বৃষ্টির রাতে পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
518

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৪০)

সমুদ্রের উপর আকাশ জুড়ে মস্ত এক চাঁদ হাসছে। তার শুভ্র স্নিগ্ধ আলো জ্বলজ্বল করছে নোনা পানির ফোয়ারায় আর সুপ্রভার দেহে। রাতের দ্বিপ্রহরে বালুকাময় বিচে বসে অশ্রুজলে গাল ভেজাচ্ছে সুপ্রভা। আজ ভোরের আগ মুহূর্তেই এসে পৌঁছেছে সে কক্সবাজারে। বাড়ি থেকে পালানো তার এই প্রথম নয় তবে এবারের পালিয়ে আসাটা খুব ভিন্ন। সারাজীবনের জন্য ভাইদের ছেড়ে এসেছে। মীরা ভাবী,বাবা আর ভাইদের জন্য তার খুব কষ্ট হবে তবুও আর ফিরবে না সেই শিকদার বাড়িতে। সে রাতের কথা মনে পড়তেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সুপ্রভা। তার অতীত তার মায়ের সত্যতা জানার পর থেকে মন বিদ্রোহ করছিলো সেই শিকদার বাড়িতে থাকতে। শুধুমাত্র মামা মানে যাকে সে এত বছর নিজের পিতা বলে জেনেছে সে তার বাবা নয় তার মায়ের চাচাতো ভাই। সে তো কোন এক প্রতারকের অবৈধ সন্তান । সে রাতে চেয়ার ছেড়ে যখন সে উঠে দাঁড়ালো তখন মা বলেছিলো, “এও কি মায়ের মত অন্য জায়গায় নাগর রেখে এসেছে!” কথাটা শুনতেই পায়ের তলার জমিনটা টলে উঠেছিল সুপ্রভার। চোখ দুটো আঁধারে ঝাপসা হয়ে মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। বড়দা হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরতে গিয়ে থেমে গেল। মা আরও কিছু বোধহয় বলার জন্য মুখ খুলছিলেন ঠিক তখনি বড়দা চেঁচিয়ে উঠেছিল তাঁর মায়ের ওপর। জীবনে এই প্রথম দেখেছিল বড়দা আর বাকি তিন ভাই মায়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়েছে। যে ভাইয়েরা কখনো মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা তো দূর চোখ তুলে তাকিয়ে কিছু বলতো না তারাও সেদিন মা! বলে ক্রোধে গর্জে উঠেছিল। শূন্যে ভেসে যাওয়া তার অন্তরাত্মা মুহূর্তেই শান্ত হয়ে ঢলে পড়েছিল দেহের ভেতর আর দেহটা পড়েছিল মেঝেতে। যখন জ্ঞান ফেরে রাত তখন তিনটে। ভাবীর মুখে শুনেছিল সে জ্ঞান হারাতেই মেজদা পাজাকোলে নিয়ে হসপিটালে ছুটেছিল সাথে ছিল বড়দা। তার জ্ঞান ফিরতেই ডাক্তার শকড জনিত আঘাতে জ্ঞান হারিয়েছে বলে আবার ঘুমের ইনজেকশনও দিয়েছিল রেস্ট এর জন্য। এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ি নিয়ে ফিরলেও সুপ্রভার ঘুম আর ভাঙেনি দিনের বেলায়। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মাথার পাশে দেখতে পেল বড়দাকে বসে ঝিমাচ্ছে। পায়ের দিকে সেজদা আর মেহেজাব। মেজদা ছিল তার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসা ফোন হাতে। ঘর জুড়ে চার ভাইয়ের উপস্থিতি দেখে চোখ ফেটে জলের স্রোত নামলো অন্তরে হাহাকার লাগলো। ছোট থেকেই তো এই ভাইগুলোকে ইচ্ছে মত জ্বালিয়েছে, কত আবদার কত বায়না আর জেদ পূরণ করিয়েছে তাদের দিয়ে আবার নিজের অন্যায়ে কত শাষণের তোপে পড়েছে ভাইদের। কখনোও তো তাদের আচরণে মনে হয়নি সম্পর্কের কোথাও একটু ফাঁক রয়েছে। তবে মা কেন অমন কথা বলল তখন! মায়ের আচরণে সে বরাবরই কষ্ট পেত কিন্তু তাই বলে কখনোই মনে হয়নি তিনি মা নন৷ আর বাবা! আজ মনে পড়ছে বাবা মানুষটা তাকে ভালোবাসলেও কেমন যেন গুটিয়ে থাকতেন প্রায়ই তাকে নিয়ে করা মায়ের সিদ্ধান্তগুলোতে। তবে সেটাই কারণ, সে তাদের সন্তান নয় বলেই কি বাবা মায়ের ওপর দিয়ে কখনো তার হয়ে কথা বলতেন না! ঝিমিয়ে পড়া বড়দার বাহু ধরে ফুপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুপ্রভা। হকচকিয়ে গেল সোহরাব, চেয়ারে বসা তৈয়াবও ততক্ষণে ফোন ছেড়ে সুপ্রভার অপর পাশে বসেছে। মাথার ওপর দু ভাইয়ের হাত খাটের সামনের দিকে দু ভাই। পুরো রাজ্যই যেন সুপ্রভার চক্ষু সম্মুখে এসে বসেছিল সেদিন। মায়ের সামান্য একটা কথায় তার কিসের দুঃখ হবে যেখানে সারা দুনিয়ার সুখ তার হাতের মুঠোয়। রাতের শেষ সময়টুকু চার ভাইয়ের আহ্লাদে কান্নার ফোয়ারা থেমে নিশ্চিন্তের ঘুমে ঢলেছিল সে। কিন্তু সকাল হতেই মায়ের মুখোমুখি হয়ে মনটা কেঁদে উঠলো। এই একটা মানুষের আদর স্নেহের কাঙাল সে আজীবন ছিল সেদিন যখন জানলো সে এই মানুষটার অংশ নয় তখন একটুর জন্য সেই কাঙালিপনা দূর হলেও নিজের জন্মদাত্রীর পরিচয় জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো মনটা। দু দিন আরো নিরবেই কেটে গেল তার। মেজদার বিয়ের হৈ হুল্লোড় থেমে গেল একমাত্র তার নিস্পৃহতায় অথচ মেজদার হবু বউটা নাকি খুব করে চাইছিলো তাদের বিয়েটা উৎসবমুখর আমেজে হোক তাই তো বেচারি আংটি বদলের পর দুটো বছর কত আবেগ নিয়ে অপেক্ষা করেছে সে। অনেকটা মনের ওপর জোর খাটিয়েই সুপ্রভা মন প্রাণ দিয়ে বড় ভাবীর সাথে কেনা কাটা করতে লাগলো। সেই সাথে মনে মনে কিছু পরিকল্পনাও করলো। নিজের পরিচয় না জেনেও সে তার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারত যেখানে মা বাবার সমান চারটা ভাইয়ের ভালোবাসায় পূর্ণ তার জীবন। তবুও কোথাও যেন মনে এক অদৃশ্য অবুঝ কৌতূহল বলল, “যা অজানা তা নিয়ে আবেগ হয় না কিন্তু যার সূত্র জানা তার ব্যাখা জানাটা জীবনে অপরিহার্য হয়ে যায়।”

