বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-২১+২২

0
355

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২১)
হুযাইফা মাইশা

পূর্ণতা বলা জায়গাটা কল্পনার চেয়েও আরো সুন্দর লাগলো ইয়াভকিনের। জায়গাটা নিরিবিলি। আসতেও সময় লেগেছে। বড় রেষ্টুরেন্ট না যদিও, তবুও কয়েক জোড়া কপোত-কপোতীদের আনাগোনা আছেই। টেবিল গুলো দূরে দূরে। দারুণ লাইটিং করা সেই সাথে। দূরত্ব বজায় রাখা সেজন্য অন্যদের কথাবার্তা কানে আসেনা। মেইন রোডের পাশে না বলে গাড়ি-টাড়ির শব্দ কানে আসছে কম। একপাশে বসল দু’জনে। পূর্ণতা আড়চোখে সবদিক দেখে নেয় একবার। আঁচল তার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইয়াভকিন চেয়ার টেনে পাশে এনে বসল। আঁচল তুলে দিল কোলে। এখানে এসে দুজনে খেয়াল করল আজ পূর্ণিমা। নীলিমায় মস্ত বড় চাঁদ। মিটমিটি তারা নেই যদিও। চাঁদের আলোয় মাখামাখি চারপাশ। পূর্ণতার একগালে হাত রাখতেই গুটিয়ে গেল সে,
‘ মানুষ আছে এখানে।’
‘ ঘরেও লজ্জা বাইরেও লজ্জা।’
‘ তো? মেয়ে মানুষের লজ্জা থাকবেনা!’
‘ হুহ, থাকবে তো। কিন্তু স্বামীর সাথে কিসের লজ্জা! ঠিকঠাক মতো তাকালেও লজ্জা, চুমু খেতেও লজ্জা।’ ইয়াভকিনের ঠোঁটে দু’ষ্টু হাসি।
‘ দোহাই লাগে চুপ করুন। কেউ শুনে ফেলবে।’
‘ এখানে সবাই কাপল। যার যার প্রেম আলাপে ব্যস্ত। কেউ এদিকে কান দিচ্ছেনা।’

পূর্ণতা আর কথার পিঠে কথা বাড়াল না। খানিক পরে খাবার অর্ডার দিয়ে খেয়ে নিল দু’জনে। খাওয়া শেষে গাড়ির পাশটায় আসলো ইয়াভকিন। দরজার পাশটায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে পূর্ণতাকে ডাকে,
‘ পূর্ণতা? এদিকে আসো।’

পূর্ণতা পা ফেলে এগিয়ে আসে। হাত ধরে টান দিয়ে কাছে আনে তাকে ইয়াভকিন। কাঁধের পাশটায় একহাত চেপে বলে,
‘ দেখি এদিকে তাকাও।’

একবার নীলিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে দৃষ্টি নেয় পূর্ণতার মুখপানে। হাত দিয়ে থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে বলে,
‘ আমার চাঁদ বেশি সুন্দর।’
পূর্ণতা অধর গলিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। মাথা এলিয়ে দেয় ইয়াভকিনের বুকে।
_

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। বরাবরের মতো স্পীডে গাড়ি চলছেনা। বরং গাড়ির গতি ধীর। ইচ্ছে করেই আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে ইয়াভকিন। পূর্ণতা অতিষ্ট হয়ে বলল,
‘ এর থেকে তো রিকশা আরও জোরে চলে।’

বলতে বলতে সে চুলগুলো প্যাঁ’চিয়ে হাত খোঁপা করল। মিনিট কয়েক গড়াতেই তা ঝরঝর করে পিঠে এলিয়ে পড়ল। মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও খোঁপা করল পূর্ণতা। সিটে পিঠ ঠেকাল। গরম লাগছে তার। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে। সেদিকে তাকাল একবার ইয়াভকিন। বলল,
‘ এসি ছেড়ে দেই?’
‘ না, জানালা গুলো খুলে দিন।’

