বৃষ্টিস্নাত তুমি পর্ব-২৯+৩০

0
447

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (২৯)
হুযাইফা মাইশা

ইয়াদ আজ হুট করে হাজির হলো। ইয়াভকিন বাড়িতে ছিলোনা। প্রতিভাও স্কুলে যাচ্ছেনা ইদানীং। সকালে উঠে কান্নাকাটি করে শুয়ে পড়ে আবার। আজও তাই করেছে। পূর্ণতা রান্না ছেড়ে কলিং বেলের শব্দ শুনে ছুটে এসে দরজা খুলে। ইয়াদকে বলে অবাক হয়ে বলে,
–” ভাইয়া! আসুন।”

ইয়াদ ভেতরে এসে সোফায় বসে। টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বলে,
–” মা মেয়ে রেডি হয়ে নিন ভাবি। শপিং এ যাবো আজ। আপনার বোনের পছন্দ তো আপনার জানা আছে তাইনা?”
–” আমার জানার কথা তো না! সাড়ে চার বছর করেছেন, এটুকু তো জানবেনই।”

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকায় ইয়াদ। বলে,
–” এভাবে বলবেন না ভাবি। সাড়ে চার বছর ওর সঙ্গে কতবার ঝ’গ’ড়া হয়েছে সেসবের হিসেব নেই। লাস্ট বারের মতো ব্লক দিয়ে সাংঘা’তিক কান্ড বাঁধিয়েছিল।”
–” ইশ! কি দুঃখের কথা!”
–” মজা নিবেন না ভাবি, আসলেই খুবই দুঃখজনক ব্যাপারটা। সেসব কথা তুলবেন না আর, কষ্ট হয়।”

হা হুতাশ করে ইয়াদ। প্রতিভা বেরিয়ে আসে। ইয়াদের কোলে চ’ড়ে বসে। ইয়াদ জিজ্ঞেস করে,
–” স্কুলে যাওনি মামনি?”

–” ও স্কুলে যায় পড়াশোনা করার জন্য? খেলতে যায় শুধু। চার বছরের বাচ্চাকে কেউ স্কুলে দেয় নাকি! আপনার ভাই তো পা’গ’ল। মেয়ে বলেছে স্কুলে যাবে সেজন্য প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পাঠায় এখন। যেদিন মন চায়না, মেয়েটাও যায়না।”

প্রতিভা বড় বড় পল্লব ঝাপটিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। ইয়াদ হেসে বলে,
–” যান ভাবি, রেডি হয়ে নিন। আমার মা কেও রেডি করিয়ে দিন। অফিস থেকে ভাইকেও সঙ্গে নিব।”
–” হাসপাতালে যান নি নাকি?”
–” ছুটি নিয়েছি।”

পূর্ণতা প্রতিভার দিকে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়। মেয়েটা বাইরে যাওয়ার কথা বুঝে গেছে, সেজন্যই চুপ করে আছে। মায়ের সঙ্গে চুপচাপই রেডি হলো। তবে বিপত্তি ঘটলো চুল বাঁধার সময়। সে নানান রকম প্রশ্ন শুরু করলো। যেমন, ” বাইরে কি জুস খাবো?”, “বাবা কই?”, “বাবা কেন আসেনা?”

অতিষ্ঠ হয়ে পূর্ণতা বলে,
–” তোর বাবা আসলে সব জানতে পারবি।”

মেয়েটা চুল না বেঁধেই ফুঁপিয়ে ছুটলো। পূর্ণতা নিজে রেডি হলো গজগজ করে। ফোন বের করে ইয়াভকিনকে কল করলো একবার। ইয়াভকিন কল না ধরায় আরো বিরক্তি আর রাগ চেপে ধরলো তাকে। সে মাথায় ওড়না তুলে বেরিয়ে আসলো।
প্রতিভা ইয়াদের ঘাড়ে মাথা রেখে বসে আছে। ফুঁপিয়ে কান্না করা তার মিনিটের মধ্যেই শেষ। তবে ফর্সা চোখ-মুখ লাল দেখাচ্ছে। পাতলা কালো চুলগুলো অগোছালো। গায়ে বেবি পিংক কালারের একটা ফ্রক। কালারটা ওর ভীষণ প্রিয়, কোথাও যেতে হলে এই রঙের জামার পড়ার জেদ ধরে সে। পূর্ণতা এগিয়ে আসে। আফসোসের স্বরে বলে,
–” এদিকে আয়, দেখি। চুলগুলোর কি অবস্থা!”