গুণে গুণে পাঁচ দিন পর মেজদার হলুদ রাত্রিতে সুপ্রভা সিদ্ধান্ত নিলো মায়ের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু বাড়িভর্তি মেহমানে প্রশ্নগুলো না বলাই থেকে গেল। পরের দিন মেজদার বিয়েতে হাসিমুখেই দিনটা পার করেছে সে। রাতে যখন সবাই যার যার ঘরে গিয়ে দিনের সকল শ্রান্তি ঘুমের তরে উগরে দিতে প্রস্তুত সুপ্রভা তখন নিঃশব্দে গিয়ে পৌছুলো মা-বাবার ঘরে। মরিয়ম শিকদার তখনো বৌভাতের আয়োজনের ব্যপারে কিছু আলাপ করছিলেন স্বামীর সাথে। সকাল হতেই আয়োজন শুরু হবে তাই কিছু বাকি রইলো কিনা কিছুতে কমতি যেন না হয় সে বিষয়েই কথা বলতে বলতে দরজা বন্ধ করতে গেলে দরজায় সুপ্রভাকে দেখলেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বলার প্রয়োজন হলো না তিনি ধীর স্বরে বললেন, “এসো ভেতরে” যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন সুপ্রভা এখনই আসবে। সুপ্রভা ঘরে ঢুকলো একবার চোখ তুলে তাকালো বিছানায় আধশোয়া বাবার দিকে। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলো নয়তো এক্ষুণি তার অশ্রুসজল আঁখি দুটো ওই মানুষটা দেখে ফেলত৷ মরিয়ম দরজাটা ভালো করে আঁটকে দিয়ে পুনরায় বিছানায় বসলেন।

“বলো কি বলতে এসেছো?”

“জানতে এসেছি।”

মরিয়ম যেন এও জানতেন সুপ্রভা কি জানতে চায়। কোন প্রকার ভণিতা ছাড়াই বললেন, “দাঁড়িয়ে থেকে সবটা শুনতে পারবে না। শুনতে পারলেও তারপর বেশিক্ষণ এ অবস্থায় নাও থাকতে পারো তারচেয়ে বরং বিছানায় বোসো।”

এবার আপনাতেই সুপ্রভার চোখ উঠলো একবার মা আরেকবার বাবার দিকে তাকিয়ে সত্যিই সে বিছানায় বসলো। রাতটা গভীর হলেও বাড়িতে পুরোপুরি নিরবতা নামেনি তা নিচ থেকে আসা দু একটা শব্দেই বোঝা যাচ্ছিলো। মরিয়ম কথা শুরু করতে প্রস্তুতি নিতেই বাবা আজ ধমকে বললেন, “বারাবাড়ি বন্ধ করো মরিয়ম৷ বয়সটা কোথায় দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করে অন্তত এসব বন্ধ করো নইলে সারাজীবন আফসোস হবে। কারো যন্ত্রণার কারণ হলে নিজের সুন্দর জীবনেও যন্ত্রণা আসে ভুলে যেও না।”

সুপ্রভার ইচ্ছে করলো বাবাকে বলুক, “থামো বাবা মাকে বলতে দাও।” কিন্তু কি আশ্চর্য তার মুখ থেকে বাবা ডাকটাও বের হতে চাইলো না। মরিয়ম পা দুটি ভাজ করে সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” সুমা শিকদার তোমার মায়ের নাম।”

