বৃষ্টির রাতে পর্ব-২৩

0
243

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(২৩)

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আমেজে রাতটা শেষ হলেও সকালের শুরুটা নীলাভ আকাশে পলকা মেঘের ছড়াছড়িতেই হয়েছে। সূর্য্যিমামাও আজ পাল্লা দিয়ে রোদে ভাসাচ্ছে শহরের আনাচকানাচ। বেলকোনিতে লোহার গ্রিল থাকায় তাসিন নিশ্চিন্তে বেলকোনি আর জানালা খোলা রেখেই ঘুমায়। নতুন জায়গায় দু রাতের মধ্যে প্রথম রাতের ঘুমটা তার ভালো না হলেও আজ রাতটা দারুণ ঘুমে কেটেছে। আর তাই হয়ত সকালের এই কাঁচ মিঠা রোদ্দুর গায়ে পড়তেও আলস্যতা বিছানা ছাড়তে দিচ্ছে না। বিছানা হাতড়ে ফোনটা নিয়ে সময় দেখে নতুন করে ফোন এলার্ম সেট করলো। সাড়ে আটটায় উঠেই সে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সারবে। অফিসে পৌঁছুতে তার হাতে গুনে দশ মিনিট রাখলেই এনাফ। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ , সে আবারও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উঠেই সে অফিসেও চলে গেল। আজকের নাশতাটা তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। পরোটার সাথে বুটের ডাল আর সেদ্ধ ডিম দিয়েছিল। ডিম আর একটা পরোটা ডাল ছাড়াই খেয়ে এসেছে। এমন ডাল সে কখনোই খেতে পারে না। আপাতত এগারোটা বাজার অপেক্ষা নিয়ে কাজে মনোনিবেশ করলো। ডেস্কে এসেই আজ কালকের চেয়েও বেশি ফাইল দেখতে পেল। কোডিংয়ের কিছু কাজ নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল আজ শুরু থেকেই এখন আর হেল্প না নিলে হবেই না বুঝতে পেরে বসের কেবিনে যেতে হলো। ফোনটা তাসিন ডেস্কের ওপরই ফেলে গেছে। মাত্রই সুপ্রভা একটা মেসেজ দিয়েছে বলা যায় শুভ সকাল শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে, “আপনার তুফানহীন দিন ভালো কাটবে।”

