বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় তুমি এসেছিলে পর্ব-০২

0
22

#বৃষ্টিভেজা_সন্ধ্যায়_তুমি_এসেছিলে
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২

রাতের আঁধারে ভ্রমণ করার আনন্দময় মুহূর্তে লাবণ্যর কাছে ধ্রুবর আনমনে চেহারা বেমানান লাগলো। বাসে থাকা সকলেই গানের আসরে নিমজ্জিত একমাত্র ধ্রুব ব্যতীত। লাবণ্যর আনন্দও বিষিয়ে উঠছিল ধ্রুবহীনা। ছটফটে লাবণ্য চোখের পলকেই মিইয়ে গেল। সকলের আড়ালে লাবণ্য ধ্রুবর কাছে যাওয়ার চিন্তা করলো।

রাতের আকাশে চাঁদ যেন এক টুকরো রুপালি রহস্য পৃথিবীর বুকে সোনালী আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার নরম আলোকরেখা সব কিছু ফাঁস করে দেয়, কিন্তু কিচ্ছু বলেও না। আকাশের আঁধারে লুকিয়ে থাকে তার অন্তর্দ্বন্দ্ব, আবার একদম নিঃশব্দে পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে। চাঁদের ছায়া যেন এক নিঃশব্দ সঙ্গীত, যে সঙ্গীত কেবল হৃদয়ের গহীনে বাজে। তার আলো, তিথি আর স্থান-কাল ভেদ করে সারা পৃথিবীতে এক চিরকালীন সম্পর্ক সৃষ্টি করে। চাঁদ রাতের অন্ধকারে তার স্নিগ্ধতায় পৃথিবীকে আলোতে ভরে তোলে, আবার কখনো, নীরবতার মাঝে একটি গভীর রহস্যের জন্ম দেয়। ধ্রুবকেও লাবণ্য কাছে নীরবতার মাঝে রহস্যময় লাগছে তবে ব্যতিক্রমী। বন্ধুমহলের সামনে লাবণ্যর সাথে অচেনা মানুষের মতো আচরণ করে অথচ একাকী লাবণ্যর পছন্দের মানুষ ধ্রুব।

প্রেমিক যুগলের জন্য চাঁদ রাতে এক বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করে। চাঁদের নরম আলো যেন তাদের মনের অজানা কোণগুলোকে উন্মুক্ত করে, যেখানে তাদের ভালোবাসার প্রতিটি অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আকাশের গভীরতায় তারা একে অপরকে খুঁজে পায়, যেন দুজনার হৃদয়ের কথা চাঁদ শুনছে, আর তারা একে অপরের নিঃশব্দে অঙ্গীকারে মুগ্ধ। চাঁদের আলোকিত পথ ধরে তারা একে অপরকে নিয়ে চলে, হালকা বাতাসে মিলিত হাসি, আর আকাশের মায়াবী রুপে ভেসে যাওয়া প্রেমের প্রতিজ্ঞা। চাঁদ যেন তাদের ভালোবাসার সাক্ষী, একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতীক। ধ্রুব বাসের পিছনের সিটে কানে হেডফোন গুঁজে সিটে মাথা হেলিয়ে শুয়ে আছে। লাবণ্য সকলের আড়ালে ধ্রুবর কাছে গেল। অতি সমর্পণে ধ্রুবর পাশের সিটে বসলো। ধ্রুবর ডান কান থেকে হেডফোন সরিয়ে নিজের কানে গুঁজলো। লাবণ্যর প্রিয় গান বাজছে। লাবণ্যর লোভ জাগছে ধ্রুবর মন খারাপের কারণ জানার জন্য কিন্তু এখন সেই সময় না। লাবণ্যর সাহস হলো না ধ্রুবর কানে পুনরায় হেডফোন গুঁজে দেওয়ার। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি তখন ঘটলো যখন লাবণ্য মান্নানকে তাদের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। লাবণ্য সামান্য ভয় পেল। ঠোঁটের কোণে মিথ্যা হাসি এনে চিৎকার করে ধ্রুবকে ডাকলো,” ধ্রুব ভাইয়া, লাঞ্চ করবেন না?”

লাবণ্যর চিৎকার এতোই বিকট ছিল যে, বাসের অন্যান্যদের গানের আসর ভঙ্গ হয়ে লাবণ্যর দিকে মনোযোগ দিল। ধ্রুবর এক কান খালি ছিল বিধায় শব্দটা কানের পর্দায় গিয়ে পৌঁছাল। ততক্ষণের মান্নানের চেহারায় বিস্মিত ভাব চলে গিয়ে বিরক্তির ভাব চলে এলো। সে লাবণ্যর কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” রাতে কেউ লাঞ্চ করে না। ডিনার করে।”

