#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৪
প্রণয় রাউন্ডে এলে প্রতিবার পারুর সাথে দেখা করে। ফাইল কিংবা রিপোর্ট দেখার বাহানায় অনেকটা সময় পারুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। গভীর দৃষ্টি মেলে দুনয়ন ভরে পারুকে দেখে। মেয়েটাকে এত দেখেও কেন যে আঙ্ক্ষাখা মিটে না। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। হৈমন্তী আর পারুর চেহারায় কোনো অমিল নেই। দুজনের হাইটও সেম। তবে হৈমন্তীর চুলগুলো বেশ লম্বা ছিল। পারমিতার চুলগুলো ছোটো ছোটো। এই অচেনা মেয়েটা এত কেন টানে প্রণয়কে? হৈমন্তীর কার্বনকপি বলেই কি? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে। না..অন্য কোনো কারণ নেই। চারবছর পর হৈমন্তীকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না প্রণয়। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে খুব। মেয়েটার সাথে গম্ভীর কণ্ঠেও কথা বলতে ভালো লাগে না। উপায় নেই। পাছে না কেউ আবার প্রণয়ের সুপ্ত অনুভূতি ঠিক পেয়ে যায়। সেই ভয়ে বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। পনেরো দিনে অনেকটাই মুভমেন্ট করেছে পারু। তবে পারমিতার প্রচুর ঘুম বেড়ে গেছে। এটা অবশ্য ঔষধের ইফেক্ট। এভাবে সেবাযত্ন পেলে খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে পারমিতা। তারপর..তারপর প্রণয় কী করবে? প্রণয়ের আটত্রিশ বছরের জীবনে কখনো এতটা অসহায় বোধ হয়নি। সব সময় নিজের কাছে স্বচ্ছ ছিল প্রণয়৷ পারমিতাকে দেখার পরই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। গৎবাঁধা জীবনটাও কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব৷ মেয়েটা আর একটু সুস্থ হলে একবার হিয়াকে এখানে নিয়ে আসবে প্রণয়। আচ্ছা হিয়া এই মেয়েটাকে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে? ওহ কী খুব চমকাবে? ঠিক মেয়েটাকে প্রথম দেখে যেভাবে প্রণয় চমকে উঠেছিল! নাকি সবার সামনে মা বলে ডাকবে? ভাবনাটা মনে আসতেই গায়ের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি হলো। হিয়া যদি সবার সামনে পারমিতাকে মা বলে ডাকে। প্রণয় খুব লজ্জা পাবে। এলোমেলো ভাবনা পিছু ছাড়ে না। প্রণয় রোগী দেখতে দেখতে পারমিতার বেডের সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটা একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছে ঠিকই। তবে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। যতটুকু সময় জেগে থাকে। ততটুকু সময় আপন ভাবনায় মত্ত থাকে। চোখ দিয়ে নোনাজল টপটপ করে ঝরে পরে। কিসের এত কষ্ট বুকের ভেতর পুষে রেখেছে মেয়েটা? প্রণয় পারমিতার একহাত আলতো করে ধরলো। হাতের পাইলস চেক করার জন্য। পারমিতা একবারের জন্য শুধু প্রণয়ের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল। খুব অল্প সময়ের জন্য এই প্রথমবার চার চোখের মিলন হলো। নিঃশব্দে প্রণয়ের বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেল। পারমিতা চোখদুটো নামিয়ে নিল। চুপটি করে বসে রইল। যেন চাবি দেওয়া পুতুল। প্রণয় কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“কী অবস্থা?”
পারমিতা উত্তর দিল না। প্রণয় আবারও কোমল কণ্ঠে বলল,
“এখন আগের থেকে ভালো লাগে?”
পারমিতা মায়া মায়া চোখ তুলে তাকাল। বলল,
“আমি বাড়ি যাব।”
প্রণয় বলল,
“সে তো অবশ্যই বাড়ি যাবেন আপনি। তার আগে সুস্থ হতে হবে যে।”
“কী হয়েছে আমার?”
