বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব-১৩

0
1996

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৩
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাত পেরিয়ে শুরু হলো সকাল। সেই সাথে শুরু হলো বাড়িভর্তি সমগ্র মানুষের ব্যস্ততা! আন্টি সকাল থেকে রান্নাঘরে রান্না করছেন আর একটু পর পর একটা করে আইটেম বানিয়ে আংকেল বা রায়হান ভাইয়াকে খাইয়ে টেস্ট করে নিচ্ছেন যে কেমন হয়েছে! আমিও টুকটাক সাহায্য করছিলাম আন্টিকে। আর দাদি বরাবরের মতোই বসে বসে তদারকি করছিলেন সবকিছুর। সবাই মিলে ঘর গুছিয়ে সবকিছু রেডি করে নিজেরা গোসল করে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
এখন আর তেমন কাজ বাকি নেই, শুধু রাইসার শশশুড়বাড়ির লোকজনদের আসার অপেক্ষা!

দুপুর হতেই আমাদের বাসায় পৌঁছে গেলেন প্রান্ত ভাইয়ার পরিবার। গেইট খুলে সবাইকে হাসিমুখে বরণ করলেন আংকেল-আন্টি। ছোট বড় সবাই মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। তারপর খাবার খেতে বসলেন সবাই। খাওয়া শেষে রেস্ট নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে গলা ঝেড়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। হাসিখুশি পরিবেশ হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন উনার দিকে।

—দেখুন বেয়াইন, এখন যে কথাটা বলতে যাচ্ছি এটা একটু গুরুত্বপূর্ণ।

“গুরুত্বপূর্ণ” শুনে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। আমিও কান পেতে রইলাম আংকেল কি বলেন শুনার জন্য। জানার আগ্রহ তো আমার কাল থেকেই হচ্ছিলো! শুনলাম আংকেল বলছেন,

—আপনাদের সাথে তো এখন আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। এখানে তো লুকোনোর কিছু নেই তাইনা?

—জি ভাই। কি হয়েছে বলেন।

—আপনাদের সম্পর্কে সব জেনেশুনেই আমরা বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছি। আপনারা ফ্যামিলি ভালো, কালচার আমাদের সাথে মিলে। তবে আপনাদের একটা বিষয়ে আমরা এখনও স্পষ্টভাবে কিছু জানিনা।

আংকেল এর কথায় ভ্রু কুচকে গেলো সবার। কি এমন কথা তাদের বলা হয়নি? রাইসার বাবা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন,

—বলছেন কি ভাই? কি এমন বিষয় আছে যেটা আপনারা জানেন না? আমাদের বলুন। আশা করছি কিছু গোপন রাখবো নাহ।

—আপনাদের বাসার সবার সম্পর্কেই আমরা জানি কিন্তু তুরফা মামনির ব্যাপারে তো কিছু জানিনা। সেদিন ইংগেজমেন্ট এর দিন ভাবীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়েছিলো তাই শুনতে পারিনি আর!

হঠাৎ করে আলোচনার মধ্যে আমার নাম আসায় চমকে উঠে তাকাই আমি। খেয়াল করি ইতোমধ্যে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে! বেশ অসস্তি হচ্ছে আমার এমন পরিস্থিতিতে। মনে মনে ভাবলাম আংকেল এর আবার কি দরকার পড়লো আমার কথা শুনার। আমাকে আলোচনা থেকে দূরে রাখলেই কি নয়? তবুও জানার আগ্রহ আমার পিছু ছাড়ছিলো না তাই চুপচাপ শ্বাস আটকে পরবর্তী কথাগুলো শুনার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি।

—তুরফা আমাদের সাথে ছোট থেকেই থাকে। ও আমার নিজের রক্তসম্পর্কের কেউ না হলেও আমার কাছে কোন অংশেই সে রাইসার থেকে কম নয়। তুরফা আমার মেয়ের মতোই বলতে পারেন।

আস্তেধীরে বললেন আন্টি। তার কথায় যেন কৌতুহল বেড়ে গেলো পূর্ণ ভাইয়ার পরিবারের। পূর্ণ ভাইয়ার মা জিজ্ঞেস করলেন,

—আচ্ছা বেয়াইন, তুরফার পরিবার কোথায়? আর বললেন যে ও ছোট থেকেই আপনাদের সাথে থাকে। এর মানে? ওর পরিবারে কি কেউ নেই??

