বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় তুমি এসেছিলে পর্ব-০৫

0
18

#বৃষ্টিভেজা_সন্ধ্যায়_তুমি_এসেছিলে
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৫

প্রথম প্রেমে অসফল হয়ে লাবণ্যর জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। জীবনের তীরে এসে বুঝলো, প্রেম মানেই বেদনা। দাদী নানীদের মুখে শুনে থাকা প্রেম নিয়ে কতশত মন্ত্রণাও সঠিক প্রমাণিত হলো। লাবণ্য ধ্রুবর থেকে বড়ো সরো ধাক্কা খেয়ে বুঝলো, তার মতো বুদ্ধিহীন গাধী পৃথিবীতে একটিও নেই। সে ধ্রুবকে উক্ত দিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইবে না। ধ্রুবকে এড়িয়ে চলবে। ধ্রুবর জীবনে যেহেতু লাবণ্যর জায়গা হয়নি। লাবণ্যও আর কখনো ধ্রুবর কাছে যাবে না।

লাবণ্য নিজেকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথম ধাপ হিসাবে বেছে নিলো পড়াশোনাকে। পড়াশোনায় ডুবে থাকলে ধ্রুবর কথা মনে পড়বে না। বাড়ি ফেরার পর থেকেই ঘরে খিল লাগিয়ে দিয়েছে লাবণ্য। ভেতরে কি করছে কেউ জানে না। লাবণ্যর মা কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাননি। অগত্যা ছেলেকে ডেকে আনতে চলে গেলেন।

সাদিফ মাত্রই বাড়ি ফিরল। অনেকদিন পর ধ্রুবও আসলো। সিলেট থেকে ফেরার পর লাবণ্যকে দেখেনি সে। আজ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। লাবণ্যকে না দেখলে শ্বাসরোধে ম’রে যাবে। ধ্রুবর হাতে মিষ্টি ও ফল।যেনো বন্ধুর বদঢি নয়,শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে সে। লাবণ্যর মায়ের হাতে ধরিয়ে বলল,” একজন কলিগের বিয়ের করিয়ে এসেছি। ছয়টায় বিয়ে, সাতটায় বাসে চড়ে চট্রগ্রাম। আমার বিয়েটা যে কবে হবে?”

লাবণ্যর মা মুখ টিপে উত্তর দিলেন,” আমি তো মেয়ের জামাই করতে দুই পায়ে রাজি আছি। তুমি বলো, কবে আসবে?”

ধ্রুব ভেবে পায় না। লাবণ্যর মায়ের মতো কিউট শাশুড়ির সন্তান লাবণ্য কীভাবে হলো। সাদিফ ও লাবণ্য একদম আলাদা। লাবণ্যকে ধ্রুব আজও বুঝে না। বুঝতে পারে না। মেয়েটা আশেপাশে থাকলে তো! গতবার এতোটাই রাগিয়ে দিয়েছিল যে, একমাস সামনে আসেনি। সিলেটে যদিও পেয়েছিল, অঘটন ঘটিয়েছিল। ধ্রুব হা করে শ্বাস ছাড়লো। কণ্ঠে তার ব্যকুলতা,” আগে মেয়েকে বড়ো হতে বলুন, আন্টি! তারপর না হয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে মেয়েকে বিদায় করবেন।”

সাদিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। মেয়ের জামাইয়ের মতো তার জন্যও যদি কাউকে ধরে আনতো! সিঙ্গেল জীবনে প্রেমের বড্ড অভাব।

স্বভাবতই সাদিফের ঘর দখল করল ধ্রুব। বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে রিমোট হাতে নিল। সাদিফ বাথরুমে হাতে ফোন নিয়ে ঢুকেছে। কতো সময় সেখানে বসে থাকবে, জানা নেই। ধ্রুবর ব্যাকুল মন লাবণ্যকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেল। সে টেলিভিশন চালু করেই ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।

লাবণ্যর দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। সাধারণত ধ্রুব বাড়ি আসলেই দরজা আটকে বসে থাকে মেয়েটা। সিলেট যাওয়ার পর তো মান ভেঙেছিল। তবে আজ কি হলো? ধ্রুব দুইবার দরজায় করাঘাত করল। লাবণ্য দরজা খুলল না। ধ্রুব আওয়াজে তুলে ডাকলো,” দরজা আটকে কার সাথে প্রেম করছিস, লাবন্নী?”

