#বৃষ্টিভেজা_সন্ধ্যায়_তুমি_এসেছিলে
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৪
অপ্রাপ্তির পাতায় নাম খুঁজা হলে ধ্রুবর নাম পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। তবে এবার মনে হচ্ছে, ধ্রুবর জীবনে অপ্রাপ্তি নামক পীড়ার আগমন ঘটবে। লাবণ্য নামক পীড়া।
কটেজ থেকে ধ্রুব বের হলেও লাবণ্যর কটেজে প্রবেশ করল না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক রমণীর ঘরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের আনাগোনা দৃষ্টিকটু। ধ্রুব কটেজের বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলো।
মানুষের জীবনে বৈরী হাওয়া হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে পথচলা কঠিন হয়ে যায়। কখনো আসে সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে, কখনো জীবিকার চাপে, কখনো সমাজের নিন্দা কিংবা নিজের ভেতরের দ্বিধায়। জীবনের বৈরী হাওয়ার মধ্যে মানুষকে শক্ত থাকতে হয়, যেমন সমুদ্রযাত্রীকে করতে হয় প্রতিকূল হাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে।প্রতিকূল হাওয়া যেমন প্রকৃতিকে নড়বড়ে করে দেয়, তেমনি বৈরী পরিস্থিতি মানুষের মনে অস্থিরতা তৈরি করে।প্রতিকূল হাওয়া শেষে আকাশ যেমন পরিষ্কার হয়, তেমনি জীবনের বৈরী পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর মানুষ নতুন করে জাগ্রত হয়। লাবণ্য ধ্রুবর জীবনের সেই বৈরী হাওয়া। যাকে ছুঁড়ে ফেলা যায় না, আপনও করা যায় না।
ধ্রুব অস্থিরতায় সিগারেট ধরলো। ধোঁয়ার সর্পিল কুণ্ডলীতে একার বিষণ্নতা গলে যায়। ধ্রুব লাবণ্যর কটেজের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার অঙ্গুলিতে ধরিয়ে রাখা ক্ষীণ আলোর একটি টুকরো সিগারেট। ঠোঁটে লাগাতেই মিশে যাচ্ছে তার গভীর শ্বাসের সাথে। প্রত্যেকটা টান, আর ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।
ধ্রুবর ভেতর থেকে হঠাৎ প্রশ্ন উঠে আসে, “এই ধোঁয়া কি সকল কষ্ট ঢেকে দেয়?”
সিগারেটের আগুন নিভে যায়, কিন্তু প্রশ্নটা অমলিন থাকে। ধ্রুব জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, ধোঁয়ার শেষ কণা মিলিয়ে যায় শীতের আকাশে।
সাদিফরা ফিরে আরো আড়াইঘন্টা পর। ধ্রুব কটেজের বাইরেই অপেক্ষা করছিল। নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে সময় কাটিয়েছে এতক্ষণ। মান্নান জমিনে সিগারেটের ফিল্টার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া অবস্থায় দেখে বিস্মিত হলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,” মরণের স্বাদ পাওয়ার ইচ্ছে করছে?”
ধ্রুব ফিল্টারগুলো কুড়াল। গুনে গুনে হাতের কড়ি হিসাব করে বলল,” তিন বছরে সর্বমোট তিনহাজার চারশো সাতানব্বইটা টানলাম। মাত্রই তো! যারা প্রকৃত সিগারেট খোর তাদের সামনে এগুলো কিছুই না।”
” অচিরেই সেই খাতায় তোর নাম যোগ হবে, ধ্রুব। ঐসব ছাইপাঁশ ছেড়ে দে, ভাই!”
তৃপ্তির কথায় সাদিফ আহত হলো। মিনমিন সুরে বলল,” ও এখন বড়ো হয়ে গেছে, দোস্ত! তিন বছর আগের কথা মনে রেখে……!”