জানালা নামালেও বাতাস আসলোনা। বাইরে বাতাস নেই। পূর্ণিমার আলোয় তখন চারপাশ বেশ পরিষ্কার। পূর্ণতা শান্ত হয়ে বসল। রাত বাজে বারোটার উপরে। ঘুমও পেয়েছে বেশ। ক্লান্ত দুজনে কাল অফিস-ভার্সিটিতে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। পূর্ণতা হাই তুলতেই হাত টেনে নিল ইয়াভকিন। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ ঘুমাবে না।’
‘ ঘুম পাচ্ছে তো। ঘরেই কিছু একটা করে নিলেই হত। এত রাত হয়েছে! কালকে না আপনার অফিস?’
‘ বউয়ের জন্য নাহয় আরেকদিন ছুটি নিলাম। কি বলোতো? সবাই বুঝবে আমি বউ পা’গ’ল।’

‘ছিহ’ বলে সরে গেল পূর্ণতা। ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকাতেই ইয়াভকিন আবার বলল,
‘ ঘরে থাকলে কি আর এমন সুন্দর রাত উপভোগ করতে পারতে? বলো?’

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝাল পূর্ণতা। মাথা এগিয়ে এনে ইয়াভকিনের কাঁধে রাখল।

ক্লান্ত দুজনে যখন ফ্ল্যাটে ফিরল তখন একটার কাছাকাছি বাজে।
পূর্ণতা ইয়াভকিনের রুমে ঢুকে বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে পড়ল। অগোছালো শাড়ি আর ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘুমঘুম ভাব পাচ্ছে তার। ইয়াভকিন আস্তে ধীরে রুমে আসল। ঝুঁকে গিয়ে বলে,
‘ পূর্ণতা? কাপড় পাল্টাবে না?’

‘ না, ঘুমোতে দিন।’

পূর্ণতা কাত হয়ে শুয়ে। বাঁকা হেসে এগিয়ে গিয়ে নিজেও গা এলিয়ে দিল ইয়াভকিন। শাড়িটা অগোছালো হওয়ায় পেটের একাংশ দৃশ্যমান। চুলগুলো ঢিলেঢালা খোঁপায় ব’ন্দি। পূর্ণতা চোখ বুজে পড়ে আছে। আচমকা ইয়াভকিন ঘাড়ে মুখ গুজ’ল। উন্মুক্ত পেটে ঠান্ডা হাত খানা চেপে ধরে বলল,
‘ এই রাত পুরোপুরিই নাহয় আমাদের হোক, পূর্ণতা?’

পূর্ণতা কেঁপে উঠল। ফট করে চোখ মেলে তাকাল। জানালা গলিয়ে গগণের সেই পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জানালাটা বেড থেকে দূরে নয়। কিঞ্চিৎ আলো এসে হাত’ছানি দিচ্ছে। ইয়াভকিনের স্পর্শ গাঢ় হতেই পূর্ণতা চোখ-মুখ খি’চে বন্ধ করল! আজ নাহয় স্বয়ং চাঁদও তাদের ভালোবাসার সাক্ষী থাকুক!

_

পূর্ণতা বর্ষার মুখোমুখি বসা। পাশে বসা নওশিন। মাথার উপর বিশাল গাছ। ঘাসের উপর বসা তিনজনে। ক্লাস নেই কারোরই। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পূর্ণতা আশপাশে তাকাচ্ছে খানিক পর পর। গেটের দিকটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ইয়াভকিন যদি নিতে আসে? সকালে আসতে দিতে চায়নি। পূর্ণতার গায়ে ব্যথা। লজ্জায় পূর্ণতা জোর করে বেরিয়ে এসেছে। মুখটাও কেমন লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে তার। বর্ষা না পারতে হেসে বলে ফেলে,
‘ দুলাভাই কি বেশি ভালোবাসছে নাকি ইদানীং? এতো লজ্জা পাস!’

কিছু বলার আগেই পুরুষালী কণ্ঠ কানে এল,
‘ তোমার বান্ধবী চাইলে আজ আমি তোমার দুলাভাই থাকতাম।’

তন্ময়ের কণ্ঠ! বাঁকা হেসে সে নিচের দিকে অর্থাৎ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পেছনে তার চার জন বন্ধু। পূর্ণতা সেদিকে নজর বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। সাথে উঠল বর্ষা আর নওশিনও। দু’কদম পিছালো তিনজনেই। দূরত্ব বাড়লো।

‘ দেখুন ভাইয়া, এই টপিকে কথা না তুললেই ভালো হয়। ও ম্যারিড জানেনই তো। শুধু শুধু এসব…’

বর্ষাকে থামিয়ে দিল তন্ময়,
‘ শুধু শুধু? ও আমার ওর হাজবেন্ড কে দিয়ে মা’র খাইয়েছে। জানেনা, আমার বাবা কে?’