“সুমা শিকদার” নামটা খুব আস্তে একবার উচ্চারণ করলো সুপ্রভা। মরিয়ম আবার বললেন, “সুমা মানে উনার চাচাতো বোন” শওকত শিকদারকে দেখিয়ে কথাটা বললেন মরিয়ম। শওকত তখন রাগে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আচেন মরিয়মের দিকে। মেয়েটাকে খুব ভালোবাসেন বলে কখনো তার মায়ের পরিচয় বলে কষ্ট দিতে চাননি৷ কিন্তু স্ত্রীকেও এত বছরে বাগে আনতে পারেননি৷ বলা যায় ব্যর্থ পুরুষ তিনি এ জীবনে, যে কিনা স্ত্রীর ভুল, অন্যায় শুধরানোর কোন ক্ষমতা রাখেন না। একমাত্র সোহরাবের কারণেই এ বাড়িতে সুপ্রভা এতগুলো বছর সকল লানত থেকে বহু ক্রোশ দূর ছিল যা ভাগ্যের পরিহাসে আজ খুব নিকটে। সুপ্রভা মনযোগ নিবিষ্ট রেখেছে তার নিজের সত্যি জানতে তার জীবনের গোপন কথাগুলো জানতে। মরিয়ম আবার বললেন, “তোমার মা এ বাড়িরই একমাত্র কন্যা ছিলো। আমার বিয়ের এক বছরের মাথায়ই তোমার মায়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলাম আমি আমার ভাইয়ের।” মরিয়ম এ কথাটা বলেই থেমে গেলেন। তার কথায় কান্না স্পষ্ট টের পেল সুপ্রভা। অবাক হয়ে তাকালো যে মাকে সে কখনো একটু আবেগে কান্না তো দূর মুখের আদলটা বদলাতে দেখেননি সেই মা কান্না লুকানোর প্রাণপন চেষ্টা করছে। মরিয়ম কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, ” আমার ভাই ভালোবেসে ফেলেছিল সুমাকে। আমার ভাই পারিবারিকভাবেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো এবং এনগেজমেন্টও হয়েছিলো ধুমধামে। সেই এনগেজমেন্টেই সুমার পরিচয় হয় আমার ভাইয়ের বন্ধু আনোয়ারের সাথে। দু চারদিন আলাদা করে তারা আলাপ করে ভাইকে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ায় একসময় তারা ঘনিষ্ঠ হয়। আর তাদের সেই ঘনিষ্ঠতার পাপী ফল তুমি।” আঙ্গুল তাক করে মরিয়ম সুপ্রভাকে কথাটা বলতেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে তার। দু হাতে কান চাপা দিয়ে সুপ্রভা বলে ওঠে, “থামো মা আমি জানতে চাই না আর কিছু। আমি তোমার মেয়ে, তোমাদের মেয়ে আমি বড়দা ভাইয়ের সুপ্রভা। আমি আর কেউ নই প্লিজ আমি জানতে চাই না আর কিছু।” কান্নায় বুক ভেঙে আসে সুপ্রভার কিন্তু মরিয়মের দয়া হয় না। সে বলে চলে একের পর এক ঘৃন্য কিছু সত্য, সুপ্রভার জন্মের কালো অধ্যায়। শওকতও এক পর্যায়ে স্ত্রীকে শাসিয়ে ওঠেন কিন্তু মরিয়ম যেন আজ পণ করেছে সবটা উগড়ে দিয়ে তবেই নিজেকে শান্ত করবে। সে বলে চলে, “তোমার মা আমার ভাইকে ঠকিয়েছে। গর্ভে তার পাপ নিয়েই বিয়ে করেছে আমার ভাইকে যখন দেখলো সত্যিটা আমার ভাই বুঝে গেছে তখন তার প্রেমিকের সাথে মিলে আমার ভাইকে খু*ন করেছে। কিভাবে করেছে তা শুনবে তোমার শোনা উচিত, তুমি সেই বে*শ্যা খু*নি সুমার মেয়ে যাকে আমি গত তেইশটি বছর ধরে চোখের সামনে দেখে আসছি, সহ্য করছি এমনকি নিজের নাম দিতে হয়েছে যার জন্ম পরিচয় রক্ষার্থে। তোমাকে না মেনে নিলে নাকি আমি আমার সন্তানদের পাবো না। এই যে আমার পাশে বসে আছে মানুষটা সে এতোটাও আলাভোলা কিংবা বউ পাগল নয়। শুধু মাত্র আমার মুখ বন্ধ রাখতে আমাকে দমিয়ে রাখতে এই সত্যগুলোকে চাপা দিয়ে রাখতেই আজও আমার সামনে চুপচাপ থাকে। আমার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নেয় বিনিময়ে তোমার জন্মের এই কালো অধ্যায়টা লুকিয়ে রাখতে। আর আমার সন্তানদেরই দেখো আমাকেই পাষাণ ভেবে তোমাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার ভাই যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে আমার সামনে ছটফট করেছে তা আমি দেখেছি আর কেউ দেখেনি। বি*ষের যন্ত্রণায় নীল হয়ে কাতরাতে কাতরাতে দম ছেড়েছে আমার হাতে৷ আমি বোন হয়ে সব দেখেছি কিন্তু কিছু করতে পারিনি৷ অথচ খু*নীর মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে এতগুলো বছর ধরে সংসার করছি খু*নির পরিবারে শুধুমাত্র নিজের সন্তানদের কথা ভেবে অথচ তারা আমার কথা কেউ ভাবছেনা।” মরিয়ম হাঁপিয়ে ওঠেছে কথাগুলো বলতে বলতে তবুও থামতে চাইলো না। তার আরও অনেক কিছু বলার আছে। সুপ্রভার জন্মের সময় তার মা মা*রা গেছে আর ম*রতে ম*রতে তাকে কিভাবে গছিয়ে দিয়ে গেছে এই পরিবারে সবটাই বলার ছিল। কিন্তু এত কি শোনার ক্ষমতা সুপ্রভার ছিলো! সে টলমল চোখে নিস্তব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মাথা নিচু করে বসে রইলো শওকত শিকদার আর মরিয়ম তখনও বিলাপ করে পুরনো অতীত ভাঁজে ভাঁজে আওড়ে চলছিলেন একাই। রাত পার হলো তিনটি মানুষের একদম নির্ঘুম। ভোর হতেই সুপ্রভা হাসিমুখে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ালো। দুপুরে নতুন বউকে পার্লারের লোক দিয়ে সাজানোর সময় মীরা আর সুপ্রভাও সাজলো। ভাইয়েরা চারজনই ক্ষণে ক্ষণে খোঁজ নিলো সুপ্রভা খেলো কিনা, কি করছে, কার সাথে কথা বলছে তার মন খারাপ হচ্ছে কিনা! নিয়মানুসারে মেজদাকে তার বউয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ি যেতে হলো। আত্মীয়রা ছোট ভাই বোনকেও সঙ্গে নিতে চাইলে মেহজাব গেল সুপ্রভা কাজ আছে বলে গেল না৷ সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে মীরা ডেকে বলল, “মা বলেছে আজ রাতেই মেহরাবকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিতে। যে সকল বান্ধবীকে দাওয়াত করতে চাস তোর বিয়ের জন্য দাওয়াত করে আসবি আর তুই তোর পছন্দ মত পার্লারে বিয়ের সাজের কন্ট্রাক্ট করে আসবি। এডভান্স পে করে আসবে মেহরাব।”

