#বৃষ্টিভেজা_সন্ধ্যায়_তুমি_এসেছিলে
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৬
মেয়েটির কোলে তখনও ধ্রুব শুইয়ে আছে। তাদের ঘিরে চারপাশে ভীড় জমেছে। লোকজন বলাবলি করছে, ছেলেটা হয়তো ম’রে’ই গেছে।”
মেয়েটা কি করবে ভেবে পেলো না। ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ধ্রুবর পাশে বসে থাকা মেয়েটি কাঁদতে শুরু করেছে। রাস্তার পাশে ভীড় দেখে কৌতূহল মেটাতে লাবণ্যও তখন চলে আসলো। লাবণ্যর পাশের মানুষটার নাম, অন্তর। লাবণ্যর প্রাইভেটের শিক্ষক। লাইব্রেরীতে বই কিনতে এসেছিল।
ধ্রুবকে পরনারীর কোলে দেখে লাবণ্যর মনের ছন্দ থেমে গেলো। ধ্রুবর চোখ বন্ধ। লাবণ্য ভাবছে, কী হচ্ছে এখানে? কিছুই বুঝে আসছে না। লাবণ্যর মাথার উপর থেকে ছাতা সরে গেল। রিমঝিম বৃষ্টি এবার তাকেও ভিজিয়ে দিল। সে ভীরু মনে ধ্রুবর পাশে বসলো। হাত বাড়িয়ে ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ধ্রুব ভাইয়া, কি হয়েছে?”
ধ্রুব উত্তর দিল না। ধ্রুবর হয়ে কেউই উত্তর দিতে এগিয়ে আসলো না। মেয়েটি কীভাবে যেনো ধ্রুবকে আগলে রাখতে চাচ্ছে। লাবণ্য মেয়েটির দিকে তাকালো। ধ্রুবর সমবয়সী হবে। মেয়েটির চোখে পানি। এই পানিতে মুক্ত ঝরছে না। লাবণ্যর চোখের পানির মতো বেদনা ঝরছে। লাবণ্য, ধ্রুবকে ডেকে বলল,” আমার সাথে কথা বলবে না, ধ্রুব ভাইয়া?”
চার জোড়া হাত এসে ধ্রুবকে কোলে তুলে নিয়ে চলল। লাবণ্য উত্তর পেল না। নির্জীব শরীর নিয়ে বসে রইলো ফুটপাতে। তার আপাদমস্তক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। অন্তর যখন লাবণ্যকে ডাকলো তখন তার ধ্যান ভাঙলো। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,” আমাকে ধ্রুব ভাইয়ার কাছে নিয়ে চলুন, স্যার!”
অন্তর বুঝলো, অসুস্থ ভদ্রলোক লাবণ্য পূর্বপরিচিত কেউ। লাবণ্যকে নিয়ে গাড়ি পিছু নিল।
সাদিফ বিশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছালো। সাদিফকে মূলত সেই মেয়ে সংবাদ দিয়েছে। মেয়েটা ধ্রুবর কলিগ। একসাথে কাজ করে তারা। ধ্রুবর ফোন দিয়ে সংবাদ দিয়েছে সাদিফকে।
ইমারজেন্সীতে ধ্রুবকে ভর্তি করানো হয়েছে। মেয়েটাই সমস্ত খরচ বহন করছে। ধ্রুবর প্রেসক্রিপশন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে মেয়েটা।
সাদিফ হাসপাতালের বারান্দায় বোনকে দেখতে পেয়ে অবাক হলো। বোনের কাছে এসে চোখ দুটো সংকুচিত করে বলল,” এখানে কি করছিস?”
ভাইকে দেখে লাবণ্যর আটকে রাখা কান্না প্রকাশ পেল। সে বিচলিত হয়ে বলতে থাকল,” ভাইয়া, ধ্রুব ভাইয়ার কি হয়েছে? আমার সাথে কথা বলেনি। আমি কতো ডাকলাম, শুনেনি।”
সাদিফ দেখল লাবণ্যর সাথে অন্তরও এসেছে। বিষয়টা সাদিফের পছন্দ হয়নি।বোনের দিকে রাগ মিশ্রিত চোখে চেয়ে ধ্রুবর খোঁজ নিতে চলে গেল সে।
এদিকে অন্তরের হাতে সময় কম। সন্ধ্যা হতে চলল, প্রাইভেট পড়াতে যেতে হবে। সে লাবণ্যর কাছে এসে বলতে শুরু করল,” চলো, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। এখানে থেকে আর কী করবে?”