তিনদিন ঠিকঠাক মতো হাঁটতে না পারার কথাটা চেপেই গেল তন্ময়। মস্তিষ্ক সে সময়ের ঘটনা হা’না দিতেই তার চোখ মুখ কুঁচকে এল। তন্ময় সেদিন বাসায় ফিরছিল। পথিমধ্যে তার বাইকের সামনে কার আসায় যারপরনাই বিরক্ত হয়ে অকথ্য গা’লি’গা’লা’জ শুরু করল। মিনিট কয়েক পর কার থেকে ইয়াভকিনকে বেরিয়ে আসতে দেখে সে থমকালো বটে। ইয়াভকিনকে সে আশা করেনি। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে পূর্ণতার স্বামী সে। একটু খোঁজ নিয়ে জানতে সমস্যা হয়নি। কথা বার্তা ছাড়াই আকস্মিক ইয়াভকিন মা’র’তে শুরু করল। নাক বরাবর পরপর দু’টো ঘু’ষি পড়তেই সে যেন ব্যথা সহ্য করতে পারলনা! বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে, বাবা নামকরা বিজনেসম্যান। ছেলের গায়ে আঁচ আসতে দেননি কোনোদিন। এজন্যই হয়ত বখে গেছে ছেলে। নেতিয়ে পড়ে ছিল তন্ময়। হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে যেতেই পা দিয়ে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল ইয়াভকিন। রাস্তার ধার হতে গাছের ডাল সংগ্রহ করে পা বরাবর বেশ কয়েকবার আঘা’ত করে ক্ষান্ত হয়েছিল সে। ঝুঁকে এসে ফুঁস-ফুঁস করে বলেছিল,
‘ লাস্ট ওয়ার্নিং, আমার ওয়াইফের আশেপাশে তোকে দেখলে মাটিতে গে’ড়ে দেব। আর তোর বাবাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। চিনি বলেই আজ বেঁচে গেছিস। নেক্সট টাইম এই ভুল করলে ভুলে যাব তোর বাবা কে!’

বলে সে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেছিল। তন্ময় বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়ে ছিল। এই রাস্তাটা নিরিবিলি। যানজট নেই, এই কারণে সে রোজ এদিক দিয়েই যাতায়াত করে। কিন্তু আজ হয়ত এদিকে না আসলেই হতো!
ভাবনার সুতো ছিঁড়ে পূর্ণতার কথায়,
‘ আপনি যেচে পিছু পড়লে কি আর করার? যে কারোর হাতেই মা’র খাবেন। দয়া করে আর সামনে আসবেন না। আমি আর ঝা’মেলা চাইনা, প্লিজ।’

হাতজোড় করার ভঙ্গিতে বলে পূর্ণতা মাথা একটু নুয়ালো। পরপরই বর্ষা আর নওশিনকে নিয়ে সরে এল। তন্ময়ের রাগ লাগলেও কিছু বলার নেই। বাবার সঙ্গে ইয়াভকিনকে পরবর্তীতে দেখেছে সে। বিশেষ কাজে বাবার অফিসে গিয়েছিল, সেখানেই মূলত দেখা। তার বাবা তন্ময়কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বেশ নরমাল ভাবেই অপরিচিতদের মত কথা বলেছিল ইয়াভকিন। সে মূলত ব্যবসার কাজে গিয়েছিল সেখানে।

ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই ইয়াভকিনের বারোটা মিসড কল নোটিফিকেশন বারে উঁকি দিল। ঢোক গিলে পূর্ণতা বর্ষা আর নওশিনের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে এল। রাস্তার ওপাশে ইয়াভকিন দাঁড়িয়ে। কার নেই সাথে। লালচে দেখাচ্ছে মুখ। সকালের ফর্মাল ড্রেস আপ বর্তমানে অগোছালো। ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত। পূর্ণতা রাস্তা পার হয়ে যেতেই প্রশ্ন ছুড়ল সে,
‘ ফোন কোথায় থাকে তোমার? কল আসছে কিনা খেয়াল না করলে ফোন রেখেছো কেনো সাথে?’
‘ ব্যাগের ভেতর ছিল তাই শব্দ শুনিনি।’

‘সাইলেন্ট করা’ ব্যাপারটা বললনা পূর্ণতা। এটা বললে হয়তো ইয়াভকিনের নিকট হতে আরও ঝাঁঝা’ল বাণী শুনতে হবে। ইয়াভকিন পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। এই বাতাসেও সে ঘামছে! পূর্ণতা ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
‘ গাড়ি কোথায়?’
‘ সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাই গ্যারেজে দিয়ে এসেছি। শাফায়াত নিয়ে আসবে বিকালে। এখন বলো? রিকশায় যাবে তো?’
‘ হেঁটে যাই?’