লাবণ্য উপরে উপরে হাসলেও তার ভেতরের সুনামির তাণ্ডব সেই বুঝতে পারল। ধ্রুব ঠোঁট নাড়ানোর আগেই নিজের সিটের দিকে এগোলো। মান্নান ধপ করে ধ্রুবর পাশে বসলো। নেচে বেচারা হাঁপাচ্ছে। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে নাখোশ কণ্ঠে বলল,” এখনো বলিসনি। শা”’লা, সারাজীবন সিঙ্গেলই থাকবি। ”

ধ্ররুব মলিন হাসলো। চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের কোণের তৃপ্তি হাসিটা মান্নানকে উপহার দিলো।

——–

ভোরে সিলেট শহরে পৌছাল। বাস থেকে নেমে লাবণ্য লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। কাঁধের ব্যাগ শক্ত হাতে চেপে চারপাশে চোখ বুলাতে থাকলো। চারপাশের সবুজ প্রকৃতিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। ক্যামেরা বের করে চারপাশের পরিবেশ রেকর্ড করে নিলো। ক্যামেরার সাথে লাবণ্যও ঘুরছে। হঠাৎই তার চোখ আটকালো রাস্তার পাশে ধ্রুবর উপর। চা বিক্রেতার কাছ থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে মনের সুখে আকাশে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ক্যামেরা ব্যাগে ভরে লাবণ্য ধ্রুবর দিকে এগিয়ে গেলো। সাদিফ সহ অন্যান্যরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পাদন করতে গেছে।

লাবণ্য ধ্রুবর কাছাকাছি আসতেই নাকে সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ পৌঁছালো। লাবণ্যর হাত সাথে সাথে নাকে চলে গেল। সে নাক এবং মুখ কুঁচকে নিলো। ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে এককাপ চা চাইলো। ধ্রুব ভদ্রতা দেখালো না। সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসে ছড়াতেই ব্যস্ত রইলো। লাবণ্য ভেবেছিল তাকে দেখে ধ্রুব সিগারেট ফেলে দিবে কিন্তু হলো উল্টো। ধ্রুব ইচ্ছে করেই লাবণ্যর সামনে ধোঁয়া উড়াতে থাকলো। যার কারণে লাবণ্য কাশি উঠে গেল। সে ডান হাতে ধোঁয়া সরাতে চেষ্টা করল। তখনই ধ্রুব বাম হাত দিয়ে লাবণ্যের দুই হাত চেপে ধরল।

ডান হাতের বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠ আঙুলের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া সিগারেট ঠোঁটে লাগালো। লম্বা টান দিয়ে লাবণ্যর মুখের উপর ছেড়ে দিয়ে বলল,” আগুনে পুড়ে আমি একাই কেনো ছাই হবো। তুইও হবি। এটা তো নমুনা মাত্র। সামনে তোর জন্য ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।”

লাবণ্য কিছু বুঝলো না। তবে ধোঁয়া নাকে মুখে দেখে খারাপ অবস্থা হয়ে গেল। কাশতে কাশতে একপর্যায়ে বমি করে দিল। ধ্রুব পকেট থেকে চকলেট বের করে মুখে ঢুকালো। তার চোখ মুখ খুবই শান্ত এই মুহূর্তে সে কোনো অঘটন ঘটায়নি। এদিকে লাবণ্য বমি করতে করতে জান যায় যায় অবস্থা। ধ্রুব লাবণ্যর হাত ধরে রাখল কিন্তু কোন সান্ত্বনা দিল না। লাবণ্যকে ঠিক হতে না দেখে ভয়ংকর কাণ্ড করে বসলো। সে সোজা লাবণ্যর নাভিতে হাত রাখলো। এতেকরে লাবণ্যর চোখজোড়া বড়ো হয়ে গেলো। শরীরে অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। ধ্রুব শুধু হাত রাখলোই না কিছু সময় চেপে ধরে রাখলো। আশ্চর্যজনকভাবে লাবণ্যর বমি করা কমে গেল। লাবণ্য শরীর ছেড়ে দিল। সে রাস্তার পাশেই ফুটপাতের উপর বসে পড়ল। বমি করার কারণে লাবণ্য চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। সে রক্তিমবর্ণ চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুবর নজর অন্যদিকে। মুখে থাকা চকলেট দুইবার উলটা পালটা করলো শব্দ করে।

ধ্রুব চা ওয়ালার কাজ থেকে এক কাপ লেবু চা এনে লাবণ্য সামনে ধরল। লাবণ্য তখন কি হলো কে জানে! ধ্রুবর হাতে থাকা লেবু চা সে ফেলে দিল। এতেকরে কিছু চা ধ্রুবর হাতে পড়লো কিন্তু ধ্রুব কোন পাত্তা দিল না। ততক্ষণে সাদিফ চলে আসলো। বোনকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে?”

