#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩০)
“উহুম আজ ডিনার করবো না। অনেক ক্লান্ত আমি বাড়ি গিয়ে বিছানায় পড়বো এখন।”
সুপ্রভার চোখেমুখে সত্যিই ক্লান্তি স্পষ্ট। তাসিন ভাবলো তবে কফির অফার তো করাই যায়!
“আচ্ছা ডিনার না হয় বাদ কফি অন্তত খাওয়া যায়!”
সুপ্রভা চোখ দুটো বড় বড় করে তাসিনের দিকে তাকালো।
“এই যে আমার চোখের দিকে তাকান দেখেন কত্তগুলো ক্লান্তি কাজল মেখে ছড়িয়ে আছে। এখন কফি খেলে এই রাতভর না ঘুমিয়ে হুতুমের মত চোখ খোলা থাকবে সকাল হলেই দূর্বল হয়ে বিছানায় আধমরা পড়ে থাকতে হবে। হুহ”
হঠাৎ সুপ্রভা এমন করে বলল কথাটা যা শুনে তাসিন প্রথমে চমকে আর পরে একদম থমকে গেল। সুপ্রভা একদম তার মুখোমুখি এসে গিয়েছিলো কথাটা বলার সময়। তাসিনের হৃৎপিণ্ড তো যেন চমকে গিয়েই ধুকপুক এর গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এই মেয়েটা সত্যিই একটা ঝড় বৈ আর কিছু নয়। এ ঝড় যা শুধু তাসিনের বুকের ভেতর আর মস্তিষ্কেই আঘাত হানে।সুপ্রভা কফি না খেলেও তাসিন খেলো এবং সুপ্রভা নিঃশব্দে পাশে বসে সঙ্গ দিলো। তাসিন অবশ্য বলেছিলো কফি, ডিনার বাদ একটা বার্গারই না হয় খাক তার স্পেশাল ইচ্ছেমত চিলিসস মিশিয়ে। সুপ্রভার মন চাইলো না কিছুই মুখে দিতে অগ্যতা তাসিনের কফি শেষ হতেই দুজন উঠে পড়লো। আজ অবশ্য একটা টিশার্ট কিনেছে তাসিন তবে কোন বাছ বাছাই করেনি। একটা শপে ঢুকে যা পছন্দ হলো তাই দাম মিটিয়ে নিয়ে নিয়েছিলো। আর তার এহেন কান্ড দেখে সুপ্রভা তো হা করে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। এখন ফিরতি পথে আবার একটু ঝামেলা হলো রিকশা নিয়ে। দুজন দু গলিতে যাবে তাই দুটো রিকশা দরকার ছিলো কিন্তু এই সন্ধ্যায় আজ বৃষ্টি না থাকলেও রিকশা সংকট দেখা দিলো। কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটা রিকশার দেখা পাওয়া গেল। তাসিন জোর করলো যেন সুপ্রভা চলে যায় সে অপেক্ষা করবে আরেকটু। অন্য কোন রিকশা পেলে তাতে চলে যাবে। সুপ্রভার মনে হলো বেচারা অফিস করে এমনিতেই তো ক্লান্ত থাকার কথা। তাই সংকোচ এড়িয়েই তাসিনকেও উঠে যেতে বলল। দুয়েকবার না করেও পরে তাসিন উঠেই বসলো রিকশায়। রাতের আকাশ আজ গাঢ় অন্ধকার নয়। মাথার ওপর থালার মত মস্ত চাঁদ, তারারও দেখা মিলছে। সেই সাথে শহুরে পথের নিয়ন কিংবা সাদা আলোয় ঝকঝকে চারিপাশ। রিকশায় বসা দুজনই কিছুটা সময় চুপচাপ কাটিয়ে দিল। মুখে কারো কথা নেই, খুঁজেই পাচ্ছে শব্দ তারা। রিকশা যখন সুপ্রভার হোস্টেলের সামনে তখন তাসিন মুখ খুলল, “বাড়ি যাও কতদিন পরপর?”
