#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩১
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
আকাশ হতে বিন্দু বিন্দু জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে আপন গতিতে। মেঘরাশি একেঅপরের সাথে ঝগড়ায় ব্যস্ত, বাতাসের গতিবেগও বাড়ছে ক্রমশ। এরই মাঝে ছাদে দাড়িয়ে আছি পূর্ণ আর আমি। না উনি নিজে নিচে যাচ্ছেন, না আমাকে যেতে দিচ্ছেন। উনার শক্ত হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ আছে আমার ছোট্ট হাতজোড়া। যে দৃঢ় হাতের বন্ধন ছিন্ন করার শক্তি, সাধ্য কোনোটাই আমার নেই!
পূর্ণ শুধুই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। বৃষ্টির মাঝে এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণে উনার চোখজোড়া খানিকটা লালচে হয়ে আছে, তবে এই লাল বর্ণটা কি নিছক বৃষ্টির কারণে নাকি অন্য কোন কারণে আমি ঠিক বুঝতে পেলাম নাহ। উনি-আমি কিছু বলার আগেই মেঘদ্বয় ক্ষিপ্ত হয়ে ডেকে উঠলো প্রবল স্বরে। যে গর্জনে ভীষণভাবে কেপে উঠলাম আমি। চোখমুখ খিচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনোরকম। বৃষ্টি আমার পছন্দ হলেও বিদ্যুৎ একেবারেই পছন্দ নাহ, খুব ভয় লাগে বিদ্যুৎ চমকালে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পূর্ণ তড়িৎ বেগে টেনে নিলেন আমায়, আলতো করে আমার মাথা চেপে ধরলেন তার বুকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়ে বন্ধ চোখদ্বয় খুলে ফেললাম আমি। বৃষ্টিতে ভিজে উনার সাদা শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, যার দরুন তার বুকে মাথা রেখে তার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পেলাম আমি। উনার কি জ্বর এসেছে নাকি? গা এরকম গরম কেন তার? আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পূর্ণ কোমল কন্ঠে বললেন,
—এত ভয় পাচ্ছিলে কেন তুমি? রিল্যাক্স। আমি আছি না তোমার সাথে? আর কখনো এভাবে ভয় পাবেনা।
উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। এদিকে তার নরম কথায়-আচরণে এতক্ষণের অভিমান ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো আমার! তবু কিছু না বলে চুপচাপ উনার সাথে লেগে থেকে তার বুকের মাঝে কম্পনরত ধুকপুক ধ্বনি শুনতে লাগলাম আমি। খানিকবাদে পূর্ণ আবার বললেন,
—কথা বলছোনা কেন আমার সাথে, তুরফা? কিছু বলো। তখন থেকে তুমি একটা কথাও বলোনি আমার সাথে।
যদিও পূর্ণর উপর জমা অভিমান আমার আগেই ধুয়ে গেছে তবুও উনাকে খানিকটা জালাতন করতে উতলা হলো মন! গলায় কৃত্তিম রাগ মিশিয়ে বললাম,
—কেন কথা বলবো আপনার সাথে? আপনি কথায় কথায় আমার উপর রাগ দেখান। আমিও রাগ করেছি আপনার উপর।
—তখন আমার মাথা গরম ছিলো খুব। তোমায় তো একবার বলেছিলাম আমার কাজ আছে তুমি তাও জিদ করছিলে। এজন্য রাগের মাথায় ধমক দিয়েছি।
—কখন কাজ থাকেনা আপনার? যখনই কিছু বলি তখনি শুধু কাজ কাজ আর কাজ!! আমার জন্য তো সময়ই নেই আপনার কাছে। আবার আমাকে খোটাও দিয়েছেন ফাকা বসে আছি বলে। ভার্সিটিতে যাই আগে, অনেকগুলো ছেলেবন্ধু বানাবো আর ওদের সাথে ঘুরতে বেড়াবো। আপনার ফ্রি হওয়ার আশায় থাকলে এ জীবনে আর কোনকিছু করা হবেনা আমার!!