প্রতিভা ইয়াদকে ঝাপটে ধরে বসে রয়। ছাড়েনা। ইয়াদ না পারতে বলে,
–” থাক ভাবি,এভাবেই সুন্দর লাগছে আমার মাকে। চলুন এবার।”

_

ইয়াভকিন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদ আগেই জানিয়েছে যাওয়ার কথা। পূর্ণতার ফোন ধরতে পারেনি, শাফায়াতের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল। ভুলক্রমে সে ফোনটা অফিসেই রেখে ছুটেছে।
ইয়াদের গাড়িটা সামনে আসতেই সে দরজা খুললো। সামনের সিটে ইয়াদ আর প্রতিভা বসা। পূর্ণতা মাথা এলিয়ে বসা পেছনের সিটে। প্রতিভাকে একহাতে ধরে রেখেছে ইয়াদ। জেদ করে সামনে বসেছে। ইয়াভকিন পেছনে উঠে বসলো। প্রতিভা ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
–” তুমি আসলে না?”
–” আসলাম তো মামনী।”
–” আমার কাছে।”
–” তুমি আসো বাবার কাছে। সামনে বসতে পারবেনা, আসো।”

মেয়েকে পেছনে নিয়ে আসে। পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে তাদের কান্ড দেখছে। সে যেন গাড়িতে নেই!
ইয়াভকিন মেয়েকে বসানোর বাহানায় তার দিকে ঝুঁকে এল। ফিসফিস করে প্রশ্ন করল,
–” রাগ করেছ, আমার পূর্ণতা?”

ফুঁস-ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মুখ ফিরায় পূর্ণতা। ইয়াভকিন হাসে। প্রতিভা তার বুকে মাথা রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা হুটহাট শান্ত থাকে। পূর্ণতার সাথেই তার যতো জে’দ, আহ্লাদ। বাবার কাছে এলে সে শান্ত হয়ে যায়। আনমনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ইয়াদকে জিজ্ঞেস করে,
–” কি একটা অদ্ভুত টাইমিং এ বের হলি? দুপুরে কেউ শপিং করতে বের হয়?”
–” আমি তো আগেই বের হতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম এত উপকার করেছো, একটা ট্রিট দেই। লাঞ্চ ট্রিট। আমি তোমার মতো অকৃতজ্ঞ নই তো ভাই।”

পূর্ণতার দিকে একপলক তাকায় ইয়াভকিন। মেয়েটার চোখ-মুখ আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। একা হাতে সব সামলায়। বাচ্চা সামলানো কি চাট্টিখানি কথা? সে নাহয় দিনের বেলা অফিসে থেকে কাজটাজ করে। কিন্তু মেয়েটা ছুটোছুটি করে প্রতিভার পেছনে। সে জানে প্রতিভাকে খাওয়াতে পড়াতে কতোটুকু কষ্ট পোহাতে হয়। অন্যহাতটা পূর্ণতার হাতের উপর রাখে ইয়াভকিন। চোখে চোখ রাখে পূর্ণতা। ইয়াভকিন চমৎকার হাসে। চোখে চোখে রাগ মিটায় পূর্ণতা। পরক্ষণে ইয়াভকিনের কাতর দৃষ্টি পরিলক্ষিত করে তার মন গলে।

