মানুষটা আর কেউ নয় বরং লাবণ্যর বড়ো ভাইয়ের বন্ধু ধ্রুব। যিনি সুদর্শন পুরুষ হিসাবে অত্র এলাকায় পরিচিত। লাবণ্যকে দেখলেই যার মুখনিঃসৃত ” লাবন্নী ” ডাকটা ভেসে আসে। যার থেকে লাবণ্য প্রচন্ড রকমের দূরত্ব রেখে চলে। আশফাক ইউনুস ধ্রুব নামটা শুনলেই লাবণ্য দৌড়ে পালায়। লাবণ্যদের বাড়িতে আসলে জেরার উপর রাখে। এজন্য ধ্রুব বাসায় আসলে লাবণ্য নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে। আজ বত্রিশদিন পর ধ্রুবর সামনাসামনি আসা লাবণ্যর। লাবণ্যর ব্যথাযুক্ত অঙ্গের দিকে ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ভয়ে, আড়ষ্টভাব বাসা বেঁধেছে মনে। কাচুমাচু নয়নে ধ্রুবকে দেখে এক নিশ্বাসে বলল,” পিছনে আপনি আছেন, জানলে কখনোই ধাক্কা খেতাম না। এবারের মতো ক্ষমা,,,,,!
” জানলে বেশি করে ধাক্কা দিতি, তাই না লাবন্নী?”
ছলছল চোখে মাথা নেড়ে না বলল লাবণ্য কিন্তু সে শুনলে তো! মনগড়া কথা সাজিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,” পিকনিকে কী তুইও যাচ্ছিস? আমাকে অনুসরণ করছিস না তো! শুনেছি, তোর চব্বিশ নাম্বার বিয়ের ঘর আসলো সেদিন। পাত্র পক্ষ নাকি বিয়ে ভেঙেও দিয়েছে। ঘটনা কী সত্যি, লাবন্নী?”
নিজের বন্ধুদের সামনে কথাটা বললেও সমস্যা ছিল না, লাবণ্যর। সমস্যা বাঁধলো তো তখন যখন সে দেখলো ধ্রুবর বন্ধুরাও সেখানে উপস্থিত আছে। উপস্থিত থাকাটাও বড়ো কথা না। সকলেই উদগ্রীব হয়ে লাবণ্যর উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। লাবণ্য হ্যাঁ বললেই সকলে বিশ্বাস করবে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল লাবণ্য। ব্যথা অনেকটাই কমে এসেছে। চাপ লাগলে ব্যথা করবে। ব্যথিত ও ভঙ্গ হৃদয় আড়াল করে শুধালো,” ঘটনা সত্যি।”
ধ্রুবর বন্ধুরা একসাথে আহারে বলে উঠলো। সিয়াম বলল,” তোমার জন্য ভালো কেউ আছে, লাবণ্য।”
মান্নান বলল,” এতো রূপসী মেয়েটার বিয়ে ভাঙা ভালো লক্ষ্মণ বলে মনে হচ্ছে না। ”
তৃপ্তি বলল,” বয়স কম, তাই পাত্রপক্ষ পছন্দ করছে না।”
লাবণ্য শুনেই গেল। নত মাথা দুলিয়ে চলে যেতে চাইলো। ধ্রুব এতক্ষণ মজা নিচ্ছিল। লাবণ্যকে চলে যেতে দেখে বলল,” আমার তো লাবন্নীর হাবভাব সুবিধা লাগছে না৷ একটা মেয়েকে এতোবার রিজেক্ট করার কারণ অবশ্যই আছে। এই লাবন্নী, তুই কী পাত্র পক্ষের সামনে সাজগোজ ছাড়াই চলে যাস?”
