#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৫
পারমিতা যখন বাড়ির সামনে নামলো। তখন পড়ন্ত বিকেল। দুপুরের কড়া রোদ সরে গিয়ে, প্রকৃতিতে শীতল ছায়া দিয়েছে। সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিম আকাশে এলিয়ে পরেছে। একফালি মিঠে রোদ পারমিতার চোখে, মুখে লুটোপুটি খাচ্ছে। প্রণয় ফিরে ফিরে পারমিতাকেই দেখছে। মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে মাথা সামান্য উঁচু করে বাড়ির দিকে তাকাল। বাড়িটা দেখেই প্রশান্তিতে পারুর দুচোখ জুড়িয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। অবিকল সেই হাসি। এ যেন সাক্ষাৎ হৈমন্তী। দুজনের এক কেন মিল? প্রণয়ের বুকের ভেতর তিরতির করে কাঁপছে। মনটা খুব অশান্ত। এই প্রথম পারমিতাকে হাসতে দেখল প্রণয়৷ এই হাসিটা প্রণয়ের খুব চেনা। হৈমন্তীও খুব সুন্দর করে হাসতো। হাসলে হৈমন্তীর গালের ভাঁজে টোল পরতো। প্রণয় আদর করে হৈমন্তীর গাল টিপে দিতো। হৈমন্তী রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে আবারও ফিক করে হেসে ফেলতো। প্রণয় বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিল। না এতটা অস্থির বোধ করলে হবে না। প্রণয়কে যথাসম্ভব স্থির থাকতে হবে। প্রণয়ও গাড়ি থেকে নেমে পারুমিতার পাশে দাঁড়াল। বলল,
“এই বাড়িটা কী আপনার?”
পারমিতা উচ্ছাস নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ..হ্যাঁ।”
“চলুন তবে?”
পারমিতা ধীর পায়ে হেঁটে গেল। প্রণয়ও ওর পিছু পিছু গেল। পারমিতার হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতে কলিংবেল বাজালো। কেউ দরজা খুললো না। আবারও বাজালো। পর পর চারবারের মাথায় অপরিচিত এক মহিলা দরজা খুলে দিল। পারমিতা বেশ চমকালো। ভদ্রমহিলা বলল,
“কে আপনারা?”
পারমিতা শুকনো ঢোক চিপে বলল,
“আপনি কে? আমার মা কোথায়?”
“কে আপনার মা?”
“আরেহ..আমার মা। এই বাড়ির মালকিন।”
“সরি বাড়িটা তো আমাদের।”
পারমিতা মাথা খানা চক্কর দিয়ে উঠল। শরীর টলে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“আপনাদের বাড়ি মানে?”
“হ্যাঁ। মাসখানেক আগে এই বাড়িটা আমরা কিনেছি।”
পারমিতা দুপা পিছিয়ে গেল। চোখে অন্ধকার দেখলো বোধহয়। মন কেমন করা কণ্ঠে বলল,
“আমার দাদা মানে এই বাড়িটা যার কাছ থেকে কিনেছেন সে কোথায় জানেন?”
“শুনেছি তারা ইন্ডিয়া চলে গেছে।”
পারমিতা ধপ করে বসে পড়লো। দুইহাত দিয়ে মুখ ডেকে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। প্রণয় হাঁটু মুড়ে পারমিতার পাশে বসল। ইতস্তত করে পারমিতার মাথায় হাত রাখলো। নরম কণ্ঠে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন পারমিতা?”
পারমিতা মাথা নেড়ে না বুঝালো। ভেতরটা ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মা..মায়ের কী একটুও বুক কাঁপলো না? পারমিতাকে একাকী ফেলে চলে যেতে। ইশ..এত দুঃখ কোথায় রাখবে পারমিতা? পারমিতার কান্নার স্রোত বেড়ে গেল। চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না। পারমিতার কান্নার শব্দে প্রতিবেশী কাকিমা এগিয়ে এলো। বলল,
“কে? পারু এসেছিস?”
পারমিতা কান্না ভেজা চোখ তুলে তাকালো। উঠে দাঁড়িয়ে কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা। কাকিমা পারুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
“তোর ভাইটা আস্ত একটা জানোয়ার বুঝলি? নাহলে নিজের বোনকে ফেলে এভাবে চলে যায় কেউ?”
পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“দাদার কথা বাদ দিলাম। মা..মা কীভাবে আমাকে ফেলে যেতে পারলো?”
“দিদির কথা বলছিস? কেন তুই কিছু জানিস না পারু?”
পারমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“না। আমি কিছুই জানি না কাকিমা।”
“দিদি মানে তোর মা আর বেঁচে নেই রে পারু।”
পারমিতার মাথা খানা আবারও চক্কর দিয়ে উঠল। এমনিতেই শরীর খুব দুর্বল। মাথা ঘুরে পরে যেতে নিল মেয়েটা। প্রণয় চট করে পারমিতার একহাত শক্ত করে ধরে ফেলল। এবার পারমিতা হাউমাউ করে কেঁদে দিল। কাকিমা বলল,
“কাঁদিস না পারু। দিদির আয়ুকাল ফুরিয়ে এসেছিল।”
“আমার মা কবে মা..আর কিছু বলতে পারলো না পারমিতা। ফুঁপিয়ে উঠল। বুকের ভেতর অসম্ভব ব্যথা করছে। এতিম হওয়ার দুঃখ কাউকে বলে বোঝানো যায় না। যার যায় সেই বুঝে। কাকিমা বলল,
“ আড়াই মাস হবে।”
“মাকে কী শ্মশানে পোড়ানো হয়েছে কাকিমা?”
“হ্যাঁ।”
পারমিতা ধীর পায়ে হেঁটে গেল। গায়ের ওড়না মাটিতে লুটিয়ে পরেছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। প্রণয়ও পারমিতার পিছুপিছু হেঁটে গেল। শ্মশানে যেখানে মরা মানুষ পোড়ানো হয় সেখানে অনেকক্ষণ চুপটি করে বসে রইল পারমিতা। প্রণয় বার বার ঘড়ি দেখছে। ইত্যিমধ্য হিয়া তিনবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। ফিরতেও তো রাত হবে। মা হারানোর বেদনা প্রণয়ও বুঝে। এই দুঃখ কাউকে বলে বোঝানো যায় না। শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। যার মা হারায় শুধু সে ছাড়া অন্যকেউ এই কষ্ট গভীর ভাবে অনুভব করতে পারে না। প্রণয় বলল,
“এখন কী করবেন পারমিতা?”
“জানি না।”
“আপনার দাদা এভাবে আপনাকে ফেলে চলে গেল কেন?”
“আচ্ছা টাকা পয়সা সয়-সম্পত্তির কাছে কী রক্তের সম্পর্ক তুচ্ছ?”
“হঠাৎ একথা বলছেন কেন পারমিতা?”
“আপনি চলে যান। এমনিতেই অনেকটা সময় নষ্ট করলাম আমি আপনার।”
“যাব।”
পারমিতা বলল,
“আমার বাবা এই পুরো বাড়িটা যখন আমাদের জ্যাঠা-কাকাদের কাছ থেকে কিনে তখন আমরা দুই ভাইবোন। বেশ বড় বড়। খুব বেশিদিন আগের কথা না। বাবা পুরো বাড়িটা কেনার সময় মায়ের সবগুলো গহনা বিক্রি করে দেয়। এরজন্য অর্ধেক বাড়ি মায়ের নামে লিখে দেয়। মা সবসময় বলতো আমার অংশটুকু আমি পারমিতাকে দেব। আর পারুর বাবার অংশটুকু পরাগ পাবে। দাদার মুখটা তখন কালো হয়ে যেত। আমি বুঝতাম। তবে ততটা পাত্তা দেইনি। আমার জীবনে খুব বড় একটা ট্রাজেডি ঘটে যাবার পর, আমি বাবার বাড়িতে সারাজীবনের জন্য চলে এলাম। মা উঠেপড়ে লাগল। তিনি বেঁচে থাকতে থাকতেই আমার নামে বাড়ির দলিল করে দেওয়ার জন্য৷ তারপর..ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম আমি। কতদিন অসুস্থ ছিলাম সঠিক জানি না। আমার অসুস্থতার সুযোগে আর মায়ের মৃত্যুর পরে দাদা আমাদের সবকিছু বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। আমার দাদা আর আমি দশ বছরের বড়ো-ছোটো ছিলাম জানেন? কত সুখ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ও আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করতে কীভাবে পারলো বলুন তো?”
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“সামান্য সম্পত্তির জন্য আজকাল ভাই ভাই খুনোখুনি হয়ে যায় পর্যন্ত। আমি এমন দুজনকে চিনি। এক ভাইয়ের অংশে কিছু জমি বেশি আছে দেখে পাশাপাশি বাড়ি। অথচ বছরের পর বছর তারা কথা বলে না। যতবারই কথা হয়। শুধু ঝগড়ার টপিক। সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তুমুল ঝগড়া পর্যন্তই তাদের কথা। অথচ ছোটোবেলায় দু’ভাই গলায় গলায় থাকতো।”
“এতে কী লাভ বলুন?”
“কোনো লাভ নেই। এই রেষারেষি যুগ যুগ ধরে চলছে। যাইহোক এইসব কথা এখন বাদ দিন। নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবলেন?”