সুপ্রভা হাসিমুখে সব কথাতেই মাথা দুলিয়ে সন্ধ্যায় তৈরি হলো। মেহরাব বাড়ির গাড়ি নিলো। গাড়ি যখন বাজারের মোড়ে সুপ্রভা তখন বলল, “সেজদা খিদে পেয়েছে আমার খুব কিছু নিয়ে আসবে?”

“কি খাবি বল?”

“মিষ্টি”

বোনের মুখ থেকে কথা বের হয়েছে ভাই কি না এনে পারে! মেহরাব তাকে বসতে বলে বাজারের ভেতর ঢুকলো। এই ফাঁকে সুপ্রভা তার ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালো। সরাসরি ঢাকার বাস এ পথে নেই এই মোড়ে চট্টগ্রামের বাস সহজেই পাওয়া যায়। মিনিট পাঁচের মাঝেই বাস পেয়ে উঠে বসলো সুপ্রভা ততক্ষণে তার ফোনে মেহরাবের কল এসে গেছে। সে কিছু না ভেবেই ফোন বন্ধ করে বসে রইলো। এরই মাঝে তাসিনও অনেকবার কল করেছে তাকে কিছুতেই লাইনে পায়নি। বলা যায় এহসান আয়নার বিয়ের রাত থেকেই সে আর যোগাযোগ করতে পারেনি সুপ্রভার সাথে। টানা পাঁচ দিনে পাগল প্রায় তাসিন হাজারবার কল করেছে হাজারের ওপর মেসেজ দিয়েছে এমনকি একসময় অস্থির হয়ে টিয়াকে দিয়েও কল করিয়েছে। কোন ভাবেই যখন সুপ্রভাকে লাইনে পেলো না আজ সে পুরোপুরি ঠিক না হওয়া পা নিয়েই যাচ্ছিলো সুপ্রভাদের বাড়িতে। আর একটা দিনও তার পক্ষে কথা না বলে থাকা যাচ্ছিলো না। সে পায়ের জন্য ড্রাইভ করার রিস্ক না নিয়ে অটোতে বাজারে এসেছে। সন্ধ্যের পরের আঁধার ঘন বাসস্ট্যান্ডে অল্প আলোতেই সে দেখেছে সুপ্রভাকে বাসে উঠতে। প্রথমে দেখার ভুল মনে হলেও পরে তার পরনের পোশাক খেয়াল করতেই আর দেরি না করে সেও উঠে পড়লো। আয়না, তুহিন আর মাইশা নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠানে গিয়ে ছবি তুলেছে। মাইশা আর তুহিনের ছবিগুলোতেই সে দেখেছে সুপ্রভাকে।

সুপ্রভা নিজ মনের বেদনায় বিভোর হয়ে দেখতেই পেলো না তার পাশ ঘেঁষে যাওয়া তার মনপুরুষটিকে। তার দেহের পারফিউম এর সুবাস নাকে লাগলেও অন্যদের হতে পারে ভেবেই আর চেয়ে দেখেনি। রাত কেটে গেল ভোরের আলো ফুটলো বলে । সুপ্রভা বাসে ঘুমিয়ে পার করলো রাতটা। ভোরের আগ মুহূর্তে বাস থামতেই সে তার পাশে একজন মহিলাকে পেলো। কিন্তু তার মনে পড়ে রাতে তার পাশে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ বসেছিলো। সকালে কক্সবাজারে এসে হোটেল নির্জনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকটা সময়। মনের ভেতর উঁকি দিল মাস নয় কি দশ আগের ঘটনা। এই হোটেলেই ওঠেছিলো সেই বৃষ্টির রাতে দেখা হওয়া মানুষটি আর তার বন্ধুদের সাথে। টিয়ার বিয়ে, পালিয়ে আসা, তাসিনের অফিসে গিয়ে তারই বসের সামনে ঝগড়া সবটা মনে করে ম্লান হাসলো। যে মানুষটাকে সে মনে প্রাণে ভালোবাসে সে মানুষটা জানতেই পারলে না তার ভালোবাসার কথা। তার জীবনের অতীত তাকে বাড়ি ছাড়া করে দিলো। মন আর মানলো না মায়ের চোখের সামনে থাকতে। মানুষটা তেইশটি বছর বি*ষ চোখে তাকে দেখে দেখে জীবন কাটালো। তার নিজের সন্তানরাই নাকি তার আপন থাকবে না যদি না সুপ্রভাকে আপন করে নেয়৷ বাবা মানুষটাকে সে আজীবন ভুল ভেবে এসেছে অথচ এখন জানলো সেই মানুষটা তার জন্যই এতোটা ছোট হয়ে জীবন পার করছে৷ এসব ভেবেই আর নিজেকে তাদের জীবনে রাখার ইচ্ছে রইলো না। অনেক তো করলো তারা এবার না হয় নিজেই নিজেকে নিয়ে বাঁচবে! হাতে কিছু টাকা পয়সা ছিলো কিছু নিয়ে এসেছে সে বড়দার ঘর থেকে। এইটুকু না আনলে তার যে বেঁচে থাকা দায় হবে। এক প্রকার চু*রি করেই এনেছে বলা যায় কারণ টাকা গুলো ভাবী ঘরে না থাকা অবস্থায় আলমারি থেকে নিয়েছে সে৷ আর ছোট করে একটা চিরকুট রেখে এসেছে, “শেষবারের মত নিচ্ছি বড়দা ক্ষমা করে দিও।”