নিজের পরিবারের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। না জানি আর কতবার এই কথাটা শুনতে হবে? যারাই শুনে আমি আন্টির নিজের মেয়ে না তারা সবাই এসব প্রশ্ন করে আমাকে ও আমার পরিবারকে নিয়ে! পূর্ণ ভাইয়ার মায়ের কথায় আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব বলতে লাগলেন। আর যতই হোক মেয়ের শশুড়বাড়ীর লোকজন বলে কথা! তাদের থেকে এই মুহুর্তে কিছু লুকানো ঠিক হবেনা।

—তুরফা আমার বান্ধবীর মেয়ে। অবশ্য শুধু বান্ধবী বললে ভুল হবে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে একজন ছিলো ওর মা। ওর বাবাও ছিলেন অমায়িক একজন মানুষ। রাইসার বাবার ব্যবসা দাড় করাতে খুব সাহায্য করেছিলেন ভাই। দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তুরফা আমাদের বাসায় রাইসার সাথে খেলতে এসেছিলো। ওকে নিতে এখানে আসছিলো ওর মা-বাবা। পথিমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন উনারা। রাস্তার মানুষ ওর মায়ের ফোন থেকে আমাদের ফোন দিলে আমরা তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই। কিন্তু আমরা যতক্ষণে হসপিটালে পৌঁছাই তুরফার বাবা ইতিমধ্যেই পরলোক গমন করেছিলেন। ওর মায়ের অবস্থাও ছিলো খুব খারাপ। ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে বারবার আমার হাত ধরে বলছিলো ওর কিছু হলে যেন আমি তুরফাকে দেখে রাখি, ওকে আমার সাথে করে নিয়ে যাই। কারণ তুরফার দাদারবাড়ির লোকজনদের সাথে ওর মা-বাবার সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলোনা। তাছাড়া আমরাও ওর পরিবারের কারও কথা জানতাম না এজন্য ওর মা-বাবার মৃতুর পর তুরফাকে আমাদের সাথেই নিয়ে আসি। রাইসা আর তুরফা প্রায় সমবয়সী হওয়ায় ওকেও রাইসার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। এভাবেই চলছে সবকিছু তখন থেকে।

এতদিন পর আমার অতীত সম্পর্কে সবকিছু শুনে আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না আজ নিজেকে। ঠোঁট উল্টিয়ে বিনাশব্দে কাদতে লাগলাম চুপচাপ। এদিকে কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি পড়েছে আন্টিরও। পূর্ণ ভাইয়ার মায়ের চোখেও এসেছে জল। আন্টি নিজের চোখের পানি মুছে বললেন,

—মেয়েটা অনেক ভালো, বেয়াইন। কিন্তু ওর কপালটা বড্ড খারাপ। এইটুকুন একটা মেয়ের সাথে ভাগ্য এত নিষ্ঠুর না হলেও পারতো। ওর ভবিষ্যত নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। যতদিন না ওকে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়েছি ততদিন ওর মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবোনা আমি।

এতক্ষণ ধরে আন্টির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। উনি হঠাৎ বললেন,

—আচ্ছা ভাবী, ওর মা-বাবার নাম কি আপনি বলতে পারবেন? এমন যদি হয় যে ওর পরিবারকে কোনভাবে খুজে বের করা যায়?

—ওর পরিবারকে খুজে বের করার চেস্টা করেছিলাম, বেয়াইন সাহেব। কিন্তু শুনেছিলাম তারা নাকি আর দেশে থাকেন না৷ তাই এরপর আর তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।

—ওর বাবার নামটা আমাকে বলেন। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে বহু ব্যবসায়ীকেই চিনি আমি। আপনি যেহেতু বললেন ওর বাবার ব্যবসা ছিলো তাই হতেও পারে আমি উনাকে চিনতাম।

—হ্যাঁ, তাই তো। এটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি আমার! অবশ্য আপনি আরেকটা কারণেও চিনতে পারেন কারণ তুরফার বাবাও চৌধুরী বংশের ছিলেন৷ কে জানে আপনাদের দূরের কোন আত্মীয়ও হতে পারেন তারা। ওর বাবার নাম ছিলো …

—ইরফান চৌধুরী?

