#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০২
রাতের আঁধার একটু একটু করে সরে গিয়ে ভোরের আলো ফুটলো। পাখির কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখোরিত। গাছের ডগায় কুয়াশার শিশির বিন্দু। একফালি মিঠে রোদ জানালার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
আলোকপর্ণা দেবী ঘুম থেকে উঠে দেখল, পারু বসে বসে আপন মনে বিড়বিড় করছে। তিনি
পারুকে জোর করে স্নান করিয়ে দিল। একটা নতুন জামা পরিয়ে দিল। ভেজা চুলগুলো ভালো করে মুছে দিল। পারু স্নান করার সময় খুব নখরা করে। গায়ে জলের স্পর্শ লাগলেই কেমন ছ্যাঁত করে উঠে। মাকে মেরে-ধরে নাজেহাল করে দেয়। মাও রেগে গিয়ে পারুর পিঠে ধুমধাম কিল বসিয়ে দেয়।
আলোকপর্ণা দেবীও মেয়ের সাথে যেতে চাইলেন। মেয়ে কোথায় কীভাবে থাকবে। তার তো মা হয়ে দেখা উচিত। পরাগ কিছুতেই মাকে সাথে নিতে রাজি হলো না। এই নিয়ে মা-ছেলের বিশাল ঝগড়া লেগে গেল। মায়ের সাথে ঝগড়া করে, বোনকে নিয়ে রওনা হলো পরাগ। আলোপর্ণাদেবী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, মেয়েটা আর কখনো এই বাড়িতে ফিরে আসবে না। মা তো। বুকের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। আলোকপর্ণাদেবী কাপড়ের আঁচলে চোখের জল মুছে, মেয়েকে শেষবারের মতো বুকে টেনে নিলেন। মাথায়, কপালে চুমু খেলেন। মন ভরে আশীর্বাদ করলেন। বাম পায়ের ধুলি এনে মেয়ের মাথায় ছুঁইয়ে দিয়ে, পারুর হাতের অনামিকা আঙুলে ছোটো করে কামড় বসিয়ে দিলেন। বুকে পাথর চেপে, মেয়েকে বিদায় দিলেন তিনি। ইশ, মনে হচ্ছে ভেতর থেকে কেউ তার কলিজাটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মাথা চক্কর দিল। শরীর ঘামে ভিজে গেল। ঘাড়ে খুব ব্যথা করছে। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে, বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কাপড়ে মুখ গুঁজে অঝরে কাঁদতে লাগলেন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালে পারুকে ভর্তি করার সময় পরাগের একটু ভয় ভয় করছে। পাছে না পরাগের আসল উদ্দেশ্য কেউ ধরে ফেলে। না..এত ভয় পেলে চলবে না। পরাগ স্বাভাবিক থাকার প্রাণপনে চেষ্টা করছে। পারুর নাগরিকত্ব সনদপত্র ও পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি সাথে পরাগের নাগরিকত্ব সনদপত্র জমা দিল পরাগ। পরাগের বুক কাঁপছে।
পেয়িং বেডে পারুকে ভর্তি করলো পরাগ। ভর্তি ফি দিল – ১০ টাকা। দুই মাসের পথ্য ও সিট ভাড়া বাবদ 325*60= 19500/- (উনিস হাজার পাঁচশত টাকা) অগ্রিম জমা দিতে হলো। টাকা লাগুক। তাতে সমস্যা নেই। তবে বাবা যে গন্ডগোল পাকিয়ে রেখে মারা গেছে। সেই গন্ডগোলের চিরতরে অবসান ঘটিয়ে তবেই আজ বাড়ি ফিরবে পরাগ। টাকার কাছে রক্তের সম্পর্ক কতটা তুচ্ছ। তা আজ আপন দাদা হয়ে প্রমাণ করে দিল পরাগ। পারুকে বেডে নিয়ে যাওয়া হলো। পারু সেই ছোটোবেলার মতো দাদার হাতের অনামিকা আঙুল মুঠো করে ধরে রইল। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“মা কোথায়?”