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বড়দা পেয়েছে চিরকুটটা! সুপ্রভা সেই হোটেলে ঢুকলো না। হোটেল নির্জনের কস্ট পে করে সে বেশিদিন থাকতে পারবে না৷ তাকে কয়েক দিন এখানে থেকেই মেহরিনকে বলতে হবে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। ঢাকায় গিয়ে টিউশনি জোগাড় করতে করতে হবে৷ এমনিতেও সে টিউশনির ব্যবস্থা আগেও করেছিলো শখের বশে এবার না হয় জীবিকার তাগিদে করবে! সস্তায় একটা ছোট্ট হোটেলে গিয়ে ওঠলো সুপ্রভা। সারাদিন না খেয়ে পড়ে রইলো রুমের ভেতর। অথচ খেয়ালই করলো না ছায়ার মত কেউ একজন পুরোটা সময় তার পেছনে লেগে রইল। এমনকি সারাদিন তাকে ফলো করে রুম থেকে বের না হতে দেখে হোটেলেরই এক স্টাফকে দিয়ে খোঁজ নেওয়ালো। মেয়ে স্টাফটি জানালো রুমের মানুষটি ঘুমিয়ে আছে।

সমুদ্রের জোলো হাওয়ায় মন ভালো হওয়া তো দূর একটু পরপর বুকটা ভারী হয়ে আসছে সুপ্রভার । বাতাসে প্রবল বিষাদ মিশে আছে যা অক্সিজেনের সাথে ভেতরে গিয়ে তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যায় মেজদার বৌভাত ছিল আর আজ সে ঠিক সেই সন্ধ্যা মুহূর্তে একা বসে আছে সুদূর সমুদ্র তীরে । তার জন্য মেজদার জীবনের সুন্দর সময় গুলো শুরুর পথটাই অসুন্দর কাটছে হয়ত তবে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজ সে ও বাড়ি থাকলে নির্ঘাত মারা পড়তো। কালকের কথা মনে পড়লেই তো দম আটকে আসে। পাত্রের বায়ো সে চেক করেনি তবে বড়দা বলেছেন বিয়ের দাওয়াত পাত্র পক্ষকেও দেওয়া হয়েছে। কারণ পাত্র নাকি এহসান ভাইয়েরই শ্বশুরবাড়ির কোন এক আত্মীয়। মেজদার বরযাত্রীতে পাত্রের পরিবার এবং পাত্রেরও আসার কথা ছিলো । কিন্তু অবাক করা বিষয় সুপ্রভা এহসান ভাইয়ের যে আত্মীয়দের দেখেছে তার মধ্যে মাইশাকে দেখেছে আয়নার পাশে। হ্যা আরো একজনকে দেখেছিলো তবে পেছন থেকে সেটা তাসিন কিছুতেই নয়। আর তাসিন কখনো বলেনি তাদের আরো কোন ছেলে কাজিন আছে কিনা। সুপ্রভা নাম শোনেনি ছেলের কিন্তু পেছন থেকে যাকে দেখেছে ছেলেটাকে অল্প বয়সী মনে হয়েছিল তার। ভাবতে ভাবতে সে কত যে ভাবনার সমুদ্রে ডুবলো তার ইয়ত্তা নেই। মনে পড়লে বড়দার মুখটা, মনে পড়লো তাসিনের মুখটা সেই সাথে মনে পড়লো নিজের জন্ম পরিচয়। সমুদ্রে জোয়ার এসেছে পানি ফুলে ফেঁপে একদম অনেকটা উপরে চলে এসেছে অথচ বিকেলেও এই পানি থাকে আরো কতদূর! মনের সাথে যুদ্ধ লেগে গেল একা একা কাঁদলো, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আবারো ফুঁপিয়ে উঠলো তবুও কিছুতেই শান্তি মিলল না। আর এই সবটাই দূর থেকে দেখল তাসিন। একটিবারও কাছে এলো না শুধু ফোনটাতে ট্রাই করলো বার কয়েক। কিন্তু মেয়েটা ফোন বুঝি অন করল না একবারও। রাত গাঢ় হলো বাতাসে শীত শীত আমেজ৷ সুপ্রভার হঠাৎ মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে৷ চকিতেই সে ঘাড় ফেরালো কিন্তু না কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই। সবাই নিজের মত চলছে ফিরছে কোথাও কারো দৃষ্টি তার প্রতি আগ্রহী নয়। কান্না এবার আর আটকাতে পারলো না শুধু মনে হলো তার মাথার ওপর বড়দার ছায়া না থাকলে সে বাঁচবে না। তাসিনকে ছাড়া থাকতে পারবে তবুও বড়দার থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়৷ দু হাতে কান্না মুছতে মুছতে সে পাগলের মত ছুটলো হোটেলের দিকে। রুমে ঢুকে ফোন বের করল তার ছোট ব্যাগটা থেকে। বড়দাকে কল লাগাতে প্রথম কল বেজে শেষ হওয়ার আগেই রিসিভ হলো কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব এলো না। সুপ্রভা পাগলের মত ডেকে চলল, “বড়দা বড়দা”