রাতভর তুমুল বর্ষণে ভেজা গ্রামের প্রতিটি পথঘাট ভিজে স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। গাছের পাতার চকচকে রঙ এখন সূর্যের আলোয় ক্যানভাসে আঁকা এক সবুজাভ হয়ে চোখ ধাঁধাচ্ছে। আয়নার পড়াশোনায় মন একদমই বসতে চায় না। মনটা সারাক্ষণই পড়ে থাকে সেই সুদূর শহর ঢাকায় যেমনটা আগে থাকতো চট্টগ্রামে। তাসিন ভাইয়ের প্রতি তার যে আকর্ষণ তা দিনকে দিন বর্ষায় হঠাৎ আসা পানির মত বেড়েই চলছে। না না উপমা বোধহয় ঠিক হলো না এই তীব্র জোয়ার বর্ষার নয়। বর্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য হলেও তা এক সময় ঠিকই ফিরে যায়, শুকিয়ে যায়, পানি কমে। কিন্তু তার এই ভালোবাসা আর আকর্ষণ কখনোই কমবে না তা সে জানে। তাসিন ভাই তার মনের ঘরে আজীবন রাজত্ব করবে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে। সকালের এই সতেজ, স্নিগ্ধ আবহাওয়া তাকে বারবার তাসিনের মুখটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মাত্র কদিন আগেই তো সে তাকে কি পরিমাণ অপমান করে গেছে তবুও বেহায়া মনটা আর কিছুতেই মানছে না বাঁধা। তার অপরিণত বয়সের কিছু অপরিপক্ক ধারণা আজকাল খুব বাজেভাবে মনে গেঁথে গেছে। কদিন ধরেই কলেজে বান্ধুবীদের কাছ থেকে সে বিভিন্ন উপায় জানতে চায় কিভাবে কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলা যায়! বান্ধবীরাও এ ব্যপারে তার মতোই অপরিণত মস্তিষ্কে নানারকম বুদ্ধি দিয়ে যাচ্ছে অহরহ। বান্ধবী বলে কথা তার দুঃখ মানে তাদেরও দুঃখ। তাদের মধ্যে আবার আরও একজন আছে যে নিজেও তাসিনকে পছন্দ করে খুব এটা আয়না জানে না৷ ব্যাপারটা এমন, আয়না ভালোবাসে তার মামাতো ভাইকে আয়নার বান্ধবীও ভালোবাসে আয়নার মামাতো ভাইকে। এ নিয়ে আবার বান্ধবীদের মধ্যেও দুটো ভাগ হয়ে গেছে আয়নার অগোচরে। তার সামনে সবাই এক থাকলেও তার পিঠ পিছে কয়েকজন বান্ধবী অপর বান্ধবীটিকে সাপোর্ট করতে গিয়ে আয়নাকে কিছু কুবুদ্ধিও দিচ্ছে৷ ফলস্বরূপ আয়নার মাথায় ঢুকে গেছে যে করেই হোক মামা মামীর সামনে খুব লক্ষীমন্ত সাজতে হবে। এরপর তাসিন ভাইকে বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করতে হবে। আর এই আকৃষ্টতার উদাহরণ আয়নাকে কিছু নিচু স্তরের পদক্ষেপই নিতে শেখালো। আজ কলেজে এসে প্রথম ক্লাসটা করেই সে ওয়াশরুমে ঢুকলো এক বান্ধবীকে নিয়ে। মাত্র কয়েক মাস আগেই সে বাবার নতুন ফোনটা নিজের জন্য নিয়েছে আর সেটাতেই দুটো সিম লাগানো। যার একটা নম্বর বাড়ির সবাই জানে এমনকি তাসিনও। তাই অন্যটি দিয়েই সে তাসিনকে কল দিলো।

বসের কেবিন থেকে ফিরে ডেস্কে বসে আবারও কাজে মন দিয়েছিলো তাসিন। সে মুহূর্তেই সুপ্রভার মেসেজটা এলো। তা চেক করার আগেই সেই অচেনা নম্বরটি থেকে কল এসেছে৷ আজ আর ইগনোর করবে না বলেই ঠিক করলো মনে মনে। ফোন রিসিভ করেই প্রশ্ন করলো তাসিন, “কেমন আছিস?”

তার এমন সরাসরি প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল আয়না। তাসিন ভাই এমন তুই তোকারিতে প্রশ্ন করলো কেন? সে কি চিনে ফেলল আয়নাকে! আয়না কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দেখলো একবার। সে কি পুরনো সিম থেকেই কল করলো! ভয়ে এবার কলটাই কেটে সে আর দু বার দেখলো নাহ, এই নাম্বার তো কেউ চেনে না। কল কাটতেই বিরক্ত হলো তাসিন এবার সে নিজেই ব্যাক করলো। ভয়ে আয়নার হাত ঘেমে উঠছে কি করবে এবার! যদি বাড়িতে বলে দেয় কাউকে তখন নির্ঘাত মায়ের হাতে মার পড়বে। আয়নার বান্ধবী তার চোখ মুখ দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে। সে বলল তাসিন ভাই মনে হয় আমাকে চিনে ফেলেছে রে! কি করি এখন? ভয়ে হাত পা ঘেমে উঠছে আবারও৷ এদিকে ক্লাসে টিচার ঢুকে গেছে দেখে সব ক্লাসমেটই হুড়মুড় করে ক্লাসে চলে গেল। আয়নার অবস্থা বেগতিক কিন্তু এই মুহুর্তে ক্লাসে যাওয়াটাও ভীষণ জরুরি।