আমার কথায় পূর্ণ আচমকাই ছেড়ে দিলেন আমায়। কোনমতে টাল সামলিয়ে দাড়ালাম আমি। এরই মাঝে পূর্ণ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
—কথা বলতে বলেছি তার মানে এই নয় যে যা মন চায় তা-ই বলবে! খুব সাহস বেড়েছে তোমার, তাই না? পা ভেঙে বাসায় রেখে দিবো, বেয়াদব।
—আসছেন আমার পা ভাংতে। শখ কত! আপনি পা ভাংগার আগেই আমি ওদের সাথে পালিয়ে যাবো।
—তুরফা। আমায় রাগিয়ো না বলছি। এখন আমি রেগে কিছু বললে পরে আবার তুমিই কস্ট পাবে।
শক্ত চোয়ালে বললেন উনি। উনার মুখের দিক তাকিয়ে এ মুহুর্তে চুপ করাটাই ভালো মনে করলাম আমি। তাই কথা না বাড়িয়ে তাকে মুখ ভেংচিয়ে চলে আসছিলাম। এমন সময় উনি পেছন থেকে বললেন,
—কেউ রাগ করেছিলো বলে তার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিলাম। সে এখন আমায় রাগিয়ে দিয়েছে তাই এগুলো আমি নিজের কাছেই রাখছি।
চকলেটের কথা শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি পূর্ণর হাতে আমার প্রিয় ডার্ক চকলেট। কত্তদিন খাইনি এটা! খুশি হয়ে উনার কাছে থেকে চকলেট নিতে ধরতেই উনি হাত উচুতে তুলে বললেন,
—এখন নিতে চাচ্ছো কেন? তখন রাগ ভাংগিয়ে নিজে থেকে দিতে চাচ্ছিলাম সেটার তো সুযোগই দিলেনা। উলটো রাগিয়ে দিলে আমায়। এখন এমনি এমনিই কেন দিবো তাহলে তোমায়? ধরতে পারলে দিবো, তাছাড়া নয়।
উনার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমি কি জানতাম উনি চকলেট আনবেন আমার জন্য? আর দিতেই যখন এসেছে তখন এসব নাটক করার কি আছে! উনি কত লম্বা, তার মধ্যে হাত উচু করে উপরে উঠিয়ে রেখেছেন। আমি তো লাফিয়েও তার উচু করা হাতের নাগাল পাবোনা। তাই জ্বালাময়ী কন্ঠে বললাম,
—দিতে মন চাইলে সরাসরি দিবেন। নাহলে দিবেন নাহ। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আর কোন তামাশা করতে মন চাইছেনা আপনার সাথে আমার।
আমার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের বিপরীতে উনি সামান্য হাসলেন। তারপর আমার হাত ধরে টেনে সেহাতের মুঠোয় দিয়ে দিলেন চকলেটটা। হঠাৎই আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,
—ছোট্ট একটা মানুষ হয়ে এত তেজ কোথা থেকে পাও তুমি? আমার উপরও রাগ দেখানো শিখেছো আজকাল! খুব বউ বউ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তোমার মধ্যে, তুরফা। ব্যাপার কি?
বাকা হেসে বললেন উনি। তার কথার বিপরীতে কোন কথা বললাম নাহ আমি। গরম হওয়া গাল লুকোতে অন্যদিকে তাকালাম। পূর্ণ হাল্কা হেসে নিচে যেতে যেতে বললেন,
—অনেক হয়েছে। এবার জলদি নিচে এসো। কতক্ষণ ধরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো সে খেয়াল আছে? ঠান্ডা লাগলে কি হবে? স্টুপিড।
উনার কথায় বোকা বনে গেলাম আমি। নিজেই আমায় বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে রাখলেন এতক্ষণ আবার এখন নিজেই বকছেন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য! খারাপ লোক একটা।
______________
পূর্ণর পিছু পিছু সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাতে রাখা চকলেটটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম আমি। হঠাৎই মনে পড়লো ছোটবেলার কথা। উনি তখনও আমার জন্য চকলেট আনতেন। পুরনো স্মৃতি মনে হতেই হাসির রেখা চলে এলো ঠোঁটের কোণে। মুচকি হেসে বললাম,
—থ্যাংকিউ, তাজওয়ার ভাইয়া।
আমার ডাকে থমকে গেলেন পূর্ণ। আচমকাই পা থেমে গেলো উনার, যার দরুণ উনার পিঠের সাথে সামান্য ধাক্কা খেলাম আমি। ভাগ্যিস এতক্ষণে আমরা সিড়ি থেকে নেমেছি নয়তো দুজনেই পড়ে যেতাম, মাথায় হাত ডলতে ডলতে ভাবলাম আমি।
এদিকে পূর্ণ অবাক চোখে বললেন,
—এতদিন পর এ নামে ডাকছো যে?
আমি স্মিত হেসে বললাম,
—আসলে আমি সেদিনই অফিসে গিয়ে জেনেছি যে আপনিই তাজওয়ার ভাইয়া। যদিও তখনই কথা বলতে চেয়েছিলাম এ ব্যাপারে। কিন্তু পরে বলবো বলবো করে আর সুযোগই হয়নি।
পূর্ণ চোখে বিস্ময় ঢেলে বললেন,
—তুমি অফিসে গিয়ে জেনেছো মানে? আমাদের বিয়ের দিন শুনোনি আমার পুরো নাম?? তুমি কি বলছো এসব, তুরফা?