চকিতে ফিরে তাকালো সুপ্রভা। তাসিনের মুখে কেন তাকালো সে নিজেও জানে না।
“নির্দিষ্ট করা সময় নেই। যখন ইচ্ছে হয় কিংবা কোন ছুটি থাকে তখন যাই। এবার তো পরীক্ষা আছে এ মাসের শেষে তাই একেবারে আগামী মাসে যাবো। খুব সম্ভবত মেজদার বিয়ের ডেটও পরবে তখন।”
“ওহ!”
রিকশা পৌঁছে গেছে হোস্টেলের সামনে। সুপ্রভা রিকশা থেকে নামতেই তাসিন বলে উঠলো, বেশি পাকামি করতে হবে হোস্টেলে যাও।”
অবাক হয়ে তাকালো সুপ্রভা। কি করল সে! রিকশাওয়ালাকে তাসিন চলতে বলেই আবার সুপ্রভাকে বলল, “ভাড়ার টাকা দেওয়ার মত মাতব্বরিটা অন্যদের সাথে দেখিয়ো।”
হি হি করে হেসে উঠলো সুপ্রভা। সে রিকশা থেকে নেমেই পার্সের জিপ খুলেছিলো তা দেখেই তাসিন বুঝলো সে ভাড়া বের করছে। বোকা লোক! সে তো শুধু ফোনটা বের করে সময় দেখছিলো। নয়টা বেজে গেলে হোস্টেলে ঢুকতে পারবে না সে ভয়েই তটস্থ সে। তাসিনের রিকশা চলে গেছে চোখের আড়ালে। হাসি থামিয়ে ফোন চোখ বুলালো। আটটা পঁচিশ বেজে গেছে ইশ, ডিনারটা বোধহয় করেই আসা যেত! এতে হয়তো আরো কিছুটা সময় লোকটা পাশে থাকতো। লজ্জা লাগছে সুপ্রভার এখন। আজ সারাটাদিন সে কিসব যে চিন্তা করেছিলো তাসিনকে নিয়ে! আর এমন সব চিন্তা আজকাল যখন তখন মাথায় ঘোরে।
“সত্যি করে একটা কথা বলতো আয়না।”
হাতের বইগুলো আয়নার টেবিলের ওপর রেখেই দপ করে চেয়ারে বসলো তুহিন। স্কুলে পড়াকালীন সন্ধ্যা হতেই মায়ের বকা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসতে হতো কিন্তু এখন আর এসব ভাল্লাগে না। কিন্তু মা’তো হিটলারের ছোট বোন এখনও কলেজ পড়ুয়া তুহিনকে বকাবকি করে পড়া নিয়ে। তাই ইচ্ছে করেই একাউন্টিং পড়াটা সন্ধ্যায় রেখেছে। এলাকারই এক সিনিয়র ভাইয়ার কাছে সে একাউন্টিং পড়তে যায় কিন্তু আজকে ভাইয়াটার জরুরি কাজ থাকায় ছুটি দিয়েছে। সে তাই সুযোগ পেয়ে ফুপির বাড়ি এসেছে। অবশ্য এখানে আসার পেছনে একটা উদ্দেশ্যও আছে। সে তার বন্ধু মাধ্যমে জানতে পেরেছে থানার নতুন অফিসারটা নাকি আয়নাকে পছন্দ করে। এমনকি প্রায়ই লোকটা কলেজের আশেপাশে ঘুরে সেই খবরটাও এলাকায় মোটামুটি চাওর হয়েছে ইয়াং ছেলে মেয়েদের মুখে। তাই তুহিন আজ এটাই জানতে চাইছে আয়নার কাছে, “সত্যি করে একটা কথা বলতো আয়না।”
আয়না রান্নাঘর থেকে আমড়ার আচার নিয়ে এসেছে বাটিতে করে। সেই আচারের বাটি তুহিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কি কথা?”
“ওই যে পুলিশটা এহসান নাম করে সে নাকি তোর কলেজের সামনে ঘুরঘুর করে রোজ?”