তাসিনের প্রচণ্ড রাগ হলো এবার। আয়না ছোট তাই বলে এতোটাও নয়। তার দ্বারা এসব লেইম কাজকর্ম মোটেও আশা করে না তাসিন। এ পর্যায়ে সে বাড়াবাড়ি করছে। মেয়েটা ইচ্ছে করেই রঙ নাম্বার থেকে তাকে জ্বালাতে চাইছে। এই আবেগের বয়সটা কেটে গেলেই হয়ত সে শুধরে যাবে এখন কোনরকম বাড়াবাড়ি করা মানেই ভুল কিছু করা। কাজ ফেলে এসব ভাবনায় মজে যাওয়াটা এবার তার ভুল তাই সে এসব বাদ দিয়ে কাজে মন দিল। সে কারণেই আর সুপ্রভার মেসেজটা দেখা কিংবা তার জবাব দেওয়াও হলো না। কাজের ব্যস্ততায় দিনটা কি করে যে কেটে গেল টেরই পায়নি তাসিন। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে অফিস থেকে বেরিয়ে আজ আর সে তার এপার্টমেন্টে ফিরলো না। কার্ডে কিছু টাকা আছে আবার ক্যাশও কিছু আছে৷ মাকে সে তার রুমের বর্ণনা বলার পর মা খুব করে বলছিল একটা কাপড় রাখার জন্য সিঙ্গেল ওয়্যারড্রোব কিনতে বলেছেন। তাসিন বলছিলো লাগবে না ছয়টা মাসই তো কিন্তু মাছুমা বললেন, “বাপের মত অত কিপটেমি করতে হবে না। কিনে ফ্যাল একটা ওয়্যারড্রব আর ড্রেসিং টেবিলও। পিরে আসার সময় সাথে নিয়ে আসবি।”

তাসিন অবশ্য বলেছিল বাড়িতে তো আলমারি আছে, ড্রয়ার, ড্রেসিংটেবিল সব আছে। কিন্তু মাছুমা শুনলেন না। বললেন, “ড্রেসিংটেবিল আছে দুটো একটা মাইশার ঘরে আর একটা আমার ঘরে। তোর বিয়ে তো আর দেরি করবো না তখন নতুন আসবে কিন্তু তুই ড্রেসিংটেবিল, ওয়্যারড্রব যেটা আনবি আপাতত তুহিনের ঘরে দিয়ে দেব। লাগলে অন্য যা প্রয়োজন কিনে নে টাকা লাগলে বল তোর বাপকে ধরে সেটাও পাঠাচ্ছি।”

মায়ের এমনসব কথাবার্তা নতুন নয়।আর মায়ের এই আচরণে আব্বাও খুব ক্ষিপ্ত হয় মাঝেমধ্যে কিন্তু তা প্রকাশ করা সাহস পায় না। তাসিন জানে আব্বা খুব ভয় পায় তার মাকে সে ভয়টা ভালোবাসাময়। মাও বোঝে আর তাই ইচ্ছে করেই এমন করে। দুজনের সম্পর্কটা একদমই অসম বলা যায় তবুও বিয়ের পবিত্রতা কখন কিভাবে যে দুজন মানুষকে এক করে দেয় তা বোধকরি বোঝার সাধ্য দুনিয়ার মানুষের নেই। একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন এতে তিনি কোন কারিশমা কিভাবে দেন! ঢাকায় এসেছে মাত্র তিনদিন হলো আর এর মাঝে সে শুধু অফিস, কোয়ার্টার এপার্টমেন্ট আর বাজার ছাড়া কিছুই চেনে না। যদিও মোহাম্মদপুর আর টিএসসির দিকের এলাকাগুলো তার আগে থেকে চেনা কিন্তু এদিককার কিছুই তেমন চেনে না। কোথায় গিয়ে কি কিনবে ভেবে উঠতে না পেরেই অফিসের এক কলিগকে সামনে পেয়ে ডেকে উঠলো, “দোলন ভাই!”