ধ্রুব ধমক দিয়ে বলল সাদিফকে,” ওর হয়ে সাফাই তোকে গাইতে বলিনি। নিজের চরকায় তৈল দে। তোর গুণবতী বোন কী করছে দেখে আয়।”
বন্ধু মহলের সকালে আহত হলো। তৃপ্তি ধ্রুবর কষ্ট দেখে কাতর হয়ে বলল, ” অবুঝের মতো থাকবি না। এবার অন্তত বলে দে।”
ধ্রুব উত্তর দিল না সে কটেজে ফিরে গেল।
সিলেট ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট হলো লাবণ্যর জন্য। পায়ে ব্যথা পাওয়ার কারণে খুব জ্বর এলো। সাদিফ বেশি ভয় পেলো। পরিবারের আদরের মেয়ে লাবণ্য। রাত হতেই ঢাকা ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। একজনের জন্য সকলের আনন্দ যেনো নষ্ট না হয়ে যায় ধ্রুব তাই সাদিফের সাথে চলে আসার জন্য বলল। ধ্রুবর উপর কেউ কোনো কথা বলল না।
রাত বাড়তেই লাবণ্যর জ্বর বাড়তে থাকলো। লাবণ্য বেহুঁশি অবস্থা। আবছায়া চোখ খুলে একবার পাশে ধ্রুবকে দেখে। সাদাবর্ণ ঠোঁট নেড়ে কিছু বলে। ধ্রুব কান পেতে সেই কথা শুনলো। স্বভাবতই লাবণ্যের আড়ালে মুচকি হাসলো। যেই হাসির ছন্দে ধ্রুবর মনওধীরে হাসতে থাকলো।
রাত শেষ হলেই লাবণ্য আবার দূরে চলে যাবে। ধ্রুব সারারাত লাবণ্যর কটেজের বাহিরে কাটিয়ে দিল। সাদিফ শতবার বিশ্রাম নিতে বললেও সরলো না। সকাল সকাল তিনজন মিলে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিল।
ধ্রুবর ব্যস্তময় জীবনের একাংশ জুড়ে লাবণ্যের বিচরণ। লাবণ্যর সামনে সে নরম কি গরম। অথচ মেয়েটা ধ্রুবর মনের লুকানো অনুভূতি ঘুনাক্ষরে টের পেল না। হয়তো পাবেও না। কেননা ধ্রুবর ভেতরে এক সত্তা এবং বাহিরে আরেক সত্তা। লোকসমাজে সে লাবণ্যর কাছে বিরক্তির পাত্র। অথচ একাকী সে লাবণ্যর গোপন প্রেমিক।
————————
একদিন বসন্তের তাজা ফুল নিয়ে তুমি আসবে। সেদিন বিরক্ত হয়ে বলবে, ” নে ধর লাবন্নী। তোর মাথায় গুবরেপোকা কামড়ে দিয়ছে। তাই তো অফিস বাদ দিয়ে এগুলো আনতে বললি।”
আমি সেদিন মুচকি হেসে বলব,” এই বাহানায় তো তোমাকে ছুঁয়ে দিতে পারি!”
ডায়েরিতে দুই তিন বাক্য লেখে লাবণ্য মুচকি হাসতে থাকলো। এমন অসংখ্য আবদার, আহ্লাদ লাবণ্যর ডায়েরিতেলেখা যাবে। যার একমাত্র হকদার ধ্রুব। লাবণ্য ভেবে পায় না, সে কবে কীভাবে ধ্রুবকে পছন্দ করে ফেলেছে। কয়েক বছর আগেও ধ্রুবকে সহ্য করতে পারতো না। অথচ আজ! শয়নে ধ্রুবর কথা চিন্তা করে বেড়ায়। সিলেট যাওয়ার আগেও ধ্রুবর থেকে পালিয়ে বেড়াতো। দুরুদুরু বুকে ঝড় বইতো কিন্তু তা প্রেমের নয়, ভয়ের। এখন তো লাজ ভর করে অঙ্গে। অনুভূতি শিহরণ বয়ে যায় ধমনিতে।
সিলেট ভ্রমণের দুই সপ্তাহ কেটে গেল। অথচ একবারও ধ্রুব আসলো না। লাবণ্যর ছটফটে মন ধ্রুবকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে ধ্রুবকে না দেখলে নিশ্বাস আটকে মরে যাবে। লাবণ্য ভাবল, সে নিজেই ধ্রুবকে দেখে আসবে। অবেলায় একাচিত্তে পিপাসা মেটাবে। প্রেমের সুধা সে একা পান করলেও পেয়ালা ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিবে। তবেই তো ধ্রুব তার মতো প্রেমের সুধা পান করবে।
বিকালে আলসে সময়ে লাবণ্য ধ্রুবর অফিসের দিকে রওনা দিল। বিকাল পাঁচটায় ধ্রুবর অফিস ছুটি। বাস ধরে পনেরো মিনিট সময় ব্যয় হবে। সময় অপচয় না করে তৈরী হয়ে নিল লাবণ্য। গায়ে জড়ালো হলদে সাদা রঙের সূর্যমুখী শাড়ি। সামনের বেবি চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে দিল। দুই ভ্রুর মাঝ বরাবর কালো রঙের টিপ পরলো। শাড়ির সাথে কালো টিপ পরতে স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করে লাবণ্য। অনেকেই বলে, কালো টিপ পরলে লাবণ্যকে খুবই মানায়। শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখতে পেয়ে ঘর ছাড়লো লাবণ্য।
লাবণ্যদের বাড়ি থেকে কিছু দূরেই ফুলের দোকান আছে। দশ বছরের একজন মেয়েকে বসে থাকতে দেখা যায়। লাবণ্য ভেবেছিল আজও মেয়েটাকে খুঁজে পাবে। অথচ আজ লাবণ্য মেয়েটাকে পেল না। মেয়েটার বদলে পেলো তার বড়ো ভাইকে। লাবণ্যর সামান্য মন খারাপ হলো। মেয়েটার নাম অনন্যা। নামের মতো সুন্দর করে প্রশংসা করতেও জানে সুন্দর। লাবণ্য চারটি গোলাপফুল কিনলো। টাকা দেয়ার সময় অনন্যার কথা জিজ্ঞেস করল,” অনন্যা আসে না? ও কি খুবই অসুস্থ? ”