আয়না বিছানায় বসে নিজেও একটা আমরা তুলে নিলো বাটি থেকে।
“ঠিকই শুনছিস ওই বেডা প্রত্যেকদিনই চোরের মত এদিক ওদিক থাকে। আমি দেখে ফেললে ভাব এমন করে যেন হুট করে দেখা হইছে।”
আমড়াটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কথাটা বলেই আয়না জিভ বের করে তাতে বাচ্চাদের মত লেহন দিলো। এরপরই মুখটাকে এমন বিকৃত করলো যেন এটা আমড়া নয় নিম পাতার রস কেউ তার মুখে ঢেলে দিয়েছে। তুহিনও মজা পেয়ে হো হো করে হাসছে। তাদের কথার মাঝেই আয়নার মা এসে ভাতিজাকে বলল, “বাবু খাবার খেয়ে যাইস আজকে তোর পছন্দের চিতল মাছ আছে।”
ফুপির মুখে পছন্দের মাছের কথা শুনে তুহিন খুশি হয়ে গেল। তারপরই আবার বলল, “ব্যাটা পুলিশ এখন নিজেই চোর হয়ে গেছে রে আয়না। আমার বন্ধুরা বলাবলি করছিলো রায়হানকে নাকি খুব টাইট দিয়েছে আর এখনও নজরে রাখে যেন তোর ধারে কাছে না আসতে পারে।”
এ কথা আয়নাও জানে। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে এই পুলিশ ব্যাটা। ভয় হয় কোন বিপদে ফেলবে নাতো আবার! রায়হান পুলিশের ছেলে হয়েই কতরকম ধমকি, হুমকি দিয়েছিলো এখন আবার আরেক পুলিশ এসে তার প্রেমে পাগল। যদি এ ব্যাটাও নিজের কোন পাওয়ার দেখাতে চায়! কথাটা ভাবতেই আয়নার মুখটা রাতের মত কালো হয়ে এলো। এই যে তার রুপে এত এত ছেলে, পুরুষ পাগল হয়ে যায় তাসিন ভাই কেন হয় না? তাসিন ভাইয়ের পছন্দ কি আরো বেশি সুন্দর! তার সৌন্দর্য কি তাসিন ভাইয়ের পছন্দের লেভেল পর্যন্ত যায় না! কদিন আগেও তো তার ক্লাসমেট তনিমার ভাই এসে প্রপোজ করে গেল। লোকটা শহরে থেকে পড়াশোনা করছে দেখতেও তাসিন ভাইয়ের মত আবার স্বভাবেও নাকি লোকটা তাসিন ভাইয়ের মত নাক উঁচু তবে সে লোক কেন তাকে পছন্দ করল! অনেক ভেবে একটা কথা মনে পড়লো আয়নার। তাসিন ভাইয়ের মনে কি আগে থেকেই অন্য কেউ আছে? এই একটা কথা মনে হতেই ঝুপ করে মন খারাপের বৃষ্টি শুরু হলো। পাশে বসা তুহিনও তার মন খারাপ ধরতে পেরে বলল, ভাইকে নিয়ে ভাবছিস নাকি?
সবাই বোঝে আয়নার মন শুধু ওই অহংকারী তাসিন ভাইটাই বোঝে না!
