বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব-৪৭

0
1550

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৭
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

কলেজ শেষে গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া। আজ সে বড্ড খুশি কারণ আজ রায়হান আসবে ওর সাথে দেখা করতে! সকালবেলা মেসেজ দিয়ে প্রিয়ার কলেজ ছুটির টাইম জেনে নিয়ে রায়হান জানিয়ে দিয়েছে ওর আসার কথা! পাঁচ মিনিট হলো দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া, বারকয়েক এদিক-সেদিক তাকাতেই চোখে পড়লো রাস্তা পার হয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসা রায়হানের দিকে! অফিসের ফর্মাল গেটাপ, দাড়িগুলোও ঠিকমতো শেভ করা। দেখতে বেশ স্মার্ট লাগছে তাকে। প্রিয়া পুনরায় ছোটখাটো একটা ক্রাশ খেয়ে ফেলে। এদিকে রায়হান ওর সামনে এসে হালকা হেসে বলে,

—কেমন আছো, প্রিয়া?

—ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

—আমিও ভালো আছি। কলেজ কখন ছুটি হয়েছে? বেশি দেরি করে ফেলিনি তো?

—নাহ, মিনিট পাঁচেক হলো দাঁড়িয়ে আছি। বেশিক্ষণ হয়নি।

—ঠিক আছে। চলো তাহলে?

—কোথায় যাবো, ভাইয়া?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়া। রায়হান ওকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে বুঝতে পারেনি সে। হাটতে হাটতেই রায়হান বললো,

—সকাল থেকে কলেজে আছো, নিশ্চয়ই খাওনি এখনো? কিছু খাই চলো।

প্রিয়া মনে মনে খুশি হলেও ভদ্রতার খাতিরে মুখে না বললো। ওর ইতস্ততা বুঝতে পেরে রায়হান বললো,

—আরে আমি তোমার একার জন্য বলিনি তো। আমিও সকালে খেয়ে বের হয়েছি। আজ হাফ আওয়ার ছিলো তাই এখনো লাঞ্চ করিনি। আমিও খাবো এজন্যই বলছিলাম।

—তাহলে চলুন৷

এবার প্রিয়া আর দ্বিমত করলোনা। আশেপাশেরই কোন একটি রেস্টুরেন্টে গেলো দুজন৷ প্রিয়া কি খাবে শুনে অর্ডার দিলো রায়হান। গল্পগুজব আর খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে দুজনের মাঝে এক সুন্দর সময় অতিবাহিত হলো!

________________

বড়াম্মু ও রাইসা দুপুরের খাবার খেয়ে উঠলো। আমি না খেয়ে চুপচাপ বসে সঙ্গ দিলাম তাদের। বড়াম্মু বেশ কয়েকবার খাওয়ার জন্য বললেন। আমি হাসিমুখে মানা করলাম। মুখে বললাম খেতে ইচ্ছে করছেনা কিন্তু আসল কারণ ভিন্ন যেটা উনাকে বলতে লজ্জাবোধ করলাম আমি। তবে রাইসার জন্য সেটাও সম্ভব হলোনা। বড়াম্মুকে উদ্দেশ্য করে মিটিমিটি হেসে বললো,

—বাদ দেন, মা। তুরফা এখন খাবেনা। ওর ইচ্ছে এখন অন্য কারও জন্য অপেক্ষায় আছে!

—মানে কি রাইসা? বুঝলাম নাহ।

—মানে হলো আপনার ছেলের বউ এখন আপনার ছেলের আসার অপেক্ষায় বসে আছে। আমার দুলাভাই ওরফে ভাসুর না আসা পর্যন্ত খাবেনা!

মুখ টিপে হেসে বললো রাইসা। ওর দিকে অগ্নিচোখে তাকালাম আমি তবুও ওর হাসির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলোনা! বড়াম্মু অবাক হয়ে বললেন,

—পূর্ণর জন্য অপেক্ষা করছে? ওর আসতে তো অনেক দেরি। তুরফা এতক্ষণ না খেয়ে বসে থাকবি?

—উনি একটু পরই আসবেন, বড়াম্মু। এজন্যই তো বসে আছি।

—বাহ! সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠলো আজ? পূর্ণ অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে! ব্যাপার কি বউমা? কি জাদু করলে আমার ছেলের উপর?