সোহরাব চোখ বুঁজে কান্না রোধ করলো। কাল রাত থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা সুপ্রভাকে। খাওয়া, নাওয়া সব ছেড়ে চারটি ভাই এই বোনটিকে খুঁজে অস্থির। সুপ্রভার গলা শুনতেই যেন সকল অস্থিরতা নিমেষে উবে গেল সোহরাবের সেই সাথে মীরারও। তার নিঃসন্তান জীবনে সুপ্রভাই সন্তানের মত ছিল। কখনো তাকে ননদ কিংবা পরিবারের শুধু মাত্র একজন সদস্য ভাবেনি । সুপ্রভা আরো কয়েকবার ডাকতেই সোহরাব জবাব দিলো, “বল”

রুষ্ট শোনালো সেই স্বর। সুপ্রভা কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি তুলে ফেলেছে তবুও জোর করে কান্না থামিয়ে বলল, “আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না বড়দা। কিছুতেই পারবো না।”

“ফিরে আয়”

এহসান বিকেলে এসে দুটো শাড়ি আর তার মায়ের দেওয়া কিছু গহনা নিয়ে এসেছে। নতুন বউ বলে কথা এখনই তো নতুন নতুন শাড়ি, গহনা এসব পরবে। বিয়ে বাড়িতে তাদের সব আত্মীয় স্বজন থাকবে এখন ছেলের বউকে সাজিয়ে ভরিয়ে না রাখলে কথা উঠবে আত্মীয়মহলে। এহসানের অবশ্য এসব পছন্দ হচ্ছে না। এইটুকুনি বউ তার নিজেকেই সামলে চলতে পারে না তাকে নাকি আবার শাড়ি, গয়নায় মুড়িয়ে রাখবে। এমনিতেই গত সপ্তাহে তৈয়াব ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে কি নাজেহালটাই না করলো তার। এই পুঁচকে মেয়ে নাকি বিয়ের নামে ষড়যন্ত্র করতে চাইছিলো সুপ্রভাকে নিয়ে অথচ বিয়ের রাতেই কয়েকটা ধমকে সব ভুলে সংসারের সব কাজকর্ম শেখা ধরেছে। বিয়ের প্রায় দু সপ্তাহ হতে চলল তাদের।এহসান তার শ্বশুর বাড়ি আর কখনো রাতে যায়নি। প্রতিদিন একবার করে আয়নাকে দেখা করার নামে তার কলেজ এর সামনে থেকে নিয়ে আধঘন্টা বাইকে ঘুরিয়ে বাড়ি দিয়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে গত সপ্তাহে সারাদিন একসাথে কাটালেও রাতেই আবার পৌঁছে দিয়ে গেছে। আজও তেমনই করবে। সে তার বউয়ের শর্ত পূরণ করে তার পরীক্ষার পরই নিজের কাছে নিবে। আয়নার ইচ্ছে ছিল সে বরপক্ষে থাকবে কিন্তু এহসানের মা ফোন দিয়ে বলল, একদমই চলবে না থাকা আমার ননদের বাড়ির বিয়েতে আমার ছেলের বউকে থাকতেই হবে। ব্যস, এহসানও চলে এসেছে জিনিসপত্র নিয়ে বউ নিয়ে ছুটবে আবার ফুপুর বাড়ি। সুপ্রভার হলুদ সন্ধ্যা বলে কথা। আয়না দেখলো কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি সাথে পাথরখচিত নেকলেস। বড্ড সাধাসিধা গহনা তবে হাতের জন্য মিলিয়ে আনা চুড়ি ছিল অনেক। সে তার মায়ের সাহায্যে শাড়ি পরে নেকলেস আর হাতভর্তি চুড়ি পরে নিলো। তার মা জোরজবরদস্তি নাক ফুঁড়াতে চাইছিলো কিন্তু ভয়েই সে দেয়নি। এহসানও বলেছে ওসব না করলেও হবে তাই আর ভাবতে হয়নি। মুখে মেকাপ করার একদমই ইচ্ছে ছিলো না তবুও বিছানায় বসা পাঞ্জাবি পরা এহসানকে দেখে মনে হলো এই লোক এমন নায়ক সেজে আসছে তার সাথে কি আয়না কাজের বুয়া হয়ে যাবে! নাহ্ অসম্ভব তার মত সুন্দরী মেয়ে কেন এই আধবুড়ো লোকের সামনে অসুন্দর দেখাবে! আয়না সাজলো চমৎকারভাবে এহসান নয় তার নিজের জন্যই কিন্তু সাজ শেষ হতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে দেখায় মনযোগ দিলো তখন দৃষ্টি গিয়ে বিঁধলো আয়নায় ভেসে ওঠা দ্বিতীয় প্রতিচ্ছবিতে। আজকের আবহাওয়া একদমই ভালো নয়। সকাল থেকেই ছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিকেলে একটুখানি আবহাওয়া স্বাভাবিক হলেও এখন আবার মেঘ ঘিরেছে প্রকৃতিতে। থেমে থেমে বিজলি চমকাচ্ছে সেই সাথে বর্ষণও শুরু হয়েছে। শীত আসি আসি দিনে এই বাদলা মোটেই সুবিধার নয়। বাসন্তি রঙা পাঞ্জাবিতে কমলা সুতোর কাজ, পাঞ্জাবীর হাতা দুটো গুটিয়ে রাখা ডান হাতে বড় ডায়ালের একটা সুন্দর ঘড়ি৷ মাথার চুলগুলো পরিপাটি আর পায়ে একদম সাধারণ এক জোড়া স্যান্ডেল পরেই চলে এসেছিলো এহসান । তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে মাদকাসক্ত তরুণের মত । আয়নার হঠাৎ মনে হলো, “ভালোবাসা তা নয় যা আমরা চাই ভালোবাসা তো তাই যা আমাদের পাশে থাকে, যা আমাদের আগলে রাখে।”