দোলন তাসিনের কলিগ ;মধ্যবয়সী আর গম্ভীর স্বভাবের মানুষ৷ তবে তাসিনের সাথে তিনদিনেই ভালো সখ্যতা প্রকাশ করেছে কথাবার্তায়। সেই সুবাদেই তাসিন তার কাছে নিজের সমস্যাটা প্রকাশ করলো৷ দোলন ফ্যামিলি ম্যান বাড়িতে কোন জরুরি কাজ থাকায় সংক্ষেপে কাছেরই কয়েকটা ফার্নিচার শপের ঠিকানা বলে গেল৷ তাসিনও রিকশা ডেকে সেই ঠিকানায় রওনা দিলো৷ মাত্র মিনিট দশেকের রাস্তা তাসিন সেখানে পৌঁছুতেই থমকে গেল, জায়গাটা তার চেনা। সুপ্রভার হোস্টেল এখান থেকে একটু ভেতরে। সুপ্রভার কথা মনে পড়তেই আবার মনে পড়লো তার সকালের মেসেজটার কথা। মনের ভেতর জেগে উঠলো সুপ্ত এক ইচ্ছে৷ মেয়েটাকে কি একবার ডাকবে! কয়েক মিনিটই তো লাগবে আসতে বলবে কি একাটাবার! পরমুহূর্তেই মনে হলো কেন আসতে বলবে সে আর মেয়েটাই’বা কেন আসবে? সারি সারি পাঁচটা বড় ফার্নিচার শপ তার পাশেই দুটো বড় হোটেল আর কিছু বিভিন্ন শপও আছে। জায়গাটা একদম গলির মত অথচ এর পেছনেই অনেকটা খোলা জায়গা নানান রকম বড় বড় গাছ আর তার পরই বড় হোস্টেলটা যেটাতে সুপ্রভা থাকে। তাসিন নিজেই নিজেকে নানান কথার মাঝে বুঝিয়ে নিলো ডাকলে সমস্যা কি না হয় দুটো আসবাবও পছন্দ করে দিয়ে গেল। দ্বিধার দোলাচালে দুলতে দুলতেই সে সুপ্রভার নাম্বারে কল দিলো। কল বাজছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। কেটে যেতেই আবার দ্বিধা বেড়ে গেল। এভাবে কল দেওয়াটা ঠিক হলো না বোধহয় ভেবেই সে একটা শপে ঢুকলো। জীবনেও সে কোনরকম ঘরের আসবাব কেনেনি৷ বাড়িতে যা কিছু আছে সব মায়ের পছন্দে মা নিজেই কিনেছে সাথে বড় মামী আর নুর আপুকে নিয়ে৷ তাসিন শপে ঢুকতেই দোকানের একজন কর্মচারী এগিয়ে এলো। জানতে চাইলো সে কি কিনবে বা কি দেখতে চাইছে। তাসিন দেখতে পেল বড় শপটার আনাচ কানাচ পূর্ণ কাঠের আসবাবে। খাট, ড্রেসিংটেবিল, জুতার ড্রয়ার, বড় বড় ওয়াল ক্যাবিনেট কমতি নেই কিছুর। আর সবগুলোর কারুকার্য এতোই শোভিত যে কোনটা রেখে কোনটা চুজ করবে বোধগম্য হচ্ছে না৷ তারওপর মনে হলো এখানে সব কিছুই খুব বড় বড় তার এত বড় আসবাবের কোন প্রয়োজন নেই। কনফিউজড হয়ে যখন সে ফার্নিচার দেখছে তখনই কলটা এলো সুপ্রভার নাম্বার থেকে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রিনরিনে একটা কণ্ঠস্বর।

“কল দিয়েছিলেন আপনি?”

“হ্যাঁ।”

“স্যরি ঘুমাচ্ছিলাম তাই কল বাজতে বাজতে কেটে গেলেও ধরতে পারিনি।”

“ওহ দ্যান আই এম স্যরি। কল দিয়ে ঘুমটা নষ্ট করলাম।”

“আরে সমস্যা নেই, কেমন আছেন?”