বিস্মিত সুরে আমায় ক্ষেপানোর উদ্দেশ্য বললেন বড়াম্মু। এদিকে রাইসা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে! আমি জানতাম এমন কিছুই হবে, এজন্যই বলিনি তাকে এতক্ষণ কিন্তু রাইসাটার জন্য আমায় এভাবে লজ্জার সম্মুখীন হতে হচ্ছে! বারকয়েক চোখের পলক ফেলে কিছু বলার আগেই রাইসা হাসতে হাসতে বললো,

—আপনার বউমা বাসায় বসে বোর হচ্ছিলো। বরের কাছে আবদার করেছে আজ বাহিরে ঘুরার। বউয়ের মন ভালো রাখতে বরও রাজি হয়ে গেছে!

ওর কথা বলার ধরন শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি! মেয়েটা এভাবে আমায় লজ্জায় ফেলবে জানলে আমি কথাগুলো ওকে কস্মিনকালেও বলতাম না। দ্রুত স্বরে বড়াম্মুকে বললাম,

—এমন কিছুই না, বড়াম্মু। রাইসা একটু বেশি বেশিই বলছে। আসলে প্রিয়ার জন্মদিন আসছে না সামনে? তাই ভাবলাম ওর জন্য কিছু গিফট কিনে আনি। উনাকে এজন্যই বলেছিলাম তাই তিনিও রাজি হয়ে গেছেন। এটাই আসল কারণ!

আমার ইতস্তত মুখের দিক চেয়ে হেসে ফেললেন বড়াম্মু। খাবারের প্লেটগুলো তুলতে তুলতে বললেন,

—আরে পাগলি, এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? নিজের বরের সাথেই ঘুরতে যাচ্ছিস অন্য কারও সাথে তো না! অসস্তি ভুলে খুশিমনে যা। তবে তোর কথা কিন্তু আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলাম নাহ ৷ আমিও রাইসার সাথে একমত।

—মানে?

গোলগোল চোখে জিজ্ঞেস করলাম আমি। বড়াম্মু যেতে যেতে দুস্টু গলায় বললেন,

—শুধুমাত্র প্রিয়ার জন্মদিনের গিফট কিনার উদ্দেশ্যে পূর্ণ কখনোই অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি আসতোনা। অফিস শেষ করে গিফট কিনতে যেতে চাইতো। আমার ছেলের দ্রুত বাড়ি ফেরার পিছুটান কি হতে পারে সেটা ওর মা ঠিকি বুঝতে পারে!

বড়াম্মুর কথায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো দু গালে। হালকা হেসে রুমের উদ্দেশ্যে চলে এলাম আমি। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় প্রিয়ার মেসেজ এলো ফোনে,

“ভাবী, আমি এখন রায়হান ভাইয়ার সাথে লাঞ্চ করতে এসেছি। আম্মু জানে আমি ফ্রেন্ডদের সাথে খেতে এসেছি। একটু পর আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। উনি আমাকে বাসায় ড্রপ করে তার বাসায় চলে যাবে”

ওর মেসেজে বিস্মিত হলাম। দেখাও করে ফেললো এত তাড়াতাড়ি! বাহ ভালোই চলছে তাহলে। দ্রুত হাতে টাইপ করলাম,

“ওকে। তুমি ভালোভাবে বাসায় এসো। আসার পর সব শুনবো তোমার থেকে”

প্রিয়ার সাথে কথা বলে যেই না ফোন রেখে দাঁড়িয়েছি হঠাৎই আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন পূর্ণ। প্রথমে চমকে উঠলেও পরমুহূর্তে লাজুক হাসি খেলে গেলো মুখে! আমার চুলের ভাজে মুখ গুজে উনি বললেন,

—কার সাথে এত হেসে হেসে টাইপিং করছিলে, বউ?

—বয়ফ্রেন্ডের সাথে করিনি। চিন্তা করেন না।

উনাকে রাগানোর জন্য কথাটি বলেই মুখ টিপে হেসে ফেললাম আমি। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা কারণ হঠাৎই ঘাড়ের চিনচিনে ব্যথা কুকড়ে উঠলাম আমি। অসভ্য লোকটা কামড় বসিয়েছেন ঘাড়ে, ফুরফুরে মেজাজটা নিমিষেই বিষিয়ে গেলো। উনাকে ছেড়ে পেছনে ফিরতেই রাগী চোখে তাকালাম আমি। উনি আমার চেয়ে দ্বিগুন রাগ দেখিয়ে বললেন,

—ভালো মুড কিভাবে নস্ট করতে হয় তা তোমার থেকে শেখা উচিত মানুষের। মেজাজটাই খারাপ করে দিলে বুঝেছো?