অনন্যার ভাই উত্তরটা হ্যাঁ হলেও কণ্ঠস্বর অন্যরকম শোনালো। চোখজোড়া ছিল লুকানো। লাবণ্যর থেকে কিছু লুকাচ্ছিলো ছেলেটা। বাড়তি কথা না বলে ধ্রুবর সাথে দেখা করার জন্য রওনা দিল।
আমরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে গেলেও পরবর্তী সময়ে কী হবে ভেবে ছটফট করি। প্রকৃতির লীলাখেলা যেমন বুঝা অসম্ভব মানুষের মনও বুঝা অসম্ভব। লাবণ্য বিশ মিনিট ধরে ধ্রুবর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে। সময় যতো গড়াচ্ছে লাবণ্যর মনের ধুকপুক শব্দ ততোই বাড়ছে। কতো মানুষ বের হচ্ছে কিন্তু লাবণ্যর কাঙ্খিত মানুষ বের হচ্ছে না৷ প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর ধ্রুর দেখা মিলল। ফরমাল ড্রেসে সুদর্শন পুরুষ লাগছে। যে কোন মেয়েকে ঘায়েল করার জন্য এই লুকটাই যথেষ্ট।
লাবণ্যর শরীরের শিরশির ভাবটা জেগে উঠলো। তাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলে ধ্রুবর কেমন রিয়েক্ট করবে? হতভম্ব হয়ে মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে থাকবে! নাকি দৌড়ে এসে ধমকে বলবে,” শাড়ি পরে ঢং করতে এসেছিস, লাবন্নী? তোর ঐ মেয়াদহীন পেট দেখে কেউ পটে যাবে না।”
লজ্জায় মরিমরি অবস্থা লবণ্যর। শাড়ির কুঁচি ঠিক করে পা বাড়াতেই ধ্রুবকে অন্য একজন মেয়ের সাথে দেখলো লাবণ্য। লাবণ্য মনে কোনো কুচিন্তা আনতে চাচ্ছে না। খানিক্ষনের জন্য মন খারাপ হলেও পরবর্তীতে সহকর্মীও হতে পারে ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিল লাবণ্য।
কয়েক কদম এগিয়ে তাদের পিছু আসলে দেখল ধ্রুব মেয়েটিকে নিয়ে পাশের কফিশপে ঢুকছে। লাবণ্য গলা ভিজিয়ে নিজেও তাদের পিছু নিলো। এই সময়টায় লাবণ্যর পিপাসা পেয়েছে। মনে হচ্ছে, এক সমুদ্র পানি পান করে ফেলতে পারবে। লাবণ্য একরাশ ভয় নিয়ে প্রবেশ করল। সবচয়ে কর্ণারের টেবিলে দুজন বসেছে। একবার ভাবল, কাছে গিয়ে পরিচয় দিবে পরক্ষণেই ভাবল, ব্যপারটা খারাপ দেখায়।
লাবণ্যর ভাবনার মাঝেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে গেলো। ধ্রুব মেয়েটির হাত ধরে বসলো। তাদের মাঝের কথোপকথন শোনা যাচ্ছে না। হাত ধরেছে, চুমু খায়নি তো! এবারও লাবণ্য নিজেকে সান্ত্বনা দিল।
ধ্রুবর সম্পূর্ণ মনোযোগ মেয়েটির উপর। কী এমন কথা বলছে তারা? লাবণ্য কী একটু বেশিই আশা করে ফেলেছিল? সাদিফ তো বলেছিল, সিলেটের সেই রাতের কথা। ধ্রুবর খেয় রাখা, ধ্রুবর চিন্তা এমনকি ধ্রুবর মনের কথা!
লাবণ্য কফিশপের অপর চেয়ারটায় বসলো। একদম ধ্রুবর পিছনে। তাদের কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। মেয়েটি বলছে,” আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই, ধ্রুব। আমাদের বিয়েটা যতো তাড়াতাড়ি হবে ততোই ভালো হবে।”
ধ্রুব প্রত্ত্যুত্তর করল,” কাজী অফিসে কখন আসবে?”
” ঠিক সকাল এগারোটায়।”
” পরে আবার মন পরিবর্তন করে ফেলবে না তো?”
মেয়েটি শব্দ করে হেসে উত্তর দিল,” বিয়ে নিয়ে তুমি খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে।”
ধ্রুবও হাসলো। উত্তর দিল,” ছেলে মানুষ তো!”
এদিকে লাবণ্যর ভাঙা মন নিয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে। তার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যার জন্য সেজে এসেছিল সে অন্যজনের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে।
লাবণ্য ফুলগুলো টেবিলের উপর রেখেই চলে আসলো। একটিবারের জন্য পিছনে তাকালো না। একটিবার তাদের পরবর্তী কথোপকথন শুনলে, গল্পটা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন হতো না। সূর্যে আলোয় আলোকিত পৃথিবীর মতো উজ্জ্বল হতো।
চলবে……..