_

আজকের শপিংটা শুধু ঊর্মির জন্য। কাজল সাফসাফ বলে দিয়েছেন, ঊর্মির কাপড় চোপড় ওর পছন্দেই কিনতে। বিয়ের পূর্বে সবাই আসবেন আবার। একেবারে নিজেদের কিনাকাটা করবেন। ইয়াদ মানা করেনি। দেরী করতে চাচ্ছেনা সেজন্য ছুটে আসে শপিং করতে। হাতে সময় কম। ঘুরে ঘুরে শাড়ি, লেহেঙ্গা কিনে নিয়েছে। লাঞ্চটাও এক ফাঁকে করে নিয়েছে সকলে। শুধু প্রতিভা বাদে। বাইরের খাবার বলতে সে জুস, চিপসই খায়। সেজন্য লাঞ্চের সময় সে মুখ ফুলিয়ে বসে ছিল। পুরো মার্কেট ঘুরলো বাবার কোলে চড়েই। পূর্ণতা কিছু বলেনি।
পূর্ণতা হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এল। একটা শাড়ি চোখে লেগেছে ভীষণ। লাল রঙের শাড়িটার পাড় সোনালি। হাত দিতেই আচমকা পরিচিত কণ্ঠ কানে এল,
–” ওটা একচুয়েলি আমার। অর্ডার কনফার্ম করলাম মাত্র।”

পূর্ণতা ঘাড় ফেরায়। তিহাকে দেখে হতভম্ব হয়। তিহাও তাকে দেখে মা’রাত্মক ভাবে চমকায়। ইয়াভকিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা সে আর করেনি। তখন চাপা জেদ কাজ করছিল। ইয়াভকিনকে সে ভালোবাসেনি ঠিকই, তবে মোহে পড়েছিল।

পিছু পিছু উপস্থিত হয় ইয়াভকিনও। তিহাকে দেখে চমকে উঠে। তিহা জানতো ইয়াভকিনও এখানে। আন্দাজ করেছে আরকি। কোলে বাচ্চাটাকে লক্ষ্য করলো এরপরই। অবাক নয়নে চেয়ে বলল,
–” ইয়াভকিন, কেমন আছিস? বাচ্চাটা কে?”

ইয়াভকিন অপ্রস্তুত জোরপূর্বক হেসে বলে,
–” ভালো আছি, ও আমার মেয়ে। প্রতিভা, প্রতিভা ইমতেহান।”

তিহা এবার পূর্ণতার দিকে তাকায়। অবাক হয়েছে যে সেটা এখনও স্পষ্ট। তবুও হালকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
–” কেমন আছো পূর্ণতা? বাচ্চাটা ভীষণ মিষ্টি।”
–” ভালো আছি, আপু। আপনি?”
–” হ্যাঁ আমিও। তা তোমরা হঠাৎ এখানে?”
–” শপিং করতে এসেছি, আপনি?”
–” হাজবেন্ডের সাথে এসেছি শপিং করতে।”

–” বিয়ে করলি কবে?”
ইয়াভকিনের চমকিত কণ্ঠ। তিহা হেসে জবাব দেয়,
–” এইতো দেড় বছরের মতো। আমার হাজবেন্ড সম্পর্কে আমার কাজিন হয়। উপরের ফ্লোরে আছে। ইশ, দেখাটা করাতে পারলাম না!”

তিহা মূলত ইচ্ছে করেই তার স্বামীকে দেখাতে চাচ্ছেনা। বিয়ের প্রতি অনিচ্ছা ছিল তার। বাবা মায়ের জোর করার কারণে চাচাতো ভাইকে বিয়ে করেছে। তাও তার থেকে বয়সে বেশ বড়। দেখতেও তেমন। যদিও ভদ্রলোক প্রচন্ড ভালো। তবে তিহা তাকে ইয়াভকিনের সামনে আনতে চাইছেনা।
সৌজন্যমূলক বিদায় নিয়ে সরে আসে পূর্ণতা।
ইয়াভকিন আসে পিছু পিছু। প্রতিভা ঘাড়ে মাথে ফেলে দিয়েছে। হাই তুলছিল বারবার। পূর্ণতা কোলে নিতে চায়, বলে,
–” দিন, হাত ব্যথা করবে। আমি নেই কোলে।”
–” উহু, লাগবেনা। আমার মেয়ে মা নিজের জন্য কিছু কিনলোনা?”
–” কি কিনবো? সবই তো আছে। শাড়ি-গয়না, কিছুরই তো বাদ নেই।”
–” একটা কিছু কিনো তাহলে। একটা শাড়ি না দেখছিলে?”
–” পছন্দ হয়নি। কিনবোনা। ভাইয়া কোথায়?”
–” ওইতো দোকানে বসে আছে। বেচারার এটুকুতেই পায়ে ব্যথা করছে।”