লাবণ্য কাঁদছিল। ধ্রুবর কণ্ঠস্বর শুনে কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে দিলল। ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে বলল,” আমাকে আর কখনো লাবন্নী বলে ডাকবেন না। আমার নাম লাবণ্য। পরেরবার নাম উচ্চারণ করার সময় সাবধানে উচ্চারণ করবেন।”

লাবণ্য কথাটা বলে দরজা আটকে দিতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না। ধ্রুব দরজা থাবা দিয়ে ধরলো। লাবণ্য এতেও মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে ভাঙা মন ও ভাঙা সুরের সাথে বিছানায় গিয়ে বসলো। মুখে দুহাত চেপে হু হু করে কাঁদতে থাকলো। ধ্রুব চিন্তায় পড়ে গেলো। লাবণ্যর কথা শুনে বুঝলো, তার দ্বারাই মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, কষ্ট পাওয়ার কারণ। ধ্রুব লাবণ্যের পাশে বসলো। চিন্তায় মাথা জ্বলে যাচ্ছে। ইদানীং সিগারেটের নেশা ভালোই হয়েছে। লাবণ্যর উপস্থিতিতেই ধ্রুবর সিগারেটের নেশা চেপেছে। বুঝাই যাচ্ছে, বেশ নেশা হয়েছে। ধ্রুব লাবণ্যর সামনেই সিগারেট ধরালো। ঠোঁটে সিগারেটের ফিলটার চেপে উপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে দিল। সে লাবণ্যকে বুঝতে চাইছে। লাবণ্যর কান্নার মাত্রা বেড়ে গেলে ধ্রুব বিচলিত হলো। লাবণ্যের চোখের পানির কাছে সিগারেটের নেশা তুচ্ছ। ধ্রুব সিগারেট বাথরুমে ফেলে দিয়ে পুনরায় ফিরে আসলো। মেয়েদের এই কান্নার মূল কারণ ধ্রুবর কাছে অজানা নয়। ধ্রুবর অন্তর মোচড় দিয়ে উঠলো। তার জন্য কী মেয়েটা কাঁদছে? নাকি অন্য কারো জন্য? পকেট থেকে সেন্টার ফ্রুট বের করে মুখে ঢুকিয়ে বলল,” ছেলেটা কে, যার জন্য এভাবে কাঁদছিস?”

লাবণ্যর কান্না থেমে গেলো। কাতর চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো। তার কান্না যে ধ্রুবর কারণেই। আফসোস ধ্রুব বুঝলোই না। লাবণ্যর মন বিষন্ন মনটা খারাপ হয়ে গেল ধ্রুবকে কাছে পেয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তখনকার ঘটনাটি। লাবণ্য চোখ মুছল ধরা কন্ঠে বলল, “ খুব ভালোবাসি, ধ্রুব ভাইয়া। আমি তার কাছে সারাজীবন থাকতে চাই। আমাকে থাকতে দিবে, ধ্রুব ভাইয়া?”

ধ্রুবর মনে হল কেউ তার অন্তরে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, ” আমি ছাড়া তুই অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারিস না লাবন্নী।”

লাবণ্য কপালে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,” আমার প্রথম অনুভূতি, আমার প্রথম প্রেম। একটু একটু করে জমিয়েছি তার জন্য। আজ সে দূরে, অনেক দূরে।”

ধ্রুব আর শুনতে পেল না। লাবণ্যর ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। সাদিফের ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরালো। তার হাত কাঁপছে। সিগারেটের ফিলটার চেপে ধরে রাখতে পারছে না। সাদিফ বাথরুম থেকে বের হয়ে বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। ধ্রুবর হাত থেকে সিগারেট কেঁড়ে নিয়ে হাত থাবা দিলো। ধ্রুব যখন সাদিফের দিকে তাকালো তখন তার চোখজোড়া ছিল লাল টকটকে।সাদিফ ভয় পেলো। বন্ধুকে অভয় দিয়ে বলল,” লাবণ্য কিছু বলেছে?”

” তোর বোন অন্য কাউকে ভালোবাসে, সাদিফ। সেই প্রেমিককে এনে দেওয়ার জন্য আমার কাছে আবদার জুড়ে দিয়েছে।

সাদিফ চমকালো। বন্ধুর রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। সে ফিচেল হেসে বলল,” ও ছোট মানুষ, প্রেম ভালোবাসার কি বুঝে!”

