#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৯)
আকাশ থেকে একঝাঁক শঙ্খচিল উড়তে উড়তে হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে ঠিক এমনটাই মনে হলো সুপ্রভার তার মায়ের কথা শুনে। পরীক্ষার ঝামেলা শেষে বাড়ি এসেছে আজ তিন দিন। এই তিনদিনে আজ আর এখনই মা তার সাথে প্রথম কথা বলল। সে বাড়ি ফিরেই মাকে সালাম দিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করার পর মা তার কথার জবাব দিয়েছিলো কিনা মনে পড়ে না। তিনদিনে সে কয়েকদফা কেঁদেছে এই নিয়ে ভাবীকেও বলেছে মা এমন কেন করে! ভাবী নিরুপায় তাই একবার শুধু বলেছে, “মাকে নিয়ে মন খারাপ করিস না সময় হলে কথা বলবে তোর সাথে।”
সেই সময় আজ তিনদিন পর এলো মায়ের হাতে। তাও কিনা তার বিয়ের কথা বলতে! সুপ্রভা সিঁড়ি মুখে দাঁড়িয়েই বলল, ” আমার বিয়ের কথা আসছে কেন এখন আমি তো এখানে এসেছি এহসান ভাই আর মেজদার বিয়ে খেতে!”
“মায়ের পাশে বোস প্রভা” গম্ভীর স্বরে বলল বড়দা। বসার ঘরে মা,বড়দা আর ভাবী ছাড়া আপাতত কেউ নেই তবে সেজদা একবার দোতলা থেকে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। সেই তাকানোতে একটু ক্ষোভ ছিলো দেখেছে সুপ্রভা কিন্তু কার প্রতি তা বুঝতে পারেনি। মায়ের কথায় গা না করলেও বড়দার কথা ফেলতে পারা অসম্ভব সুপ্রভার জন্য। সে এগিয়ে এসে বসলো বড়দার পাশে। ততক্ষণে মীরা ভাবীও এসে বসেছে তার অন্যপাশে। হঠাৎ কেন জানি মনে হলো এই দুটো মানুষ আজ তার দুপাশে ভিত হয়ে বসেছে। মন কু ডাকল মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে আর তখনি ভেতরে ভেতরে একটা মানুষের নামও আওড়ে নিলো সুপ্রভা।
আজই তো সে মন খুলে বান্ধবীর কাছে ভালোবাসার মানুষটির নাম বলে এসেছে। খোলাসা করেছে তার জীবনের প্রথম প্রেমিক পুরুষের গল্প আর আজই মা বলছে তার বিয়ের কথা।
মরিয়ম শিকদার খুব একটা ভণিতা করতে চাইলেন না। জোর আওয়াজে একবার ছোট ছেলের নাম ধরে ডাকলেন, “মেহেজাব!”
খুব সম্ভব মেহজাব তখন তার কম্পিউটার রুমেই ছিলো। এই ছেলেটা কম্পিউটার, গ্রাফিক্স বিভিন্ন প্রযুক্তিগত জিনিসের প্রতি আসক্ত। তার জন্যই নিচ তলায় আলাদা একটা কম্পিউটার রুম আছে, আছে ফ্যাক্স মেশিন, প্রিন্টার সব। মায়ের এক ডাকেই সে একটা বড় খাম হাতে এসে ঢুকলো বসার ঘরে৷ মরিয়ম শিকদার ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “কাগজটা এনেছো?”