পূর্ণতা তাকায়। ইয়াদ সত্যিই একটা চেয়ারে বসে আছে। চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ক্লান্ত।

–” আপনার কি? নিজের বিয়ের শপিং তো করেননি নিজে। বিয়ের শাড়িটা অব্দি কিনেননি নিজে দেখে।”
–” আমি জানতাম নাকি আমার বিয়ে? বিয়ের পর তো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি ম্যারিড।”
–” বিশ্বাস করতে করতে বাচ্চার বাপ হয়ে গেলেন।”
অসহায় চোখে তাকায় ইয়াভকিন। পূর্ণতা হেসে ফেলে। দু’হাতে ইয়াভকিনের একহাত আগলে ধরে বলে,
–” দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবেন।”
–” তোমার বিরহেই কান্না আসে আমার।”
–” আমার বিরহে?”
–” হ্যাঁ, আজকাল কাছে পাওয়া যায়না তোমাকে। সবার খেয়াল রাখো অথচ আমার দিকে ফিরেও তাকাওনা!”
–” কি আবোলতাবোল বকছেন?”

ইয়াভকিন হাসে। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–” সেসব বাদ। এখন শুনো?”
–” হু?”
–” দিনদিন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসি এত বাড়ছে, পূর্ণতা! তুমি কি তা টের পাচ্ছো?”

চলবে।

#বৃষ্টিস্নাত_তুমি – (৩০)
হুযাইফা মাইশা

দিন কয়েক পর ইয়াদের বিয়ে। আজ পুরো ইমতেহান বাড়ি আসলো ইয়াভকিনদের বাড়িতে। ইরিন আর তার ছেলেটাও এসেছে। এত মানুষ দেখে ভড়কে গেল প্রতিভা। ইশরাত কোলে নিতে চাইলে সে কান্না করে ছুটলো পূর্ণতার কাছে। কাজল ছাড়া কারোর সঙ্গে তার ওমন সখ্যতা নেই। ইশরাত হতভম্ব হয়ে গেল। পূর্ণতার কাছে গিয়ে বলল,
–” প্রতিভা কি আমাদের চেনেনা?”
–” চেনে চেনে। এখন এসব করবেই। একটু পর দেখবে তোমার কোলে চড়ে বসে আছে।” রান্না করতে করতে জবাব দেয় পূর্ণতা। সায়মা আসেন রান্নাঘরে। হাতে হাতে সাহায্য করতে চাইলে মানা করে দেয় পূর্ণতা। পিছু পিছু আসেন কাজলও। প্রতিভা তাকে দেখে বলে,
–” দাদু কোলে নাও।”

হাত বাড়ান কাজল। চোখের পলকে মেয়েটা কোলে উঠে যায়। ইশরাত ওর নরম গালে মৃদু চাপ দিয়ে বলে,
–” আমার কোলে আসোনা কেন?”
প্রতিভা কাজলের ঘাড়ে মাথা ফেলে দেয়। সরে যেতে বলে কাজলকে। কাজল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যান।

ইয়াসিন সাহেব অনেকক্ষণ যাবত নাতনীর পিছু পিছু ছুটছেন। বাচ্চাটা কোলে আসতে চায়না। আশ্চর্য ব্যাপার! এত বছরেও দাদাকে চিনলোনা?
প্রতিভা ছুটতে ছুটতে কেঁদে ফেলে। এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বলে,
–” বাবার কাছে বি-বিচার দিব।”
–” তোমার বাপ আমার কিছুই করতে পারবেনা। কারণ আমি ওর বাপ।”

বুক ফুলিয়ে বলেন ইয়াসিন সাহেব। হাঁটু গেড়ে বসে বলেন,
–” দাদার কাছে আসো দেখি। তোমার জন্য কতোকিছু এনেছি। আসো।”
প্রতিভা সময় নিয়ে কোলে উঠে।