পরাগ উত্তর দিল না। পারুকে যে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই রুমে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর অভাব নেই। সবাই বেশ বয়স্ক কিংবা মধ্য বয়স্ক মহিলা রোগী। এত অল্পবয়সী রোগী একমাত্র পারুই। পারুর বয়স ২৪ বছর। গায়ের গড়ন সুন্দর। মুখটা হলুদ ফর্সা, চোখদুটো টানা টানা, টিকালো নাক, গোলাপি রঙা সুন্দর ঠোঁট। একসময় মাথা ভর্তি চুল ছিল। এখন চুল নেই। কেটে ঘাড় পর্যন্ত করে দিয়েছে মা। তবুও পারুর সৌন্দর্য একটুও কমেনি। এই মেয়ে চুপচাপ থাকলে কেউ ধরতেই পারবে না। ও যে মানসিক ভারসাম্যহীন। পারু পরাগের হাতখানা কিছুতেই ছাড়তে চাইলো না। পরাগ বোনের মাথায় হাত রেখে বোনকে ফুসকার লোভ দেখিয়ে চলে গেল। পারু একমনে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। দাদা কখন ফুসকা নিয়ে আসবে। পরাগ সেই যে চলে গেল। দিন ফুরায়, রাত নামে, পরাগ আর আসে না। পারুর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। চাতকপাখির মতো পরাগের অপেক্ষায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে পারু।
পাশের বেডের মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীটা আচমকা ছুটে এসে পারুকে খামচি দিয়েছে।
পারু অতিরিক্ত ভয় পেয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। দুজন নার্স এসে রোগীটাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে হাতে ইনজেকশন পুশ করে দিল। রোগীটা নার্স দুজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
ডাক্তার তন্ময় প্রণয় বিশ্বাস।
এমবিবিএস, এম.ফিল (সাইক্রিয়াটি) পি.এস.ডি সাইক্রিয়াটি (ব্রেইন, মানসিক স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি) বিশেষজ্ঞ।
পাবনা মানসিক হাসপাতাল।
আজ প্রণয়ের শিডিউল আছে। নাইট ডিউটি। ঘড়িতে সন্ধ্যে ৭:৫১ বাজে। আর নয় মিনিট পর রাউন্ডে যেতে হবে। প্রণয়ে একটু আগে এসে চেম্বারে বসেছে। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে,
টেবিল থেকে ফোনটা টেনে নিল। কল দিল প্রণয়ের একমাত্র মেয়ে হিয়াকে। হিয়া ফোন ধরেই আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
“পৌঁছে গেছো পাপা?”
প্রণয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল,
“হ্যাঁ মা।”
“মাকে কবে আমার কাছে নিয়ে আসবা পাপা?”
প্রণয় বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চার বছরের ছোট্ট হিয়াকে বলতে ইচ্ছে করল না। তোমার মা আর জীবনেও ফিরে আসবে না হিয়া। তোমার মা ভগবানের কাছে চলে গেছে। ওই দূর আকাশের মিটিমিটি জ্বলতে থাকা সবচেয়ে বড় সুখতারাটা হলো, তোমার মা। প্রণয়ের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। চশমাটা খুলে রেখে টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ, মুখ মুছে নিল। বলল,
“এখন রাখি সোনা? রাউন্ডে যেতে হবে।”
“আচ্ছা পাপা। গুড নাইট।”
“গুড নাইট হিয়া।”
প্রণয় উঠে দাঁড়াল। হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে কেবিন থেকে বের হতেই নার্সও ডাক্তার প্রণয়ের সাথে সাথে দরকারি কথা বলতে বলতে হেঁটে গেল। দোতলায় অনেক বড় হলরুম। এক রুমে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা বেড পাতা। তাতে সব মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা রোগী। প্রণয় একমনে রোগী দেখছে। কখনোবা রোগীর হাতের পালস্ চেক করে দেখছে। ঔষধ লিখে দিচ্ছে। রোগীর আগে থেকে টেস্ট করে রাখা ফাইল খুলে দেখছে। নতুন টেস্ট লিখে দিচ্ছে। ডাক্তার তন্ময় প্রণয় বিশ্বাস খুব সৎ ও একনিষ্ঠ মানুষ। ফাঁকিবাজি তার ধাতে নেই। প্রত্যেকটা রোগী দেখে অনেক সময় নিয়ে। রোগী দেখতে দেখতে প্রায়ই ভোর হয়ে যায়। আজও অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। ৪০০-৫০০ রোগী এই হাসপাতালে সবসময়ই থাকে। মহিলা রোগী দেখা শেষ করে যাবে পুরুষ রোগী দেখতে। পুরুষ রোগীদের রুম আবার আলাদা। খুব অল্প বয়সে এই পেশায় খুব নাম-ডাক ও প্রশংসা কামিয়েছে প্রণয়। প্রণয়ের হাতে প্রপার ট্রিটমেন্ট পেয়ে অনেক বদ্ধ উন্মাদ পাগলও সুস্থ হয়ে যাওয়ার রেকর্ড আছে। প্রণয় যখন পারুর বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তখন নার্সকে পারুর ফাইলগুলো দেখতে চেয়ে একপলক বেখেয়ালে পারুর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর কী তিরতির করে কাঁপছে? কাঁপছে বোধহয়। নাহলে..এত কেন অস্থির লাগছে? প্রণয় অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
“হৈমন্তী?”
(চলবে)