—তাই না? আপনিও কম যান কিসে? একটু মজা করেছি বলে এমন করবেন? খারাপ লোক কোথাকার।

—হ্যাঁ, আমি তো খারাপই। এজন্যই তোমার কথায় অফিস থেকে নিজের মিটিং প্রান্তকে সামলাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি তোমার মন ভালো করার জন্য। ভালো হলে এতক্ষণ অফিসেই পড়ে থাকতাম। নর্মাল কথা জিজ্ঞেস করেছি তাতেও পেচিয়ে উত্তর দিতে হলো তোমার!

অভিমানি কণ্ঠে বললেন পূর্ণ। হাত-মুখ ধুতে গেলেন সাথেই সাথেই। উনাকে সরুচোখে পর্যবেক্ষণ করলাম আমি! একটু আগের হাসোজ্জল মুখটা কেমন নীরস লাগছে। উনি কি মন খারাপ করলেন নাকি? ভাবতে ভাবতেই বিছানায় বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে এলেন পূর্ণ। আড়চোখে তার দিকে তাকালাম আমি। এখনো প্যাচার মতো মুখ করে রেখেছেন। আমি কি এমন কিছু বলেছি? মনে মনে হালকা অনুতপ্ত হলাম। উনি কথা বলছেন না আমার সাথে আর। আর বসে থাকতে না পেরে দ্রুতকদমে হেটে গেলাম বারান্দায়। পূর্ণ সবে মাত্র মুখ মুছে পাশ ফিরেছেন। এই সুযোগে আলতো করে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—আপনি কি মন খারাপ করেছেন? আমি সত্যিই ওভাবে ভেবে বলিনি। মন খারাপ করবেন না প্লিজ।

কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো, পূর্ণ এখনো কিছু বললেন নাহ। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনাকে ছাড়তে উদ্যত হতেই দৃঢ় হলো তার বলিষ্ঠ হাতের বন্ধন। আমার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

— পূর্ণ এত সহজে মন খারাপ করেনা বুঝলে? তাও তুর পাখির ওপর? এ তো অসম্ভব। আমার মন খারাপে তুমি কেমন বিচলিত হও দেখতে চাইছিলাম আর কি!

শেষের দিকে খানিকটা হেসে বললেন কথাটা। যে হাসি দেখে ক্ষিপ্ত হলাম আমি! উনি আমায় এতক্ষণ বোকা বানালেন? রেগে ছাড়াছাড়ি করতে যেতেই পূর্ণ হেসে আমায় ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

—এখন মন খারাপ করিনি ঠিক আছে। কিন্তু আমার থেকে কখনো কিছু লুকোবেনা, তুরফা। যদি বড় কিছু তুমি আমার থেকে লুকোও আর আমি পরে সেটা জানতে পারি ওইদিন কিন্তু আমি ঠিকই মাইন্ড করবো। তুমি তো আমাকে চেনোই।

পূর্ণর কথায় শুষ্ক ঢোক গিললাম আমি। মাথায় সাথে সাথেই খেলে গেলো প্রিয়া ও রায়হান ভাইয়ার কথা৷ মুহুর্তেই কপালের কোণে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘাম! আমার কি উনাকে বলে দেওয়া উচিত প্রিয়ার কথা? কিন্তু আমি যে ওকে কথা দিয়েছি সেটার কি হবে? দুশ্চিন্তায় মাথাও কাজ করছেনা ঠিকমতো আমার! এসব ভাবতে ভাবতেই উনার দিকে আড়চোখে তাকাতেই পূর্ণ হঠাৎ খোলা গলায় গেয়ে উঠলেন,

“ভাল্লাগে চাইলে তুই আড়চোখে
চাইছি তোর ওই দুচোখ আর তোকে”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমি অন্যদিক ফিরতেই পূর্ণ চলে যেতে যেতে বললেন,

—আড়চোখে তাকানোর অভ্যাস তোমার কবে যাবে, তুর পাখি? কিছু বলার থাকলে এখনি বলতে পারো, আমি রাগ করবোনা।

একদিকে প্রিয়া অন্যদিকে পূর্ণ। কোনদিকে যাবো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝলাম নাহ! এখন মনে হচ্ছে উনাকে আজ তাড়াতাড়ি আসতে বলেও ভুল করেছি! এতক্ষণের শান্ত মন যেন নিমিষেই অশান্ত হয়ে গেলো আমার!

#চলবে