অসহায় চোখে তাকাল ইয়াভকিন। অফিস থেকে হেঁটেই সে এসেছে এতটুক। এজন্যই ঘেমে গেছে। রিকশা পায়নি একটাও। পূর্ণতা সে দৃষ্টির অর্থ বুঝে, বলল,
‘ আচ্ছা, রিকশা নিয়ে নেই।’

_

ঊর্মির ইদানীং কিছু ভালো লাগেনা। মেডিকেল থেকে সে ফিরে উদাস হয়ে। পড়াশোনায়ও মন বসছেনা তার। বার বার ম্যাসেঞ্জারে ঢু মে’রে আসছে। কিন্তু যার কাছ থেকে একটা ম্যাসেজ আশা করছে, সে দিচ্ছেনা! লাস্ট কথা হয়েছে গত পরশুর আগের দিন। শেষ ম্যাসেজটা ঊর্মিরই। আজকেও মেডিকেলে ক্ষীণকালের জন্য ইয়াদকে দেখেছে সে। চোখাচোখি হয়নি, ইয়াদ তাকায়নি। তার হাতে বই ছিল। বন্ধুদের নিয়ে সে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করছিল। কফি খেতে খেতে ফেসবুক আইডি আদান প্রদান করেছে দুজনে। পরেরদিন থেকে টানা কয়েকদিন চ্যাট করেছে দুজনে। কিন্তু হুট করে ম্যাসেজ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইয়াদ। ঊর্মি নিজ থেকে দিচ্ছেনা আর। হয়তো ইগোর কারণে!

রিতু বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছে ঊর্মি এই খামখেয়ালিপনা। এই তো, প্রায় তিন মিনিট হতে চললে সে ঊর্মির পাশে চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার বলছে, ‘ আপা, তোমার চা।’
কিন্তু ঊর্মি সেই কলম মুখে দিয়ে কি যেন ভাবছে। তাই সে একহাত বাড়িয়ে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘ আপা?’
চমকে উঠে ঊর্মি,
‘ হ্যাঁ।’
‘ ধরো, তোমার চা। কতো সময় ধরে মুখের সামনে নিয়া ছিলাম। কি ভাবছিলা?’
‘ কিছুনা রিতু। তুই যা।’

মাথা নাড়িয়ে চলে এল রিতু। এ বাসায় তিন বছর যাবত কাজ করে সে।
বিথি রান্নাঘরে। রিতু যেতেই জিজ্ঞেস করেন,
‘ দিয়েছিস চা?’
‘ মুখের সামনে কতোক্ষণ ধরা ছিলাম। কি যেন ভাবতেছিল আপায়।’
‘ কি?’
‘ বলেনাই তো।’
‘ তাহলে?’
‘ আমার মনে হয়কি?’
‘ কি?’
‘ আপায় মনে হয় প্রেম-পিরিতে জড়ায়া যাবে।’

চোখ মুখ শক্ত হল বিথির। এই একটা জিনিসই সহ্যের বাইরে উনার! প্রেম নিয়ে উনার এতো বিরোধ! শক্ত মুখে চেয়ে বললেন,
‘ আমার মেয়ে ওমন না রিতু। ফালতু বকিস না। আমার মেয়ে আমার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে ওইসব প্রেম-ট্রেম করবেনা। দেখিস।’

চলবে।

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২২)
হুযাইফা মাইশা

দিন কয়েক পরের কথা। ইয়াভকিন ফিরেছে সবে। বারোটা বাজে। দুপুরে আসলেও আজ একটু জলদি এসেছে। কাজ নেই, ভালো লাগছেনা এটাই মূল কারণ। সে যখন এসে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে তখন চিন্তা গ্রাস করল। পূর্ণতা ভার্সিটিতে যায়নি। শরীর খারাপ লাগছিল তাই। সকালে বিছানা ছেড়েও উঠেনি। ইয়াভকিন চা-নাশতা বানিয়েছে নিজেই। পূর্ণতার জন্য টেবিলের উপর রেখে কপালে চুমু-টুমু খেয়ে বেশ কয়েকবার বলে গেছে, ‘ কোথাও যাবেনা এই গরমে। ঘরে থাকবে। বেশি দরকার হলে আমাকে কল দিবে। আমি চলে আসবো জলদি।’