মাথা নেড়ে জবাব দিলো মেহজাব এনেছে। মা হাত বাড়াতেই খামটা তুলে দিলো মেহেজাব মায়ের হাতে। মরিয়ম শিকদার সেটা হাতে নিয়ে একবার খুলে ভেতরের কাগজগুলো চেক করে আবারও খামে রাখলেন। ধীর অথচ ভরাট গলায় বললেন, “এটা নিয়ে যাও আমি ছেলের বায়োসহ দুটো ছবিও আছে এতে। ভালো করে চেক করে নিও আর চাইলে মেহরাবের সাথে সম্ভবত ফেসবুক মাধ্যমে এড আছে ছেলে সেখানেও দেখে নিও। আমাদের পক্ষ থেকে জবাব হ্যাঁ হয়ে গেছে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নাও। তারা চাইলেই বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে।”
সুপ্রভা তাকালো খামটার দিকে। তার চোখে সত্যিই ঘুম ছিলো কিয়ৎক্ষণ আগেও কিন্তু মায়ের এখনকার কথার পর তা শরতের মেঘের মত চোখের পলকে ওড়ে গেল সূদুরে। আনমনেই মনটা হঠাৎ বিদ্রোহী হতে তৎপর হয়ে ওঠলো। তার সাথে প্রতিবারই কেন এমন হয়! প্রতিবারই কেন মা তার মনের বিরুদ্ধে কোন না কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন৷ তবে প্রতিবারই মায়ের সে সকল সিদ্ধান্ত বদলে যায় বড়দার মাধ্যমে। মন আশ্বস্ত হলো এবারও বড়দা আছে সামনে। সে ভরসার চোখে তাকায় মায়ের পাশে বসা বড়দার দিকে৷ বড়দার দিকে চোখ পড়তে আচমকাই ভয় জমে ওঠে চোখের তারায়। বড়দার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব আর নিস্পৃহতা। তার মানে কি এবার আর বড়দা কিছু করবে না! যারপরনাই অস্থির দৃষ্টি এবার সুপ্রভার পুরো বসার ঘরে ঘুরলো। বাবা নেই আশেপাশে শেষ ভরসা কি তবে এবার বাবাই হবে! যদিও বাবা আজ অব্ধি মায়ের বিপরীতে কোন কথা বলেননি আর মা মানুষটা আজীবন শুধু তার মত বিরুদ্ধ কোন না কোন সিদ্ধান্তই শুনিয়েছেন সব বিষয়ে। তার কেন জানি মনে হয় মা প্রতিবারই ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে কষ্ট দিতেই এমন করেন কিন্তু কেন! কোন মা নিজের সন্তানের সাথে এমন করেন? উত্তর এ জীবনে কখনো পায়নি সুপ্রভা। মায়ের খুব আপন, খুব কাছের হওয়ার চেষ্টা তার সবসময়কার আর প্রতিবারই মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ার যন্ত্রণায় দগ্ধ সে। রাত বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে চারপাশের নিস্তব্ধতা। টি টেবিলের ওপর পড়ে রইলো পাত্রের বায়োসহ খামটা। সুপ্রভা একবার অসহায় চোখে বড়দার দিকে তাকিয়েই চলে গেল দোতলায়। পেছন পেছন শোনা গেল মায়ের চেঁচিয়ে ডাকা আর বড়দার শীতল কণ্ঠের ডাক। নিজের ঘরে ঢুকে ফোন হাতে নিয়ে উদভ্রান্তের মত কল করতে লাগলো তাসিনকে। প্রথম দু বার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না। রাতের শুনশান নীরবতা ছাপিয়ে তাসিনের ফোনটা তৃতীয় বার বাজতেই তার ঘুম হালকা হলো। অন্যান্য ঔষধের সাথে বোধহয় ঘুমের ঔষধও ছিলো তাই সারাটা সময় সে ঘুমেই অচেতন পড়ে থাকে। আধখোলা চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে কল রিসিভ করে কানে তুলল। অন্ধকার ঘরে ফোনের তীব্র আলোয় চোখ ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলো বলেই সে আর ভালো করে নামটা দেখেনি কে কল করেছে। এখন রিসিভ করে ওপাশের নিস্তব্ধতা দেখে বিষ্ময়ে চোখ খুলল। ভারী চোখের পাতা টেনে দেখলো নামটা ‘তু-ফান’। এবার বড্ড শীতল গলায় প্রশ্ন করলো, “চুপ করে আছো কেন?”
ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরটা বুঝি একটু কাঁপলোও তাসিনের। সুপ্রভা শুনলো তবু কিছু বলল না। তাসিন বার কয়েক ডেকে বিড়বিড় করলো, “ঘুমের ঔষধ খেয়েছি আমি আর অবচেতন পড়ে আছে উনি কি আশ্চর্য কথা!”
“কথা বলছো না কেন সুপ্রভা? বিয়ে তো ঠিকঠাকভাবে হয়ে গেছে শুনলাম মা ফোন করেছিল। তুমি কি বাড়ি ফিরে এসেছো?”
কত স্বাভাবিক আর কত নির্ভার স্বরে কথা বলছে লোকটা। এদিকে তার ভেতরটায় ধ্বংসলীলা চলছে তার তা কি করে বোঝায়! কি এক অদৃশ্য বেহায়াপনা তাকে ভীষণরকম জোর দিচ্ছে তাসিনকে আজ মনের আগল খুলে সবটা জানিয়ে দিতে। এরপর যা হয় হোক তাসিন ভালোবেসে হাত ধরলে ধরবে না হয় সারাজীবনের জন্য মনকে দাফন করবে অতল গহ্বরে। কিন্তু নাহ শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হলো না উল্টো সে বিভ্রান্ত হলো তাসিনের কণ্ঠ শুনে। পরেই আবার মনে হলো হয়ত ঘুম থেকে জেগে কথা বলায় এমন শোনাচ্ছে। সুপ্রভা গুড নাইট বলে ফোন কাটলো। তাসিনও ঘুমের তাড়নায় আর কিছু না বলে ফোন রেখে ঘুম দিলো।
ভোরের আলো ফুটতেই পাশের মানুষটা সটান উঠে বসলো। আয়না টের পেলেও নড়াচড়া করার সাহস পেলো না। জীবনে এই প্রথম কোন রাত কাটলো তার ভয়ে, আতংকে। ভূতের ভয়ও সে এমন করে কখনো পায়নি যতোটা একজন মানুষকে পেয়েছে। রাতে এ ঘরেই খাবার পাঠিয়েছিল মামী সাথে মাইশাও ছিল। লোকটা প্রথমে খুব সুরল কন্ঠে তাদের দুজনকে খাওয়া শুরু করতে বলে নিজেও প্লেট নিয়ে বসলো। ভদ্রলোক নিজের প্লেট নিয়ে আয়নার পড়ার টেবিলে বসেছিল মাইশা আর আয়না বসেছে বিছানায়। আয়নার খাওয়ার একদমই মুড ছিল না তার তো মনে মনে দহন আর যন্ত্রণায় ছারখার হচ্ছিলো। আবেগে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছিল বারবার। বিয়েতে হ্যাঁ বলা মোটেই উচিত হয়নি। বান্ধবীদের কাছ থেকে বুদ্ধি পেয়ে সে যা ভেবেছে দশ মিনিটেই সেই বুদ্ধি তার জীবনের চরম ভুল বলে মনে হয়েছে। বিয়ে জিনিসটা সস্তা নয় তা গত দুদিনের বাড়ির প্রতিটা সদস্যের ব্যস্ততা আর হাসিমুখই প্রমাণ করে দিয়েছে। আর এই তার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড় আর চতুর লোক এই লোকটাকে নিয়ে তার ধারণা আমূল বদলে গেল এক রাতেই। বিয়ে, প্রেম কোন ফ্যান্টাসি নয় তা যেন এক রাতের দীর্ঘ সময়ে আয়নার মগজে ঢুকে গেল। এহসান কাল রাতে তাকে খাওয়ার জন্য শুধু একটা ধমক দিয়েছিল সেই ধমকে সে একা না মাইশাও ঝটপট করে পেট পুরে খাবার খেয়েছে। মাইশার যাওয়ার পর যখন তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করা হলো তারপর আরও এক ধমক খেয়েছে আয়না। সে ধমকটাতে শাষণ ছিল অত্যাচার ছিল না তবুও সে ভয় পেয়েছে। নিশুতি রাত মধ্য গগনে চাঁদ যখন শুভ্র হাসিতে ধরনী আলোকিত করছে তখন এহসান বসেছিল আয়নার পাশে। ঘরের জানালার এক পাল্লা খোলা মৃদু আলো সাথে ফুরফুরে