নতুন কেনা টি শার্টটা একটু নেড়েচেড়ে দেখে নিলো তাসিন। একটু আগেই মা ভিডিও কল দিয়েছিলো তখনও তার হাতে এটাই ছিল। আজ আর মায়ের ফোন ইগনোর না করে ধরলো। স্ক্রীণে মায়ের মুখটা ভেসে উঠতেই তার হাসি হাসি মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। আয়নার জন্য তৈরি হওয়া এক ঝামেলায় আজ কতটা দিন পর মায়ের মুখটা দেখতে হলো। মায়ের মুখটা কি একটু জীর্ণ লাগছিলো! লাগছিলো বোধহয়। তার মায়ের মুখটা সর্বদা উচ্ছল দেখায় থাকুক সে রাগে কিংবা খুশিতে। কিন্তু আজ তাতে উচ্ছলতা নেই শুধু অভিমানটা ছিলো। ভালোমন্দ তেমন কথাও তো বলল না আজ। শুধু তার খোঁজখবর নিয়ে রেখে দিলো। তবে রাখার আগে টি শার্টটা দেখে একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে গেল আর তাতেই তাসিনের বুকে প্রশান্তি নেমেছে। মা টি শার্টটা দেখে বললেন, “ভি নেক টি শার্ট কিনেছিস! তোকে এই গলায় ভালো মানায়।”
ব্যস, মন ভালো হতে আর একটুও বাকি নেই। আজ আর আয়না এবং বিয়ে নিয়ে কোন তর্ক, যুদ্ধ হয়নি। খুশিতে মন আরেকটু নাচতে নাচতে এক কাজ করে বসলো। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে কোন কারণ ছাড়াই সুপ্রভাকে একটা মেসেজ করে দিলো, “গুড নাইট মিস-তুফান।”
চলবে
#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩১)
জীবন প্রকৃতির মত; তাতে হরহামেশাই পরিবর্তন ঘটে, ঘটতে থাকে। তাসিনের জীবনেও ঘটেছে দারুণ পরিবর্তন তবে তার অগোচরেই ঘটেছে অনেকটা। সুপ্রভার সাথে এখন তার প্রায়ই দেখা হয় কাকতালীয়ভাবে। না মানে এটা তাদের নিজেদের তৈরি করা কাকতালীয় ব্যপার। একদিন সুপ্রভা কোন কারণ ছাড়াই চলে যায় তাসিনদের গলিতে ঠিক তাসিনের অফিস যাওয়া টাইম। দেখার হওয়ার পরই আচরণটা এমন করে যেন, সে কোন কাজেই এসেছে এদিকটায় আর দেখা হয়ে গেল। আবার তাসিনও আজকাল এমনটাই করে। কখনো কফি খাওয়ার বাহানায় সেই কফিশপে যায় যেখানে সুপ্রভা প্রথমবার তাকে স্পেশাল ক্রাশ বার্গার খাইয়েছিলো! মনের অলিগলি দখল করা মানুষগুলোকে দেখার লোভ বোধহয় এমনই চতুর করে সবাইকে। দেখা লোভ আর মনের অস্থিরতা কি পরিমাণ যে উদ্ভট করে দেয় একটা সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষকে তার প্রমাণ এখন তাসিন সুপ্রভাই। দেখতে দেখতে মাস হয়ে গেছে তাসিনের ঢাকার জীবনের। ছুটির সপ্তাহ শুরু হতেই মন খারাপ হয়ে গেল তাসিনের। সত্যি বলতে সুপ্রভাকে চারটা দিন না দেখতে পারার চেয়ে খারাপ লাগাটা বেশি তার মায়ের জন্য হচ্ছে। আজ রাতের বাসে রওনা দেবে বলে টিকিট কেটেছে অথচ তৈরি হতে গিয়ে মনে পড়ছে কালই মা একটা সিদ্ধান্ত শোনাবে। তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় আয়নাকে বিয়ে করা। এখন তো একদমই নয় যখন তার মনের ঘরে সুপ্রভার পদার্পণ পড়ে গেছে। সুপ্রভা বলুক আর নাই বা বলুক তাসিনের বোঝা হয়ে গেছে সুপ্রভার অনুভূতি। মেয়েটা