এহসান অনেকটা সময় নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। কাঁচের আয়নায় তার পুচকে আয়নাকে দেখতে দেখতেই আনমনে বসা থেকে উঠে এলো। অতি সন্তর্পণে পেছন থেকে আয়নাকে জড়িয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার গ্রীবাদেশ। ভালোবাসার মানুষকে এহসানের দেওয়া এই ছিলো প্রথম প্রেমময় স্পর্শ। আজ সুপ্রভার হলুদ সন্ধ্যা নয় এহসানের এখন প্রেমসন্ধ্যা পালনের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে।

থেমে থেমে বৃষ্টি ; দু হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে হাঁটুতে চিবুক রেখে উদাস বসে আছে সুপ্রভা। হলুদের জন্য সেজে বসতেই বড়দা এসে তাকে হলুদ ছুঁইয়ে গেছে৷ ভাবী হলুদ দিতে এসেও দেয়নি কোন এক আত্মীয়ের কথা কানে তুলে। বন্ধ্যা আর বিধবাদের নাকি শুভ কাজে থাকতে হয় না৷ ভাবী তাকে হলুদ না ছুঁইয়ে চলে গেছে অথচ সুপ্রভা কত করে বলল, “আমিই তোমার সন্তান৷ তুমি আমাকে হলুদ না দিলে কি করে হবে!”

ভাবী শোনেনি সে চলে গেছে। মেজো ভাবীও খুব আদর করে সুপ্রভাকে তাই এখন যখন তার হাতে মেহেদী পরানো হচ্ছিলো মেজো ভাবী গিয়েছে বড় ভাবীর কাছে। সে তার শিক্ষা জীবনের সকল জ্ঞান জড়ো করে বড় ভাবীকে বুঝিয়ে যে করেই হোক সুপ্রভার কাছে উপস্থিত করবেই। মা নামমাত্র হলুদ ছুইয়ে গেছে লোকে দেখবে বলে। বাড়ির ছাঁদে অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়েছিল কিন্তু আচমকা বৃষ্টির তান্ডবে সব ফেলে কনেকে নিয়ে সবাই ঘরে ঢুকলো। সুপ্রভা হাতের মেহেদীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, তাসিন কি করছে এখন? সে কি জানে আজ সুপ্রভার হলুদ, কাল বিয়ে! পরক্ষণেই মনে হলো তাসিন জানে সব। বড়দা তো বললই এহসান ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় তারমানে তাসিনেরই কোন আত্মীয়। চোখ দুটো উষ্ণ জলে ভরে এলো। জীবনের প্রথম পাগলামি ভরা ভালোবাসা যেই মানুষটার জন্য ছিল সেই মানুষটা জানতেই পারলো না। কান্না চেপে তাসিনের কথা ভাবতে ভাবতেই সুপ্রভা অস্থির হয়ে উঠলো। সে আশপাশে খুঁজে নিজের ফোনটাকে খাটের ওপরই পেয়ে গেল। ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই কারেন্ট চলে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে পুরো বাড়ি আঁধারে ঢেকে গেল। নিভে গেল বাড়ির ফটকের ঝিলমিল করতে থাকা মরিচাবাতিগুলো। নিভে গেছে শিকদার বাড়ির সকল আলো৷ চারদিকে হৈ চৈ কেউ মোম চাইছে, কেউ চার্জার বাতি। সুপ্রভা ফোন হাতে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। কেউ জানলো না বিয়ের কনে শিকদার বাড়ি ছেড়ে তখন নয়াগঞ্জের বাজারের চলে গেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি বলেই বড়দার বড় পুরানা এক ছাতা মাথায় সুপ্রভা হেঁটে চলছে। এক হাতে ছাতা অন্য হাতে ফোন কানে। বারংবার একটাই নম্বর ডায়াল করে চলছে অথচ ওপাশের মানুষটার রিসিভ করার নামই নেই। এদিকে সুপ্রভা আঁধার ঘেরা রাস্তায় চলতে ভয়ডর সব ভুলে বসেছে৷ মনের যাতনা বুঝি এমনই হয়! বৃষ্টি ঝরছে সেই সাথে ঝরছে অশ্রু। ওপাশের মানুষটির বুঝি দয়া হলো এবার সে ফোন তুলেছে। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ ভেসে আসতেই সুপ্রভা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, “যে পথে প্রথম দেখা হয়েছিল দুজনার সেখানে একটিবারের জন্য আসতে পারবেন!”