উনার কথায় খানিকটা লজ্জাই পেলাম আমি। আসলেই বিয়ের দিন ক্ষুধায় অসস্তিতে আমি কোনকিছুই ঠিকমতো খেয়াল করিনি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়ে করছিলাম যেহেতু তাই কোনমতে কবুল বলে দিয়েছি। এখন এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট লজ্জিত। তাই ভীষণ ইতস্ততভাবে বললাম,
—আসলে বিয়ের দিন শরীরটা ভালো ছিলোনা আমার। আপনি তো দেখেছিলেনই আমার কেমন অবস্থা হয়েছিলো। ওর মধ্যে কি আর খেয়াল করবো বলুন। কোনরকম বিয়ে সেড়ে ফেলার চিন্তায় ছিলাম শুধু আমি।
আমার কথা শুনে পূর্ণ হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আহত গলায় বললেন,
—অথচ আমাদের বিয়ের সবকিছু আমার মনে আছে। তোমার ক্লান্ত মলিন চেহারা, তোমার কবুল বলা, আমার কবুল বলা। ভেবেছিলাম তুমি ক্লান্ত হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে মনোযোগী ছিলে। কিন্তু আমার ধারণাকে তুমি ভুল প্রমাণ করলে। এত খামখেয়ালিপনা কেন তোমার মধ্যে, তুরফা?
পূর্ণর কথার বিপরীতে কি জবাব দিবো আমি তৎক্ষণাত ভেবে পেলাম নাহ। হঠাৎ করেই যেন অপরাধবোধ কাজ করলো নিজের মধ্যে। পূর্ণ তো ভুল কিছু বলেন নি, ভুল আমারই ছিলো। কিন্তু আমি নিজেও ইচ্ছা করে অমনোযোগী ছিলাম নাহ। পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো। উনাকে কিভাবে বুঝাবো বুঝতে পারলাম নাহ। তবুও কাচুমাচু করে উনাকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমায় জোরেশোরে ডাকলেন দাদি। দাদির কন্ঠ শুনে পূর্ণ একবার আমার দিক চেয়ে চলে গেলেন রুমে, আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ চলে গেলাম দাদির কাছে।
_________________
কাজিনমহলের সাথে গল্পগুজব করে রাতের খাবার খেয়ে পূর্ণর রুমে চলে আসলাম আমি। দাদি নিজেই আজ পাঠিয়েছেন আমায় উনার রুমে। বেশি মানুষ হয়েছে বিধায় বাকি রুমগুলোই অন্যরা গাদাগাদি করে থাকবে। যাই হোক, রুমে এসে দেখি পূর্ণ বালিশছাড়া চুপচাপ শুয়ে আছেন উপর হয়ে। উনাকে এভাবে দেখে ভ্রু কুচকে গেলো আমার। কি হয়েছে লোকটার? ডিনারেও তেমন কথা বললেন না আজ কারও সাথে, আগে আগে খেয়েই চলে এলেন। আমি ভেবেছিলাম সবসময়ের মতো এবারও উনার কাজ আছে তাই এমন করছেন কিন্তু উনি তো চুপচাপ শুয়ে আছেন রুমে! ব্যাপার কি?
খাটের কোণে গিয়ে পূর্ণর পাশে বসে উনাকে ডাকলাম বার কয়েক। উনি সাড়া দিলেন নাহ। ভাবলাম ঘুমোচ্ছেন তাই উনার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে দেওয়ার জন্য তার গলার নিচে হাত দিতেই চমকে উঠলাম আমি। শরীর ভীষণ গরম উনার, জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে গা! জ্বরের প্রকোপে তার ফর্সা চেহারা যেন ফ্যাকাশে গেছে। তার এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় ভয়ে ঘামছুটে গেলো আমার। কাপা কাপা হাতে উনার মাথায় হাত রেখে কি করবো ভাবতে লাগলাম আমি…
#চলবে
গত পর্বে অনেকেই আমের কথা জানতে চেয়েছিলেন। শরতকালেও কিছু প্রজাতির আম হয়, যার মধ্যে গৌরমতি এক প্রজাতি। আমাদের এদিকে আছে। তাই গল্পে এড করেছিলাম। আর শীতকাল-শরতকালের মধ্যে অনেকে কনফিউজড। বিষয়টা এই ছিলো যে শরতের রাত থেকেই গ্রামাঞ্চলে হালকা হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। শহরে যেটা বুঝা যায়না তবে গ্রামের দিকে প্রকৃতির আসল রুপবদল বুঝা যায়। আশা করি সবাই ক্লিয়ার হয়েছেন।