হাওয়া এসে ছড়িয়ে ছিল ঘরে। দমবন্ধকর অস্বস্তিতে আয়না যখন জড়োসড়ো এহসান তখন সপ্রতিভ কণ্ঠে তাকে বলেছিল, “বিয়েটাকে ছেলেখেলা ভাবাটা একদম ঠিক হয়নি আয়না। আমি ফ্যান্টাসি জগতের কোন প্রিন্স কিংবা ভিলেন নই। বাস্তব জীবনে অতি সাধারণ এক পুলিশ অফিসার। তুমি কারো ভালোবাসায় বিরহিনী সেজে তাকে শায়েস্তা করতে আমায় বিয়ে করতে রাজী হবপ আর আমি সব জেনে-বুঝে চুপ থাকব তেমন পুরুষ নই৷ আমি ভালোবেসে তোমাকে চেয়েছিলাম কিন্তু সেই চাওয়ায় জবরদস্তি ছিলো না। তুমি যা জেনেছো তা আমিও জেনেছি। আমাদের প্রভার সাথে তোমার কাজিনের একটা না হওয়া সম্পর্ক আছে সেটা আদৌ হবে কিনা জানি না। কিন্তু তুমি সেই না হওয়া সম্পর্কটাকে চক্ষুশূলে আচর কাটতে যে ফন্দি এঁটেছ তা ভীষণ অন্যায় অন্তত সেই ফন্দিতে বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে খেলা বোধহয় ওপরওয়ালাও সইবেন না৷”
আয়না থরথর করে কেঁপেছিল এহসানের মুখের কথা শুনে। তার সাজিয়ে রাখা পরিকল্পনা লোকটা কি করে বুঝলো ভাববার সময়টুকুও সে পেলো না৷ এহসানই বলল, “মনে আছে গতমাসে তোমাদের বাড়ির বা দিকের পুকুর পাড়ে এক সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল আমাদের?” এহসান প্রশ্নটা করলেও উত্তরের অপেক্ষা করে না আয়নার অবশ্য মনে পড়ে যায় দেখা হয়েছিল তার লোকটার সাথে কিন্তু তার আগে দেখা হয়েছিল তাসিনের সাথে। চারপাশে সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা আর আঁধারের ঘন হওয়া সামনে দাঁড়ানো তাসিন আর কান্নায় ব্যাকুল হওয়া আয়না। সব মনে আছে আয়নার। এহসান সেই সময়টার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আর তাসিন যখন কথা বলছিলে ঠিক তাসিন নয় শুধুই তুমিই কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিলে সবটা আর আমি তখন তোমাদের উল্টোদিকেই দাড়িয়ে ছিলাম। কাকতালীয় হলেও সেদিন সন্ধ্যেটা আমার জন্য অনেক বড় ভুল থেকে সরে আসার সুযোগ নিয়ে এসেছিল। আমি শুনেছিলাম তাসিনের প্রতিটি কথা। সে তোমাকে বোঝাতে গিয়েও বোঝাতে না পেরে ধমকেছিল সেদিন তারপরই বুঝি চলে গেল ঢাকায়। এই বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল না তবুও হয়ে গেল। বিয়ের প্রস্তাবটা আমি নই তাসিনই পাঠিয়েছিল আমার বাড়ি অব্ধি শুধু একটু কৌশলে। আমি আমার পরিবারকে বুঝিয়ে নিতাম কোন একভাবে কিন্তু তোমার সে রাতের বাচ্চামি শর্ত আমায় প্রচণ্ড রাগিয়ে দিয়েছিল। জেদ ধরেছিল তোমার মনের কুটিল চক্রান্ত টের পেয়ে। তুমি কি ভেবেছো আমাকে খেলনার মত ব্যবহার করবে! সিরিয়াসলি! তোমার মত হাঁটুর বয়সী এক মেয়ে আমাকে ব্যবহার করে তাসিন সুপ্রভার জীবনে বিষ ঢোকাবে? ভাবতেই গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটে আমার। যা ভুল তুমি করেছো তার মাশুল তোমাকে দিতে হবে সংসার সারাজীবন আমার সাথেই করবে আর তাসিন সুপ্রভার জীবনে তোমার প্রবেশের পথ গত সপ্তাহেই আমি বন্ধ করেছি তা হয়ত তুমি এখনো বুঝতে পারোনি।”