জবাব এলো না ওপাশ থেকে৷ গুনে গুনে সাত মিনিট পর সেই তিন রাস্তার মোড়, সেই গ্রামের পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়া মেয়েটির সামনে এসে হাজির হয়েছে তাসিন। ভিজেপুরে তার কমলা রঙের পান্জাবীটি গায়ের সাথে লেপ্টে আছে৷ চুলগুলো লেপ্টে আছে কপাল জুড়ে৷ অন্ধকারেও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল দুজন দুজনাকে। তাসিন ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি রেখে বলল, “পালিয়ে যাচ্ছো বুঝি!”

সুপ্রভা কথা বলল না প্রথমেই। ছাতাটা বৃষ্টি আর হাওয়ার তোড়ে বারবার এদিক ওদিক হেলে পড়ছে। বৃষ্টি জল অনেক আগেই সুপ্রভার পরনের শাড়িটা পা থেকে কোমর অব্দি ভিজিয়ে গেছে। তাসিন এক পা দু পা করে একদম সুপ্রভার মুখোমুখি হলো। কোন কিছু না বলে হাতের ছাতাটি কেঁড়ে নিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। সুপ্রভা তখনো কাঁদছে এই বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে তার হলদে গোলাপির মিশ্রণের শাড়িটি, ধুয়েমুছে দিচ্ছে তার চোখের কাজল, গালের ব্লাশ, তার গলা, মাথায় থাকা তাজা ফুলের গহনা। তাসিন মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখতে লাগলো সেই ঝড়কন্যাকে৷ ঝড়-তু*ফা*ন নামটা কিছুতেই বেমানান নয় সুপ্রভার জন্য। এইতো একটু আগেই আয়না ফোন করে অভিনন্দন জানালো তার হবু বউ পালিয়ে গেছে বলে। সে কি করে বলতো তখন আয়নাকে, “আমার পাগল আমার কাছেই আসবে পালিয়ে।”

কান্নার দমকে সুপ্রভা কিছু বলতে পারলো না। তাসিনই বলল, “যত ইচ্ছা কান্না করো আমি সব বলতে থাকি।”

সুপ্রভা তখনও কিছু না বলে কাঁদছে। তাসিন বলল, ” হোস্টেল থেকে যেদিন তুমি চলে আসছিলে সেদিন আমি গিয়েছিলাম তোমার কাছে তোমাকে প্রপোজ করতে। আমার যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমার বাবা মানুষটা বড্ড সরল৷ মামীর মুখে জেনেছিল আমি একটা পা*গল কথায় কথায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে ভালোবাসি। সেদিনই কোন দিক বিদিক না ভেবেই এহসানের মায়ের কাছে প্রস্তাব রাখে তোমাকে পছন্দ হয়েছে বলে। তোমার পরিবার রাজী হয়ে গেল ছেলের বায়ো আর গ্রামে খোঁজ নিয়ে৷ ততদিনে আমি সুন্দর একটা দিন খুঁজছিলাম মনে মনে তোমাকে জানাতে। কিন্তু দূর্ভাগ্য কিনা জানি না আয়নার বিয়ের দিন আমি তোমার অনুভূতি জেনে যাই মুরাদের মাধ্যমে। ওই যে টিয়ার সাথে বলছিলে তুমি ভালোবাসো তাসিনকে!”

তাসিনের কথা শুনে কান্নার মাঝেই অবাক হয়ে গেল সুপ্রভা। তাসিন আবার বলল, “আমি তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভুলেই গেলাম কোথায় আছি। রাস্তার মাঝেই হাটছিলাম আর তখনি বেখেয়ালে এক রিকশার তলায় পড়লাম।”

সুপ্রভার এবার কান্নাই বন্ধ হয়ে গেল। সে তাসিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকালো। তাসিন বলল, “কালই ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে নইলে তো পঙ্গু বর হয়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হতো।”

বৃষ্টিতে সুপ্রভার মাথার ঘোমটা লেপ্টে আছে। চুল আর কপালের ফুলগুলো ইতোমধ্যে খুলে গেছে একটুআধটু। তাসিন রাস্তার চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে কোন গাড়ি আছে কিনা! না এ পথটা একদমই খালি আজ বৃষ্টি বলে। বৃষ্টিতে ভিজে সুপ্রভার এবার গা কাঁপছিলো কিন্তু তাসিনের কথা শেষ হয়নি। সে এবার একদমই হুট করে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রাস্তায়। পকেট থেকে খুব চিকন আর অতি সাধারণ এক গোল্ডের চেইন বের করে এগিয়ে ধরলো, “সুপ্রভা শিকদার উইল ইউ বি মাই তু*ফান?” চেইনটা সে আগেই কিনেছিল কিন্তু প্রপোজ করার দিনটা তার কিছুতেই আসছিল না।

আশেপাশে কোথাও বুঝি একটা বাজ পড়লো। ভয়ে কেঁপে উঠলো সুপ্রভা তারপরই তাসিনের দিকে তাকিয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তাসিন পুনরায় একই প্রশ্ন করলে সুপ্রভা এলোমেলো মাথা নাড়লো। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে তাসিন উঠে দাঁড়ালো। দু বাহু টেনে সুপ্রভাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমো খেতেই সুপ্রভা ঢলে পড়লো তাসিনের বুকে৷

“তু*ফান এমন সাইক্লোনের বেগে থামলো কি করে!” বলেই তাসিন আরো প্রশস্ত হাসলো।

______সমাপ্ত______