“সমস্যা তো আছেই সেজন্যই কল করেছি।” অকপটে বলল তাসিন। সুপ্রভা মাত্রই শোয়া থেকে উঠে বসেছে। ঘুমটা উবে গেলেও শরীরে কেমন একটা ম্যাজম্যাজে ভাব৷ সে ফোনটা লাউড করে বিছানায় রেখে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞেস করলো ‘কি সমস্যা?’

এরপরই তাসিন তার ফার্নিচার কেনার কথা জানাতেই সুপ্রভা বলল, “ওহ এই সমস্যা আগে বলবেন না! আপনি দাঁড়ান আমি দু মিনিটে এসে তিন মিনিটেই আপনার সমস্যা মিটিয়ে দিচ্ছি।”

বলার ঢং এতোই হাস্যকর ছিলো যে তাসিন হা হা করে হেসে ফেলল। দোকানের কর্মচারীটি বোধহয় বিরক্ত হলো কিছুটা। সে আবার চলে গেল নিজের কাজে। তাসিনকে বোধহয় তার কাস্টমার হিসেবে খুব একটা পছন্দ হয়নি। তাসিনও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বিভিন্ন ফার্নিচার দেখতে লাগলো মনযোগ দিয়ে। সুপ্রভা সত্যিই দু কি তিন মিনিটে এসে হাজির হলো দোকানটার সামনে। তাসিনকে দেখে আজ প্রথমেই সালাম দিলো আর তারপরই বলল, “আপনি সিঙ্গেল মানুষ এত দামী দোকানে ঢুকেছেন কেন। সিঙ্গেল একটা অটোবি বা মালায়শিয়ান বোর্ডের একটা কিনলেই তো পারেন। কাঠের গুলোতে দাম তো যাবে চওড়া।”

তাসিন একটু মনযোগে সুপ্রভাকে দেখছিল কিন্তু তার কথা শুনে ভীমড়ি খেল। এইটুকুনই মেয়ে কথার ধাঁচ সবসময়ই বড়দের মত। এসেই কিনা খীচের হিসেব ধরতে বসলো! সুপ্রভার পরনে ব্লু জিন্স আর হোয়াইট, ব্লু কম্বিনেশনে একটা কূর্তা৷ গলায় ব্লু রঙের স্কার্ফ প্যাচানো৷ কূর্তাটা তার কয়েক জায়গায় ভালোরকমের কুঁচকানো যা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে হয়ত জামাটা একটু টেনেও দেখেনি। যেভাবে ছিলো সেভাবেই চলে এসেছে৷ চোখ দুটো তার ফুলে ঢোল হয়ে আছে চোখের নিচটাতে লেপ্টে থাকা কাজলের আভাস। চুলগুলো আঁচড়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কারণ তাতে একটু এলোমেলো খোঁপা উচু করে করা আর তাতে একটা কাঠি ঢোকানো। চুলগুলো কি বাতাসে এলোমেলো হয়েছিলো নাকি ঘুম থেকে উঠার পর যেমন ছিলো তেমনই পেঁচিয়ে খোঁপা করেছে কিনা কে জানে! সুপ্রভার পায়ের দিকেও চোখটা নেমে এলো তাসিনের। পায়ে তার একজোড়া স্লিপার যা দেখে মনে হচ্ছে ঘরেই পরার হয়তো জুতোজোড়াটা। আর এই জুতোর বদৌলতেই বোঝা গেল সুপ্রভার উচ্চতা তাসিনের বুক পর্যন্ত অথচ এর আগে যতবার দেখেছে প্রতিবারই মেয়েটাকে সে তার থুঁতনি পর্যন্ত লম্বা দেখেছিলো। তাসিনের হা করে তাকিয়ে থাকা দেখেই সুপ্রভার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
“হা করে কি আমাকে গিলছেন? এটাই আপনার সমস্যা ছিলো!”