পূর্ণতার ফ্ল্যাটে থাকার কথা, সেখানে বড় তালা ঝুলছে কেন? ইয়াভকিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে পকেট থেকে ফোন বের করে বেশ কয়েকবার কল করলো পূর্ণতাকে। কল রিসিভ হলোনা। চিন্তায় সে নেমে এল ছয় তালা থেকে। দারোয়ান বেশ ভালো করেই তাকে চেনে। সে এগিয়ে গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ চাচা, আমার ওয়াইফকে দেখেছেন?’
‘ না তো বাবা।’

বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর ‘না’—ই আসলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে যখন সে ফের ছয়তলায় উঠে এল, তখনই সামনের ফ্ল্যাট থেকে পূর্ণতাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। সে দিব্যি হেসেখেলে বেরোচ্ছে। পাশে রাফিয়া। পূর্ণতার ফ্ল্যাটে সকালে গিয়েছিলেন উনি। মেয়েটা অসুস্থ দেখে গল্প গুজব করতে করতে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে খাইয়েছেন কতো কি!
কথা বলতে বলতে যখন বেরোল পূর্ণতা, আচমকাই নজর গেল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াভকিনের দিকে। যার চোখ-মুখ শক্ত। শান্ত হলেও কেমন ভয় করছে পূর্ণতার। রাফিয়ার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে সে দ্রুত হেঁটে এসে ফ্ল্যাটের তালা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল। ইয়াভকিন ঢুকার সময় আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি জলদি আসবেন, বলে যাবেন না? কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন?’

জবাব পেলনা পূর্ণতা। ইয়াভকিন অফিসের ব্যাগটা সোফার উপর রাখল বেশ জোরেই। জুতো না খুলেই রুমে ঢুকে গেল গটগট পায়ে। পূর্ণতা দরজা লাগিয়ে পিছু নিল। ব্লেজার খুলে সেটা বিছানার উপর একপ্রকার ছুঁড়েই মা’রল ইয়াভকিন। পূর্ণতা অত্যন্ত বিস্ময় সহিত চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে আপনার? রেগে আছেন কেন?’
‘ তুমি ওখানে কি করছিলে?’
‘ আন্টির সাথে গল্প করছিলাম। একা ছিলাম তাই।’
‘ বেশ, ফোন কোথায় তোমার?’

জিহবায় কাম’ড় দিল পূর্ণতা। কাতর মুখে চেয়ে বলল,
‘ সরি খেয়াল ছিলনা। এজন্য রেগে গেছেন? আশ্চর্য ব্যাপার! হারিয়ে তো যাইনি।’

রক্তিম চোখে তাকায় ইয়াভকিন। মাথায় আগু’ন ধরিয়ে দিচ্ছে পূর্ণতার কথাগুলো। প্রত্যুত্তর না দিয়ে সে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে।

পূর্ণতা ব্লেজার জায়গামতো রেখে বেরিয়ে এল। দুপুরের খাবার সে আগেই রান্না করে ফেলেছে। সেগুলো সুন্দর মতো বেড়ে আবার রুমে এল। অন্য রুম থেকে কাপড়-চোপড় সেদিনই এনে ফেলেছে। ইয়াভকিনের আদেশ তাই! দিন কয়েকের মধ্যে বেশ রাগারাগি করেছে ইয়াভকিন। প্রতিবারই রাগের মাত্রা তার আকাশ ছুঁয়েছে। এই একটা কারণে পূর্ণতা বেশ ভীত থাকে প্রায় সময়। হুটহাট ইয়াভকিন রেগে যায়। যেই-সেই রাগও না। রেগে যখন জ্বলন্ত চোখে তাকায়, পূর্ণতা কেঁপে উঠে।

ইয়াভকিন গোসল করেই বের হল একেবারে। সে বিছানায় বসতেই বারান্দা থেকে বেরিয়ে এল পূর্ণতা। গলার কাছটায় ওড়না আরেকটু টেনে-টুনে বলল,
‘ খাবেন চলুন।’
‘ তুমি খেয়ে নাও।’
‘ আপনাকে ছাড়া খাবোনা।’
‘ ক্ষিদে নেই আমার।’
‘ তাহলে আমিও খাবোনা।’