আন্টির বলার আগেই পূর্ণ ভাইয়ার বাবা বলে উঠলেন কথাটা। নিজের বাবার নাম উনার মুখে শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। একিসাথে অবাক হলেন রাইসার মা-বাবা সহ পুরো পরিবার! আন্টি কোনরকম নিজেকে সামলিয়ে বললেন,

—হ্যাঁ, ভাই। কিন্তু আপনি কি চিনতেন উনাকে?

আন্টির মুখে “হ্যাঁ” শুনে মুহুর্তেই চকচক করে উঠলো পূর্ণ ভাইয়ার বাবার চোখ। একটু পর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাদতে লাগলেন পূর্ণ ভাইয়ার বাবা। একের পর অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে দেখে আমার মনের মধ্যে উশখুশ করতে লাগলো! আংকেল কিভাবে জানেন আমার বাবার কথা? তাহলে উনি নিশ্চয়ই চিনবেন আমার পরিবারকে? আর না চিনলে কাদবেনই বা কেন?? আজ কি তবে এতদিনের খোজ পূরণ হবে আমার?!
দুরুদুরু বুকে আংকেলের দিকে চেয়ে রইলাম আমি।

হঠাৎ দেখি চোখের পানি পূর্ণ ভাইয়ার বাবা এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। সবার উৎসুক দৃষ্টি এখন আংকেল আর আমার দিকে। আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে উনি হাত রাখলেন আমার গালে। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—তুমিই আমাদের তুরফা?

“আমাদের তুরফা” শব্দটা বিদ্যুৎ এর মতো খেলে গেলো আমার মাথায়। হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগলো! তবে কি উনারা আমার পরিবারের মানুষ? চোখ বড় বড় করেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আংকেলের দিকে। আমার চোখের ভাষা হয়তো বুঝতে পেলেন উনি, তাইতো বলে উঠলেন,

—মা রে,সম্পর্কে আমি তোর বড় চাচা হই। তোর বাবার একমাত্র বড় ভাই। তোর বড়আব্বু।

পূর্ণ ভাইয়ার বাবার কথা শুনে যেন বাজ পড়লো রুমের মধ্যে! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন সবাই যেন কেউই ভাবেননি তিনি এমন কথা বলবেন! আংকেল এর কথা কানে আসতেই মুহুর্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো আমার। টলমলে পানিগুলো টাল সামলাতে না পেরে বেয়েই পড়লো দুচোখ গড়িয়ে। কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও কথাগুলো যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে ভেতরে। এ অঅনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়! কোনরকম অস্পষ্ট গলায় বললাম,

—আ-আপনারা আমার পরিবার?

বড়াব্বু হালকা হেসে মাথা নাড়লেন। এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতর চেপে রাখা শ্বাস ছাড়লাম আমি! সত্যকে অনুধাবন করে অনুভুতি প্রখর হয়ে উঠলো আমার! এদিকে আমার চোখ দিয়ে বইছে হাজার প্রশ্নের জোয়ার। কোথায় ছিলেন উনারা এতদিন? কেন নিতে আসেননি আমায়? আর অপরদিকে, বড়াব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছেন আমায়। যেন এত বছর পর মন ভরে দেখছেন!
প্রায় সাথে সাথেই পূর্ণ ভাইয়ার মা অর্থাৎ বড়মা এলেন আমার কাছে। দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলেন আমার। এতক্ষণে হুহু করে কান্না শুরু করে দিয়েছি আমি! নিজের আবেগকে কোনভাবেই আর কন্ট্রোলে রাখতে পাচ্ছিনা আজ!! এতদিনের পরিবারের প্রতি জমানো সব মান-অভিমান, আক্ষেপ, ভালোবাসা সব যেন তাদের ফিরে পেয়ে একসাথে ভীড় জমিয়েছে আমার কাছে।

বড়মাকে জড়িয়ে ধরেই কাদতে কাদতেই মাথা ঘুরে উঠলো আমার। হঠাৎ করেই এত আবেগের ধাক্কা সইতে পারলো না আমার ছোট্ট মন। আর কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই জ্ঞান হারালাম আমি…

#চলবে