সুপ্রভার কথার চটকে ধ্যান ভাঙলো তাসিনের। সে নিজেকে স্বাভাবিক প্রকাশ করতেই হেসে বলল, “এসেছিলাম তো ফার্নিচার গিলতে মানে কিনতে কিন্তু তোমার যা অবস্থা তা দেখে মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেল।”

“আমি সুন্দরী তা আমি জানি। এভাবে হা করে আর নজর লাগাবেন না যা কিনার বলুন আমি পছন্দ করে দিচ্ছি।”

মুখে টান টান হাসির ফোয়ারা রেখেই বলল সুপ্রভা। তাসিন খেয়াল করলো মেয়েটা যেমন চঞ্চল তেমন অস্থির চিত্তের। সেও এবার বলল তার ছোট্ট রুমটার কথা এবং তার প্রয়োজনীয় কি কি লাগবে। সুপ্রভা সব শুনেই চট করে বলল, “তবে আর বড় ড্রেসিংটেবিল কি করবেন? একার সংসার ভালো দেখে একটা ওয়্যারড্রোব কিনুন৷ ঘরে যেহেতু বেলকোনি আছে একটা বা দুটো চেয়ারও কিনুন মাঝেমধ্যে বসে সময় কাটাতে অথবা ম্যাট আর কয়েকটা কুশন বালিশ যা নিচে বসতে আরামের হবে।”

তাসিন তা শুনে বলল, “ভালো বললে তো৷ কিন্তু একটা আয়নাও না কিনলে হচ্ছে না।” কিছুটা ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলেছে তাসিন তার মুখে। বাইরে আকাশ সন্ধ্যেমুখো হয়েছে কিয়ৎক্ষণ আগেই। সুপ্রভা এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকটা ওয়্যারড্রোব দেখে একটা পছন্দও করে নিলো। খুব বেশি কারুকার্যও নয় আবার একেবারে সাদামাটাও নয়। তাসিনের দিকে না তাকিয়েই বলল, “আপনার ড্রেসিংটেবিলে রাখার মত কসমেটিকস তো আর নেই তাই বড় এবং লম্বাটে দেখে ডিজাইনার একটা মিরর কিনে ওয়ালে লাগান আর তার সাথে এক কর্ণারে একটা ঝুলন্ত ফুল। দারুণ লাগবে ব্যাচেলর পাবলিকের রুমে।” বলতে বলতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সুপ্রভা। তাসিন চুপচাপ সুপ্রভার কথা শুনছে আর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আসবাব দেখতে দেখতে। একটা আলমারির সামনে গিয়ে হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল সুপ্রভা। তাসিন খেয়াল না করেই আরো এগিয়ে আসছিলো এবং সুপ্রভা থেমে যাওয়ায় মৃদু ধাক্কা খেল এগিয়ে আসা তাসিনের বুকে। দুজনেই আকস্মিক ধাক্কায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লে। তবে তাৎক্ষণিক নিজেকে স্থির করে নিতে পারলো সুপ্রভা৷ সে আগের মতোই চটপটে গলায় তার পছন্দ করা ওয়্যারড্রোবটা দেখিয়ে বলল, আর কি নিবেন?”

“ওই যে বললে কুশন, ম্যাট সেগুলোই নেবো।”