এরপর আয়নার রাতটা কাটলো নির্ঘুম। এহসান তাকে আবারও ধমকে বিছানায় গিয়ে শুতে বলেছিল। সে ভয়ে নিঃশব্দে কান্না করতে করতপ গুটিশুটি মেরে বিছাছানায় শুয়ে চোখ বুজেছিল। তাকে চমকে দিয়ে এহসান সে অবস্থায় কপালে চুমো খেয়ে অপর পাশে শুয়েছে। রাতভর দুজনেই পাশ ফিরেছে দু রকম বিষাদ বুকে নিয়ে। আর এখন সকাল হতেই একদম স্বাভাবিক চেহারায় এহসান বেরিয়ে গেছে। বাইরে ভোরের আলো সবেই ফুটেছে। বাড়ির আর কেউ এখনো জেগেছে বলে মনে হলো না আয়নার অথচ লোকটা চুপচাপ বেরিয়ে গেল!
পায়ের ফ্র্যাকচার নিয়ে অফিসে যাওয়া হবে না তাসিনের। তাই হসপিটাল লিভ পেয়েছে তিন দিনের নিজেও ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে আরও চারদিন বাড়িয়ে নিয়েছে। মোট সাত দিনের ছুটি নিয়ে সে ভাবলো বাড়ি চলে যাবে। এমনিতেও সুপ্রভা নেই এ শহরে তাই তারও মনও টিকছে না এখানে। গতরাতে কি কথা হয়েছিল মনে পড়ছে তাসিনের কিন্তু আজও ফোন করতে চায় না। একেবারে বাড়ি গিয়েই কথা বলবে। এমনিতেও সে মনে মনে সুপ্রভাকে অনুভূতি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। প্রপোজ করার এটাই মোক্ষম সুযোহ বাড়িতে গিয়েই প্রপোজ করবে। কিন্তু পায়ের যা অবস্থা তাতে সে গাড়ি ড্রাইভ করবে কি করে৷ নাকি নিজের গাড়িটা রেখেই চলে যাবে আবার তো ফিরবেই পা ঠিক হলে। কমলা রোদে রাঙা সকালটা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই তাসিন কিছু পরিকল্পনা করল। তার পরিকল্পনার প্রথম অংশ বাড়ি ফিরেই আগে সুপ্রভাকে প্রপোজ করবে। তারপর বাড়ি ফিরে মাকে একদফা স্যরি বলবে।
সুপ্রভার রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে উঠেও নাশতার জন্য মন টানছে না তবুও নিচে এসে চেয়ার টেনে সকলের সাথে বসলো। ভাবী তাকে প্লেটে নাশতা দিতে দিতে বলল, ” দশটার পর কেনাকাটার জন্য বের হব আমরা তৈরি হয়ে নিস প্রভা।”
লম্বাটে খাবার টেবিলটাতে তখন চার ভাই, মা-বাবা আর সুপ্রভা বসা। মীরা সকলের নাশতা এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসলো সুপ্রভার পাশে। সুপ্রভা একবার ঘাড় বাঁকিয়ে ভাবীকে বলল, “আমার মুড নেই ভাবী তোমরা যাও।আর এমনিতেও মেজদার বিয়েতে আমি থাকব না কালই হলে ফিরব।”
সুপ্রভার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই চার ভাই একসাথে তাকালো তার দিকে৷ তাকালো তার বাবা আর ভাবীও শুধু নির্বিকার রইলো মরিয়ম শিকদার। সুপ্রভার ডান দিকে বসা ছিল বড়দা তিনি মাথায় হাত রেখে বললেন, “এত রাগ কেন করিস বল তো! মা কিন্তু তোর ভালো চায়। তৈয়াবের বিয়ে আর তোর বিয়ে এক সপ্তাহ আগপিছ। হাতে সময় আছে আর আট দিন এখন এমন কিছু করিস না বোন যাতে আমি লজ্জায় কাউকে মুখ না দেখাতে পারি!”