ইয়াভকিন আজ জলদি জলদি অফিস থেকে ফেরে।
বাড়িটায় এত হইচই হচ্ছে। ইয়াদও এসেছে এখানে। ইয়াজিদ, ইয়াদ, ইশরাত আর ইরিনের ছেলে মিলেই যেন চেঁচানোর জোয়ার ভাসিয়ে দিচ্ছে। ইয়াভকিন প্রবেশ করতেই তারা হইহই করে উঠে।

বিকালে শপিং এ বের হোন সবাই। শপিং সেড়ে একেবারে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। প্রতিভা ইয়াদের কোলে। শপিং এ গিয়ে নতুন বউয়ের জন্য আরো কয়েকটা শাড়ি কিনলেন কাজল। পূর্ণতা দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। গত চার বছরে ইয়াভকিন এত এত শাড়ি কিনে দিয়েছে তাকে! কতগুলো এখনও ছুঁয়ে দেখাও হয়নি। কাজল তাকে পাশে বসিয়ে বলেন,
–” শাড়ি দেখো তো।”

বলে একটা জামদানী শাড়ি হাতে তুলে নিলেন,
–” এটা কেমন?”
–” সুন্দর আছে মা, আপনাকে মানাবে।”
–” ধ্যাত! আমি পড়বোনা! তোমার জন্য বলছি। দেখি কেমন মানায় তোমাকে।”

পূর্ণতার কাঁধে শাড়িটা রেখে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন কাজল। বলেন,
–” মানাচ্ছে বেশ। এটা রাখো তোমার হাতে। অন্যকেউ নিয়ে যাবে।”

পূর্ণতা মাথা দুলোয়। শাশুড়িকে মানা করার এত সাধ্য তার নেই। আদর করে দিচ্ছেন, দিন না!

দোকানের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল ইয়াভকিন। আনমনে হাসলো। তার মা বোধহয় তার চেয়ে বেশি এই মেয়েটাকেই পছন্দ করেন।

ইয়াদ পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে,
–” ভাই,মেয়েদের দোকানে কি করছো? ইয়াজিদ পাঞ্জাবি বেছে রেখেছে। পছন্দ হয়না কিনা এসে দেখো।”

ঘাড় থেকে মাথা তুলে প্রতিভা। হাই তুলে বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
–” আম্মুর কাছে..”
ইয়াভকিন কোলে নেয় তাকে। পা বাড়িয়ে পূর্ণতার কাছে রেখে আসে।
___

আজ ইয়াদদের বাড়িতে ছোটখাটো হলুদের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। যদিও ইয়াদ এসবে ইন্টারেস্টেড না। ইরিন আর ইশরাতের কথাবার্তায়ই রাজি হয়েছে। খানিক পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে। গায়ে ক’জন হলুদ ছোঁয়াবে শুধু। ইয়াদের মতে এসব মেয়েলি ব্যাপার স্যাপার। এই কথা শুনে ইরিন আর ইশরাত রেগেমেগে বসে ছিল। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। কাজল, সায়মা আর শায়লা ইয়াদকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে পূর্ণতা রুমে আসে। ছুটোছুটি করেছে খুব। ইয়াভকিন রুমে বসে ছিল। প্রতিভাকে খাইয়ে নিজের কাছেই শুইয়ে দিয়েছেন কাজল। বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যেও নাতনীকে কাছছাড়া করছেন না।

পূর্ণতার গায়ে সেই কলাপাতা রঙের শাড়িটা। আঁচল ভাঁজ করে কাঁধে তুলে রাখা। উন্মুক্ত ফর্সা পেট দেখা যাচ্ছে। তার উপর একহাতে মেহেদি দেয়া। ইশরাত ভালো মেহেদি দিতে পারে। জোর করে পড়িয়ে দিয়েছে। ইয়াভকিন বিছানায় আড়মোড়া ভেঙ্গে শুয়ে শুয়ে পর্যবেক্ষণ করছে পূর্ণতাকে। খানিক পরে সোজা হয়ে বসে বলল,
–” এই সময় মেহেদি দিয়েছো?”
–” ইশরাত জোর করে দিয়েছে।”
–” এখন শুকাবে?”
–” হুহ, শুকাবো না? মেহেদির রঙ যত লাল, স্বামীর ভালোবাসাও ততো গভীর।”

আড়চোখে তাকিয়ে বলে পূর্ণতা।
ইয়াভকিন সে কথা শুনে হাসে। এক হাতে বাড়িয়ে পূর্ণতাকে কাছে আনে। পাশে বসিয়ে বলে,
–” নিজের বিয়েতে মেহেদি দিয়েছিলে?”
–” না।”
–” তারপরও দেখো, তোমার স্বামীর ভালোবাসা কত গভীর!”