লাবণ্যর প্রস্তাবটা পছন্দ হলো না। সে তার ধ্রুব ভাইয়াকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কল্পনাও করতে পারছে না। অন্তর বারংবার জোর করাতে লাবণ্য চটে গিয়ে বলল,” আপনি দেখছেন না, আমার ধ্রুব ভাইয়া অসুস্থ। আপনি কী বুঝতে পারছেন,আমার এখানে থাকা কতোটা জরুরী! আপনার ইচ্ছে হলে চল যান। আমি ধ্রুব ভাইয়াকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
কয়েকটা দিন, এই কয়েকদিনে কী একজনের মন থেকে ভালোবাসার মানুষটিকে মুছে ফেলা সম্ভব? লাবণ্য চেষ্টা করছিল কিন্তু আদৌও সরাতে পেরেছে? ধ্রুব নামক প্রাণপাখি সর্বদাই লাবণ্যর মনে বিচরণ করেছে।
অবাক করার বিষয় হলো, অন্তর সত্যি সত্যিই চলে গেল। লাবণ্য তাচ্ছিল্য হাসলো। তেঁতো হলেও সত্য, ছেলেরা বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত হয়। মেয়েদের অভ্যন্তরে মনটাকে কেউ খুঁজেও দেখে না। লাবণ্য ধ্রুবকে ভুলে থাকার প্রয়াস করেছিল মাত্র।
লাবণ্য বারান্দায় বসে চোখের পানি ফেলছে। ধ্রুবকে নিয়ে আসা মেয়েটি কখন এসে লাবণ্যর পাশে বসলো; টের পেল না। মেয়েটি নিজ থেকেই কথা বলা শুরু করল,” তুমি তোমার কথা রাখোনি, লাবণ্য।”
লাবণ্য মেয়েটার দিকে তাকালো। মনে পড়লো সেদিনের ঘটনা। যেদিন কফিশপে ধ্রুবর সাথে অন্য মেয়েকে দেখে লাবণ্য চলে আসছিল। তখনই এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল লাবণ্যর। মেয়েটার নাম নীরা। ধ্রুবর বস। খুবই সাধারণ পোশাকে চলাফেরা মেয়েটার। এতো বড়ো পদে অবস্থান তার, বুঝা মুশকিল। নীরা, লাবণ্যকে দেখে বুঝে গিয়েছিল মেয়েটা ধ্রুবকে ভালোবাসে। সে লাবণ্যর সাথে কথা বলল। তাদের কথোপকথন এমন ছিল,
” তুমি খুবই ছোট। ধ্রুবর মন মানসিকতার সাথে তোমার খাপখাওয়াতে হিমশিম খাবে।”
” আমাকে আর চেষ্টা করতে হবে না। উনি অন্য কাউকে পছন্দ করে।”
নীরা হাসলো। আলগোছে মাথার চুলগুলো গুছিয়ে বলল,” ধ্রুবর প্রকৃত ভালোবাসা হলাম আমি। ঐ মেয়েটা ধ্রুবর বন্ধুমাত্র।”
লাবণ্য অবাক হয়েছিল। ভাঙা মন জোড়া লাগার পরিবর্তে পুনরায় ভেঙে গেল। লাবণ্য উত্তর দিল, ” ধ্রুব ভাইয়া যদি আপনাকে ভালেবেসে থাকে। তাহলে আমি কখনো আপনাদের মাঝে আসবো না।
” ভেবে বলছো তো?
” লাবণ্য, ভেবেই প্রেমে পড়েছিল। এবার ভেবেই দূরে সরে যাবে।”
নীরা হেসে সেদিন বলেছিল, ” তুমি ছোট হলেও খুবই চতুর একজন মেয়ে।”
লাবণ্য মলিন হেসে চলে এসেছিল।
বর্তমানে লাবণ্যর মুখে রা নেই। মেয়েরা নিজেদের স্বার্থের জন্য কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা ভাবনার বাহিরে। লাবণ্য আজ নিজের ও ধ্রুবর কথা ভেবে এখানে পড়ে রয়েছে। ধ্রুব যদি লাবণ্যকে চলে যেতে বলে তবেই সে যাবে। নয়তো এখানেই পড়ে থাকবে।
নীরা বিরক্ত হলো। লাবণ্যকে জানে মে’রে ফেললে হয়তো শান্তি পেতো। সে কিছুই করল না। ধ্রুবকে পেতে হলে ছলচাতুরীর সাহায্য নিতেই হবে।
লাবণ্য উদাসীন হয়ে বলল,” আমি হয়তো ধ্রুব ভাইয়াকে ছাড়া বাঁচব না।”
নীরা দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” ধ্রুব আমাকে ভালবাসবে।”
লাবণ্য শান্তসুরে বলল,” ধ্রুব ভাইয়া শুধু আমাকেই ভালোবাসে, সারাজীবন বাসবে।”