“আমার কাকা-জেঠুরা কেউ এই দেশে থাকে না। দাদু-দিদা মারা গেছে। মামা নেই। এক মাসি আছে। এখন মাসি বাড়ি যাব ভাবছি।”
“সেখানে কতদিন থাকবেন?”
“তারা যতদিন থাকতে দেয়।”
প্রণয় সাহস করে বলল,
“আপনি কী আমার সাথে যাবেন পারমিতা?”
পারমিতা চোখ তুলে প্রণয়ের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকাল। প্রণয় প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে হৈমন্তীর ছবি পারমিতার চোখের সামনে তুলে ধরতেই পারমিতা চমকে উঠল। মুখে হাত দিয়ে বলল,
“এ তো আমি।”
প্রণয় নিঃশব্দে হাসল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“এটা আপনি নন পারমিতা। আমার স্ত্রী হৈমন্তী।”
“অবিকল আমার চেহারা কেটে বসানো।”
“চার বছর আগে আমার স্ত্রী হৈমন্তী আমার মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। এতগুলো দিন আমার ছোট্ট মেয়েকে আমার মা পেলেপুষে বড় করেছে। মাস ছয়েক আগে আমার মাও হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। বাড়িতে আমার বাবা আর আমার চার বছরের মেয়ে হিয়া থাকে। দুজন কাজের মাসিও আছে অবশ্য। আপনাকে প্রথম দেখে ও আপনার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে মনে হয়েছে। আপনিই আমার ছোট্ট মেয়েটাকে মাতৃস্নেহে বড় করতে পারবেন৷ আপনি কী আমার মেয়ের দায়িত্ব নিবেনপারমিতা? বিনিময়ে আমি আপনার সমস্ত দায়িত্ব নেব।”
“আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন আপনি?”
“খুব বেশি কিছু জানি না। তবে আমি জানতে চাই পারমিতা। আপনি কী বলবেন?”
“আজ বলতে ইচ্ছে করছে না। অন্যদিন।”
“চলুন তবে আমার সাথে?”
পারমিতা কী করবে বুঝতে পারছে না। লোকটা সেধে এসে পারমিতাকে আশ্রয় দিতে চাচ্ছে। আচ্ছা লোকটার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই তো? পারমিতা তো লোকটাকে চিনেও না। কীসের আশায় লোকটার সাথে যাবে? একটা আশা অবশ্য আছে। ডাক্তার বলেছে পারমিতা কোনোদিনও মা হতে পারবে না। লোকটার স্ত্রীর চেহারার সাথে অসম্ভব মিল পারমিতার। ওই ছোট্ট মেয়েটা কী পারমিতাকে মা বলে ডাকবে? পারমিতার নারী সত্তাকে পরিপূর্ণ করবে? লোকটা যে বানোয়াট গল্প বলছে না তার কী গ্যারান্টি? পারমিতা জীবনে যতগুলো সিদ্ধান্ত একা একা নিয়েছে। সবগুলোই ভুল ছিল। এটাও যে ভুল হবে না তার কী গ্যারান্টি? কিন্তু হাজার হলেও লোকটা যে ডাক্তার। বলতে বাঁধা নেই। নার্সরা বলাবলিও করছিল। ওনার জন্যই পারমিতা এত দ্রুত সুস্থ হয়েছে। ডাক্তার মানুষের টাকা-পয়সার অভাব নেই। চাইলে আরও দুটো কাজের লোক নিজের মেয়ের জন্য রাখতে পারবে। কিন্তু তিনি তা রাখবে না। মেয়েটা যেন মাতৃস্নেহে বড় হয়। তারজন্য পারমিতাকেই মেয়ের জন্য নিয়ে যাবে। আরও একবার বিশ্বাস করবে কী? যদি ঠকে যায়? তাছাড়া যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই তো। মাসির অভাবের সংসার। কতদিন সেখানে থাকতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মাথায় হাজারো চিন্তা বাসা বেঁধেছে। লোকটা কী শুধু আশ্রিতা করেই রাখবে পারমিতাকে? কী জানি!
“কিছু তো বলুন পারমিতা?”
“আপনি জানতেন তাই না?”
“কী?”
“আমার দাদা ইন্ডিয়া চলে গেছে। মা মারা গেছে।”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে আগে বলেননি কেন?”
“আমার কাছ থেকে শুনলে বিশ্বাস করতেন না। কিছু কিছু তিক্ত সত্য সামনে থেকে জানতে হয়, শুনতে হয়।”
“আপনি আজ শুধুমাত্র নিজের স্বার্থেই আমার সাথে এতদূর এসেছেন। তাই না?”
“হয়তো।”
“সবাই স্বার্থলোভী।”
“চলুন পারমিতা। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
(চলবে)