নিজেই হয়ত এখনো বুঝতে পারছে না নিজেকে। তাসিন ভেবে নিয়েছে অপেক্ষা করবে সে ঠিক ততদিন, যতদিন না সুপ্রভা নিজের অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারছে। ভালোবাসা একতরফা হলে অপরপক্ষ জেনে বুঝে প্রেমে পড়ে৷ তাসিন চায় সুপ্রভা তার অনুভূতি জেনে নয় বরং নিজের অজান্তেই তাকে ভালোবাসুক। ‘উপলব্ধি ‘ শব্দটা শতভাগ পরিপূর্ণতা পাকে তাদের জীবনে এটাই তাসিনের কাম্য। আর তাই এ যাত্রায় যত্রতত্র কাটিয়ে নিবে মায়ের সিদ্ধান্তকে। চারটা দিনই তো! ঠিক পার করে দেবে সে। পুরোপুরি তৈরি হয়েই ফ্ল্যাটের ডাইনিংয়ে খাবার খেল তাসিন। হাবিব চাচা আর তাসিনের টিকিট দু জায়গার বলেই বাসও ভিন্ন। কিন্তু বাস স্টেশন আর ছাড়ার সময় এক বলেই চাচা আর সে একসাথেই বেরিয়ে গেল। স্টেশন যাওয়ার পথে এক রিকশায় উঠেছিলো তাসিন আর হাবীব চাচা। যেতে যেতে কত যে গল্প জুড়েছেন চাচা আর সব গল্প ঘুরে ফিরে চাচীর মাঝেই শেষ হয়েছে। তাসিনের মনে হলো প্রেম ভালোবাসা অপার্থিব আর আধ্যাত্মিক কোন জিনিস। নইলে এই প্রেমেই কেন মানুষ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সুখী কিংবা ভয়ংকর দুখী হয়! হাবীব চাচা মধ্য বয়সের শেষ প্রান্তে এসেও এখনো তার বিয়ের আগের প্রেমিকা আর বিয়ের পরের অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে কি করে এতোটা আবেগী আর চঞ্চল হতে পারে? আবার তার ছোট মামার কথাই ধরা যাক, মানুষটা সেই কবে ভালোবাসায় ধোঁকা পেয়েছিল আর আজও সেই ধোঁকার জন্য কাউকে ভরসা করেন না। ছোট মামীকে আজও ভালোবাসেন না। সম্পত্তির ভাগ হাতছাড়া হবার ভয়ে সংসার করে গেলেও তারা স্বামী-স্ত্রী মোটেই সুখী নয়। অপ্রেমের সম্পর্কটা ধরে বেঁধে রাখা গেলেও সে সম্পর্কে প্রাণ থাকে না। আচ্ছা, মা কি বোঝে না আয়নার সাথে তার বিয়েটা হলেও ছোট মামার মতোই অবস্থা হবে তার!
রাত বাড়ছে, আঁধার ঘন হয়েও আবার ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আজও আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোই কখনো মেঘের আড়ালে কখনোবা ভূলোকে লুটিয়ে পড়ছে।সুপ্রভার মন ভার হয়ে আছে তাসিনের মেসেজ পাওয়ার পর থেকেই। সে গ্রামে যাচ্ছে এটা মানতে কষ্ট কেন হচ্ছে! সে তার বাড়ি যাবে ছুটিতে এটাই তো স্বাভাবিক। বিছানার কাছেই জানালাটা খোলা রেখে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে সুপ্রভা। হাতে ফোন আর দৃষ্টি বাইরে গাছের ফাঁকে দেখা যায় আকাশটাতে। আজ ভীষণ গরম পড়েছে একটুও বাতাস নেই। মাথার ওপর চলন্ত ফ্যানটারও যেন আজ শীতল করার ক্ষমতা নেই। হুট করেই সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। তাসিন কথায় কথায় একদিন বলেছিলো তার ছুটি চারদিন থাকবে। আর আজ সে অফিসেই ছিল সারাদিন তারমানে নিশ্চয়ই ছুটিটা কাল থেকে শুরু! মন যা চায় সুপ্রভা তাই করে বরাবর তবে এবারও তাই হোক!