লাবণ্যর চলে যাওয়া হলো না। পিছনে ফিরে উত্তর দিল,” সেজেগুজে যাই। ছোট ফুফু সাজিয়ে দেয়।”
ধ্রুব সজোরে তালি দিল। কণ্ঠে তার উৎফুল্লতা। যেনো এই মুহূর্তে কঠিন অংকের সমাধান করতে পেরেছে,” এজন্যই তো বলি, পাত্র পক্ষ কেনো বারবার বিয়ে ভেঙে দেয়। সাজলে তোকে যে, শেওড়াপাড়ার পেত্নীর মতো লাগে। একথা কেউ বলেনি? বলবেই বা কীভাবে! কেউ কী আমার মতো তোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নাকি?”
লাবণ্য এবার মাথা উঁচু করে ধ্রুবর দিকে তাকালো। তার তাকানোতেই হাজারো প্রশ্নের উত্তর মিলল। শেষোক্ত কথাতেই সে আটকে গেল। নির্জীব কণ্ঠে বলল, ” কিন্তু এবার তো সেজেগুজে পাত্র পক্ষের সামনে যাইনি।”
ধ্রুব চমকাল হয়তো কিছুটা অপ্রস্তুতও হলো। লুকোনো কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেল মনে হলো। ধমকের গলায় বলল,” বড়োদের মুখের উপর কথা বলতে শিখে গেছিস? বেয়াদব মেয়ে! যা বাসে উঠে বোস।”
নিরুত্তর লাবণ্য তাই করলো। বাসে উঠে পিছনে সবচেয়ে ভালো সিটটাতে বসলো। আজ তার ভাগ্য খুবই খারাপ। সে আর কোনোভাবেই তার মেজাজ খারাপ করতে চায় না। এমনিতেও কম ব্যথা পায়নি। ধ্রুবর কথা ভেবে বাড়তি ব্যথা পেতে চায় না সে। লাবণ্যদের গন্তব্য সিলেট ভ্রমণ। লাবণ্যর বড়ো ভাইয়ের নাম সাদিফ। সাদিফের বন্ধুমহলের সংখ্যা সীমিত। তিনজন বন্ধুর সাথে ছেলেবেলা বড়োবেলা পার করেছে সাদিফ। কথা ছিল, চার বন্ধুর পরিবারবর্গ নিয়ে একসাথে ভ্রমণ করতে যাবে। সবই ঠিক ছিল শেষমুহূর্তে এসে মান্নানের পরিবার নাকচ করে দিল। এক পরিবারের জন্য অন্য পরিবারগুলোও নাকচ করল। তবে বাচ্চাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে আসেনি কেউ। লাবণ্যর মতো মান্নানের ছোট বোন, সিয়ামের ছোট ভাই, তৃপ্তির স্বামীসহ যাচ্ছে।
বিয়ে ভাঙা বড়সড় ব্যপার নয় কিন্তু এবারের ছেলেটা লাবন্যকে কুৎসিত চেহারার মেয়ে বলেছে। এমন নয় যে লাবন্যর গায়ের রং কালো, শ্যামলা গায়ের রং। চেহারার ঔজ্জ্বল্যভাব আছে। টানা চোখে কাজল দিলে মায়াবতী লাগে। লাবণ্যর সাজের মধ্যে কাজল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। লাবণ্যর বাবা তো মায়াপরী বলে ডাকেন। মা মাথায় তুলে রাখেন। ভাইয়েরও খুব আদরের শুধুমাত্র ধ্রুবর কাছেই লাবণ্য হাসির পাত্রী। লাবণ্যর মনের কোঠায় ধ্রুবর জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। ধ্রুব যদি কোনোদিন জানতে পারে তবে শূলে চড়াবে।
কানে হেডফোন গুঁজে লাবণ্য সিটে গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে পছন্দের গান শুনতে থাকলো। বাহিরের জগতের আনন্দ উল্লাস থেকে দূরে সরিয়ে নিলো।
লাবণ্য নিজেকে বেশিক্ষণ সকলের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারল না। পিছনের সিট থেকে কেউ একজন তার চুল প্যাঁচিয়ে ধরলো। লাবণ্য সামান্য আর্তনাদ করে হাতজোড়া মালিকের হাতের উপর হাত রাখলো। কান থেকে হেডফোন সরিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। ধ্রুবকে স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। লাবণ্যর চুল প্যাঁচিয়ে ধরে একমনে মোবাইল দেখছে। লাবণ্যর চোখে পানি জমা হলো। গলার স্বর ভারী হয়ে বলল,” আমার চুল ছেড়ে দাও, ধ্রুব ভাইয়া।”
ধ্রুব সাথে সাথে চুল ছেড়ে দিল। চুলের গোড়া জ্বলে যাচ্ছে। এভাবে চুল টেনে ধরার কারণ খুঁজে পেল না লাবণ্য। সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ধ্রুব মোবাইলে চোখ রেখে বলল,” তোর তো আজ ব্যথা পাওয়ার দিবস মনে হচ্ছে। গতবছরও কী এই দিবস পালন করেছিলি, লাবন্নী?”