” লাবণ্য কাঁদছে সাদিফ। ওর কান্নায় বলে দিচ্ছে, ও বিশেষ কাউকে পছন্দ করে। আমি হান্ডেট পার্সেন্ট শিউর, সেই বিশেষ ব্যক্তি আমি নই।”

সাদিফ লাবণ্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যেতেই নিচ্ছিল। তখন ধ্রুব আটকায়। তার চোখেমুখের ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে,যে যেভাবে আছে তাকে সেভাবেই ছেড়ে দেয়া উচিত। সাদিফ আহত চোখে তাকালো। বন্ধুর কষ্ট দেখে নিজেও কষ্ট পেলো।

—————-

লাবণ্য নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। আজকাল ধ্রুবর জন্য মন পুড়ে না। পড়াশোনায় ব্যস্ত রেখে সবদিক থেকেই দূরে আছে। ইন্টার প্রথম বর্ষের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আজকাল লাবণ্য আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়ায়। কলেজের নতুন শিক্ষককে দেখে মনে অন্যরকম দোলা খায়। সে এতোদিনে বুঝে গেছে, ধ্রুব তার ভালোলাগা ছিল মাত্র। মূল ভালোবাসা তার জীবনে আসেনি। হয়তো, এবার আসবে!

পূর্বের মতো ধ্রুব লাবণ্যর বাসায় আসে। লাবণ্য বুঝতে পারলে দরজায় খিল লাগিয়ে বসে থাকে। ধ্রুব সবসময়ের মতো অপেক্ষা করে চলে যায়। তবে লক্ষনীয়ভাবে ধ্রুব স্বাভাবিক। একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। লাবণ্যর জন্য মনের লুকোনো অনুভূতি প্রকাশ্যে আনেনি। লাবণ্য চায় না তাই মনের কথা আটকে রেখেছে।

গতমাসেই সাদিফকে এনেছিল কলেজের নতুন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে। সাদিফ বরাবরের মতোই বোনের মতিগতি লক্ষ্য করার ব্যপারে উদাসীন ছিল। সে জানলোও না বোনের কথা শুনে কতো বড়ো ক্ষতি কর দিয়ে এসেছে।

দুইমাস পর,

ধ্রুব অফিস থেকে বাসে করে ফিরছিল। পথিমধ্যে চোখ গেল রাস্তার অপরপাশে। লাবণ্য একজন ছেলের হাতে হাত রেখে হেঁটে আসছে। লাবণ্যর মুখের রিনরিনে হাসি ধ্রুব আগে কখনো দেখেনি। তার ডানহাত আপনাআপনি বুকের বামপাশে চলে গেল। চেপে ধরে রাখলো সেখানটায় কিছুক্ষণ। লাবণ্যকে কতোটুকু ভালোবাসে বিশ্লেষণ করতে পারবে না। আজ তার ভালোবাসার কোরবান হলো।

ধ্রুব চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। চোখ খুলতে পারছে না। তারপর! তারপর বাসের মধ্যে হৈ হুল্লোড় লেগে গেল। কেউ বলল,” মাথায় পানি ঢালেন।”

আরেকজন মেয়ে বলল,” হাসপাতালে নেন, দ্রুত! ”

ধ্রুব বাঁচতে চাইছে না। সকলকে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমার কলিজা কা’ই’টা নিয়া যাচ্ছে। কেউ তাকে বাঁধা দাও।”

কেউ শুনলো না। লোকজন ধরাধরি করে ফুটপাতের রাস্তায় ধ্রুবকে বসালো। ধ্রুবর মাথায় ঠদন্ডা পানি ঢালা হচ্ছে। একজন মেয়ে বলছে,” চোখ খুলে রাখো, ধ্রুব! তোমার কিছুই হবে না।”

ধ্রুব চোখ খুলল না। আবহাওয়াও আজ ধ্রুবর মন খারাপের সঙ্গী হলো। ঝরঝর করে ঝরতে শুরু করলো।ধ্রুবর শরীর বেয়ে পানি ঝড়ে জমিনে মিশে গেল।
মেয়েটি ধ্রুবর মাথার কাছে ছিল। অদুরে যত্নে মাথার পানি মুছে দিল। যেনো মেয়েটি ধ্রুবর পূর্বপরিচিত। অশ্রুভেজা কাজল লেপটে গেল। চোখের কার্নিশ বেয়ে অবাধ্য অশ্রু জানাল,
“বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় তুমি এসেছিলে,
তবে এখনই কেনো চলে গেলে।
মনের কথা অজানাই রইলো পড়ে।
তুমি ফিরে আসবে তো!
আমার নীড়ে!”

চলবে………….