রাতভর জার্নি করে ভোরের আগেই এলাকায় এসে পৌঁছেছে তাসিন। আঁধার তখনো সরে যায়নি, ফজরের আজানটাও হয়নি। বাস থেকে নেমে একটুখানি হেঁটেই তাদের এলাকার বাজার। সাথে কাপড়চোপড়ের ব্যাগ নেই তার। এক কাপড়ে এসেছে বলে কিছুটা স্বস্তি। এ সময়ে রিকশা, অটো কিছুই নেই। বাজারের দোকানপাট বন্ধ এমনকি একটা কুকুর বেড়ালেরও দেখা মিলবে না এখন৷ প্রকৃতিতে রাতের নিস্তব্ধতা এখনো বিরজামান চারদিকে শুনশান গা ছমছমে ভাব। তবুও ভয় লাগছে না তাসিনের, লাগার কথাও না। তার নিজের গ্রাম, নিজস্ব ভূমি। এখানে সব তার চেনা সেই ছোট্ট বেলাটি থেকে। হাতের ফোন বের করে নেট অন করে একটা দোকানের বেঞ্চিতে বসে গেল। গাছে গাছে দুয়েকবার পাতা নড়ার শব্দ কানে এলেও গা করলো তাসিন। চুপচাপ অনেকটা সময় ফোনে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতেই আজানের ধ্বনি শুনতে পেল। পাশেই একটা বড় মসজিদ আছে আর এখনই গ্রামের অনেক মুরুব্বি আসবেন নামাজের জন্য । সেও আর বসলো না ভাবলো আল্লাহর ডাক এতোটা নিবিড়ে বসে শোনার পরও অবহেলা কি করে করে! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো সে৷ ফোনটা পকেটে রেখে মসজিদের সামনে গিয়ে বাইরে থাকা টিউবওয়েলে ওযু করে নিলো। তাসিন ওযু করে উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো একজন লম্বা, চওড়া, সুঠাম সুন্দর দেহের যুবক এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। লোকটা ওযু করবে বোঝা যাচ্ছে৷ সে সরে গেল সেখান থেকে আর যেতে যেতে ভাবছে লোকটা অচেনা। নিজের এলাকায় প্রায় বড়, ছোট সবাইকেই কমবেশি চেনে সে৷ বছরের বেশিরভাগটা সময় গ্রামের বাইরে থাকলেও চেনে না এমন কেউ আছে বলে জানা ছিলো না তার। হতে পারে কলেজ, ভার্সিটি কিংবা থানার কোন লোক নতুন এসেছে তাই অচেনা। যদিও কলেজ, ভার্সিটির যারাই নতুন আসে তারা সবাই পাশের এলাকা কলেজ পাড়ায় থাকে। আর বেশি না ভেবে মসজিদে প্রবেশ করলো তাসিন। এরই মাঝে আরো কিছু মুসুল্লি এসে গেছেন। তাসিনের বাবা বাড়ির পাশের মসজিদে যান তাই এখানে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরিচিত অনেকেই ইতোমধ্যে তাকে খেয়াল করে কথা বলেছে। নামাজ শুরু হতেই তাসিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এহসান। পাশাপাশি সালাত আদায়ের পর তাসিন যখন মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলো তখন এহসানই ডাকলো, “শুনুন।”
তাসিন ডাক শুনেই ফিরে তাকালো। কৌতূহলী হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকাতেই প্রশ্নটি কানে এলো, “আপনি তুহিন মীরের কেউ হোন?”
তাসিনের কৌতূহল দ্বিগুণ হওয়ার জায়গায় এবার কেটে গেল। ধরেই নিলো লোকটা কলেজের কোন টিচার বোধহয়। সে জবাব দিলো, “জ্বী আমি তার বড় ভাই।”
‘তুহিনের বড় ভাই!’ ব্যপারটা বোধহয় এহসানকে কিছুটা আন্দোলিত করলো ভেতরে ভেতরে৷ কারণটা হয়ত আয়না। সে জানে আয়নার মামাতো ভাই তুহিন তার মানে এই ছেলেটাও। হতে পারে মনের ভেতর ভবিষ্যত এক সম্পর্ক কল্পনা করেও এহসান কিছুটা সমীহ আচরণ করছে। তাসিন এবার প্রশ্ন করলো, “আপনাকে ঠিক চিনলাম না আপনি বোধহয় এলাকায় নতুন? ”