“আপনার কী হয়েছে পারমিতা?”
“আমি তো জানি না।”
“মনে করার চেষ্টা করুন। কোনো কিছু নিয়ে কী খুব আপসেট ছিলেন? কিংবা মানসিক ডিপ্রেশন?”
পারমিতা মনে করার চেষ্টা করল। কিছু তো মনে পড়লই না। উল্টো মাথাব্যথা হয়ে গেল। পারমিতা দুইহাত দিয়ে মাথা শক্ত করে চেপে ধরল। প্রণয় বলল,
“জোর করে কিছু মনে করার দরকার নেই। আস্তে আস্তে অনেককিছুই মনে পড়বে। আবার অনেককিছু স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে যাবে। যেমন এই সময়ের অনেক ঘটনা আপনার পরবর্তীতে আর মনে পড়বে না।”
শেষের কথাগুলো আপনমনে বিড়বিড় করে বলল প্রণয়।
কিছু ঔষধ বাদ দিয়ে দিল। নতুন ঔষধ লিখে দিয়ে চলে গেল প্রণয়।
আলোকপর্ণা দেবীর মরাদেহ বের করলো। পরদিন সকালে। মানুষটা যে কখন মারা গেছে। কেউ সঠিক বলতে পারবে না। রাতে পরাগকে খাওয়ার সময় বলেছিল, আমার বুকে চাপ ধরে আসছে পরাগ। নিঃশ্বাস নিতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। পরাগ পাত্তা দেয়নি। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলেছে,
“সকাল হোক ঔষধ এনে দেব।”
আলোকপর্ণা দেবী বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো পায়ে ঘরে চলে গেলেন। ঘুমের ঘোরে কখন প্রাণপাখিটা মাটির দেহখানা ছেড়ে অজানায় উড়াল দিয়েছে কেউ বলতে পারবে না। মানুষটার আক্ষেপ থেকেই যাবে। শেষ একবার পারমিতাকে দেখে যেতে পারল না। পরাগ কাঁদছে। কাঁদছে ছোটো পাখিও। আত্মীয় প্রতিবেশী পারমিতাকে নিয়ে আসতে বলেছিল। পরাগ রাজি হয়নি। বলেছে, হাসপাতালে বেসিক কিছু নিয়ম আছে। অন্তত তিনমাসের আগে তারা রোগী ছাড়বে না। আসলে পারমিতাকে এখানে আনার পরাগের কোনো ইচ্ছে নেই। সবাই পরাগের কথা মেনে নিল। আলোকপর্ণা দেবীর শেষকৃত্য করার জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো।
মাকে দাহ করে এসে পরাগ ঝিম মেরে বসে রইল। নমিতা পরাগের পাশে এসে বসল। নমিতার বাবা-মা ইন্ডিয়া থাকে। নমিতার বিয়ের আগে বাংলাদেশেই ছিল। পরে সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেছে। সেখানে জায়গাজমি কিনে থিতু হয়েছে। নমিতারও খুব শখ ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার। কতগুলো বছর মা-বাবা, দাদার সাথে সামনা-সামনি দেখা হয় না। শুধু ভিডিওকলে যাও একটু দেখা হয়। ওইটুকু দেখাই কী মন ভরে? শাশুড়ী আর ননদের জন্য এতদিন ইন্ডিয়া চলে যেতে পারেনি। এবার আর কোনো বাঁধা নেই। এই বাড়িঘর বিক্রি করে একদিন কাউকে না জানিয়ে ওরাও ইন্ডিয়া চলে যাবে। পরাগের সদ্য মা মারা গেছে। এত তাড়াতাড়ি নমিতার গোপন ইচ্ছেটা পরাগকে বলা যাবে না। কিছুদিন যাক। পরাগ একটু স্বাভাবিক হোক। তারপর বলবে। নমিতার দৃঢ় বিশ্বাস পরাগ কিছুতেই নমিতার কথা ফেলতে পারবে না।