বড়দার মুখের কথা সুপ্রভার জন্য কি তা বড়দা ভালো করে জানে আর তাই সুযোগে সদ্ব্যবহার শুধু বড়দাই করতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে সুপ্রভার এই সুযোগ দিতেই ইচ্ছে করছে না। মন প্রাণ সব উজার হয়ে গেছে সেই কবেই এখন বিয়ের নামে কারো জীবনে জড়িয়ে দুটো জীবন ন*ষ্ট করার মানেই হয় না৷ কিন্তু বলার মত কোন জবাবও তো নেই তার কাছে। তাসিন কি কখনো বলেছে তাকে ভালোবাসে! ভালো যদি বেসেও থাকে বিয়ে করবে এমনও তো নিশ্চয়তা নেই। হতে পারে শুধু ভালোলাগাটুকুি বিদ্যমান তার মনে। আর ভালো লাগে না সুপ্রভার। জীবন এত দূর্বিষহ কেন হয়ে উঠলো তার এত অল্পেই। বিনা সংকেতে ঝড় কেন উঠছে তার এইটুকুনি জীবনটাতে! খাবার গলধকরণ করার কোন অবস্থাই রইলো না তার। মেজদাও এবার মুখ খুললেন, “বড় হয়েছিস বোন সব বিষয়ে জেদ ভালো নয়।আমরা তোকে জোর করে বিয়ে দিব না বিশ্বাস কর। তুই শুধু একবার বায়ো দেখ প্রয়োজনে দু চারবার নিজেদের মত করে দেখা সাক্ষাৎ কর সে কিন্তু ছেলে ভালো। মে..”
“তুই থাম তৈয়াব। অত কথা শুনতে চাচ্ছি না আমি আর। তোর বাবা, আমি, সোহরাব তিনজনেই খুব যাচাই করেছি এই এক সপ্তাহ তারপরই কথা এগিয়েছি। ছেলে নিজে থেকে ডেট ফিক্সড করেছে আর আমরা সেই তারিখ মতেই রাজী হয়েছি। এখন কে পছন্দ করলো কে করলো না সেসব দেখার ইচ্ছে নেই আর। আগামী সপ্তাহে তোর বিয়ে শেষ হতেই পরের সপ্তাহে ওর।” শেষের বাক্যটা তৈয়াবকে উদ্দেশ্য করে বললেন মরিয়ম শিকদার৷ এতোটা সময় সুপ্রভা নিজেকে খুব সামলে নিলেও একন আর পারলো না। সে খাবার ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল, ” আমি এই বিয়ে কিছুতেই করছি না। তোমার যা খুশি করো শুধু আমাকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে যেও না এতে সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় আছে। এখনো সময় আছে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দাও মা।”
কথাটা শেষ করে চেয়ার সরিয়ে চলে যেতে বাড়ালো সুপ্রভা। বড়দা তার হাত ধরতে নিলেই কানে এলো মরিয়ম শিকদার এর কথা, “এও কি মায়ের মত অন্য জায়গায় নাগর রেখে এসেছে নাকি!”
চলবে