পূর্ণতা কপট রাগ দেখায়,
–” মেয়ে কোথায়?”
–” মায়ের কাছে। কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই।”

পূর্ণতা সরে যেতে চায়। অথচ ইয়াভকিন ছাড়েনা। একহাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে,
–” শাড়িটা আগে পরোনি কেন? এত মায়াবী লাগছে!”
–” পরার সুযোগ পেলাম কই?”

কথা বলার মধ্যে ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ঊর্মির নাম। ইয়াভকিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
–” রোম্যান্সের বারোটা বাজাল তোমার বোন।”
–” ইশ!”

বলে কল রিসিভ করে পূর্ণতা। ওপাশ থেকে চটপটে কণ্ঠে ঊর্মি বলে,
–” বোন থেকে দেবর আপন আপু?”
–” এভাবে বলছিস কেন?”
–” বরযাত্রী হয়ে গেলে? এখানে আসলেও পারতে।”
পূর্ণতা হাসে। ফারুক মির্জা সহ ওর বাড়ির সবাই-ই ওদের ওখানে। সে আর যায়নি। এখানে সব সামলাতে তিন গিন্নি হিমশিম খান যদি?

টুকটাক কথা সেড়ে কল রাখে পূর্ণতা। ইয়াভকিন ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে। হাই তুলে পূর্ণতাও। বলে,
–” মেহেদি তুলে ফেলি?”
–” না থাক, পরে তোমার মনে হবে রঙ হয়নি তাই তোমার স্বামী তোমাকে ভালোবাসেনা।”
ধপ করে উঠে বসে ইয়াভকিন। পূর্ণতা বোকা হেসে বলে,
–” ঘুম আসছে।”
–” আচ্ছা তুমি ঘুমাও, আমি খেয়াল রাখছি।”

.

রাত দেড়টার কাছাকাছি। ইয়াভকিনের ফিসফিসানো ডাকে পূর্ণতার ঘুম ভেঙে যায়। পূর্ণতা পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
–” হু?”
–” উঠে মেহেদি ধুঁয়ে নাও।”

পূর্ণতার হুশ ফিরে। উঠে বসে বাথরুমে যেতে যেতে বলে,
–” হায় আল্লাহ, এত সময় জেগে ছিলেন?”

মেহেদি ধুঁয়ে সে এসে দেখে ইয়াভকিন অনবরত হাই তুলছে। টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট বাতিটা নিভিয়ে সে আলগোছে ইয়াভকিনের পাশে এসে শুয়ে পড়লো। গায়ে টেনে নিল পাতলা চাদরটা। বুকে মাথা রেখে বলল, ” ঘুমিয়ে গেলেন না কেন?”
–” ঘুমন্ত পূর্ণতাকে দেখার সাধ জেগেছিল, তাই।”

ইয়াভকিনের চোখ বুজে আসছে। পায়েও ব্যথা করছে। অনেক্ষণ বসে ছিল, পূর্ণতার হাত কোলে নিয়ে। ইয়াভকিন চোখ বুজতেই পূর্ণতা বলে,
–” ঘুমিয়ে গেছেন?”
চোখ বুজেই বলে ইয়াভকিন,
–” না।”
পূর্ণতা চুপ থাকে। তার এই নিরবতাই যেন ইয়াভকিনের ঘুম কে’ড়ে দেয়। সে চোখ খুলে বলে,
–” বলো, কি বলবে?”
–” আপনি সবসময় আমার সাথেই থাকবেন।”
–” থাকবো তো। এটা কেমন কথা?”
শক্ত করে চেপে ধরে পূর্ণতা। পূর্ণতা চোখ বুজে হাসে। আজকাল ইয়াভকিনকে নিয়ে বেশ চিন্তা হয় ওর।

চলবে। রিচ্যাক দেইনি।