তাসিন ওয়্যারড্রোবের দাম নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেও দাম ঠিকঠাক করতে পারলো না। ছোট্ট সাইজের তবুও কাঠের বলে সতেরো হাজার পড়লো। তার কাছে ক্যাশ নেই আবার এইসব দোকানে কার্ড পেমেন্টের ব্যবস্থাও নেই। তবে দোকানদার তার ঠিকানা জেনে তার ফোন নম্বর আর নাম এবং অফিস আইডির একটা ছবিও রেখে বাকিতে দিলো। তাসিন জানালো কালকেই সে বাকিটা পেমেন্ট করতে পারবে। দোকানের মালিক নিজেই উপস্থিত ছিলো বলে আরো সুবিধা হলো লোকটা জানালো তাদের অফিসের এবং কোয়ার্টারের আরো অনেকেই এখন থেকে কেনাকাটা করেছে। এবার সুপ্রভা তাকে নিয়ে কুশন কিনতে ম্যাট্রেস এর দোকানে ঢুকলো। এরপরের কেনাকাটাগুলোতে সময় লাগলো একদমই কম। এক ঘন্টার মধ্যে তাসিনের সবই কেনা হয়ে গেল। হাতে খুচরো পায়সা বলতেও আর এ মুহূর্তে কিছু নেই অথচ সেই সন্ধ্যের আগ মুহূর্ত থেকে মেয়েটা তার সাথে ঘুরে হেল্প করলো। এখন খুব লজ্জা লাগছিলো মেয়েটাকে একটু কি কিছু খাওয়ার জন্য অফার করতে পারবে না! কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সুপ্রভা বলে উঠলো, আপনার অনেক হেল্প করলাম এবার আমার একটা হেল্প করুন।”

তাসিন কৌতুহলী হয়ে তাকাতেই সুপ্রভা বলল, ” আমি এখন এক কাপ চা খাবো তাতে একটু সঙ্গ দিতে হবে এই যা। আসলে আমার চায়ের সঙ্গীনি এখন আর আমার সাথে থাকে না তো তাই…” এইটুকু বলেই কেমন মুখে বিষন্নতার ছায়া নামলো সুপ্রভার। তাসিন কিছু আর বলার সুযোগ পেলো না। ওয়্যারড্রোব ঠিকানা অনুযায়ী দোকানের মালিক নিজেই ভ্যানে করে পাঠিয়ে দেবে বলেছে এখন একটু লাস্ট মোমেন্ট বার্নিশিং বাকি তাই লেট হবে। তাসিন এগোলো সুপ্রভার সাথে। রাস্তায় নামতেই হঠাৎ ঝড়ো বাতাস টের পেল তারা৷ বাতাসটা আরো আগে থেকেই বইছে কিন্তু তারা দোকানের ভেতর থাকায় খুব একটা বুঝতে পারেনি৷ রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের অভাব নেই বলেই বাতাসে অনেক ফুল ওড়ে ওড়ে পড়ছে। দুজন পাশাপাশি হাটতে লাগলো। সুপ্রভা যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তাসিনও সেদিকেই যাচ্ছে। বাতাসে একটা দুটো ফুলের পাপড়ি ওড়ে এসে পড়েছে সুপ্রভার চুলের ওপর। খোঁপাটা এখন আরো বেশি এলোমেলো। সন্ধ্যের পথে ফুটপাতের হলদে বাতির আলোয় তাসিন বার বার আঁড়চোখে দেখছে সুপ্রভাকে। এই যে ঝড়ো বাতাস আর সন্ধ্যের অস্থিরতা মেয়েটা কি টের পাচ্ছে এই বদল হাওয়ায় তার পাশে একটা বদলে যাওয়া মনের পুরুষও হেঁটে চলছে! মেয়েটা কি বুঝতে পারছে এই জাগতিক তুফানের মতোই তার পাশের পুরুষটির ভেতরেও এক তুফান শুরু হয়েছে তার অগোছালো রূপের মোহে! বুঝতে পারছে না নিশ্চয়ই নইলে এতোটা সময়েও মেয়েটা কেন একটিবার তাকাচ্ছে না তার দিকে! তাসিনের ভেতরে হঠাৎ করেই প্রচণ্ডরকম অস্থিরতা জেঁকে ধরলো। এই মুহুর্তে সুপ্রভার থেকে একটু সরে থাকতে পারলেই হয়ত ভালো হতো। একটা ছোট্ট কফিশপের সামনে এসে সুপ্রভা ফিরে তাকালো।

“এখানেই বসি কেমন!”

সুপ্রভার কথায় ঘোর কাটলো বুঝি তাসিনের। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, “হু।”

চলবে