তাকাল ইয়াভকিন। সে দৃষ্টিতে বিরক্তি ঝরে পড়ল যেন। বলল,
‘ তুমি জেদ করা ছাড়বেনা, তাইনা?’
‘ আপনি এমন কেন করছেন? আন্টির ফ্ল্যাটে গেলে কি?’
‘ তুমি জানো কল রিসিভ না হওয়ায় কতো টেনশনে ছিলাম? আইডিয়া আছে কোন? দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি অব্দি। আমার কেমন লেগেছে জানো?’

পূর্ণতার বড় বড় নেত্রযুগলের কোণে নোনা জল জমল। সে দু’কদম পিছিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?’

বিড়বিড় করে বললেও এই বাক্যখানা কানে আসলো ইয়াভকিনের। রাগ না কমলেও কেমন অশান্তি শুরু হল এবার। সে চট করে এগিয়ে গিয়ে পূর্ণতার নিকটে এল,
‘ বাসি তো! খুব বাসি। একমাত্র তোমাকে আমি ভালোবাসি, পূর্ণতা। এভাবে বলোনা..’
‘ সরুন।’
পূর্ণতা সরে যেতে চাইল, পারলোনা। ইয়াভকিন ঝাপটে ধরল তাকে। কাঁধের নিচে কপাল চেপে ধরে বলল,
‘ তুমি চাইলেও আমার থেকে সরতে পারবেনা পূর্ণতা। আমি সরতেই দিবনা।’
‘ আপনি অযথা রাগ দেখান।’ ফুঁপানোর স্বর ভেসে এল।
‘ সরি, সরি। অফিসে ভীষণ ঝা’মেলা। না চাইতেও মেজাজ খারাপ হয়। কি করব বলে? আজকে কাজ ছিলনা তাই জলদি এসেছি। তুমি অসুস্থ ছিলে সেজন্যও। এসে দেখি ফ্ল্যাটে তালা। কল রিসিভ হয়না। রাগ উঠবেনা, বলো?’
ফুঁপানো থেমে গেল মুহুর্তেই।

ঊর্মির সামনে আচমকা পুরুষালী অবয়ব ভাসতেই সে চমকে উঠল। ইয়াদ ক্লাসে এসেছে তার। ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ইয়াদ শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ মিস ঊর্মি, লেখা বাদ দিয়ে যদি একটু আসতেন আমার সঙ্গে? খুবই দরকারি কথা আছে।’

ঊর্মি ক্লাসে চোখ ঘুরাল। বেশ কয়েকজন বসে আছে। গোলগোল চোখে তাকাচ্ছেও।
ঊর্মি সময় ব্যয় না করে উঠে পড়ল। পিছু নিল ইয়াদের। ইয়াদ মেডিকেলের বাইরে নিয়ে এল তাকে। ছায়াতলে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ বের করে বলল,
‘ তোমার প্রতি আমি অন্য রকমের অনুভূতি ফিল হয়, ঊর্মি। জানিনা কিভাবে, কিন্তু একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি। প্রথমে ভালোলাগা হলেও এখন সেটা ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে। আমি সুন্দর মতো প্রপোজ করতে পারবোনা, ঊর্মি। এভাবেই এক্সেপ্ট করো নাহয়। জোর করছিনা, তোমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে সব। উত্তরটা এখনই দিলে ভালো হয়, আমার ধৈর্য্য কম।’

গোলগোল চোখে তাকিয়ে ঊর্মি ঢোক গিলল। একটু পিছিয়ে বলল,
‘ আমার মা, আমার মা এসব পছন্দ করেন না।’
‘ আর মাত্র দুই বছর। মেডিকেল, ইন্টার্নি শেষ করে ফেলব। তখন মানবেন উনি। তোমার উত্তর কি? এবার বলো।’

লজ্জায় আড়ষ্ট ঊর্মি সাহস করে হাত বাড়িয়ে ফুলটা নিয়ে নিল। মুখে উত্তর দেয়া লাগলনা তার। ফুল নিতেই অধর প্রসারিত করে চওড়া হাসল ইয়াদ।

চলবে।
রিচ্যাক দেইনি।