” এতোটা আত্নবিশ্বাসী হয়ো না, লাবণ্য। তোমার কথায় বাচ্চামো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।”
লাবণ্য উত্তর দিল না। তার দৃষ্টি অদূরে নিমজ্জিত।
ধ্রুবর জ্ঞান ফিরে এসেছে। অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার কারণে রক্তচাপ কমে গিয়েছিল। আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। ডাক্তার তিন ঘণ্টার সেলাইন দিয়েছে। সাদিফ বন্ধুর পাশে বসে আছে। ধ্রুব কথা বলছে না। চোখের সামনে লাবণ্যর সাথে ছেলেটার চিত্র ভেসে উঠছে। ধ্রুব সাদিফকেও প্রশ্ন করল না। চোখ বন্ধ করে রাখলো। সে এবার তাই করবে,যা লাবণ্য চায়। লাবণ্যর ইচ্ছে অপূর্ণ রাখার মতো লাভারবয় ধ্রুব নয়।
লাবণ্য ধীরপায়ে কেবিনে প্রবেশ করল। ধ্রুবর বন্ধ চোখজোড়া দেখে থমকে রইলো। সাদিফের মনে হলো, ধ্রুবর সাথে এবার ভালো কিছু ঘটবে। আজ লাবণ্যর চোখজোড়াও ভিন্ন কথা বলছে। সে লাবণ্যকে জায়গা করে দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
লাবণ্য ধ্রুবর সেলাইন লাগানো হাতটার উপর হাত বুলিয়ে দিল। ধ্রুবর চোখজোড়া তৎক্ষনাৎ খুলে গেল। সে ভবাতেও পারেনি, লাবণ্যকে দেখতে পাবে। লাবণ্যর ফ্যাচফ্যাচ কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারল না ধ্রুব। মুখে বিরক্ত ভাব এনে বলল,” কি শুরু করলি, লাবন্য? মৃত্যুর দুয়ারে প্রবেশ করা মানুষকেও ঠিকঠাকমতো ম’র’তে দিবি না নাকি?”
লাবণ্য কান্নামাখা কণ্ঠস্বরে উত্তর দিল,” মৃত্যুর কথা বলবে না, ধ্রুব ভাইয়া।”
” কেনো, আমি ম’রে গেলে কী তুইও ম’রে যাবি?”
” হ্যাঁ বললে কী, একসাথে বেঁচে ফিরবে?”
ধ্রুব অবাক হলো। লাবণ্যর মুখনিঃসৃত বাক্য বিশ্বাস হলো না। সে পুনরায় শুনতে চাইলো, ” কি বললি?”
লাবণ্য ভয় পেলো। ভাবলো, পুনরায় বললে যদি গালে থাপ্পড় পড়ে? সে মিনমিন সুরে বলল,” আর বলব না, ধ্রুব ভাইয়া। আমি বাড়ি যাব।”
ধ্রুব বিড়বিড় করল,” আমাকে একা ফেলে যাস না, লাবণ্য।”
লাবণ্য শুনলো না। নীরা দরজা ঠেলে আসলো তখন। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে বলল,” আপনার বুদ্ধি কবে হবে,মিস্টার ধ্রুব? আমার জন্য আপনাকে কে এতো বড়ো রিক্স নিতে বলেছিল, বলুন?”
ধ্রুব লাবণ্যর দিকে তাকালো। লাবণ্যর চোখের ভাষা পড়ার শিক্ষা সে ভুলে বসেছে। সেই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলো ধ্রুবর চোখের পাতায়। ধ্রুবর উচ্ছ্বসিত মন থমকে গেল তৎক্ষনাৎ উঁকি দিল আগুনের ঝঙ্কার। সে রিনরিনে সুরে লাবণ্যর উদ্দেশে বলল,” মিস নীরার সাথে আমার কিছু কথা আছে, লাবণ্য। তুই কী….?
লাবণ্য অবিশ্বাসের চোখে তাকালো। নীরার দিকেও চোখ পড়লো। নীরা মুচকি হাসছে। ভ্রু নাচিয়ে বলতে শুরু করল,” বড়োদের কথার মাঝে থাকতে নেই, মেয়ে! তুমি বাহিরে অপেক্ষা করো। আমাদের কথা শেষ হলে ডেকে দিব।”
লাবণ্য, ধ্রুব ও নীরকে একা রেখে কেবিন ত্যাগ করলো। তার গলা মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেল। তৃষ্ণায় ঢোক গিলল কয়েকবার। ভেতরের পারিবেশের কথা ভেবে হাত কচলাতে লাগলো। নীরা যদি সবটা বলে দেয়? ধ্রুব তো তাকে ভুল বুঝবে। এমনিতেও দূরত্ব কম হয়নি। তাদের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ভিজতে অনেক দেরী।
চলবে………..