পারমিতার পুরোপুরি সেরে উঠতে তিনমাস সময় লাগলো। তবে শরীর খুব দুর্বল। সুস্থ হয়ে অনেকবার মা-দাদার সাথে ফোনে কথা বলতে
চেয়েছে। তবে দাদার ফোন বার বার বন্ধ বলে। তাছাড়া পারমিতার ভর্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ পরাগের সাথে যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা করেছে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। পরাগের ফোন বন্ধ। অগত্যা তারা এনআইডি কার্ডের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছে। পারমিতার অভিভাবক বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে। ওই বাড়িতে পারমিতাদের আপন বলতে আর কেউ নেই। কথাটা এখনো পারমিতাকে বলা হয়নি। তবে মেয়েটা বাড়ি যাওয়ার জন্য মাকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে গেছে। এই মেয়েটার দায়িত্ব এখন কে নেবে? কার আশায় বা রোগী ছেড়ে দেবে? এই নিয়ে মিটিং বসেছে। প্রণয়ের মিটিংয়ে জয়েন্ট করতে একটু লেট হলো৷ পারমিতার বাড়ির লোকের ব্যাপারে সব কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে প্রণয়। তবে সবার সামনে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“কারো আপত্তি না থাকলে পারমিতার দায়িত্ব আমি নিতে চাই।”
উপস্থিত সবাই বেশ চমকালো। সিনিয়র ডাক্তার বলল,
“এটা কীভাবে সম্ভব?”
“সম্ভব স্যার। আমার চার বছরের মেয়েটা সারাদিন বাসায় একা থাকে। আমার মেয়েকে পারমিতা দেখেশুনে রাখবে। বিনিময়ে ওর থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তাছাড়া আমার মেয়েটাকে আমি সময়ও দিতে পারি না। ব্যস্ত থাকার কারণে।”
“পেশেন্ট কী আপনার সাথে যেতে রাজি হবে?”
“সেই দায়িত্ব আমার।”
“ওকে। আপনি দায়িত্ব নিলে আমাদের আর কারো কিছু বলার নেই।”
প্রণয় যেন মেঘ না চাইতেই জল হাতে পেয়ে গেল। মিটিংরুম থেকে বেড়িয়ে চলে গেল সরাসরি পারমিতার বেডে। পারমিতা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল। প্রণয় বলল,
“আপনার ছুটি হয়ে গেছে। সবকিছু গুছিয়ে নিন পারমিতা?”
পারমিতা চোখ তুলে তাকাল। এতগুলো দিন পর মাকে দেখবে। বাড়ি যাবে। সেই আনন্দে উচ্ছ্বাস নিয়ে কাঁপা হাতে সবকিছু গুছিয়ে নিল পারমিতা। প্রণয় পুরোটা সময় পারমিতাকে দেখল। এই মেয়েটা যখন জানতে পারবে, তার পরিবারের কেউ আর এই দেশে নেই। না জানি কত কষ্ট পাবে। কথাগুলো ভেবেই তো প্রণয়ের খুব খারাপ লাগছে। ভগবান এই মেয়েটা সদ্য সুস্থ হয়েছে। এতবড় শোক সহ্য করার শক্তি ওকে দিও তুমি।
প্রণয় ছুটি নিয়ে, গাড়িতে উঠে বসল। ইশারায় পারমিতাকেও পাশে বসতে বলল। পারমিতা ইতস্তত করে করে ধীর পায়ে প্রণয়ের পাশে খানিক দুরত্ব বজায় রেখে উঠে বসল। প্রণয় বলল,
“ড্রাইভারকে আপনার ঠিকানা বলুন পারমিতা?”
পারমিতা নিচু কণ্ঠে ঠিকানা বলতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
(চলবে)