চোখের পানি মুছে লাবণ্য নাক টেনে উত্তর দিল,” গতবছরের কথা আমার কীভাবে মনে থাকবে?”
” মনে রেখে কী করবি? ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতে ঠিকই মনে থাকে। উফ পিঠটা এখনও টনটন করছে রে, লাবন্নী।”
লাবণ্য মিনমিন সুরে আওড়ালো,” ব্যথা আমারও লেগেছে। আপনার পিঠে আর আমার বুকে।”
ধ্রুব হয়তো কথাটা শুনেছে। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে লাবণ্যর চোখে চোখ রাখলো। এতেই যেন লাবণ্যর মনে কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব ঘটাতে শুরু করলো। ধ্রুব দুই সিটের মাঝামাঝি ফাঁকা অংশটাও ঘুচে দিল। দুই হাত লাবণ্যর সিটের উপর রাখলো। লাবণ্য সরে গেল। শরীর সামনের সিটের দিকে এলিয়ে দিল। ধ্রুব বাম চোখ টিপে বলল,” শরীরের অঙ্গটা ঠিক আছে তো? কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে নাকি চেক করেছিস, লাবন্নী? ”
লজ্জায় লাবণ্যর কান গরম হয়ে আসলো। সে ধ্রুবর দিক থেকে আোখ ফিরিয়ে জানালার বাহিরে তাকালো। মুখনিঃসৃত হলো, ” ছিহ্!” শব্দ।
ধ্রুব হাসতে লাগল। হঠাৎই মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করে বলল,” এতোদিন আমার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছিস কেনো? আমি বাঘ নাকি সিংহ যে, তোর বাড়িতে গেলেই নিজেকে বন্দী করে রাখিস?”
লাবণ্য চোরা চোখ এদিকসেদিক ঘোরাফেরা করতে ব্যস্ত। তখনই সাদিফ ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে বাসে উঠলো। লাবণ্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সাদিফের পিছু অন্যান্যরাও আসতে লাগলো। লাবণ্য এতক্ষণে খেয়াল করল, বাসে এত সময়ে তারা দুজনই ছিল। সাদিফ এসে ধ্রুর কোলে ব্যাগ পোটলা ছুঁড়ে দিয়ে লাবণ্যর পাশে বসে বলল, ” বলেছিলাম, খেয়াল রাখতে। লাবণ্যকে ভয় দেখাতে তোকে পাঠাইনি, ইডিয়ট।”
ধ্রুব ব্যাগ পাশের সিটে রেখে বলল,” ভয় দেখালাম কোথায়? আমি তো পিরিতের এ বি সি ডি শিখাচ্ছিলাম।”
সাদিফ সহ উপস্থিত বন্ধুরা হাসতে শুরু করলো। ধ্রুবর কথা সকলেই মজার ছলে নিলেও লাবণ্যর মনে অন্যরকম প্রভাব ফেলল। সে লজ্জায় লালনীল হয়ে নুইয়ে পড়লো। কানে হেডফোন গুঁজে বিড়বিড় করল,” সময় হলে আপনার কাছ থেকেই পিরিতের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করব, ধ্রুব ভাইয়া। ”
চলবে…………..