“জ্বী আমি এসেছি মাস প্রায় পাঁচ চলছে তবে এ পাড়ায় এসেছি গত মাসে। আমি আপনাদের থানার নতুন এস আই, এহসান মাহমুদ।”
এহসান হাত বাড়িয়ে দিলো তাসিনের দিকে। তাসিনে চমৎকার হেসে হাত মিলিয়ে বলল, “আমি তাসিন মেহতাব। জবের জন্য প্রায় সারাবছর চট্টগ্রাম থাকতাম আপাতত ঢাকায় আছি, ভোরেই এসেছি।”
“পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। হোপ সি ইউ স্যুন আগেইন, গুড ডে।”
“থ্যাংকস, গুড ডে।” তাসিন হাসিমাখা মুখেই বলল। এহসান চলে যেতেই তাসিনও আবার বাজারের সামনে গেল। এখনো রিকশা চোখে পড়লো না তবে চারপাশে দিনের আলোয় ঝকঝকে। আর বসে থাকার মানে হয় না ভেবে হেঁটেই এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরেই অবাক হয়ে গেল মাকে রান্নাঘরে দেখে। কেমন আছে, কি করছে এটুকুর পর আর কথা জমলো না মা ছেলের তবে মাছুমা কষ্ট পেলেন তাসিনের এমন আলগা আচরণে। ভেবেছিলো একটু এসে জড়িয়ে ধরে বলবে, মা এত সকালে কি রান্না করছো? আমাকে জলদি এক কাপ চা দাও না! ”
এমনটাই তো করতো আগে। কিন্তু আজকের আচরণে বুঝিয়ে দিলো মনে এখনো ছেলের রাগ রয়ে গেছে৷ সেও কম যায় না রাগ তো তারও আছে এখনো। সারাটা দিন খুব একটা কথা হলো আর তাসিনের কারো সাথে। বাড়ি এসে এখন মনে হচ্ছে না আসাটাই ভালো ছিল। বন্ধুরা সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তাদের জন্য রাতের অপেক্ষা। এদিকে তাসিন এসেছে শুনতেই আয়না সারাক্ষণ তাদের বাড়ির গেইট থেকে উঁকি মেরে থাকে। তাসিন বাড়ি থেকে পুকুরের রাস্তা দিয়ে গেলেই সে দেখার সুযোগ পাবে। কিন্তু না কোন ভাবেই সারাদিনে তাসিনের দেখা মিলল না তার। আজ তো তাসিনকে দেখার লোভেই কলেজেও গেল না। এদিকে এহসানও সময়মত কলেজ রোডে ঘুরে আসতে বাদ দেয়নি কিন্তু আয়নার দেখা মিলল না কিছুতেই। দুপুরে খাওয়ার পর তাসিন ঘরের পেছনের বাগানে বসে ছিলো অনেকক্ষণ। গাছের ফাঁকে আকাশী রঙা আকাশে তুলোর মত ভাসা মেঘ দেখতেই বিষন্ন মনটা কিছুটা শীতল হয়েছিলো। হাতের ফোনটা নিয়ে গাছের ফাঁকের ওই এক টুকরো আকাশের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিলো। দুই লাইনের চমৎকার একটা ক্যাপশনও লিখে দিলো নিজের মত করে,
গনগনে দুপুরের এক চিলতে রোদ তুমি!
শুভ্রনীলের এক টুকরো আকাশ তুমি ঝড়কন্যা!
‘ঝড়কন্যা!’ এ কেমন কোন উপনাম?
কক্সবাজারে পরিচিত হওয়া সেই মেহউইশ নামের মেয়েটিই প্রথম মন্তব্য করেছে তাসিনের পোস্টে। ইনবক্সে না হলেও মেয়েটার সাথে তার বিভিন্ন পোস্টে টুকটাক কথা হয়, আজও হলো। তাসিনও রিপ্লাই করলো, “হ্যাঁ আমার দেওয়া তার উপনাম।”
তাসিন আর মেহউইশের মন্তব্যের মাঝে হুট করেই রিমন ঢুকে গেল, “কিরে বন্ধু এ ঝড়কন্যা আবার কেডা? রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়!”
মেহউইশ রিমনের নাম দেখে তাকে চিনতে পেরেছে। সে আবারও রিপ্লাই দিলো রিমনকে ম্যানশন করে, “কেমন আছেন ভাইয়া?”