ধ্রুব উত্তর দিল,” বমি করেছে। বাস জার্নি করতে পারেনা তবুও কেন এটা নিয়ে আসলি, শা”’লা? আনন্দটাই মাটি করে দিল।”

সাদিফ ধ্রুবর কথায় কান দিল না। সে লাবণ্যকে ধরে পাশের হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলো। চলে যাওয়ার সময় লাবণ্য অশ্রুমাখা নয়নে মনে মনে বলল, ” আপনি খুব খারাপ ধ্রুব ভাই, খুব খারাপ। আমি আর কখনোই আপনার আশেপাশে থাকবো না।”

লাবণ্য তার কথা রেখেছে। সত্যিই সে ধ্রুবর আশেপাশে গেলো না। ধ্রুবর দিকে ফিরেও তাকালো না। দুই ঘণ্টার মধ্যে সে ঠিক হয়ে গেল। বড়ো ভাইয়ের পিছু পিছু ঘুরঘুর করতে থাকলো। লাবণ্যরা পৌঁছালো মাধবকুণ্ডের ইকোপার্কে। সময় অপচয় না করে জলপ্রপাত কাছে আসলো।

প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টিলা হতে পাহাড়ি ঝর্নার পতিত জলরাশি দেখে উৎফুল্ল হয়ে গেলো। তৃপ্তি স্বামীকে নিয়ে ফটাফট ছবি তুলতে ব্যস্ত। সাদিফ, মান্নান ঝর্ণায় ভেজার প্রস্তুতি নিতে থাকলো। জলাধারের উৎস উঁচু পাহাড়ের ঝর্ণাধারা আর রাশি রাশি জল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। লাবণ্যর মনে ভিন্ন এক ভালো লাগায় মুগ্ধ করতে লাগলো। জলপ্রপাত ও আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। লাবণ্য ভাইয়ের কাছে সেখানে যাওয়ার বায়না ধরলো। সাদিফ বোনের সকল আবদার পূরণ করবে বলল কিন্তু আদৌও পারবে তো?

প্রপাতের নিকটেই খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। লাবণ্য শুনেছে এরা পরোপকারী হয়প থাকে। লাবণ্য একজন মেয়েকে পেয়ে গেলো। যে দূরে বসে পানিতে কিছু কুড়াতে ব্যস্ত। জলপ্রপাতের চতুর্দিকে বিশাল বনভূমি অবস্থিত। ধ্রুব কপাল কুঁচকে এক জায়গায় বসলো। তার মধ্যে আনন্দ উন্মাদনা কাজ করছে না। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লাবণ্যর উপর আটকে আছে। লাবণ্য ফিরেও চাইছে না। লাবণ্য জলরাশির কিছু ছবি তুলে নিলো। সাথে নিজের কোন ছবি না থাকলে বান্ধবীদের কীভাবে মুখ দেখাবে?

আশপাশে তার ছবি তুলে দেওয়ার মত কাউকে পেল না। সাদিফ ও মান্নান জামা পাল্টাতে চলে গেছে কোথায়। তৃপ্তি তার বরের সাথে ব্যস্ত। একমাত্র কাজ নেই ধ্রুবর। লাবণ্য চাইছে না মানুষটার কাছাকাছি থাকতে কিন্তু ভাগ্য কীভাবে যেনো ধ্রুবর কাছেই পাঠিয়ে দেয় লাবণ্যকে। এ যেন চুম্বুক এবং লোহার আকর্ষণ বিকর্ষণ শক্তি।

লাবণ্য আর যাইহোক, ধ্রুব কাছে যাবেই না বলে নিয়ত করলো। ক্যামেরা ব্যাগে রেখে ঝর্নার কাছাকাছি গেল। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে তখন সিগারেট ধরাচ্ছিল। লাবণ্যর দিকে খেয়াল ছিল না তার। নিষেধকৃত বর্ডার পেরিয়ে লাবণ্য কখন যে পিচ্ছিল পাথরের দিকে এগিয়ে গেলো টের পেলো না। যখন ধ্রুবর চোখ লাবণ্যর উপর পড়লো ততক্ষণে অনেকটাই দেরী হয়ে গেল। লাবণ্য দুই হাত হাওয়ায় ভাসিয়ে এক পাথর থেকে অপর পাথরে লাফাতে ব্যস্ত।

না না বলতে বলতে ধ্রুব জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দৌড় দিল। পানির উপর দৌঁড়ানো সম্ভব নয়। হাঁটুর নিচ অব্দি পানি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সময় শরীরের অর্ধেক অংশ ভিজে গেলো। ধ্রুবর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।

এদিকে প্রথম কয়েকটা পাথরে পা ফেলে আনন্দ অনুভব করছিল লাবণ্য কিন্তু পানির আরেকটু কাছে গেলে পিচ্ছিল পাথরে পা ফেলে বুঝতে পারলো কতো বোকামি করে ফেলেছে সে। দুইটা পিচ্ছিল পাথর ডিঙিয়ে তিন নাম্বার পাথরে পা রাখতেই পিছলে পড়ে গেল লাবণ্য। আ বলে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে নিলো। সে বুঝলো অতিরিক্ত পাকনামির ফল সে এখন ভোগ করবে। হয়তো সে জমের বাড়ি যাবে নয়তো হাসপাতালের বাড়ি।

চলবে…………..