এখানেই বোধহয় রিমনের বুকে কাঁচ ভাঙা শব্দ হলো। ইশ, যে মেয়েকে ক্রাশ ভেবেছে সেই মেয়ে ভাইয়া ডেকে হৃদয়টাই ভেঙে দিল! মজার ব্যপার হলো আরো কয়েকটা মন্তব্য যখন মেহউইশ, তাসিন আর রিমনের মধ্যে হলো তারপরই রিশাদের কমেন্ট দেখা গেল তাসিনের পোস্টে। পেট ফাটিয়ে হাসি উঠে এলো তাসিনের। এই লোকটা কি অসম্ভব বউ পাগলা! হতে পারে নয়ত যে পোস্টে মেহউইশ থাকবে শুধু মাত্র সে পোস্টেই তাকে দেখা যায়। মন্দ নয় ব্যপারটা। আর ভালো লাগছে না ফেসবুকিং তাই বাগান থেকে আবারও ঘরে চলে গেল তাসিন৷ মামীকে ফোন দিয়ে কথা বলল কিছুক্ষণ৷ মামী আবদার করছে চট্টগ্রাম যেতে তাই সে প্রমিস করেছে পরের মাসের ছুটিতে মামীর কাছে যাবে৷
গত রাতে অনেক ভেবে ঠিক করেছিলো আজই বাড়ি আসবে সুপ্রভা কিন্তু তা আর হলো না। সকালে ক্যাম্পাসে যেতেই জানতে পারলো শর্ট নোটিশে পরীক্ষা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার। মোটামুটি রকম প্রস্তুতি ছিলো তার পরীক্ষার কিন্তু হাত ভাঙায় পনেরোটা দিন পড়াশোনা থেকে বহুদূর ছিল। এখন আবার হাতে সময় এগারো দিন। এরই মাঝে তাকে প্রস্তুত হতে হবে এদিকে আবার পড়ায় মনই বসছে না তার ইদানীং৷ মাথার ভেতর সারাক্ষণ তাসিন তাসিন একটা কবিতা চলে। এখন আবার ভাবী ফোন করে বলল মা নাকি মেজদার বিয়েটা আগামী মাসেই করাতে চান৷ মেজদার বিয়ে নিয়ে তারও অপেক্ষা অনেক কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি তাও আবার তার পরীক্ষার কথা না জেনেই ঠিক করলো! অথচ সেদিনই তো বড়দা আর বাবা বলল প্রভার পরীক্ষার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তারিখ দিতে যাবে। একে তো তাসিনের জন্য মন খারাপ হচ্ছিলো এখন এ কথা শুনে কষ্ট হচ্ছে খুব৷ তার কেন জানি মনে হয় সে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণই সবার আদর আহ্লাদের ভাগীদার হয়। দূর হতেই সবাই কেমন দায় ছেড়ে দূরত্ব বুঝিয়ে দেয়। ভাবতে গেলেই যন্ত্রণারা পোকা কিলবিল করে মন জুড়ে। আজও মন খারাপ নিয়ে কেটে গেল দিন। রাতভর তুমুল বৃষ্টি হয়েছে নিশ্চুপে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছে সুপ্রভা বইয়ে মুখ গুঁজে। পরের দিন কাটলো ক্যাম্পাস আর পড়াশোনায়।একমনে অবশ্য অপেক্ষা ছিলো তাসিনের একটা ফোনকল অথবা মেসেজের। কিন্তু আফসোস কোনটাই এলো না সেদিনও। দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেছে তাসিনের গ্রামে যাওয়ার। সুপ্রভা মেহরিন আর সৌহার্দ্যের সাথে ক্যাম্পাসে বসেই গল্প করছিলো। তাদের গল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিলো পরীক্ষা। হঠাৎ করেই তাদের সামনে এসে হাজির হলো তাসিন। মেহরিন আর সৌহার্দ্য তাকে চেনে না তাই সৌহার্দ্যই প্রশ্ন করলো, “কিছু বলবেন?”
সুপ্রভা তখনো বিষ্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তাসিনের দিকে৷ কেমন অগোছালো লাগছে তার চোখমুখ, পরনের শার্ট কুঁচকে আছে। শার্টের এক হাত ফোল্ড করা অন্যটা নামানো৷ বিষ্ময় কাটিয়ে সুপ্রভাও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “আপনি এখানে?”
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। ইটস আর্জেন্ট।”
চলবে